মানসোল্লাস (অপর নাম: অভিলাষিতার্থ চিন্তামণি) হল খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে অধুনা কর্ণাটক ভূখণ্ডের শাসক তথা কল্যাণী চালুক্য রাজা তৃতীয় সোমেশ্বর কর্তৃক রচিত একটি সংস্কৃত গ্রন্থ। এটি রাষ্ট্রব্যবস্থা, শাসনপ্রক্রিয়া, নীতিশাস্ত্র, অর্থনীতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যোতিষ, অলংকার শাস্ত্র, পশুরোগবিষয়ক ঔষধিবিজ্ঞান, উদ্যানবিদ্যা, সুগন্ধি, খাদ্য, স্থাপত্য, খেলাধুলা, চিত্রকলা, কাব্য, নৃত্য ও সংগীত বিষয়ক একটি বিশ্বকোষতুল্য গ্রন্থ। এই বইটি একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীর ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতি-বিষয়ক একটি মূল্যবান তথ্যসূত্র।
ক্রমবর্ধমান স্তরে ১০০টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত পাঁচটি উপগ্রন্থ দ্বারা এই বিশ্বকোষতুল্য আলোচনা-গ্রন্থটি গঠিত। শিল্পকলা (বিশেষত সংগীত ও নৃত্য) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য বইটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বইয়ের রন্ধনপ্রণালী ও উৎসব-বিষয়ক অধ্যায়গুলিও বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়; কারণ সে-সবের অনেকগুলি আধুনিক ভারতীয় সংস্কৃতিরও অঙ্গ।
মধ্যযুগে সংস্কৃত ভাষায় মানসোল্লাস নামে আরেকটি গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এটি ভক্তিমূলক স্তোত্রের সংকলন। একই নামের বিশ্বকোষীয় আলোচনা-গ্রন্থটির থেকে এর বিষয়বস্তু পৃথক প্রকৃতির।
দ্বাদশ শতাব্দীতে মৎস্য রন্ধনপ্রণালী
মাছগুলিকে টুকরো টুকরো করে কাটবেন ও ভালো করে ধোবেন।
তেঁতুলের রস দিয়ে রান্না করবেন।
গমের আটা ভালো করে ছিটিয়ে দেবেন। গরম তেলে ভাজবেন যতক্ষণ না রং বাদামি হয়।
খনিজ লবণ দেবেন। গুঁড়ো এলাচ ও গোলমরিচ ছড়িয়ে দেবেন।
—মানসোল্লাস ৩.১৫৩০–১৫৩১[১]
মানসোল্লাস (मानसोल्लास) শব্দটি মনস (मनस्) বা "মন" ও উল্লাস (उल्लास) বা "আনন্দিত হওয়া" শব্দ দু’টি নিয়ে গঠিত একটি সংস্কৃত যৌগিক শব্দ।[২] "মানসোল্লাস" শব্দের অর্থ "মনের আনন্দবর্ধনকারী" বা "চিত্তবিনোদনকারী"।[৩][৪] শব্দটির বিকল্প অর্থ হল "মনের আনন্দ"।[৫][৬]
সমগ্র গ্রন্থটি পাঁচটি উপগ্রন্থে বিভক্ত। প্রতিটি উপগ্রন্থের নামের সঙ্গে বিংশতি (विंशति) শব্দটি অধিযোজিত হয়েছে। বিংশতি শব্দের অর্থ "কুড়ি"; এই শব্দটি প্রতিটি উপগ্রন্থের অন্তর্গত কুড়িটি অধ্যায়ের পরিচায়ক।[৭] সংস্কৃত লিপ্যন্তরের আন্তর্জাতিক বর্ণমালা অনুযায়ী আধুনিক গবেষকেরা এই গ্রন্থটির নামের বানান নির্ধারণ করেন "Manasollāsa"[৮] ও "Mānasollāsa"।[৯]
