মান্তা রে সময়গত পরিসীমা: ২.৩–০কোটি প্রাকমাইওসিন – বর্তমান | |
---|---|
মালদ্বীপের ধারাভান্দুতে সাঁতাররত "মান্তা আলফ্রেডি" | |
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস | |
জগৎ: | অ্যানিমালিয়া |
পর্ব: | কর্ডাটা |
শ্রেণী: | কনড্রিকথিস |
বর্গ: | মাইলিওব্যাটিফর্মেস |
পরিবার: | মোবুলিডেই |
গণ: | মান্তা |
প্রজাতি: | সেফালোপটেরাস মান্তা |
মান্তা রে হলো মান্তা গণের অন্তর্ভুক্ত বড় ধরনের এক প্রজাতির রে। তুলনামূলকভাবে বড় প্রজাতির মান্তা বাইরোস্ট্রিস ৭ মিটার (২৩ ফিট) পর্যন্ত চওড়া হতে পারে, অপরদিকে তুলনামূলকভাবে ছোট প্রজাতির মান্তা আলফ্রেডি ৫.৫ মিটার (১৮ ফিট ১ ইঞ্চি) চওড়া হয়। উভয় প্রজাতিতেই ত্রিভুজাকার বক্ষীয় পাখনা, মাথার দু পাশে প্রায় শিং-সদৃশ্য দুটি পাখনা এবং সম্মুখবর্তী মুখ বিদ্যমান। এই প্রাণীদেরকে মাইলিওব্যাটিফর্মেস (স্টিং-রে এবং একই ধরনের অন্যান্য প্রাণীসমূহ) গোত্রের মাইলিওব্যাটিডেই পরিবারে অন্তর্ভুক্ত করে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে উষ্ণমণ্ডলীয়, ক্রান্তীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলের জলে মান্তা রে-দেরকে বিচরণ করতে দেখা যায়। উভয় প্রজাতিই সামুদ্রিক; মান্তা বাইরোস্ট্রিস একক বা দলগতভাবে মুক্ত সমুদ্র-জলে বিচরণ করার প্রবণতা প্রদর্শন করলেও মান্তা আলফ্রেডি-কে উপকূলবর্তী পানিতে একই স্থানে দীর্ঘদিন বাস করতে দেখা যায়। উভয়ই ছাঁকনি-খাদক এবং প্রচুর পরিমানে জুয়োপ্লাঙ্কটন আহার করে থাকে, যেগুলো তারা সাঁতার কাটার সময় মুখ খোলা রেখে গ্রহণ করে। যাই হোক বিভিন্ন গবেষণা হতে জানা যায় যে, তাদের খাদ্যের একটা বিরাট অংশ (৭৩%) জুড়ে রয়েছে মেসোপেলাজিক উৎস থেকে প্রাপ্ত খাদ্য। তাই তাদেরকে গভীর সমুদ্রের শিকারী, যারা কিনা সমুদ্রের ২০০-১,০০০মিটার (৬৫০-৩৩০০ ফিট) গভীরতায় বসবাস করা বিভিন্ন মাছ এবং প্রাণীসমূহ শিকার করে অতঃপর আহার করে থাকে।[১]
এদের গর্ভকালীন সময় ১ বছরের বেশি দীর্ঘ হয় এবং জীবন্ত বাচ্চা প্রসব করে। দেহের বহিঃ-অংশে এঁটে থাকা পরজীবী নির্মূল করার লক্ষ্যে এরা শুচি-কেন্দ্র গমন করে থাকে। কোনো এক অজানা কারণে তিমির ন্যায় এই প্রাণীরাও পানির উপরে উঠে বিদীর্ণীত হয়।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংঘ কর্তৃক উভয় প্রজাতিই বিপদাপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত রয়েছে। নৃতাত্ত্বিক হুমকির মধ্যে দূষণ, মৎস্য শিকারী জালে জড়িয়ে যাওয়া এবং চীনা-ওষুধপত্রে প্রয়োজনীয় এদের ফুলকা-রেকারের জন্য সরাসরি এদেরকে শিকার করা অন্যতম। এদের ধীর-গতির বংশবৃদ্ধির হার এই হুমকিগুলোকে আরো গুরুতর করে তোলে। বন্য-প্রাণী সমূহের পরিযায়ী প্রজাতি প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্মেলন কর্তৃক আন্তর্জাতিক জলসীমায় প্রজাতিটি সংরক্ষিত হলেও উপকূলবর্তী এলাকায় এরা তুলনামূলকভাবে বেশি বিপদাপন্ন। কেবল মাত্র গুটি-কয়েক পাবলিক একুয়ারিয়াম এদের ধরনের জন্য যথেষ্ট, যেখানে এর স্বাচ্ছন্দে বসবাসের সুযোগ পায়।
| ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
Phylogeny of stingrays (Myliobatiformes)[২] |
''মান্তা'' নামটি একইসাথে পর্তুগিজ এবং স্পেনীয় ভাষায় ম্যান্টল (আচ্ছাদন/কম্বল), তথা কম্বল-আকৃতির এক জাতীয় ফাঁদ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, যার সাহায্যে ঐতিহ্যগতভাবে রে শিকার করা হয়।[৩] মান্তা-রা তাদের মাথার দু পাশের শিং-সদৃশ্য দুটি পাখনার দরুন অসুর মাছ নাম পরিচিত; যার জন্য তারা অপদেব-স্বরূপ একটি চেহারায় জনমনে দৃশ্যমান হয়।
মান্তা রে হলো মাইলিওব্যাটিফর্মেস গোত্রের সদস্য; যার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে স্টিং-রে এবং সম্পর্কিত অন্যান্য প্রাণী সমূহ। মান্তা গণটি "ঈগল-রে" পরিবার মাইলিওব্যাটিডেই-এর অন্তর্ভুক্ত, যেখানে প্রজাতিটি "মোবুলা-অসুর রে"-এর সাথে মোবুলিনেই উপপরিবার-এর অন্তর্ভুক্ত।[৪] ২০১৭ সালে একটি ডি-এন-এ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ক্ষুদ্রতর মাত্রায় অঙ্গসংস্থানবিদ্যা অনুযায়ী জানা যায় যে, মান্তা রে-দের সাপেক্ষে মোবুলা গণটি প্যারাফাইলেটিক ছিল, আর সে অনুযায়ী মান্তা নামটি যে মোবুলা নামটির উপসমার্থক তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়।[৫]
