মাহার বা মহার কথার অর্থ মহারাষ্ট্রের আদি বাসিন্দা।[১] মাহার একটি ভারতীয় জাতি যা মূলত মহারাষ্ট্র রাজ্য এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাস করে।[২] বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বেশিরভাগ মাহার সম্প্রদায়ের লোক ভীমরাও রামজি আম্বেদকরকে অনুসরণ করে বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিল।[৩][৪] ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভারতের ১৬ টি রাজ্যে মাহার জাতিকে তফসিলি জাতি হিসাবে মনোনীত করা হয়েছিল।
ঐতিহাসিকভাবে মাহারদের ভূমিকা ছিল বহিরাগতদের ও উপজাতিদের আক্রমনের হাত থেকে গ্রামের সীমানা রক্ষা করা এবং গ্রামবাসীকে অপরাধী ও চোরদের হাত থেকে বাঁচানো। তারা গ্রাম জুড়ে "আইন-শৃঙ্খলা" বজায় রাখার কাজও করত।[৫] প্রারম্ভিক ইসলামী শাসনের সময় থেকে মহারাষ্ট্রের গ্রামগুলি ছিল বালুতা ব্যবস্থার অংশ। সেই ব্যবস্থায় বিভিন্ন জাতিকে আলাদা আলাদা ভূমিকা দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যেকের নিজস্ব কাজ এবং অধিকার ছিল। বালুতা পদ্ধতিতে অনেক ঐতিহ্যগত দায়িত্ব ছাড়াও মাহারদের গ্রাম থেকে মৃত গরু সরানোর কাজ দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রদায়টি প্রাকৃতিকভাবে মারা যাওয়া গরুর মাংসও খেতে শুরু করে এবং গরুর মাংস খাওয়া জাতিকে অস্পৃশ্য হিসাবে বিবেচনা করার ভিত্তি তৈরি করে।[৬] মাহার সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজেদের সমর্থনে বলে যে দুর্ভিক্ষের কারণে তারা গরুর মাংস খাওয়া শুরু করেছিল।[৭] যাইহোক, তারা আর্থ-সামাজিকভাবে অন্যান্য বেশিরভাগ অস্পৃশ্য গোষ্ঠীর থেকে উপরে ছিল কারণ তাদের ঐতিহ্যগত ভূমিকা গ্রামীণ প্রশাসনিক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সমকক্ষ হওয়ার জন্য তাদের অন্তত একটি প্রাথমিক শিক্ষার প্রয়োজন ছিল।[৮]
মাহারেরা মহারাষ্ট্রের আদি বাসিন্দা বলে বিবেচিত হয়। সম্প্রদায়টি "কাঠিওয়ালে" (লাঠিওয়ালা পুরুষ), বুমিপুটেরা (মাটির পুত্র) এবং মিরাসি (ভূমিস্বামী) নামেও পরিচিত। তারা গ্রামের জমিতে বাস করত যেখানে তারা একসময় পূর্বে শাসন করেছিল। কিন্তু তাদের বসতিস্থল সক্লের থেকে আলাদা জায়গায় হত। ঐতিহাসিকভাবে মাহাররা ছিল জমিদার বা বতানদার, এবং সময়ের সাথে সাথে তারা বালুতেদারে পরিণত হয়েছিল। বালুতা ব্যবস্থা চলাকালীন তারা গ্রামের প্রহরী, চোরদের নজরদারিকারী, বার্তাবাহক, প্রাচীরের মীমাংসাকারী, সীমানা বিরোধের বিচারকারী এবং মোটা কাপড় সরবরাহকারী ইত্যাদি ভুমিকা পালন করত। এই পরিষেবাগুলির বিনিময়ে গ্রাম তাদের নিজস্ব চাষাবাদ করার জন্য ছোট ছোট জমির মালিকানা দেয়। গ্রামের উৎপাদিত পণ্যের একটি অংশও তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল।[৯] তারা মাঝে মাঝে কৃষি শ্রমিক হিসেবেও কাজ করত।[১০][১১]
ইসলামী শাসনের আমলে মাহাররা দাক্ষিণাত্য সালতানাত, বাহমানি সালতানাত এবং মুঘলদের বিভিন্ন বাহিনীতে সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[১০]
১৪ শতকে মহার ভক্তি সাধক চোখামেলা এবং তার পরিবারের অনেক সদস্য যেমন কর্মমেলা, বাঙ্কা, নির্মলা এবং সোয়রাবাই তাদের রচিত অভঙ্গ নামক ধর্মীয় কবিতা শৈলীর জন্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।[১২][১৩][১৪][১৫]
মাহাররা কয়েক শতাব্দী ধরে বিভিন্ন সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন। মারাঠা রাজা শিবাজি মহারাজ তাদের আনুগত্য এবং সাহসিকতার কারণে ১৭ শতকে তাদের অনেককে তাদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করেছিলেন।[১৬] তারা পার্বত্য দুর্গে প্রহরী এবং সৈনিক হিসেবে কাজ করত।[১৭] ১৬৬৫ সালে কোলি ও মারাঠাদের সাথে মাহাররা দিলিরখানের মোগল বাহিনীর হাত থেকে পুরন্দরের দুর্গ রক্ষা করেছিল।[১৮] পরবর্তীতে পেশোয়া শাসনকালে ১৭৯৫ সালে খড়দার যুদ্ধের সময় শিদনাক মাহার তার সেনাপতি পরশুরামভাউ পাটবর্ধনের জীবন রক্ষা করেন।[৬] পেশোয়াদের শাসনকালে মাহাররা সামাজিক অধঃপতনের শিকার হয়েছিল কারন উচ্চবর্নের লোকেরা তাদের সাথে অস্পৃশ্য আচরণ করত।[১৯]
