মালিকুল মুজাহিদ | |
---|---|
হিমসের আমির | |
রাজত্ব | ১১৮৬–১২৪০ |
পূর্বসূরি | মুহাম্মাদ বিন শিরকুহ |
উত্তরসূরি | মানসুর ইবরাহিম |
মৃত্যু | ফেব্রুয়ারি ১২৪০ |
ধর্ম | সুন্নি ইসলাম |
মালিকুল মুজাহিদ আসাদুদ্দিন শিরকুহ দ্বিতীয় ছিলেন ১১৮৬-১২৪০ সাল পর্যন্ত হিমসের আইয়ুবীয় আমির । তিনি ছিলেন নাসির মুহাম্মাদ বিন শিরকুহের পুত্র, শিরকুহের নাতি। শিরকুহ ছিলেন সালাহুদ্দিনের দ্বিতীয় চাচাতো ভাই।[১] তার অঞ্চলের মধ্যে পালমিরা এবং আর-রাহবাও অন্তর্ভুক্ত ছিল।[২] মুজাহিদ তেরো বছর বয়সে আমির হন যখন তার পিতা ৪ মার্চ ১১৮৬ সালে হিমসে অপ্রত্যাশিতভাবে মারা যান (১০ জিলহজ ৫৮১)।[৩][৪]
আইয়ুবীয়দের কনফেডারেসির মধ্যে হামা ছিল একটি আক্রমণকারী রাজ্য; যেটি ত্রিপোলির ক্রুসেডার কাউন্টির সীমান্তে এবং ক্রাক দেস শেভালিয়ার্সের হস্পিটালার দুর্গের কাছাকাছি। হামার আমিরের ভূমিকা ছিল ক্রুসেডারদের উত্তর সিরিয়ায় অভিযান, ভূমি ধ্বংস করা এবং আলেপ্পো বা দামেস্ককে হুমকি দেওয়া থেকে বিরত রাখা। প্রায়শই মুজাহিদ তার আরেক চাচাতো ভাই, বালাবেকের আমির বাহরাম শাহ এবং হামার মানসুর মুহাম্মাদের সাথে ক্রুসেডার আক্রমণ প্রতিহত করতে এবং কখনও কখনও ক্রুসেডার অঞ্চলে আক্রমণ করার জন্য একসাথে কাজ করেছিলেন।[৫] এইভাবে ১১৯৭ সালের নভেম্বরে (মুহাররম ৫৯৪) মুজাহিদ বালাবেকের বাহরামশাহ এবং অন্যান্য আমিরদের সাথে ত্রিপোলি কাউন্টি থেকে ক্রুসেডার বাহিনীর দ্বারা অবরুদ্ধ টরনের দুর্গ থেকে মুক্তির জন্য বাহিনী প্রেরণ করেন। তারা ফ্রাঙ্কদের তাড়িয়ে দিতে অক্ষম হন এবং ১১৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত (রবিউল আউয়াল ৫৯৪) সুলতান আজিজ উসমান কর্তৃক প্রেরিত একটি মিশরীয় সেনাবাহিনী কাছাকাছি আসার আগ পর্যন্ত অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়নি।) [৬] ১২০৩ সালের মে মাসে (রমজান ৫৯৯) মুজাহিদকে সুলতান আদিল নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, হামার মানসুরের ক্রাক দেস শেভালিয়ার্স আক্রমণ করার জন্য একটি অভিযানকে সমর্থন করার জন্য এবং ১২০৭ (৬০৩)[৭] এর বসন্তে তিনি একটি অভিযানে অংশ নেন। এটি ছিল প্রথম আদিল দ্বারা হসপিটালারদের তাদের ক্রমাগত অভিযানের জন্য শাস্তি দেওয়ার জন্য। আইয়ুবীয় বাহিনী ত্রিপোলি অবরোধ করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত করের বিনিময়ে প্রত্যাহার করতে রাজি হন।[৮] ১২১৪-১৫ (৬১১) সালে হিমসের মুজাহিদ এবং হামার মানসুর উভয়কেই হস্পিটালারদের নেতৃত্বে একটি বড় আক্রমণের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। পরে যাহির গাজী হস্পিটালারদের তাদের বিরোধিতা না করার জন্য চাপ দিলে তারা হুমকি দেয়া বন্ধ করে।[৯] ১২২৯ বা ১২৩০ (৬২৭) সালে মুজাহিদ বারইন এবং হামার মধ্যবর্তী একটি গ্রাম আফনুনের যুদ্ধে ক্রাক দেস শেভালিয়ার্সের হস্পিটালারদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হন এবং অনেক ফ্রাঙ্ককে বন্দী করা হয়।[১০]