তলদেশে বসবাস করা স্টিং-রে থেকে মান্তা-রা উদ্ভূত হয়েছে। বিবর্তনের ধারায় ঘটনাক্রমে এই গণের প্রাণীরা আরো বড় আকারের ডানা-সদৃশ্য বক্ষীয়-পাখনার অধিকারী হয়েছে।[৬] মান্তা বাইরোসট্রিস-এ এখনও পর্যন্ত পুচ্ছ-দণ্ড রূপে দৃশ্যমান দংশন-শুঙ্গ রয়েছে। বেশির ভাগ রে-দের মুখ মাথার নিম্নাংশে থাকলেও মান্তা রে-দের ক্ষেত্রে ঠিক সম্মুখভাগে থাকে। মান্তা রে এবং অসুর রে হলো একমাত্র রে প্রজাতি যারা ছাঁকনি-খাদক হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে।[৭]
মান্তার বৈজ্ঞানিক নামকরণের এক জটিল ইতিহাস রয়েছে, যে সময়কালে গণ (সেরাটোপটেরা, ব্রাকিওপ্টিলন, ডিমোমান্টা এবং ডিবোলিকথিস) এবং প্রজাতি(যেমন; ভ্যামপিরাস, আমেরিকানা, জনি এবং হ্যামিল্টনি) উভয়কেই বিভিন্ন নামকরণ করা হয়েছিল। ঘটনাক্রমে এর সবগুলো প্রজাতিকেই স্বতন্ত্র প্রজাতি মান্তা বাইরোস্ট্রিসের সমার্থকরূপে গণ্য করা হতো।[৮][৯][১০] ১৮২৯ সালে জ্যামাইকার এডওয়ার্ড নাথানিয়েল ব্যানক্রফট এর দ্বারা গণটির নাম মান্তা প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রজাতির সুনির্দিষ্ট বাইরোস্ট্রিস নামটি নামকরণে কোনো কোনো কর্তৃপক্ষ ইয়োহান জুলিয়াস ওয়ালবাউম-কে উপাধিত করলেও অন্যান্য সকলে ইয়োহান অগাস্ট ডনডোর্ফ-কে উপাধিত করে থাকে। প্রজাতিটির সুনির্দিষ্ট আলফ্রেডি নামটি অস্ট্রেলীয় জীববিজ্ঞানী জেরার্ড ক্রেফট-এর দ্বারা প্রথম ব্যবহৃত হয়, যিনি রাজকুমার আলফ্রেড-এর নামে নামকরণটি করেছিলেন।[৯][১১]
প্রজাতিটির বিষয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও গবেষক এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছিলো না এমনকি অনেকে বিতর্ক জুড়ে দিয়ে বলে যে, প্রাণীটির মধ্যে যাদের দেহের বাইরের রং অধিকতর কালো তারা সাদা রংবহুল প্রাণীটির সাপেক্ষে একটি ভিন্ন প্রজাতি। কিন্তু ২০০১ সালে প্রাণীটির সাদা রংবহুল ও কালো রংবহুল উভয় প্রজাতিরই মাইটোকন্ড্রিয়াল ডি. এন. এ গবেষণা করে জানা যায় যে প্রস্তাবনাটি ভুল এবং পরবর্তিতে বিষয়টি আর গ্রহণযোগ্যতা পায় নি।[১২] ২০০৯ সালের একটি গবেষণা উভয়ের অঙ্গসংস্থান বিশ্লেষণ করে; যেমন, এই একই প্রজাতির বিভিন্ন প্রাণীর শরীরের রং, মৎসসূলভ বৈশিষ্টের ভিন্নতা, শিরদাঁড়া, আঁশ এবং দাঁতের বিশ্লেষণ করে দেখা হয়। বৈশিষ্টমন্ডিত দুটি ভিন্ন প্রজাতি উদ্ভূত হওয়ার নজির পাওয়া যায়; একটি হচ্ছে ভারত মহাসাগর ও ক্রান্তীয় পূর্ব-অতলান্তিক মহাসাগরে বিচরণ করতে দেখা অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর প্রজাতি মান্তা আলফ্রেডি এবং অপরটি হচ্ছে ক্রান্তীয়, উপক্রান্তীয় ও উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চল জুড়ে বিচরণ করতে দেখা মান্তা বাইরোস্ট্রিস। প্রথমটি অপেক্ষাকৃত বেশি উপকূলবর্তী জীবন-যাপন করলেও দ্বিতীয়টি গভীর সমুদ্রে বসবাস করতে ও পরিযায়ী হতে বেশি পছন্দ করে। ২০১০ সালে জাপানে মান্তাদের উপর সংগঠিত একটি গবেষণা থেকে এই উভয় প্রজাতির মধ্যে দৃশ্যত এবং জৈবিক পার্থক্য সমন্ধে নিশ্চিত হওয়া গেছে।[১৩]
সম্ভবত একটি তৃতীয় প্রজাতি, প্রাথমিকভাবে মান্তা প্র. সি. বাইরোস্ট্রিস নামে পরিচিত, যা ৬ মিটার (২০ ফিট) পর্যন্ত চওড়া হয় এবং ক্যারিবীয় সাগর সহ ক্রান্তীয় পশ্চিম-অতলান্তিক মহাসাগরে বসবাস করে। মান্তা বাইরোস্ট্রিস এবং এই স্বতন্ত্র প্রাণীটিকে একই ভোগৌলিক অঞ্চলে বিচরণ করতে দেখা যায়।[৭]
এই প্রাণীটির অল্প কিছু দাঁত এ যাবৎ পাওয়া গেলেও জীবাশ্ম কঙ্কাল খুব কমই আবিষ্কৃত হয়েছে। অস্থিময় মাছদের মতো এদের কঙ্ককালে জমাটকরণ সংঘটিত হয় না বলে এদের তরুনাস্থিময় কঙ্কাল প্রকৃতিতে খুব একটা বেশি সময় সংরক্ষিত থাকে না। এ যাবৎ মান্তা রে-এর জীবাশ্ম সংবলিত মাত্র তিনটি পাললিক স্তর খুঁজে পাওয়ার খবর পাওয়া যায় এবং সেগুলো হলো দক্ষিণ-ক্যারোলিনা থেকে প্রাপ্ত ওলিগোসিন যুগের একটি এবং উত্তর-ক্যারোলিনা থেকে প্রাপ্ত মায়োসিন ও প্লিওসিন যুগের দুটি পাললিক স্তর। দক্ষিণ-ক্যারোলিনার শ্যান্ডলার ভূতাত্ত্বিক অঞ্চলে একটি প্রজাতির অবশিষ্টাংশ খুঁজে পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত অবশিষ্টাংশের ভিত্তিতে মূলত মান্তা ফ্রাজিলিস নামে প্রাথমিকভাবে এদেরকে বর্ণনা করা হলেও, পরবর্তীতে প্যারামোবুলা ফ্রাজিলিস নামে পুনঃ-শ্রেণিবিন্যাসিত করা হয়।[১৪]
