মার্ক অ্যান্ড্রু স্পিৎজ (ইংরেজি: Mark Andrew Spitz; জন্ম: ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০) ক্যালিফোর্নিয়ার মডেস্টো এলাকায় জন্মগ্রহণকারী সাবেক মার্কিন প্রতিযোগিতাধর্মী ও প্রথিতযশা সাঁতারু। নয়বার অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের মর্যাদা লাভ করেন তিনি। এছাড়াও সাত বিষয়ে তৎকালীন বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী ছিলেন। মিউনিখে অনুষ্ঠিত ১৯৭২ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে সাতটি স্বর্ণপদক লাভ করেন। তার এ অসম্ভব অর্জন পরবর্তীতে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে মাইকেল ফেলপসের আটটি স্বর্ণপদক লাভের ফলে ম্লান হয়ে যায়। তবে, ১৯৭২ সালের প্রতিযোগিতায় মার্ক স্পিৎজ সাতটিতেই বিশ্বরেকর্ড করে ইতিহাস গড়েছিলেন। অলিম্পিকের ইতিহাসে তিনি যে-কোন ইহুদির তুলনায় সর্বাধিক পদক লাভকারী হিসেবে পরিচিত হয়ে আছেন।[১]
১৪ আগস্ট, ২০০৮ তারিখে লস অ্যাঞ্জেলেস কেএনবিসি-৪ এর সকালের নিউজ শো টুডে ইন এল.এ.-তে স্পিৎজ এক স্বাক্ষাৎকার প্রদান করেন। এতে তিনি মন্তব্য করেন যে, মাইকেল ফেলপস অলিম্পিকের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ।[২]
ক্যালিফোর্নিয়ার মডেস্টো এলাকায় জন্মগ্রহণকারী স্পিৎজ তিন ভাই-বোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন।[৩] তার বাবার নাম আর্নল্ড স্পিৎজ ও মাতার নাম লেনোর সিলভিয়া। পরিবারটি ইহুদি। বাবা হাঙ্গেরীয় ও মা রুশ।[৪][৫][৬] দুই বছর বয়সে স্পিৎজের পরিবার হাওয়াইয়ের হনোলুলু এলাকায় স্থানান্তরিত হয়। সেখানকার ওয়াইকিকি সৈকতে প্রতিদিন সাঁতার কাটতেন। লেনোর স্পিৎজ ১৯৬৮ সালে টাইমের প্রতিবেদককে বলেন যে, মহাসাগরে একটি ছোট্ট বাচ্চা সাঁতার কাটছে। সে দৌড়ে যাচ্ছে যেন আত্মহননের দিকে এগুচ্ছে।[৩] ছয় বছর বয়সে তার পরিবার ক্যালিফোর্নিয়ার সাক্রামেন্তোয় পুনরায় স্থানান্তরিত হয়। সেখানকার স্থানীয় সুইমিং ক্লাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে থাকেন। নয় বছর বয়সে সাক্রামেন্তোর আর্ডেন হিলস সুইম ক্লাবে প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। এখানে তার কোচের দায়িত্ব পালন করতেন শার্ম চাভুর। তিনিই পরবর্তীকালে স্পিৎজের পরামর্শদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
১৫ বছর বয়সে ১৯৬৫ সালের মাকাবিয়া গেমসের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তেল আবিবে অনুষ্ঠিত ঐ প্রতিযোগিতায় চারটি স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত হন তিনি। এছাড়াও সর্বাপেক্ষা অসাধারণ ক্রীড়াবিদের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন তিনি।[৩]
১৯৬৭ সালের প্যান আমেরিকান গেমসে পাঁচটি স্বর্ণপদক পান। পরবর্তীতে রিও দি জানেইরুতে অনুষ্ঠিত ২০০৭ সালের প্রতিযোগিতায় ব্রাজিলীয় সাঁতারু থিয়াগো পেরেইরা ছয়টি স্বর্ণপদক জিতে তার এ রেকর্ডটি ম্লান করে দেন।
ইতোমধ্যেই দশটি বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী স্পিৎজ মেক্সিকো অলিম্পিকে অংশ নেন। ১৯৬৮ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে তিনি ছয়টি স্বর্ণ জেতেন। দলগত পর্যায়ে তিনি কেবল দুইটি স্বর্ণপদকধারী হন। তন্মধ্যে ৪×১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলেতে ৩:৩১.৭০ ও ৪×২০০ মিটারের ফ্রিস্টাইল রিলেতে সময় নেয় ৭:৫২.৩৩।[৭] এছাড়াও ১০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে ৫৬.৪০ সময় নিয়ে দ্বিতীয় হন। এ বিষয়ে সতীর্থ মার্কিন সাঁতারু ডগ রাসেলের কাছে আধা সেকেন্ডের ব্যবধানে পরাজিত হন। অথচ, এ বিষয়ে তিনি বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী ছিলেন ও ঐ বছরে পূর্বেকার দশটি স্বাক্ষাতে রাসেলেকে হারিয়েছিলেন।[৮]