বইটির অপর নাম অভিলাষিতার্থ চিন্তামণি (Abhilaṣitārtha Cintāmaṇi) (আক্ষরিক অর্থে, "ইচ্ছাপূর্ণকারী মূল্যবান মণি")।[১০][৩] বইটির শিরোনাম মনসোল্লাস।[৮] মানসোল্লাস (সংস্কৃত: मानसोल्लास)নামে মধ্যযুগে রচিত আরেকটি ভারতীয় গ্রন্থ পাওয়া যায়। এটি দক্ষিণামূর্তির স্তোত্রের সংকলন। কথিত আছে, এই গ্রন্থটির রচয়িতা আদি শঙ্কর অথবা সুরেশ্বর।[১১]
১১২৯ খ্রিস্টাব্দে কল্যাণী চালুক্য রাজবংশের তৃতীয় রাজা তৃতীয় সোমেশ্বর এই গ্রন্থটি রচনা করেন। ১১২৭ সালে তিনি রাজা হয়েছিলেন।[১২] তবে সিংহাসনে আরোহণের এই তারিখটি আনুমানিক। কোনও কোনও গবেষকের মতে তারিখটি হল ১১২৫ খ্রিস্টাব্দ।[১৩] লেখক মধ্যযুগীয় দাক্ষিণাত্য অঞ্চলের (অধুনা কর্ণাটক, তেলঙ্গানা, পশ্চিম অন্ধ্রপ্রদেশ ও দক্ষিণ মহারাষ্ট্র অঞ্চলের বৃহদাংশ) অধিবাসী ছিলেন।[১]
অভিলিখনের প্রমাণ থেকে জানা যায় যে, এই রাজবংশ শৈবধর্ম ও সন্ন্যাসী মঠের বিদ্যাচর্চার জন্য প্রচুর ভূসম্পত্তি ও আর্থিক পুরস্কার প্রদান করত।[১৪] ভারতীয় উপদ্বীপে এই মঠগুলি বেদ ও ন্যায় সহ বিভিন্ন হিন্দু দর্শন চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়।[১৪] রাজত্বকালের প্রথম দিকেই তৃতীয় সোমেশ্বর এই গ্রন্থটি রচনা করেন।[৮]
সংস্কৃত ভাষায় বিশ্বকোষীয় আলোচনা-গ্রন্থ মানসোল্লাস রচিত হয়েছিল ভারতের কন্নড়-ভাষী অঞ্চলে। সমগ্র বিশ্বকোষটি কাব্যে রচিত।[৩][৮] বইটি পাঁচটি উপগ্রন্থে এবং উপর্যুপরি ১০০টি অধ্যায়ে বিভক্ত। পাঁচটি উপগ্রন্থ অর্থাৎ বিংশতি-র নাম হল রাজ্যপ্রাপ্তিকারণ, রাজ্যস্য স্থৈর্যকারণ, ভর্তুর্ উপভোগকারণ, প্রমোদ কারণ ও ক্রীড়া বিংশতি।[৮][১৬] প্রত্যেকটি অধ্যায়ে নির্দিষ্ট একটি বিষয় আলোচিত হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে রাজ্যপ্রাপ্তি, রাজ্যের পরিচালনা, অর্থনীতি, পরিকাঠামো, স্থাপত্য, ঔষধিবিজ্ঞান,[১৭] খাদ্যাভ্যাস, অলংকার, সুগন্ধী ও প্রণয়-ক্রীড়া,[১৮] খেলাধুলা, গহনা, চিত্রকলা, সংগীত ও নৃত্য।[৩][৮][১৯] বইটির একটি বড়ো অংশ (২৫০০টি শ্লোক) সংগীত ও বাদ্যযন্ত্র বিষয়ক।[৮]
এই গ্রন্থের শ্লোকসংখ্যা নিম্নরূপ:
বিংশতি[১৬] | অধ্যায় | শ্লোক |
---|---|---|
এক. রাজ্যপ্রাপ্তিকারণ বিংশতি | ২৯ | ৩০৮ |
দুই. রাজ্যস্য স্থৈর্যকারণ বিংশতি | ২০ | ১৩০০ |
তিন. ভর্তুর্ উপভোগকারণ বিংশতি | ২০ | ১৮২০ |
চার. প্রমোদ কারণ বিংশতি | ২০ | ৩২১৯ |