মান্তা রে-এর চওড়া মাথা, ত্রিভুজাকার বক্ষীয় পাখনা এবং শিং-আকৃতির মস্তকিয় পাখনা তাদের মুখের দু'দিকে রয়েছে। তাদের দেহ অনুভূমিকভাবে সমতল, এর সাথে মস্তকিয় পাখার পেছনে মাথার দুপাশে দুটি চোখ রয়েছে এবং তাদের অঙ্কীয় পৃষ্ঠে ফুলকা লম্বালম্বিভাবে সংযুক্ত রয়েছে। তাদের লেজগুলিতে কঙ্কালের কোনো অবলম্বন নেই এবং ঐ লেজ ডিস্ক আকৃতির সমগ্র দেহ খন্ডের চেয়ে ছোট।[১৫] পৃষ্ঠের পাখনা গুলি ছোট এবং লেজের গোড়ায় অবস্থিত। আকারে সবচেয়ে বড় মান্তাগুলি ১,৩৫০ কেজি (২,৯৮০ পাউন্ড) পর্যন্তও হতে পারে। উভয় প্রজাতিতে, শরীরের প্রস্থ দৈর্ঘ্যের প্রায় ২.২ গুণ; এম. বিরোস্ট্রিস প্রস্থে কমপক্ষে ৭ মিটার (২৩ ফুট) প্রস্থের হয়ে থাকে, এবং এম আলফ্রেডি প্রায় ৫.৫ মিটার (১৮ ফুট) পর্যন্ত হয়ে থাকে। সাধারণত, মান্তাদের পৃষ্ঠীয় দিক কালো অথবা গাঢ় বর্ণের হয়ে থাকে, এর সাথে কাঁধে থাকে ফ্যাকাশে ছোপযুক্ত চিহ্ন। অঙ্কীয় দিক সাধারণত সাদা বা ফ্যাকাশে হয়ে থাকে এবং এর সাথে থাকে স্বতন্ত্র গাঢ় চিহ্ন যার দ্বারা পৃথক পৃথক মান্তা চেনা সম্ভব। সমস্ত-কালো বর্ণে রূপান্তরিত মান্তাও বিদ্যমান রয়েছে বলে জানা যায়।[১৫] ত্বক শ্লেষ্মা দ্বারা আচ্ছাদিত যা এটিকে জীবাণু সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।[১৬]
মান্তার দুই প্রজাতির মধ্যে রঙের প্যাটার্ন, আঁশের ধরন এবং দন্তবিন্যাসে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এম. বাইরস্ট্রিসের কাঁধে অধিকতর কৌণিক দাগ , উদরীয় অঞ্চলে বৃহত্তর উদরীয় গাঢ় দাগ , পার্শ্বীয় পাখনায় কয়লা বর্ণের উদরীয় সীমারেখা এবং গাঢ় রঙের একটি মুখ রয়েছে। এম. আলফ্রেডির কাঁধের দাগগুলি আরও গোলাকার হয়, আর এর উদরীয় দাগগুলি পশ্চাদ-দেশের শেষ প্রান্ত ও ফুলকা অঞ্চলের মধ্যে থাকে এবং মুখটি সাদা বা ফ্যাকাশে বর্ণের হয়।
মান্তারা পাখির ডানার ন্যায় তাদের বক্ষীয় পাখনা পানির মধ্য দিয়ে চালনার ফলে সামনে এগিয়ে চলতে। তাদের বৃহৎ মুখ চতুর্ভুজাকৃতির এবং সম্মুখবর্তী যা অন্যান্য রে এবং স্কেইট প্রজাতির বিপরীত বৈশিষ্ট যাদের মুখ সাধারণত নিম্নবর্তী। রে-এর সাধারণ শ্বসনছিদ্রগুলি সনাক্তযোগ্য এবং অক্সিজেন সমৃদ্ধ পানি ফুলকার মধ্য দিয়ে চালনা করার জন্য মান্তাদেরকে বিরামহীনভাবে সাঁতার কাটতে হয়। মস্তকীয় পাখনাগুলি সাধারণত গুটানো থাকে তবে খাদ্য গ্রহণের সময় প্রসারিত হয়। এই মাছের ফুলকা রন্ধ্রে গোলাপী-বাদামী বর্ণের টিস্যুগুলির তন্তু রয়েছে যা খাদ্য কণা সংগ্রহ করে। মান্তারা তাদের দৃষ্টিশক্তি এবং ঘ্রানশক্তি ব্যবহার করে শিকারকে অনুসরণ করে।[১৭] দেহ অনুপাতে বৃহত্তম মস্তিষ্কের অধিকারী প্রাণীদের মধ্যে এরা অন্যতম এবং সমস্ত মাছের মধ্যে এরা বৃহত্তম মস্তিষ্কের অধিকারী। এদের মস্তিষ্কে রেটিয়া মিরাবিলিয়া রয়েছে যার বদৌলতে সম্ভব তাদের দেহ উষ্ম থাকে।[১৮] মান্তা আলফ্রেডীকে ৪০০ মিটার (১,৩০০ ফুট) গভীরতায় বিচরণ করতে দেখা গেছে, আর একই রকম কাঠামোর অধিকারী তাদের নিকট আত্মীয় মবুলা ট্যারাপাকানাকে প্রায় ২,০০০ মিটার (৬৬০০ ফুট) পর্যন্ত বিচরণ করতে দেখা গেছে; সম্ভবত রেটিয়া মিরাবিলিয়া এই ধরনের গভীরতায় বিচরণকালে তাদের মস্তিষ্ককে ঠান্ডা জলের মধ্যে শীতল হওয়া থেকে বিরত রাখতে সাহায্য করে।[১৯]
মান্তাদের বিচরণ পরিসীমার মধ্যে বছরের বিভিন্ন সময়ে মান্তাদের প্রজনন সংঘটিত হয়ে থাকে। দ্রুত সাঁতার কাটা এই মাছটির পক্ষে সঙ্গমে রত হওয়া কঠিন, যদিও অগভীর জলে কখনও কখনও একাধিক পৃথক পৃথক মান্তাদেরকে একে অপরের কাছাকাছি সাঁতার কেটে সঙ্গমের প্রশিক্ষণ নিতে দেখা যায়। সঙ্গম ঘটনাটি পূর্ণিমার দ্বারা উদ্দীপ্ত হতে পারে এবং দেখে মনে হয় যে সঙ্গমের এই বিষয়টি ১০ কিলোমিটার/ঘণ্টা গতিতে ছুটে চলা স্ত্রী মান্তাদের পিছু পিছু গমনের মাধ্যমে পুরুষ মান্তাদের দ্বারা শুরু হয়। পুরুষ মান্তা নিজের মুখ দিয়ে স্ত্রী মান্তার বক্ষীয় পাখনা আঁকড়ে ধরার বারংবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়; এই প্রক্রিয়াটি ২০-৩০ মিনিট স্থায়ী হতে পারে। একবার শক্ত করে আঁকড়ে ধরার পর পুরুষ মান্তা উল্টা দিকে ঘুরে যায় এবং স্ত্রীর অঙ্কীয় পৃষ্ঠে নিজের অঙ্কীয় পৃষ্ঠ দ্বারা চাপ প্রয়োগ করে। তারপরে পুরুষটি তার ক্ল্যাসপারগুলির একটি স্ত্রী মাছটির ক্লোয়েকায় প্রবেশ করায়, যেখানে এটি ৬০-৯০ সেকেন্ড অবধি থাকে। ক্ল্যাসপার একটি নল তৈরি করে যা জেনিটাল প্যাপিলা থেকে শুক্রাণু বয়ে নিয়ে যায়; একটি সাইফন ডিম্বাশয়ের মধ্যে বীর্য চালিত করে। পুরুষ আরও কয়েক মিনিটের জন্য দাঁত দিয়ে স্ত্রী মাছটির বক্ষীয় পাখনা আঁকড়ে ধরে রাখে এবং একই সাথে উভয়ই সাঁতার কাটতে থাকে, প্রায়শই প্রায় ২০ টি পুরুষ অবধি এই প্রক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। অতঃপর জোড়া বিভক্ত হয়ে যায়। কোনো কারণে, পুরুষ প্রায়শই সর্বদা বাম দিকের বক্ষীয় পাখনা আঁকড়ে ধরে থাকে এবং স্ত্রী মাছদের প্রায়শই এই আঁকড়ে ধরে থাকার দাগ থাকে।