মুজাহিদ একজন উদ্যমী সামরিক নেতা ছিলেন বলে মনে হয় এবং তিনি ছয়টি বড় অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন যেখানে বিভিন্ন আইয়ুবীয় শাসক তাদের বাহিনীকে বাইরের শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য একত্রিত করেছিল।[১১] সপ্তম বড় অভিযানে হিমসের বাহিনী তার ছেলে মানসুর ইব্রাহিমের নেতৃত্বে ছিল। তবে ১২৩৪ (৬৩১) সালে রুম সালতানাতের ভূমিতে অভিযানের সময় মুজাহিদের আচরণ ছিল বেশ লক্ষণীয়। তিনি একটি গুজব ছড়িয়েছিলেন যে যদি সুলতান কামিল অঞ্চল জয় করতে সফল হন, তবে তিনি অন্যান্য আইয়ুবীয় শাসকদেরকে তাদের বিদ্যমান রাজ্যগুলি আনাতোলিয়ায় নতুনদের জন্য বিনিময় করতে বাধ্য করবেন, কামিলকে মিশর এবং সিরিয়া উভয়ের নিয়ন্ত্রণে রেখে দেবেন। ফলস্বরূপ, অভিযানে মনোবল কম ছিল, যা আলাউদ্দিন কায়কোবাদ দ্বারা চালিত হয়েছিল।[১২] ১২৩৫ (৬৩৩) এর অভিযানটি আরও সফল হয়েছিল এবং মুজাহিদ আবার কামিলের সাথে যোগ দেন। এবার তারা এডেসা এবং হারান দখল করেন।[১৩]
১১৯৩ সালে সালাহুদ্দিনের মৃত্যুর পর তার পুত্র আফযাল এবং আজিজ উসমানের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই হয়েছিল। মুজাহিদ তাদের মধ্যে মতপার্থক্য নিরসনের চেষ্টা করার জন্য সেই বছর অনুষ্ঠিত পারিবারিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। বেশ কিছুকাল পরে, ১২২৮-২৯ (৬২৬) সালে তিনি দামেস্কের অবরোধেও অংশ নেন। যেই অবরোধের ফলে নাসির দাউদকে অপসারণ করা হয় এবং আশরাফকে স্থাপন করা হয়।[১৪] কয়েক বছর পর মুজাহিদ ছিলেন সিরিয়ার আইয়ুবীয় শাসকদের জোটের অন্যতম প্রধান উপাদান; যারা মিশরের সুলতান কামিলকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চেয়েছিল। যাইহোক, ১২৩৭ সালের সেপ্টেম্বরে (মুহাররম ৬৩৫) জোটের মূল নেতা দামেস্কের আশরাফ মারা যান, তার মিত্রদের বিপদে ফেলে দেয়। মুজাহিদের প্রতিবেশী হামার মুযাফফর মাহমুদের সাহায্য নিয়ে কামিল হিমস থেকে মুজাহিদকে অপসারণের জন্য একটি সামরিক অভিযান শুরু করেন। কামিলকে শুধুমাত্র ২০ লক্ষ দিরহাম প্রদানের বিনিময়ে হিমস আক্রমণ থেকে বিরত থাকতে রাজি করানো হয়েছিল।[১৫] কয়েক সপ্তাহ পরে ১১ মার্চ ১২৩৮ (২৩ রজব ৬৩৫) কামিল হঠাৎ মারা যান।[১৬]