পাঁচ. ক্রীড়া বিংশতি | ২০ | ১৩৭৫[২০] |
রাজ্যপ্রাপ্তিকারণ বিংশতি উপগ্রন্থটিতে বর্ণিত হয়েছে রাজা ও মন্ত্রিবর্গের যোগ্যতা, কর্তব্য এবং সেই সব নৈতিক আদর্শগুলির কথা যা একজন রাজাকে এক সুস্থির ও সমৃদ্ধ রাজ্য পরিচালনায় সক্ষম করে তোলে।[১৬][২১]
এই অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, রাজাকে বিশ্বস্ত হতে হয়, ক্রোধ সংবরণ করতে হয়, গুণবান হতে হয় এবং উদাহরণের দ্বারা চালিত হতে হয়।[২১] রাজা, মন্ত্রীবর্গ ও নাগরিকদের পরস্পরের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকতে হয়, আত্মসংযম অনুশীলন করতে হয় ও দাক্ষিণ্য প্রদর্শন করতে হয়, দেবতায় বিশ্বাস রাখতে হয়, দরিদ্র ও অসহায়কে অন্নদান ও সহায়তা করতে হয় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে হয়।[২২] রাজাকেও পূর্বপুরুষ ও সকল অতিথিকে সম্মান করতে হয়।[১৬]
রাজ্যস্য স্থৈর্যকারণ বিংশতি অর্থাৎ দ্বিতীয় উপগ্রন্থের আলোচ্য বিষয় হল রাজ্য পরিচালনা ও অর্থনৈতিক বিষয়, যা রাজাকে রাজ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে।[২২][২৩] এই অংশে মন্ত্রিবর্গ ও তাদের যোগ্যতা, একজন সেনাপতির অধীনে সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ, যুদ্ধপ্রস্তুতি গ্রহণ ও প্রশিক্ষণ, রাজার উপদেষ্টা রূপে পুরোহিতবর্গ ও জ্যোতিষীর উপস্থিতি, রাজকোষ ও করারোপ পদ্ধতি আলোচিত হয়েছে।[২২]
প্রাচ্য আইনের অধ্যাপক জে. ডানকান এম. ডেরেটের মতে, ২.৮ সংখ্যক অধ্যায়টিতে তিন ধরনের সংবিধান আলোচিত হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, রাজার উচিত বৃহৎ দায়িত্বগুলি মন্ত্রীদের হস্তে অর্পণ করা। এই ব্যবস্থায় রাজ্য কার্যত মন্ত্রীদের দ্বারাই শাসিত হয়।[২৪] মানসোল্লাস গ্রন্থে রাজার উপদেষ্টা পরিষদে এক জ্যোতিষীকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রদান করা হয়েছিল। তিনি আক্রমণের প্রতিক্রিয়া জানানোর পবিত্র ক্ষণ ভবিষদ্বাণী করতেন। ইন্দো-ইউরোপীয় বিদ্যার অধ্যাপক হার্টমুট শার্ফের মতে, এই প্রথাটিই দাক্ষিণাত্য উপদ্বীপে বিদেশি মুসলমান আক্রমণের সময় বিপর্যয় ডেকে এনেছিল।[২৫]