নিষিক্ত ডিমগুলি ডিম্বাশয়ের মধ্যে বিকাশ লাভ করে। প্রথমদিকে, এগুলি ডিম্বক খোলস দ্বারা আবদ্ধ থাকে; যখন কিনা বিকাশরত ভ্রূণগুলি কুসুম গ্রহণ করে। ডিম ফোটার পর, ছানা মাছগুলো ডিম্বনালীর মধ্যে অবস্থান করে এবং দুগ্ধযুক্ত ক্ষরণ থেকে প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত পুষ্টি গ্রহণ করে থাকে। কোনো নাড়ি বা অমরা না থাকায় অনাগত ছানা মাছগুলো অক্সিজেন পেতে বুকাল পাম্পের উপর নির্ভর করে। প্রসবকৃত ছানা মাছের সংখ্যা সাধারণত একটি বা মাঝে মাঝে দুটি হয়ে থাকে। গর্ভধারণের সময়কাল ১২-১৩ মাস বলে মনে করা হয়। সম্পূর্ণরূপে বিকাশ সাধনের পর, ছানা মাছগুলোকে প্রাপ্তবয়স্ক মাছগুলোর একটি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ বলে মনে হয় এবং অদূর ভবিষ্যতে পিতামাতা কর্তৃক কোনও যত্ন ছাড়াই ডিম্বনালী থেকে বের হয়। বন্য প্রাণীগোষ্ঠীতে, স্বাভাবিকভাবে একেকটি শাবকের জন্মের মধ্যে দুবছরের ব্যবধান হতে পারে তবে স্ত্রী মন্টা আগত প্রতিবছরে একটানা গর্ভবতী হয়ে থাকে, যা উক্ত স্ত্রী মান্তাদের বার্ষিক ডিম্বস্ফোটিক চক্র প্রদর্শন করে। ওকিনাওয়া চুরাউমি অ্যাকোয়ারিয়াম মান্তা আলফ্রেডী প্রজননে কিছুটা সাফল্য পেয়েছে, সেখানে একটি স্ত্রী মাছ পর পর তিন বছর সন্তান প্রসব করে। এর মধ্যে একটি গর্ভাবস্থায়, গর্ভধারণের সময়কাল ছিল ৩৭২ দিন এবং জন্মের সময় ছানা মাছটির প্রস্থ ১৯২ সেন্টিমিটার (৭৬ ইঞ্চি) এবং ওজন ৭০ কেজি (১৫০ পাউন্ড) ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকাতে মান্তা বাইরোস্ট্রিস প্রজাতির পুরুষরা ৪ মিটার (১৩ ফুট) এ পরিপক্ব হয় এবং স্ত্রী মাছেরা তার চেয়ে কিছুটা বেশি দৈর্ঘে পরিপক্ব হয়। ইন্দোনেশিয়ায় মান্তা বাইরোস্ট্রিস প্রজাতির পুরুষদেরকে ৩.৭৫ মিটারে (১২ ফুট এবং স্ত্রীদেরকে প্রায় ৪ মিটারে (১৩ ফুট) পরিপক্ব হতে দেখা যায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় মান্তা আলফ্রেডী প্রজাতির পুরুষরা ৩ মিটার (১০ ফুট) এবং স্ত্রীরা ৩.৯ মিটার (১৩ ফুট) প্রস্থে পরিপক্ব হয়। মালদ্বীপে মান্তা আলফ্রেডী প্রজাতির পুরুষরা ২.৫ মিটার (৮ ফুট ২ ইঞ্চি) এবং যখন স্ত্রীরা ৩ মিটার (৯.৮ ফুট) প্রস্থে পরিপক্ব হয়। হাওয়াইতে, মান্তা আলফ্রেডী প্রজাতির পুরুষরা ২.৮ মিটার (৯ ফুট ২ ইঞ্চি) এবং স্ত্রীদের জন্য ৩.৪ মিটার (১১ ফুট) প্রস্থে পরিপক্ব হয়। স্ত্রী মান্তাদেরকে ৮-১০ বছর বয়সে পরিপক্ব হতে দেখা যায়। মান্তা রে ৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
আবাসস্থলগুলির ভিন্নতার উপর নির্ভর করে মান্তাদের সাঁতারের আচরণে পার্থক্য দেখা যায়: গভীর জলের উপর দিয়ে ভ্রমণ করার সময়, তারা একটি সরলপথে একটি ধ্রুব হারে সাঁতার কাটতে থাকে, অন্যদিকে উপকূলবর্তী এলাকায় সাঁতার কাটার সময়ে, তারা সাধারণত রড পোহাতে পোহাতে সাঁতার কাটতে থাকে বা অলসভাবে সাঁতার কাটে। মান্তারা একা বা সর্বোচ্চ ৫০ সদস্যের দলে দলে বিচরণ করতে পারে। তারা অন্যান্য মাছের প্রজাতির পাশাপাশি সমুদ্রের পাখি এবং সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর সাথে একই সাথে বসবাস করতে পারে।[১৫] মান্তারা কখনও কখনও পানির উপরে বিদীর্ণীত হয়, আংশিক বা পুরোপুরিভাবে জল থেকে লাফিয়ে শুন্যে উঠে আসে। নির্দিষ্ট একটি দলের মান্তারা একের পর এক পানির উপরে লাফিয়ে উঠতে পারে। এই লাফগুলি তিনটি ভাবে ঘটে - সম্মুখবর্তী লাফ - যেখানে লাফের পরে মাথা প্রথম জল স্পর্শ করে, একইভাবে আগে লেজ দিয়ে পুনরায় প্রবেশ বা সমারসল্ট পদ্ধতিতে লাফিয়ে পড়া। পানির উপরে এদের বিদীর্ণীত হওয়ার কারণ জানা যায়নি; সম্ভাব্য ব্যাখ্যার মধ্যে রয়েছে সঙ্গমের রীতি, প্রসব, যোগাযোগ বা পরজীবী এবং কমেনসাল রিমোরোস (চোষক-মাছ) অপসারণ।