মেক্সিকো অলিম্পিকের পর ১৯৬৯ সালে পুনরায় মাকাবিয়া গেমসে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এবারে তিনি ছয়টি স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত হন।[৯] আবারো তিনি প্রতিযোগিতায় অসাধারণ ক্রীড়াবিদ হিসেবে মনোনীত হন।[১০]
মিউনিখ অলিম্পিকের পর স্পিৎজ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। অথচ, তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর ছিল। ১৯৯৯ সালে ইএসপিএনসেঞ্চুরি ৫০ গ্রেটেস্ট অ্যাথলেটসে তাকে তালিকার ৩৩ নম্বরে রাখা হয়।[১১] এ তালিকায় তিনিই ছিলেন একমাত্র সাঁতারু।
৪১ বছর বয়সে ১৯৯২ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের মাধ্যমে ক্রীড়াঙ্গনে ফিরে আসার চেষ্টা চালান। চলচ্চিত্রকার বাড গ্রীনস্প্যান তাকে এক মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাবনা দেন যদি তিনি কৃতকার্য হন। কিন্তু তিনি বাছাইপর্বের গণ্ডী পেরুতে পারেননি। তবে ২০ বছর পূর্বেকার তার পদক জয়ী সময়ের কাছাকাছি ছিলেন। অলিম্পিক বাছাইয়ে যোগ্যতা নির্ধারণকল্পে প্রয়োজনীয় সময়ের চেয়ে দুই সেকেন্ড পিছনে ছিলেন তিনি। তবে, ২০০৮ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে প্রমিলা সাঁতারু স্পিৎজের বয়স নিয়েই সফলভাবে ডরা টোরেস অলিম্পিকে ফিরে এসেছিলেন।
সুইমিং ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন কর্তৃক ১৯৬৯, ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে তিনি বর্ষসেরা বিশ্ব সাঁতারুর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। তৃতীয় ক্রীড়াবিদ হিসেবে নয়টি অলিম্পিক স্বর্ণপদক জয় করেছেন তিনি। ১৯৮৫ সালের মাকাবিয়া গেমসে মশাল প্রজ্জ্বলনের অধিকার লাভ করেন তিনি।[১৪]
অলিম্পিক থেকে অবসর নেয়ার পর ইউসিএলএ থিয়েটারের ছাত্র ও খণ্ডকালীন মডেল সুজি ওয়েনারের সাথে ডেটিং করতে শুরু করেন। সুজি বিখ্যাত ব্যবসায়ীর কন্যা ছিলেন।[২১][২২] মিউনিখ অলিম্পিকের এক বছর পর ৬ মে, ১৯৭৩ সালে তারা বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন।[২৩] বেভার্লি হিলস হোটেলে সনাতনী ইহুদি রীতি অনুযায়ী বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।[২৪] অক্টোবর, ১৯৮১ সালে ম্যাথু ও সেপ্টেম্বর, ১৯৯১ সালে জাস্টিন নামের দুই সন্তানের জনক তিনি। তন্মধ্যে জাস্টিন স্টানফোর্ড সাঁতার দলের সদস্য ছিলেন।[২৫][২৬][২৭] নৌকা চালনা, স্কিয়িং ও চিত্রকর্ম সংগ্রহকে শখের বিষয় হিসেবে স্পিৎজ উল্লেখ করেন।[২৮]
তার সময়কালে যখন অন্যান্য সাঁতারুরা শরীরের অবাঞ্চিত লোম রাখা থেকে বিরত থাকতো, তখন তিনি গোঁফ নিয়ে সাঁতরাতেন। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান যে, কলেজে অবস্থানকালে একজন কোচ তাকে বলেছিলেন তার কখনো গোঁফ উঠবে না।[২৯] চার মাসের অধ্যবসায়ের পর গোঁফ বড় হতে থাকে। স্পিৎজ এরজন্য গর্ববোধ করেন ও গোঁফকে সৌভাগ্যের প্রতীকরূপে আখ্যায়িত করেন।[৩০] রুশ কোচ তার গোঁফের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি দ্রুত অন্যান্য কোচদের এ বিষয়ে জানান। ফলশ্রুতিতে পরের বছর প্রত্যেক রুশ সাঁতারু গোঁফ নিয়ে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।[৩১]
↑Park, Alice (আগস্ট ১৬, ২০০৪)। "10 Questions For Mark Spitz"। TIME। ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ৩০, ২০১১।