ব্রিটিশ শাসনের অধীনে মাহাররা সামাজিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতির সুযোগ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। তাদের ঐতিহ্যগত ভূমিকা ছিল নিম্ন-মর্যাদা কিন্তু গ্রাম ব্যবস্থায় তারা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।[৮]
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মহাররা গ্রামীণ মহারাষ্ট্রে তাদের ঐতিহ্যবাহী চাকরি ছেড়ে দেয় এবং শহুরে কল, ডক, নির্মাণ সাইট এবং রেলওয়েতে চাকরি নেয়।[২০] শহুরে মাহার কর্মীদের একটি গ্রহণযোগ্য সংস্থা ছিল যারা উচ্চ মর্যাদা এবং সমতার জন্য একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিতে প্রস্তুত ছিল।[২১][অস্পষ্ট]
১৯৬৯ সালের গননা অনুসারে ভারতের মোট তফসিলি জাতি জনসংখ্যার প্রায় ৭০% মাহার জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত, এছাড়াও মহারাষ্ট্র রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ৯% মাহার জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত।[২২] ভারতের ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে মাহার হল সংখ্যাগতভাবে মহারাষ্ট্রের বৃহত্তম তফসিলি জাতি।[২৩] ২০১৭ সালে মাহার সম্প্রদায়কে ভারতের ১৬টি রাজ্যে অন্ধ্রপ্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ আসাম, ছত্তিশগড়, দাদরা এবং নগর হাভেলি, দমন এবং দিউ, গোয়া, গুজরাট, কর্ণাটক, মধ্য প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, তেলেঙ্গানা, পশ্চিমবঙ্গ ও হরিয়ানাতে তফসিলি জাতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[১]
বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে মাহারেরা গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু দেবতা ও স্থানীয় সন্ত যেমন শিব, খান্ডোবা, বিঠোবা এবং বারকরী সাধক, চোখামেলা এবং জ্ঞানেশ্বর ইত্যাদির পূজা করতেন। মাহারদের পারিবারিক দেবতারা সাধারণত শিব, মারিদেবী, ভূমিদেবী, নবনাথ এবং ভবানী। নাগদেবতাদের এরা বিশেষ সম্মান করেন।[২৪]
১৯ শতকের শেষের দিকে আহমদনগর জেলার সঙ্গামনার এলাকায় অটো ওয়েইশাপ্টের ধর্ম প্রচারের প্রচেষ্টার দ্বারা মাহার সম্প্রদায় প্রভাবিত হয়।[২৫] বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আহমেদনগর এবং অন্যান্য সংলগ্ন এলাকায় কিছু মাহার খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করেছিল।[২৬]
বি.আর. আম্বেদকরের বৌদ্ধধর্মের প্রতি আগ্রহ ও ধর্মান্তরন, মাহারদের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মান্তর আন্দোলনকে কিছুটা স্তিমিত করে দেয়।[২৭] ১৯৫৬ সালে নাগপুরে যখন তিনি বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হন তখন তাকে অনুসরণ করে অনেক মহারও বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন।[২৮] এই গণধর্মান্তরের প্রায় দুই মাস পর আম্বেদকর মারা যান।[২৯] তার সৎকারের পর আরও মাহার বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়।[৩০]
ধর্মান্তরনের পর কিছু বৌদ্ধ নেতার পছন্দ অনুসারে এই ধর্মান্তরিত জনগন্দের সম্বোধনের জন্য আর মাহার শব্দ প্রয়োগ করা হবে না।[৩১] বৌদ্ধধর্ম মাহারদের মধ্যে সমতার বোধ আনয়ন করেছিল।[৩২] মহার বংশোদ্ভূত একজন বুদ্ধিজীবী বলেছেন, "আমি বৌদ্ধ মতবাদ গ্রহণ করেছি। আমি এখন বৌদ্ধ। আমি এখন মাহার নই, অস্পৃশ্যও নই, এমনকি হিন্দুও নই। আমি মানুষ হয়েছি"।[৩৩]
১৯৯৬ সালের একটি বইতে লেখক দে এবং শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন যে নব্য-বৌদ্ধদের পক্ষে তাদের পুরানো হিন্দু ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান, অনুশীলন এবং উৎসবগুলি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা কঠিন। বৌদ্ধ ধর্মান্তরিতদের জন্য ভি আর রণপিসে ১৯৬২ সালে মারাঠি ভাষায় বৌদ্ধ সংস্কার পথ নামে একটি বই লিখেছিলেন কিন্তু খুব কম লোকই সেই বইটি পড়েছেন।[৩৪]