মিন্চের নীলমানব, ঝড়ের কেলপি অথবা স্কট্স গ্যালিক ভাষায় na fir ghorma, fear gorm বা sruth nam fear gorm, হলো একপ্রকার পৌরাণিক জীব যারা উত্তর হেড্রিজ থেকে স্কটল্যান্ডের মূলভূখন্ডের মধ্যবর্তী সমুদ্রে বাস করে এবং নাবিকদের পানিতে নিমজ্জিত করতে এবং নৌকা ডোবাতে চেষ্টা করে। তারা প্রধানত মিন্চ এবং আশপাশের এলাকার স্থানীয় এবং বাকি স্কটল্যান্ডে সুপরিচিত নয়। বাকি বিশ্বে এদের কোন সমগোত্রীয় পৌরাণিক জীব নেই।
শুধুমাত্র গাত্রবর্ণ ব্যতীত এই পৌরাণিক জীবগুলোর বাকি সবকিছুই মানুষের মত। এদের আকারও মানুষের সমান। তাদের ঝড় সৃষ্টি করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু আবহাওয়া ভালো থাকলে তারা সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরে বা ঠিক নিচেই ভাসমান থাকে। নীলমানবরা তাদের কোমরের উপর অংশ পানির উপরে তুলে সাঁতার কাটে। তারা কথা বলতে পারে, এবং যখন একদল মিন্চ কোন জাহাজের দিকে অগ্রসর হয় তখন এদের নেতা জাহাজের কাপ্তানের উদ্দেশ্যে দুই পদ কবিতা আবৃত্তি করে এবং কাপ্তানকে বাকিটা বলতে বলে। কাপ্তান এতে ব্যর্থ হলে নীলমানবেরা জাহাজটি উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করে।
পৌরাণিক নীলমানবকে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ধারণা করা হয়, এটি সমুদ্রেরই ব্যক্তিসত্বায় বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। এরা পিক্টও হতে পারে, যাদের রঙ্গিন দেহ ও কায়াক নৌকা দেখে সমুদ্র থেকে উঠে আসা মানবদেহ বলে বিভ্রম হতে পারে। নীলমানবের উপাখ্যান ভাইকিংদের সাথে আনা উত্তর আফ্রিকান দাসদের মাধ্যমেও আসতে পারে, যারা শীতের সময়টা মিঞ্চের শাইন্ট দ্বীপপুঞ্জে অবস্থান করতো।
মিন্চ একটি প্রণালী যা স্কটল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিম উচ্চভূমি ও উত্তরের নিকটবর্তী হেড্রিজ দ্বীপপুঞ্জকে দূরবর্তী হেড্রিজ দ্বীপপুঞ্জ থেকে পৃথক করে। এখানেই মিন্চের নীলমানবের আবাস।[১] ভাষাবিদ এডওয়ার্ড ডয়েলির ভাষ্যমতে, স্কটিশ গায়েলিক ভাষায় নীলমানবের নাম – na fir ghorma, fear gorm এবং sruth nam fear gorm – এতে ব্যবহৃত gorm এর অর্থ যেকোন নীল বর্ণ, fear এর অর্থ হলো মানব এবং na fir দ্বারা মানবের বহুবচন বোঝায়।[২]
নীলমানবকে অনেকসময় কেলপিও বলা হয়।[৩][৪] কেলপি একপ্রকার ঘোড়া যারা স্কটিশ লোকপ্রথায় সমুদ্রের আত্মা হিসেবে বিভিন্ন রূপে বহুলপ্রচলিত।[৫][৬] কেলপি নামটি স্কটিশ গায়েলিক calpa বা cailpeach থেকে এসেছে যার অর্থ একপ্রকার ঘোড়া।[৭]