এই গ্রন্থে রাষ্ট্র-পরিচালনার প্রতিনিধিত্বমূলক ধরনটিকে বিদ্যমান বা অর্জিত প্রদেশগুলির জন্যও প্রস্তাব করা হয়েছিল। বলা হয়েছে, প্রদেশগুলি সেখানকার ভূমিপুত্রের দ্বারাই শাসিত হওয়া উচিত। যদিও এও বলা হয়েছিল, রাজার সন্নিকটে থাকা সকল মন্ত্রীই যেন দীর্ঘকাল পূর্বে প্রতিষ্ঠিত রাজ্যেরই জাতক হন।[২৬] আরও বলা হয়েছে যে, রাজা যেন প্রজাপীড়ক আমলাবর্গ ও আধিকারিকদের উপর দৃষ্টি রাখেন এবং তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করে।[২৭] এই গ্রন্থে রাজাকে সাবধান করে বলা হয়েছে যে, তিনি যেন প্রজাবর্গকে আধিকারিক, দস্যু, শত্রু, রাজার প্রিয়পাত্র ও রাজার নিজের লোভের পীড়ণের হাত থেকে রক্ষা করেন।[১৩]
গ্রন্থের এই অংশে শুল্কের বিভিন্ন ধরন আলোচিত হয়েছে।[২৮] চতুর্থ অধ্যায়ে সীমান্তে আগত পণ্যদ্রব্যের উপর সীমান্তবন্দরে সংগৃহীত করের বিষয়টিও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।[২৯]
দ্বিতীয় উপগ্রন্থে সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত ঘোড়া ও হাতির চিকিৎসা-বিষয়ক কয়েকটি অধ্যায় রয়েছে। পশুদের জ্বর, আঘাত, পেট খারাপ ইত্যাদি নানা সমস্যার ঔষধের কথা বর্ণিত হয়েছে, সেই সঙ্গে তাদের সঠিক পুষ্টির কথাও আলোচিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২.৬ অধ্যায়ের শ্লোকগুলিতে পশুদের জন্য ঔষধ প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া বর্ণিত হয়েছে।[১৫] এই গ্রন্থে পশুদের ঔষধ প্রস্তুতের জন্য প্রয়োজনীয় চল্লিশটিরও বেশি গুল্মের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।[১৫]
মানসোল্লাস গ্রন্থে নিরামিষ ও আমিষ উভয় প্রকার রন্ধনপ্রণালীই বর্ণিত হয়েছে। এনসাইক্লোপিডিয়া অফ কিচেন হিস্ট্রি গ্রন্থের সম্পাদিকা মেরি এলেন স্নোডগ্রাসের মতে, ইউরোপেও রান্নার বই লেখা এই গ্রন্থে এক শতাব্দীকাল পরে শুরু হয়েছিল।[৩২] এই বইটি প্রক্রিয়াকৃত খাদ্য বর্ণনাকারী প্রথম ভারতীয় গ্রন্থ না হলেও, এতে খাদ্যশস্য ও আটা-ময়দা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তৈরি করা বেশ কিছু খাবারের কথা বলা হয়েছে।[৩০][৩৩] আমিষ পদের মধ্যে এই গ্রন্থে গোরু, ঘোড়া, হাতি, তোতাপাখি, ময়ূর ও ডিমের পদ বর্ণিত হয়নি। অন্যান্য পদের মধ্যে রয়েছে শূকরমাংস, মৃগমাংস, ছাগলের মাংস ও মাছের পদগুলি।[৩৪]
এই গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, রান্নার ক্ষেত্রে শুদ্ধ জলই হল অমৃত এবং অন্য জল বিষ।[৩৫] তৃতীয় সোমেশ্বর নিত্য ব্যবহারের জন্য বৃষ্টির জল (শরতে), ঝর্নার জল (গ্রীষ্মে), নদী ও হ্রদের জল (শীতে) শুদ্ধ বস্ত্রে ছেঁকে নিয়ে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। এই গ্রন্থে ব্যবহারের আগে জলকে গরম করে নিতে এবং সেই জল এক দিনের মধ্যেই ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।[৩৫] পানীয় জল ফুটিয়ে খাওয়া সম্ভব না হলে এই গ্রন্থের মতে তার বিকল্প শুদ্ধিকরণ প্রণালীটি হল ত্রিফলা এবং পরে এক টুকরো আম, পটল বা চাঁপা ফুল অথবা সুগন্ধের জন্য কর্পূর গুঁড়ো মিশিয়ে ব্যবহার করা।[৩৫] এই গ্রন্থে শুদ্ধ নারিকেলোদক ও ‘পনকস’ নামে পানীয়ের কথা বলা হয়েছে।[৩৬]