মান্তা রে একই সাথে ছাঁকনি খাদক ও সর্বোচ্চ স্তরের খাদক। জলপৃষ্ঠে তারা জুপ্ল্যাঙ্কটন যেমন, চিংড়ি, ক্রিল এবং ক্ষুদ্রাকৃতির কাঁকড়া বৃহত পরিমাণে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। অধিকতর গভীরতায় মান্তারা ছোট থেকে মাঝারি আকারের মাছ গ্রহণ করে। খাদ্য খোঁজার সময়, এটি ধীরে ধীরে তার শিকারের চারপাশে সাঁতার কাটতে থাকে, যার ফলে ছোট মাছগুলো একইসাথে দল বেঁধে বলয় আকারে সাঁতার কাটতে বাধ্য হয়, এবং তারপরে মান্তা মুখ খোলা রেখে দলবদ্ধ মাছগুলো মধ্য দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে যায়। যদি বলয়টিতে মাছের ঘনত্ব বেশি থাকে, তবে মান্তা সমারসল্ট পদ্ধতিতে বলয়ের মধ্য দিয়ে ছুটে চলে। খাদ্য গ্রহণের সময় মান্তারা তাদের মস্তকীয় পাখনা প্রসারিত রাখে যাতে খাবার কোনো ঝামেলা ছাড়াই সরাসরি মুখের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে এবং ক্ষুদ্রাকৃতির খাদ্যকণা ফুলকা রন্ধ্রের মধ্যকার টিস্যু দ্বারা সংগৃহিত হয়। প্লাঙ্কটন সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের ক্ষত্রগুলিতে একক সময়ে প্রায় ৫০ টির মতো মাছ জড়ো হতে পারে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে দেখা গেছে যে মান্তা বাইরোস্ট্রিসের খাদ্যের প্রায় ২৭ শতাংশ জলপৃষ্ঠ থেকে এবং প্রায় ৭৩ শতাংশ অধিকতর গভীরতা হতে গ্রহণ করে থাকে। মান্টাসরা নিজেরাই বড় হাঙ্গর ও হত্যাকারী তিমি দ্বারা শিকার হয়। এরা কুকি কাটার হাঙ্গর এবং হারবার পরজীবী কোপিপডগুলি দ্বারাও দংশনের শিকার হয়ে থাকে।
মান্তারা বাহ্যিক পরজীবীগুলি অপসারণের জন্য প্রবাল প্রাচীরে অবস্থিত শুচি-কেন্দ্রগুলোতে গমন করে থাকে। পরিষ্কারক মাছগুলো যখন মান্তাদের গায়ে লেগে থাকা পরজীবী গ্রহণ করতে থাকে তখন মান্তারা কয়েক মিনিটের জন্য প্রবাল পৃষ্ঠে প্রায়-স্থিরাবস্থা বজায় রাখে। জোয়ারের সময় মান্তারা প্রায়শই শুচি-কেন্দ্রে গমন করে থাকে। হাওয়াইতে, ল্যাব্রিডেই পরিবারভুক্ত মাছের এই পরিষ্কার কাজ সম্পন্ন করে থাকে; কিছু কিছু প্রজাতির ছোট মাছ আছে যারা মান্তার মুখ ও ফুলকার আশেপাশের এলাকা থেকে একইসাথে পরিষ্কারকরণ একং খাদ্য গ্রহণ করে থাকে, আর অন্যরা শরীরের বাকী অংশ এই কাজ কোম্পন্ন করে থাকে। মোজাম্বিকে, পিন্টানো প্রজাতির মাছগুলি মুখ পরিষ্কার করে, তবে প্রজাপতি মাছগুলি কামড়ের ফলে সৃষ্ট ক্ষতস্থানগুলিতে পরিষ্কারকরণে নিয়োজিত থাকে। মান্তা. আলফ্রেডি শুচিকেন্দ্রগুলোতে এম. বাইরোস্ট্রিসের চেয়ে বেশি গমন করে থাকে। নির্দিষ্ট কোনো একটি মান্তা একই শুচিকেন্দ্রে বা খাদ্য সংগ্রহের স্থানে পরপর একাধিকবার গমন করতে পারে এবং মান্তাদের এমন আচরণ দেখে মনে হয় যে তাদের বিচরণক্ষেত্র ও এর আশেপাশের পরিবেশের মানচিত্র সম্পর্কে তাদের যথেষ্ট জ্ঞান আছে।
২০১৬ সালে, বিজ্ঞানীরা একটি গবেষণা প্রকাশ করেছিলেন যাতে দেখানো হয় যে মান্তা রে স্ব-সচেতনতার সাথে সম্পর্কিত আচরণ প্রদর্শন করে। পরিবর্তিত দর্পন পরীক্ষায়, স্বতন্ত্র মান্তারা আকস্মিক পরীক্ষণ এবং অস্বাভাবিক স্ব-নির্দেশিত আচরণে রত হয়।
মান্তারা পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় সমস্ত প্রধান মহাসাগরীয় জলে বিচরণ করে এবং এদেরকে উষ্ণমণ্ডলীয় সমুদ্রগুলিতেও বিচরণ করতে দেখা যায়। নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে সবচেয়ে দূরে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ক্যারোলিনা (৩১° উত্তর) এবং নিউজিল্যান্ডের উত্তর-দ্বিপাংশে (৩৬° দক্ষিণ)। তারা ২০° সেলসিয়াস (৬৮° ফারেনহাইট)[১৫] তাপমাত্রার পানিতে বিচরণ করতে বেশি পছন্দ করে এবং এম. আলফ্রেডি মূলত ক্রান্তীয় অঞ্চলে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। দুটি প্রজাতিই সামুদ্রিক। এম. বাইরোস্ট্রিস বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উন্মুক্ত সমুদ্রের মধ্যে বাস করে, স্রোতের সাথে ভ্রমণ করে এবং এমন অঞ্চলে পাড়ি জমায় যেখানে পুষ্টি সমৃদ্ধ জলে শিকারের বৃহৎ সমাবেশ খাদ্যের ঘনত্ব বাড়ায়।