পৌরাণিক নীলমানব "দেবদূত" এর তিন গোত্রের একটি হতে পারে, যার প্রথমটি ভূমিতে অবস্থানরত দেবদূত, দ্বিতীয়টি সমুদ্রের বাসিন্দা নীলমানব ও তৃতীয়টি মেরি নর্তক যারা উত্তর আকাশে আলোকবর্তিকা সৃষ্টি করে।[৮] পুরাণে বর্ণিত এই প্রাণীগুলো মানুষের মতই আকৃতির এবং তাদের নাম অনুসারে নীল রঙের।[৯] লেখক এবং সাংবাদিক লুইস স্পেন্স মনে করেন যে, নীলমানব আসলে সমুদ্রের নীল রঙের সাথে মিল রেখে "সমুদ্রেরই ব্যক্তিরূপে বহিঃপ্রকাশ"।[১০] তাদের মুখমন্ডল ধূসর ও লম্বাটে, কয়েকজনের হাত লম্বা, মাথার অলংকারও নীল এবং কিছু বর্ণনা অনুসারে তাদের ডানাও রয়েছে।[৯][১১] শাইন্ট দ্বীপপুঞ্জের ১৯ কিলোমিটার উত্তরের "স্কাইই" অঞ্চলের দুর্যোগপূর্ণ সাগরের পার্শ্ববর্তী গুহাসমূহে নীলমানবের বাস।[১২] এই সাগরটি বেশকিছু জাহাজডুবির জন্য "ধ্বংসের স্রোত" নামে পরিচিত।[১৩]
যদিও কবি, লেখক ও লোকশিল্পী এলেসডিয়ার আলপিন ম্যাকগ্রেগর অনুসারে ঝড়ের কেলপিদের বাস কোরিয়েভরেকেন উপসাগরে, নীলমানবদের বাস খুবই সীমিত এলাকায়।[৪] ডোনাল্ড এ. ম্যাকেনজি বর্ণনা করেন যে নীলমানবের মত কিছুই সারাবিশ্বে নেই এবং খোদ স্কটল্যান্ডেও এদের বাস সীমিত, একটি পৈশাচিক আত্মার লোকগাথা হিসেবে এমন নিদর্শন বিরল।[১৪] লোকসংস্কৃতির গবেষক জন গ্রেগরসন ক্যাম্পবেল বলেন যে নীলমানব নিকটবর্তী মূল ভূখন্ডের আরগাইলেও প্রচলিত নয়। যদিও স্কটিশ চার্চের কর্মচারী জন ব্র্যান্ড ১৭০০ সালের মাঝামাঝিতে শেটল্যান্ডের কোয়ার্ফ ভ্রমণকালে একপ্রকার জীবের কথা বর্ণনা করেন যার সাথে নীলমানবের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।[১৫] এটি গোঁফযুক্ত বৃদ্ধ মানুষের মত সমুদ্রের বুক হতে উঠে আসতো এবং নৌকার যাত্রী ও শ্রমিকদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতো।[১৬]
লোকমুখে প্রচলিত পুরাণের গল্প অনুসারে, নীলমানবের প্রলয়ংকারী ঝড় সৃষ্টির ক্ষমতা আছে। তবে ভালো আবহাওয়ায় তারা সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরে বা ঠিক নিচেই ভাসমান থাকে।[৩] নীলমানবরা তাদের কোমরের উপর অংশ পানির উপরে তুলে সাঁতার কাটে।[১৭] তারা "শিনটি" খেলায় পারদর্শী।[১৮] তারা কথা বলতে পারে এবং নাবিকদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে, এবং কোন জাহাজডুবি হলে তারা উচ্চৈঃস্বরে হাসতে থাকে।[১৯]
নীলমানবেরা একত্রিত হয় এবং তাদের নেতা জাহাজের কাপ্তানকে দুই পদ কবিতা শোনায় কাপ্তানকে বাকিটা বলতে বলে।[১১] কাপ্তান এতে ব্যর্থ হলে নীলমানবেরা জাহাজটি উল্টে দেয়ার চেষ্টা করে।[১৭] ম্যাকেনজি এরূপ একটি কথোপকথন তুলে ধরেন:[১৭]
নীলমানবের সর্দারঃ কালো জাহাজের নেতা তুমি কি বলো
যখন তোমার গর্বের জাহাজ সাগরের বুক চিরে এগোয়?