মানসোল্লাস-এ আঙুর ও আখ থেকে মদ প্রস্তুত করার বর্ণনাও দেওয়া হয়েছে। এমনকি তালিমদ্য (তাল), নারিকেলাসব (নারকেল) ও খজুরাসব (খেজুর) নামে তিনটি বেদস্তুর উৎস থেকে প্রস্তুত করা মদেরও বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।[৩৭]
এই গ্রন্থে রাজার প্রিয় মিষ্টান্নের পাকপ্রণালীও বর্ণিত হয়েছে। দুগ্ধজাত মিষ্টির পাশাপাশি গোলামু (গমের আটা থেকে নির্মিত এক ধরনের পিঠে), আধুনিক পান্তুয়া ও লেডিকেনির অনুরূপ চালগুঁড়ো দিয়ে তৈরি মিষ্টি ও ঘরিকা-র (মাষকলাই গুঁড়ো দিয়ে নির্মিত ভাজা পিঠে) মতো ভাজা মিষ্টিরও পাকপ্রণালী বর্ণিত হয়েছে।[৩৮]
মানসোল্লাস-এর চতুর্থ উপগ্রন্থে সংগীত, নৃত্য, সংগীত ও প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলার ন্যায় বিনোদন মাধ্যমগুলির কথা আলোচিত হয়েছে। এই গ্রন্থে নৃত্য ও সংগীত নিয়ে একাধিক স্বতন্ত্র অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে, এমনকি প্রথম দুই উপগ্রন্থের মিলিত শ্লোকসংখ্যার চেয়ে এই দুই বিষয় নিয়ে লেখা শ্লোকের সংখ্যা অনেক বেশি।[৮][৩৯] এই বিষয়টি সম্ভবত দ্বাদশ শতাব্দীর ভারতে পরিবেশনীয় শিল্পকলার গুরুত্বের দিকটি প্রতিফলিত করে। উল্লেখ্য, তৃতীয় সোমেশ্বরের পুত্র তথা উত্তরসূরি রাজা দ্বিতীয় জগদেকমল্ল সংগীতচূড়ামণি নামে এক বিখ্যাত আলোচনা-গ্রন্থের রচয়িতা।[৪০]
এই গ্রন্থে বিভিন্ন ধরনের গীতি ও সংগীত, বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য এবং সেই সঙ্গে সেগুলি পরিবেশনের উপলক্ষ্যও আলোচিত হয়েছে।[৪২] ৪.১৬ সংখ্যক অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, ‘ত্রিপদী’ পরিবেশিত হয় ফসল কাটা ও শস্য ভানার মরসুমে, ‘ষট্পদী’ পরিবেশিত হয় লোককথার কথকদের দ্বারা, ‘ধবল’ গীত হয় বিবাহ অনুষ্ঠানে, ‘মঙ্গল’ ও ‘চচ্চরি’ জাতীয় সংগীত ও বাদ্য পরিবেশিত হয় দোল প্রভৃতি উৎসবে।[৪৩] এই গ্রন্থের মতে ‘চর্যা’ হল ধ্যানের সংগীত।[৪২] বলা হয়েছে যে, ‘গান’ (गान) হল এক ধরনের ‘জনপ্রিয় সংগীত’ এবং ‘গীত’ দ্রুত বা ধীর লয়ের গান নয়, তবে এটিতে কড়ি ও কোমল উভয় প্রকার সুরই বিদ্যমান এবং এই জাতীয় গানে ধর্মগুরুদের কাছে কথা ও সুর সমপরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ।[৪২]