যে মাছগুলিকে রেডিও ট্রান্সমিটার ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত করা হয়েছিল সেগুলি যেখান থেকে ধরা হয়েছিল সেখান থেকে ১,০০০ কিলোমিটার (৬২০ মাইল) দূর অবধি ভ্রমণ করেছিল এবং কমপক্ষে ১,০০০ মিটার (৩,৩০০ ফুট) গভীরে অবধি বিচরণ করেছিল। এম. আলফ্রেডি একই স্থানে বসবাস করতে আরও বেশি পছন্দ করে এবং এরা উপকূলীয় প্রজাতি। মৌসুমী পরিযাণও সংগঠিত হয় তবে এগুলি এম. বাইরোস্ট্রিসের চেয়ে দৈর্ঘে খাটো। বসন্ত থেকে শরতের সময়কালে মান্তাদেরকে বিচরণ করতে দেখা যায়, তবে শীতকালে আরও দূরবর্তী স্থানে ভ্রমণ করে থাকে। তারা দিনের বেলায় জল-পৃষ্ঠের এবং অগভীর জলের কাছে বিচরণ করে এবং রাতে তারা আরও গভীরতায় সাঁতার কেটে থাকে।[১৫]
মান্তা রে-এর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো অত্যধিক পরিমানে মৎস আহরণের বিষয়টি। এম. বাইরোস্ট্রিস সমুদ্রের সবখানে সমানভাবে বিস্তৃত নয়, তবে এমন অঞ্চলে এরা সাধারণত একত্রিত হয় যেখানে এটি প্রয়োজনীয় খাদ্য সম্পদের যোগান পেয়ে থাকে, অন্যদিকে এম. আলফ্রেডি একই স্থানে বসবাস করতে আরও বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। তাদের বসবাসের বিস্তৃতি বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত, যেখানে বিভিন্ন উপ-জনসংখ্যার মধ্যে অন্তর্নিহিত হওয়ার খুব কম প্রমাণই পাওয়া যায়। তাদের দীর্ঘ জীবনকাল এবং কম প্রজনন হারের কারণে, অতিরিক্ত মৎস আহরণ মান্তা রে-দের স্থানীয় প্রাণীসংখ্যা এমন মারাত্মকভাবে হ্রাস করতে পারে যে অন্য কোনো স্থান থেকে আরো মান্তা এসে সেই শূন্য-স্থান পূরণ করতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম।
বাণিজ্যিক এবং শৌখিন মৎস আহরণ উভয়ই এদের মাংস এবং দৈহিক বস্তু নির্মিত পণ্যগুলির জন্য মান্তাদেরকে বিশেষ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। এগুলি সাধারণত জাল, ট্রল এবং হারপুনের সাহায্যে ধরা হয়। লিভারের তেল এবং চামড়ার জন্য ক্যালিফোর্নিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায় মৎস্যজীবীরা মান্তা আহরণ করতো; এদের চামড়া ক্ষয়কারী ঘর্ষক হিসাবে ব্যবহৃত হতো। এগুলির মাংস ভক্ষণযোগ্য এবং কিছু দেশে খাওয়া হয় তবে অন্যান্য মাছের তুলনায় এটি কম আকর্ষক। এদের ফুলকাকে সুরক্ষা প্রদানকারী তরুনাস্থিময় ফুলকা রেকারের চাহিদা সম্প্রতি ঐতিহ্যগত চীনা ওষুধপত্রে বৃদ্ধি পেয়েছে। এশিয়ায় এদের ফুলকা রেকারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ব্রাজিল এবং তানজানিয়ায় উদ্দেশ্য মূলক মৎস্য আহরণ ব্যবসার বিকাশ ঘটেছে। প্রতি বছর, কেবলমাত্র তাদের ফুলকা রেকারের জন্য হাজার হাজার মান্তা রে, মূলত এম. বাইরোস্ট্রিস অহরণ করে মারা হয়। শ্রীলঙ্কা এবং ভারতে মৎস্য সংক্রান্ত গবেষণার সংগৃহিত তথ্য অনুসারে অনুমান করা হয়েছিল যে প্রতি বছর দেশটির মাছের বাজারে ১০০০ টিরও বেশি মান্তা বিক্রি করা হয়ে থাকে। তুলনামূলক দিক দিয়ে , বিশ্বজুড়ে সমগ্র প্রধান প্রদর্শনী এলাকাগুলোতে এম.বাইরোস্ট্রিসের জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমানে ১০০০ টিরও চেয়েও কম বলে অনুমান করা হয়। ক্যালিফোর্নিয়া উপসাগর, মেক্সিকো, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনের পশ্চিম উপকূলে মান্তা রে কেন্দ্রিক মৎস আহরণের এলাকা সমূহে এদের মোট সংখ্যা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে।
মান্তা রে অন্যান্য মানবসৃষ্ট হুমকির অধীনেও রয়েছে। যেহেতু মান্তাদেরকে তাদের ফুলকায় অক্সিজেন সমৃদ্ধ প্রবেশ করানোর যাওয়ার জন্য অবিরাম সাঁতার কাটতে হয়, তাই তারা জাল সহ আরো বিভিন্ন বস্তুতে জড়িয়ে পড়ার এবং পরে শ্বাসরোধের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মান্তা পিছন দিকে সাঁতার কাটতে পারে না এবং তাদের প্রসারিত মস্তকীয় পাখার কারণে মাছ ধরার লাইন, জাল, পরিত্যক্ত জাল এবং এমনকি আলগা পানিতে স্থায়ীভাবে রাখা লাইনগুলিতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। যখন ফাঁদে পড়ে, মান্তারা প্রায়শই সমারসলটিং চলন পদ্ধতিতে নিজেদেরকে মুক্ত করার চেষ্টা করে, যা তাদেরকে ওই ফাঁদে আরও বেশি করে জড়িয়ে ফেলে। আলগা, টানা মাছ ধরার লাইন এদেরকে চারপাশ দিয়ে জড়িয়ে ফেলতে এমনকি এর মাংসের মধ্যে দিয়েও কেটে ফেলতে পারে, যার ফলে স্থায়ী ক্ষত তৈরী হতে পারে। একইভাবে, মান্তারা ছোট মাছ ধরার জন্য বিশেষভাবে তৈরীকৃত ছাঁকনি জালগুলিতেও জড়িয়ে পড়ে। কিছু মান্তা আবার নৌকার সাথে সংঘর্ষের ফলে আহত হয়, বিশেষত যে জায়গাগুলিতে তারা জমায়েত হয় এবং তাদের প্রদর্শনীসংগঠিত হয়। অন্যান্য হুমকি বা কারণগুলি যা মান্তাদের মোট সংখ্যাগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে সেগুলি হল জলবায়ু পরিবর্তন, পর্যটন, দুর্ঘটনাজনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠে তেল ছড়িয়ে পড়া থেকে দূষণ এবং সমুদ্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোপ্লাস্টিক।