কাপ্তানঃ আমার দ্রুতগামী জাহাজ সংক্ষিপ্ত পথে চলে
এবং আমি তোমাকে পদে পদে অনুসরণ করবো
নীলমানবের সর্দারঃ আমার লোকেরা উৎসুক, আমার লোকেরা প্রস্তুত
তোমাকে স্রোতের নিচে টেনে নিয়ে যেতে
কাপ্তানঃ আমার জাহাজ দ্রুতগামী, আমার জাহাজ সুস্থির
যদি এটা ডোবে, তো তোমাদের গুহা ধ্বংস হবে।
এরূপ ত্বরিত জবাব নীলমানবের সর্দারকে অপ্রস্তুত করে। তারা হেরে যায় ও জাহাজের কোন ক্ষতি করতে পারেনা এবং তাদের সাগর তলের গুহার আবাসে ফিরে যায়। জাহাজটি নিরাপদে সমুদ্র পাড়ি দেয়।[১৭] জাহাজের কাপ্তান প্রত্যুত্তরে ব্যর্থ হলে নীলমানবেররা জাহাজে উঠে নাবিকদের থেকে অর্থ দাবী করে, এবং দাবী না মেটালে সমুদ্রে ঝড় সৃষ্টির হুমকি দেয়।[১১]
কোন প্রচলিত লোকগাথাতে এই পিশাচগুলোকে হত্যা করার বর্ণনা পাওয়া যায় না, তবে একটি গ্রেগরসন ক্যাম্পবেলের গল্পে একটি নীলমানবের আটক হওয়ার বর্ণনা পাওয়া যায়। বর্ণনা অনুসারে, কিছু নাবিক একটি নীলমানবকে ভাসমান অবস্থায় আটক করে ও বন্দি করে।[৯] শীঘ্রই আরো দুটি নীলমানব তাদের নৌকা তাড়া করে এবং নিমরুপ পদ্য আউড়াতে থাকে,
ডানকান হবে এক, ডোনাল্ড হবে দুই
তোমার কি আরেকজন দেবদূত লাগবে তীরে পৌঁছাতে?[১৭]
সঙ্গিদের কথা শুনে আটককৃত নীলমানব বাঁধন ছিঁড়ে লাফিয়ে সাগরে পড়ে। সেসময় সে বলে,
আমি ডানকানের কথা শুনেছি এবং ডোনাল্ডও নিকটে
কিন্তু কোন সাহায্যের প্রয়োজন নেই ইয়ান মুরই যথেষ্ট।[১৭]
এটি থেকে নাবিকেরা ধারণা করে যে, সব নীলমানবেরই নাম আছে এবং তারা একে অপরকে নাম ধরে ডাকে।[১৭]
ম্যাকেনজির ব্যাখ্যা অনুসারে, নীলমানবের উপাখ্যান বেশ প্রাচীন এবং এর শেকড় আয়ারল্যান্ডের প্রথম নর্স রাজা ফেয়ারহেয়ার এর ভাইকিং এর সাথে যুদ্ধের আমলে প্রথিত। স্কটিশ গায়েলিক শব্দ fear gorm যার অর্থ "নীল মানব",[২০][২১] একই সাথে নিগ্রোদেরও বোঝায়।[২২] একইভাবে , নীলমানবদের গায়েলিক নাম fear gorm, যার আক্ষরিক অর্থের ভাষান্তর হয় "নীলমানবদের খড়া[২৩]" বা "নীল নিগ্রোর নদী"[২৪]। নবম শতাব্দীর দিকে ভাইকিংরা মুর জাতিগোষ্ঠির কিছু সদস্যকে আটক করে দাস হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। ভাইকিংরা শীতকাল শাইন্ট দ্বীপপুঞ্জে কাটাতো, এবং ম্যাকেঞ্জির ধারণামতে নীলমানবদের উপকথাটি এই বিদেশি দাসদের মাধ্যমেই প্রাণ পেয়েছে।[২৫] তিনি ইতিহাসবিদ এলেন অরর এনডারসন-এর "স্কটিশ ইতিহাসের আদি উৎস: ৫০০ হতে ১২৮৬ অব্দ" থেকে উদ্ধৃত করেন।[২৪][২৬]
এরাই হলো নীলমানব, কারণ মুরেরা আর নিগ্রোরা একই; মৌরিতানিইয়ার মানেও নিগ্রোল্যান্ড [আক্ষরিক অর্থেই কালো]
সাম্প্রতিক সংবাদপত্রগুলোও ম্যাকেঞ্জির ধারণাকেই উপজিব্য করেছে।[২৭] ইতিহাসবিদ ম্যালকম আর্চিবাল্ড একমত হন যে, আদিম নর্সদের হাতে বন্দি আফ্রিকান দাস থেকেই এই উপকথার উৎপত্তি, কিন্ত তার ধারণা যে আফ্রিকান দাসগুলো সাহারার তুয়ারেগ গোত্রের। এরা "মরুভূমির নীল মানব" নামেও পরিচিত ছিলো।[১০]
নীলমানবদের উপকথার উৎপত্তি বিকল্পভাবে মানবদেহে উল্কি অঙ্কনের মাধ্যমেও হতে পারে,[২৮] বিশেষ করে পিক্টের সাহায্যে যার ল্যাটিন নাম picti যার অর্থ "রঙিন মানুষ"। যদি তাদের কায়াক নৌকায় করে সমুদ্র পাড়ি দিতে দেখা যেতো তাহলে সাধারণ দ্বীপবাসী এবং নাবিকেরা এদের কোন নীলমানবের দেহের উপরের অংশ ভেবে ভুল করতে পারে।[২৯]