মানসোল্লাস গ্রন্থের ৪.১৭ সংখ্যক অধ্যায়ে অলংকার শাস্ত্র আলোচিত হয়েছে।[৪৪] ৪.১৮ সংখ্যক অধ্যায়ে সাড়ে চারশোরও বেশি শ্লোকে নৃত্যকলা, নৃত্যের বিভিন্ন শৈলী, নৃত্যোপযোগী বাদ্যযন্ত্র এবং নৃত্য পরিবেশনার উপলক্ষ্যগুলি আলোচিত হয়েছে।[৪৫] এই গ্রন্থে বিভিন্ন ধরনের নৃত্যশিল্পী, তাদের বৈশিষ্ট্য ও ভূমিকার কথাও আলোচিত হয়েছে — ‘নট’ (অভিনেতা), ‘নর্তক’ (পুরুষ নৃত্যশিল্পী), ‘নর্তকী’ (মহিলা নৃত্যশিল্পী), ‘বৈতালিক’ (কবি), ‘চারণ’ (চারণকবি) ও ‘কোল্লাতিক’ (কসরতবাজ)।[৪৫] তাদের অঙ্গসঞ্চালন (৬টি ‘অঙ্গ’, ৮টি ‘উপাঙ্গ’ ও ৬টি ‘প্রত্যঙ্গ’) সেগুলির গুরুত্ব সহ আলোচিত হয়েছে। এই আলোচনাটি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে রচিত সংস্কৃত গ্রন্থ নাট্যশাস্ত্র-এর আলোচনার অনুরূপ।[৪৬] এরপর এই গ্রন্থে নৃত্য পরম্পরার ২১টি ‘স্থান’ ও ২৬টি ‘চারী’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে।[৪৬]
নৃত্যভঙ্গিমার ছয়টি শ্রেণি এই গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে — অনুকরণাত্মক (‘নাট্য’), পেলব (‘লাস্য’), তেজস্বী (‘তাণ্ডব’), কসরত-নিপূণ (‘বিসম’), ভয়ানক (‘বিকট’) ও সাধারণ (‘লঘু’)।[৪১]
চতুর্থ উপগ্রন্থে মাছধরা,[১] কুকুরের (গ্রেহাউন্ড ধাঁচের) দৌড়,[৪৭] ঘোড়দৌড়, হাতির দৌড়, সেই সঙ্গে তিরন্দাজি, কুস্তি ও মল্লযুদ্ধের[৪৮][৪৯] মতো খেলাধুলার কথা আলোচিত হয়েছে। কয়েকটি স্বতন্ত্র ধরনের দলগত ক্রীড়ার কথাও আলোচনা করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় পোলো খেলার একটি ধরনের নাম করা যায়, যেটি আট সদস্যের দুই দলের মধ্যে আয়োজিত হত।[৫০]
এই গ্রন্থের সর্বশেষ উপগ্রন্থে উদ্যানপালন ও উদ্যানসৃজনের মাধ্যমে চিত্তবিনোদন,[৫১] চিত্রকলা, সুগন্ধীবিদ্যা, স্থাপত্য এবং ঘোড়া, হাতি, লবক্কি (এক প্রকার তিতির) ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর প্রশিক্ষণ ও প্রজননের কথা আলোচনা করা হয়েছে। একটি পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে মৃগয়ার মতো রাজকীয় ক্রীড়া ও অন্যান্য বনক্রীড়ার উপর।[৫২] মৃগশিকারের ৩৫টি পন্থার সঙ্গে সঙ্গে কুকুর ও বাজপাখির সাহায্যে শিকার এবং মাছধরার কথাও আলোচিত হয়েছে।[৫৩]