২০১১ সালে, বন্য প্রাণী সমূহের পরিযায়ী প্রজাতি সংক্রান্ত সম্মেলনে তাদের অন্তর্ভুক্তির কারণে মান্তা রে আন্তর্জাতিক জলসীমানায় কঠোরভাবে সুরক্ষিত হয়েছিল। সিএমএস হল বৈশ্বিক পর্যায়ে পরিযায়ী প্রজাতি এবং তাদের আবাস সংরক্ষণ সম্পর্কিত একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সংস্থা। যদিও স্বতন্ত্র দেশগুলি ইতিমধ্যে মান্তা রে সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে, মাছগুলি প্রায়শই সার্বভৌম বিভিন্ন দেশের জলসীমার মধ্য দিয়ে পরিযায়ী হয়, যা তাদেরকে অত্যধিক পরিমানে মৎস আহরণের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। আইইউসিএন এম. বাইরোস্ট্রিসকে বিপদাপন্ন প্রাণী বলে উল্লেখ করে এবং ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে 'বিলুপ্তির ঝুঁকিতে' ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করেছে।
একই বছরে, এম. আলফ্রেডিকে নির্দিষ্ট স্থানে বসবাস করা মোট সংখ্যার তুলনায় এক হাজারেরও কম এবং উপ-দল সমূহের মধ্যে সামান্য বা কোন বিনিময় না থাকার দরুন বিপদাপন্ন প্রাণী হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছিল। মান্তা ট্রাস্ট হল যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একটি দাতব্য সংস্থা যা মান্তা রে-এর জন্য গবেষণা এবং সংরক্ষণ সংক্রান্ত প্রচেষ্টায় নিবেদিত রয়েছে। সংগঠনের ওয়েবসাইটটি মান্তার সংরক্ষণ এবং এই বিষয় প্রাসংগিক জীববিজ্ঞানের জন্য একটি তথ্য সংস্থান কেন্দ্রও বটে।
এই আন্তর্জাতিক উদ্যোগগুলি ছাড়াও কিছু দেশ তাদের নিজস্ব পদক্ষেপ নিচ্ছে। ১৯৫৩ সালে বন্যপ্রাণী আইন প্রবর্তনের পর থেকে নিউজিল্যান্ড মান্তা রে আহরণ নিষিদ্ধ করেছে। ১৯৯৫ সালের জুনে মালদ্বীপ সমস্ত রে প্রজাতি এবং তাদের দেহের বিভিন্ন অঙ্-প্রত্যঙ্গ রফতানি নিষিদ্ধ করেছিল, মান্তা শিকার কার্যকরভাবে বন্ধ করেছিল, যেহেতু অতীতে ভোজ্য খাদ্য হিসাবে এর কোনো প্রচলন ও এই সংক্রান্ত কোনো মৎস ব্যবসা ছিল না। ২০০৯ সালে দুটি সামুদ্রিক সুরক্ষিত অঞ্চল চালু করার মাধ্যমে সরকার এটিকে আরও জোরদার করে। ফিলিপাইনে ১৯৯৮ সালে মান্তা আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু স্থানীয় জেলেদের চাপে ১৯৯৯ সালে এই নিষেধাজ্ঞাটি তুলে নেয়া হয়েছিল। ২০০২ সালে মৎস মজুদ প্রসংগে জরিপ করা হয়েছিল এবং নিষেধাজ্ঞার পুনঃপ্রবর্তন করা হয়েছিল। ২০০৭ সালে মেক্সিকান জলে মান্তা আহরণ বা হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এই নিষেধাজ্ঞার কঠোর প্রয়োগ নাও হতে পারে, তবে ইউকাটান উপদ্বীপের একটি দ্বীপ ইসলা হলবক্সে আইনগুলি আরও কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে, যেখানে পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য মান্তা রে ব্যবহার করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম প্রথম কোনো রাজ্য হিসাবে হাওয়াই ২০০৯ সালে মান্তা রে হত্যা বা আহরণে নিষেধাজ্ঞার প্রবর্তনকারী হয়ে ওঠে। পূর্বে, রাজ্যে মান্তা আহরণ প্রসংগে কোনও মৎস্য ব্যবসার অস্তিত্ব ছিল না তবে দ্বীপপুঞ্জের পাশ দিয়ে গমন করা পরিযায়ী মাছগুলি এখন সুরক্ষিত। ২০১০ সালে, ইকুয়েডর একটি আইন চালু করে যা মান্তা এবং অন্যান্য রে প্রসঙ্গিক সকল ধরনের মৎস আহরণ নিষিদ্ধ করে, এমনকি অনিচ্ছাকৃতভাবে ধরা ও বিক্রয়ও নিষিদ্ধ করা হয়।
প্রাচীন পেরুর মোচে জনগোষ্ঠী সমুদ্র এবং এর প্রাণীদের উপাসনা করত। তাদের শিল্পকলায় প্রায়শই মান্তা রেকে চিত্রিত করা হত। ঐতিহাসিকভাবে, মান্তা তাদের আকার এবং শক্তির জন্য লোকের ভয়ের কারণ ছিল। নাবিকরা বিশ্বাস করতেন যে তারা মানুষের জন্য বিপজ্জনক এবং নোঙ্গরগুলিতে টান দিয়ে নৌকো ডুবতে পারে। এই মনোভাবটি ১৯৭৮ সালের দিকে পরিবর্তিত হতে শুরু করেছিল, যখন ক্যালিফোর্নিয়া উপসাগরের আশেপাশের ডাইভাররা তাদেরকে প্রশান্ত প্রাণী হিসেবে আবিষ্কার করলো এবং তারা এটাও দেখলো যে তারা অন্যান্য প্রাণীদের সাথে সহাবস্থানে বসবাস করতে পারে। জ এর লেখক পিটার বেঞ্চলি সহ বেশ কয়েকজন ডাইভার মান্তাদের সাথে নিজেদের ছবিও তোলেন।[২০]