১২১৯ (৬১৬) আমির মানসুর মুহাম্মাদ মারা গেলে প্রতিবেশী আমিরাত হামার উত্তরাধিকার সংকট দেখা দেয়। মানসুরের দ্বিতীয় পুত্র নাসির কিলিজ আরসালান তার বড় ভাই ও উপযুক্ত উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় মুযাফফর মাহমুদ উদ্যোগ নিতে পারার আগেই ক্ষমতা দখলে সফল হন। ফলস্বরূপ মুযাফফরকে আমির উপাধি গ্রহণ করার আগে নয় বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আর শুধুমাত্র তা সম্ভব হয়েছিল এই জন্য যে, গাজার নিকটে তেলুল আজুলে মুজাহিদ একটি সম্মেলন আয়োজন করে কিছু শর্ত তৈরি ও বৈধ করেছিলেন। যার ভিত্তিতে অন্যান্য আইয়ুবীয় শাসকরা মুযাফফরকে স্বীকৃতি দেন।[১৭] এই শর্তগুলোর মধ্যে একটি ছিল যে মুজাহিদকে সালামিয়ার জাহাত গ্রহণ করতে হবে। যাইহোক, শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরে মুজাহিদ কাছাকাছি একটি বড় দুর্গ তৈরি করেছিলেন। যা হামার শাসক তার জন্য হুমকি হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। এটি আমীরদের মধ্যে খারাপ সম্পর্কের দিকে পরিচালিত করে এবং মুযাফফর যখন মুজাহিদকে ক্ষমতাচ্যুত করার অভিযানে মিশরের কামিলের সাথে যোগ দেন, তখন তাদের মধ্যে উত্তেজনা প্রকাশ্য সংঘর্ষে রূপ নেয়। কামিল মারা গেলে মুজাহিদ হামার ভূখণ্ডে আক্রমণ করে গ্রামাঞ্চলকে ধ্বংস করে দেন এবং ওরোন্টেস নদী এবং শহরের চারপাশের ক্ষেতগুলিকে সেচ দেওয়ার জন্য থাকা খাল দুটিকে সরিয়ে দেন।[১৮] যাইহোক, তিনি শহরটি দখল করতে অক্ষম হন, যার ফলে তাদের বাকি দিনের জন্য দুই শাসকের মধ্যে চলমান উত্তেজনা এবং আগ্রাসন ঘটে।
হামার আমির কামিলের মৃত্যুর পর কূটনৈতিক কৌশলে মুজাহিদের পুরানো শত্রু মুযাফফর নিজেকে সালিহ আইয়ুবের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেছিলেন এবং তাকে রাজি করান যে, তিনি মিশরে আক্রমণ করার আগে হিমস থেকে মুজাহিদকে সরিয়ে সিরিয়ায় তার অবস্থান কার্যকর করতে পারবেন। ১২৩৯ সালের মার্চ মাসে (শাবান ৬৩৬) সালিহ আইয়ুব তার বাহিনী নিয়ে হিমস আক্রমণ করার জন্য রওনা হন, কিন্তু মিশর থেকে দ্বিতীয় আদিলের শাসনের অভিযোগ এবং তাকে নিজে এসে ক্ষমতা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে দূত পান। ফলে ১২৩৯ সালের এপ্রিল মাসে সালিহ আইয়ুব হিমস থেকে সরে আসেন এবং মিশরে আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে তার বাহিনীকে দক্ষিণে সরিয়ে নেন।[১৯] হুমকি কমে যাওয়ার সাথে সাথে মুজাহিদ সালিহ আইয়ুবের চাচা সালিহ ইসমাইলের সাথে দামেস্ক দখল করার এবং তাদের মধ্যে সিরিয়া অঞ্চল ভাগ করার ষড়যন্ত্র করেন। তাদের বাহিনী ২৮ সেপ্টেম্বর ১২৩৯ (২৭ সফর ৬৩৭) দামেস্ক দখল করে।[২০]
দামেস্ক দখল করে মুজাহিদ লাভবান হওয়ার আগেই তিনি ১২৪০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে (রজব ৬৩৭) মারা যান। তিনি একটি উল্লেখযোগ্য সময়; ৫৪ বছর ধরে হিমস শাসন করেছিলেন এবং এই সময়ে হিমস সম্ভবত আইয়ুবী রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে স্থিতিশীল ছিল।[২১] তার স্থলাভিষিক্ত হন তার পুত্র মানসুর ইব্রাহিম।