এই গ্রন্থের মতে, উদ্যান নকশার মধ্যে পাথর ও উঁচু ঢিবি, পরিষ্কার করে ছাঁটা বিভিন্ন ধরনের গাছপালা, কৃত্রিম জলাশয় ও বহতা ছোটো নদী থাকা বাঞ্ছনীয়।[৫১] এই গ্রন্থে উদ্যান ব্যবস্থাপনা, মাটি, বীজ, বিভিন্ন ধরনের গাছপালার মধ্যবর্তী দূরত্ব, সার প্রস্তুত করার পদ্ধতিসমূহ, যথাযথভাবে সারের প্রয়োগ ও উদ্যান রক্ষণাবেক্ষণ, কোন কোন গাছ আগে লাগানো উচিত এবং কোন কোন গাছ পরে কখন লাগানো উচিত সেই তথ্য, গাছে জল দেওয়া, গাছের বেশি ও কম জল পাওয়ার লক্ষণ, আগাছা, উদ্যান রক্ষার উপায় ও অন্যান্য বিষয় আলোচিত হয়েছে।[৫১] জনসাধারণের ব্যবহার্য উদ্যান ও বনভূমির কথাও আলোচিত হয়েছে। ‘বনক্রীড়া’ অধ্যায়ে সাধারণের উদ্যানের জন্য চল্লিশ ধরনের গাছ লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।[৪৪][৫১]
পঞ্চম উপগ্রন্থে বর্ণিত অন্যান্য শিল্পকলা ও বিনোদনমূলক কাজের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রঙের ফুল নির্দিষ্ট নকশায় গেঁথে মালা প্রস্তুতকরণ ও সুগন্ধীবিদ্যা।[৫৪] চন্দন সহ বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধী কাঠ ও তাদের গুণাবলিও এতে বর্ণিত হয়েছে।[৫৫] এই গ্রন্থে তিন ধরনের চিত্রকলার কথা বর্ণিত হয়েছে — ‘বিদ্ধা’ (প্রতিনিধিত্বমূলক), ‘অবিদ্ধা’ (রৈখিক) ও ‘ভাব’ (বর্ণনাত্মক)।[৫৬][৪৪] এই গ্রন্থে বিভিন্ন ধরনের রং প্রস্তুত করার পদ্ধতি,[৫৭] সেই সঙ্গে আঁকার খড়ি প্রস্তুতকরণ এবং তারপর চিত্রাঙ্কনের স্তরগুলিও আলোচিত হয়েছে।[৫৮]
এই গ্রন্থে গহনা ও নারীর প্রসাধনীর কথাও বলা হয়েছে। আলোচিত হয়েছে চোখের পাতা, অক্ষিপক্ষ, গাল ও বাহুতে ব্যবহার্য প্রসাধনী, কপালে তিলকের ভঙ্গি ও রঙের কথাও।[৪৪][৫৯] বিশেষভাবে চুলের গহনা ও কানের দুলের কথা এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়।[৪৪][৫৯]
মানসোল্লাস গ্রন্থটিকে মধ্যযুগীয় ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক মূল্যবান উৎসগ্রন্থ মনে করা হয়।[২৮] বিশেষত ভারতে খাদ্য, পানীয় ও পাকপ্রণালী[৬০] ও খেলাধুলার ইতিহাস বিষয়ে এটি একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।[৬১] দক্ষিণ এশীয় বিদ্যার অধ্যাপিকা মন্দাক্রান্তা বসু মনে করেন যে, বইটি ভারতীয় নৃত্যশৈলীগুলির আলোচনা-সমৃদ্ধ প্রাচীনতম জ্ঞাত গ্রন্থ হওয়ায় এটি বিশেষ কৌতুহলোদ্দীপক।[৬২] সংগীত ও নৃতত্ত্ববিদ্যার অধ্যাপক ব্রুনো নেটলকে নিয়ে গঠিত একটি গবেষক দল মানসোল্লাস গ্রন্থটিকে সংগীত, নৃত্য ও অন্যান্য পরিবেশনোপযোগী শিল্পকলা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাকারী এক প্রকাণ্ড আলোচনা-গ্রন্থ বলে উল্লেখ করেছেন।[৬৩]
|display-authors=এবং অন্যান্য
অবৈধ (সাহায্য)