তাদের বৃহৎ আকারের দরুন মান্তাগুলি বন্দী অবস্থায় খুব কমই সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় এবং বর্তমানে গুটি কয়েকটি অ্যাকুয়ারিয়াম সেগুলি প্রদর্শন করে থাকে। একটি উল্লেখযোগ্য মান্তা হলো "ন্যান্ডি", একটি মান্তা রে যা দুর্ঘটনাক্রমে ২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান শহরে হাঙরের জালে ধরা পড়েছিল। ইউশাকা মেরিন ওয়ার্ল্ডে অ্যাকুরিয়াম পুনর্বাসিত ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে ন্যান্ডি ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে বৃহত্তর জর্জিয়া অ্যাকোয়ারিয়ামে স্থানান্তরিত হয়, যেখানে এটিকে ২৩,৮৪৮ ঘনমিটার আয়তনের (৬,৩০০,০০০-মার্কিন গ্যালন) "ওশান ভয়েজার" প্রদর্শনী অ্যাকুয়ারিয়ামে স্থান দেয়া হয়। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় আরেকটি মান্তা রে এবং ২০১০ সালে তৃতীয় আরেকটি মান্তা রে অ্যাকোয়ারিয়ামের সংগ্রহে সংযুক্ত করা হয়েছিল।[২১]
বাহামাসের প্যারাডাইজ আইল্যান্ডে আটলান্টিস রিসর্ট "জিউস" নামে একটি মান্তার পুনর্বাসন করেছিল যা ২০০৮ সালে প্রকাশ না হওয়া অবধি ৩ বছর যাবৎ গবেষণার বিষয় হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। ওকিনাওয়া চুরাউমি অ্যাকুয়ারিয়ামে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম বৃহত অ্যাকুরিয়াম ট্যাঙ্ক, "কুরোশিও সমুদ্র" ট্যাঙ্কে মন্টা রে রয়েছে। সেখানে ২০০৭ সালে বন্দিদশায় প্রথম কোনো মান্তা রে-এর জন্ম হয়েছিল। যদিও এই ছানাটি বাঁচেনি, তবে অ্যাকুরিয়ামে ২০০৮, ২০০৯ এবং ২০১০ সালে আরও তিনটি মান্তা রে-এর জন্ম হয়েছিল।[২২]
সমুদ্রের যে এলাকাগুলিতে মান্তা রে একত্রিত হয় সেই এলাকাগুলি পর্যটকদের আকর্ষণ করে এবং মান্তা পরিদর্শন স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে বার্ষিক আয় উপার্জনের রাস্তা সুগম করে দেয়। বাহামা, কেইম্যান দ্বীপপুঞ্জ, স্পেন, ফিজি দ্বীপপুঞ্জ, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, হাওয়াই, মালদ্বীপ ও পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় পর্যটন এলাকাগুলি বিদ্যমান রয়েছে। মান্তারা তাদের বিশাল আকারের এবং মানুষের সাথে সহজে অভ্যস্ত হতে পারার কারণে বেশ জনপ্রিয়। স্কুবা ডাইভাররা শুচি-কেন্দ্রগুলিতে মান্তাদের অভিগমন এবং রাত্রিতে ডাইভ করার মাধ্যমে আলো দ্বারা আকৃষ্ট মান্তাদের প্ল্যাঙ্কটন আহারের ঘটনাটি পর্যটকরা পরিদর্শন সুযোগ পেতে পারেন।[২৩]
রে প্রদর্শন সংক্রান্ত পর্যটন প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রসংগে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রাণী সম্পর্কে তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদান করে স্থানীয় মানুষজন ও দর্শনার্থীদের উপকার করে। এর ফলে গবেষণা এবং সংরক্ষণের জন্য তহবিল সরবরাহ করার বিষয়টি সহজতর হয়। পর্যটকদের সাথে অবিরাম অনিয়ন্ত্রিত মিথস্ক্রিয়া পরিবেশগত সম্পর্ক বিঘ্নিত করে এবং রোগের সংক্রমণ বাড়িয়ে মাছটিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। বোরা বোরাতে অতিরিক্ত সংখ্যক সাঁতারু, নৌকা ও জেট স্কির কারণে স্থানীয় মান্তা রে প্রাণীসমষ্টি এই অঞ্চলটি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল।
২০১৪ সালে, ইন্দোনেশিয়া এই মাছ ধরা এবং রফতানি নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি প্রবর্তন করেছিল, কারণ দেশটি বুঝতে পেরেছে যে মাছটিকে মেরে ফেলার অনুমতি দেওয়ার চেয়ে মান্তা রে পর্যটন অর্থনৈতিকভাবে আরও বেশি উপকারী ও লাভজনক। একটি মৃত মান্তার মূল্য ৪০ থেকে ৫০০ ডলার, অন্যদিকে মান্তা রে ট্যুরিজম একটি নির্দিষ্ট মান্তা রে-এর জীবদ্দশায় ১ মিলিয়ন ডলার মূল্যের আয় বয়ে আনতে পারে। ইন্দোনেশিয়ায় ৫৮ লক্ষ বর্গমিটার (২২ লক্ষ বর্মমাইল) আয়তনের সমুদ্রাঞ্চল রয়েছে এবং এটি এখন মান্তা রে-এর জন্য বিশ্বের বৃহত্তম অভয়ারণ্য।[২৪]
|তারিখ=
(সাহায্য)
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; Dean
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)