মার্কসবাদ |
---|
একটি সিরিজের অংশ |
মিথ্যা চেতনা (False consciousness) পুঁজিবাদী সমাজগুলোতে শ্রেণীসমূহের মধ্যকার সামাজিক সম্পর্কে অন্তর্নিহিতভাবে যে শোষণ বিদ্যমান তাকে লুকিয়ে রেখে যে উপাদানগত, ভাবাদর্শগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে প্রোলেতারিয়েত বা সর্বহারা শ্রেণী ও অন্যান্য শ্রেণীকে ভুল পথে চালনা করা হয় তা প্রকাশ করার জন্য মার্ক্সীয় সমাজতাত্ত্বিকগণ প্রাথমিকভাবে এই শব্দটিকে ব্যবহার করেন।
ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস "মিথ্যা চেতনা" শব্দটিকে এমন একটি পরিস্থিতিকে তুলে ধরার জন্য ব্যবহার করেছিলেন যেখানে শাসক শ্রেণীর ভাবাদর্শকে অধীনস্থ শ্রেণী ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রহণ করে নেয়।[১] এই প্রসঙ্গে "চেতনা" একটি শ্রেনীর এই ইচ্ছাকে রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিতকরণ ও প্রকাশ করার সক্ষমতাকে প্রতিফলন করে। এখানে অধীনস্থ শ্রেণী হচ্ছে সচেতন: এই অধীনস্থ শ্রেণী তার ধারণা ও কার্যের দ্বারা পর্যাপ্ত পরিমাণে একীভূত হওয়ায় সমাজে একটি গুরুতর ভূমিকা পালন করে এবং তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে। এঙ্গেলস এই সচেতনতাকে "মিথ্যা" বলে আখ্যায়িত করেন, কেননা এই অধীনস্থ শ্রেণী নিজেকে সেই লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে যেখানে সেই শ্রেণী নিজে উপকৃত হবে না।
মার্শাল আই. পমার যুক্তি দিয়ে বলেন যে, ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতা বা আপওয়ার্ড মোবিলিটির সম্ভাবনায় বিশ্বাস রাখার জন্য প্রোলেতারিয়েত শ্রেণীর সদস্যগণ শ্রেণীসম্পর্কের সত্যিকারের প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে।[২][৩] অর্থনীতিতে এরকম বিশ্বাস বা এটার মত কোন কিছুর দরকার হয় যেখানে কর্তাকে যৌক্তিক হতে হবে এরকম একটি পূর্বানুমান রয়েছে। এরকম বিশ্বাস না থাকলে মজুরি শ্রমিকগণ অর্থনীতির সেই যৌক্তিক কর্তার পূর্বানুমানকে লঙ্ঘন করে তাদের নিজেদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন সামাজিক সম্পর্কের সচেতন সমর্থকে পরিণত হত না।[৪]
ইতালীয় মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক এন্টোনিও গ্রামসি সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ এর ধারণার বিকাশ ঘটান। সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ বলতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির এমন একটি পদ্ধতিকে বোঝায় যেখানে শাসক শ্রেণীসমূহ একটি সংস্কৃতি তৈরির জন্য সামাজিক নিয়ম, মূল্যবোধ ব্যবস্থা, এবং সামাজিক কলঙ্ক বা সোশ্যাল স্টিগমা (সমাজ আরোপিত যে বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে সমাজের কোন ব্যক্তিকে অন্যদের থেকে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় ও আলাদা করা হয়) তৈরি করে, যে সংস্কৃতির দ্বারা তাদের অবিরাম আধিপত্যকে উপকারী বলে বিবেচনা করা হয়।[৫] মিথ্যা চেতনাকে যাতে সাংস্কৃতিক এবং সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনুধাবন করা যায়, তাই গ্রামসি মিথ্যা চেতনার ধারণাকে সম্প্রসারিত করেন।
১৯৬০ এবং ৭০ এর দশকে কাঠামোবাদ নামের দার্শনিক ও নৃতাত্ত্বিক ধারাটি শিক্ষায়তনিক ও জনপ্রিয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে খ্যাতি অর্জন করতে শুরু করে। কাঠামোবাদে মানব সংস্কৃতিকে তার অবলম্বনস্বরূপ কাঠামো যেমন সাংকেতিক, ভাষাতাত্ত্বিক, এবং মতাদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়। ফ্রেঞ্চ কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য এবং গণ-বুদ্ধিজীবী লুইস আলথুজার মিথ্যা চেতনার কাঠামোবাদ প্রভাবিত ব্যাখ্যাকে জনপ্রিয় করেন, যাকে তিনি ভাবাদর্শিক রাষ্ট্র সরঞ্জাম বা দি আইডিওলজিকাল স্টেট এপারেটাস হিসেবে অভিহিত করেন। মিথ্যা চেতনার আলথুজারের কাঠামোবাদ প্রভাবিত ব্যাখ্যাটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহে, বিশেষ করে আনুগত্য, অনুসার বা কমফরমিটি এবং অধিনস্ততা সৃষ্টির স্বপক্ষের মতাদর্শিক ব্যবস্থাকে যেসব গণশিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে চাপিয়ে দেয়া সেই প্রতিষ্ঠানসমূহের দিকে মনোনিবেশ করে।[৬]
অন্যান্য বিশিষ্ট মার্ক্সীয় দার্শনিক এবং বুদ্ধিজীবী মিথ্যা চেতনার ধারণার বিশেষ ব্যাখ্যার বিকাশ ঘটিয়েছেন। যেমন, ফ্রাংকফুর্ট ধারার থিওডোর আডোর্নো এবং হারবার্ট মারকুজ, দ্য সিচুয়েশনিস্টস নামক নান্দনিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের গাই ডেবোর্ড এবং রাওউল ভ্যানেইগেম, ঔপনিবেশবাদ-বিরোধী লেখক ফ্রান্টজ ফানন, এবং সমসাময়িক দার্শনিক স্লাভোয় জিজেক মিথ্যা চেতনার বিশেষ ব্যাখ্যার বিকাশ ঘটিয়েছেন। মার্ক্সীয় রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে নৈরাজ্যবাদী ভাষাতাত্ত্বিক নোম চম্স্কি একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা প্রতিমান তৈরি করেছেন যেখানে ব্যক্তিমালিকানাধীন গণমাধ্যম শিল্পের গভীর কেন্দ্রীভূত মালিকানার স্বার্থে তথ্যকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বেছে বেছে সম্প্রচার করা হয়।