মিশ্র আগ্নেয়গিরি

ইতালির নেপলস শহরের কাছে, ভিসুভিয়াস পর্বত, ৭৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবল অগ্ন্যুৎপাত করেছিল। ১৯৪৪ সালের মার্চ মাসে এই মিশ্র আগ্নেয়গিরিতে সর্বশেষ অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল।

মিশ্র আগ্নেয়গিরি, অথবা বলা যায় সংযুক্ত আগ্নেয়গিরি, হল শক্ত লাভা, টেফরা, ঝামা পাথর এবং ছাইয়ের বহু স্তর দ্বারা গঠিত এক ধরনের শঙ্কু আগ্নেয়গিরি[] মিশ্র আগ্নেয়গিরিগুলির বিশেষত্ব হল একটি আগ্নেয়গিরির মুখ সহ খাড়া পরিলেখ এবং পর্যায়ক্রমিক বিস্ফোরকউদ্গীরক অগ্ন্যুৎপাত। এইরকম কিছু আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ ধ্বসে পড়লে, সেগুলিকে বলা হয় জ্বালামুখ কুণ্ড। মিশ্র আগ্নেয়গিরি থেকে প্রবাহিত লাভা সাধারণত শীতল হয়ে যায় এবং দূরে ছড়িয়ে পড়ার আগে শক্ত হয়ে যায়, কারণ এগুলির সান্দ্রতা খুব বেশি থাকে। যে ম্যাগমা থেকে এই লাভা তৈরি হয় সেটি প্রায়শই ফেলসিক গোষ্ঠির হয়, এর মধ্যে প্রচুর বা মাঝারি পরিমানে সিলিকা থাকে (রায়োলাইট, ডেসাইট, বা অ্যান্ডেসাইট এর মত), স্বল্প পরিমাণে কম-সান্দ্র মাফিকও থাকে। বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ফেলসিক লাভা প্রবাহ অস্বাভাবিক, কিন্তু কখনো কখনো ১৫ কিমি (৯.৩ মা) প্রবাহিত হয়েছে দেখা গেছে।[]

মিশ্র আগ্নেয়গিরিগুলিকে কখনও কখনও "সংযুক্ত আগ্নেয়গিরি"ও বলা হয়। এর কারণ,- এদের সবেগে উৎক্ষিপ্ত অনুক্রমিক অগ্ন্যুৎপাতের উপাদান থেকে তৈরি যৌগিক স্তরযুক্ত গঠন। ঢাল আগ্নেয়গিরির তুলনায় এগুলি আগ্নেয়গিরির সবচেয়ে সাধারণ ধরন। মিশ্র আগ্নেয়গিরি দুটি বিখ্যাত উদাহরণের মধ্যে একটি হল ইন্দোনেশিয়ার ক্রাকাতোয়া, যেখানে ১৮৮৩ সালে সর্বনাশা বিস্ফোরণ হয়েছিল, এবং দ্বিতীয়টি ইতালির ভিসুভিয়াস পর্বত, যেখানে ৭৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবল অগ্ন্যুৎপাতে রোমান সাম্রাজ্যের পম্পেই এবং হেরকুলেনিয়াম শহর দুটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। উভয় অগ্ন্যুৎপাতেই হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। আধুনিক যুগে, সেন্ট হেলেনস পর্বত এবং পিনাটুবো পর্বত থেকে ধ্বংসাত্মক অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে, অবশ্য মৃতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল।

সৌরজগতের অন্যান্য শিলাময় গ্রহগুলিতে মিশ্র আগ্নেয়গিরির সম্ভাব্য অস্তিত্বের নির্ধারিতভাবে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।[] এর একটি সম্ভাব্য ব্যতিক্রম হল মঙ্গলগ্রহে কিছু বিচ্ছিন্ন স্তূপপর্বতের অস্তিত্ব, উদাহরণস্বরূপ জেফরিয়া থোলাস[]

সৃষ্টি

[সম্পাদনা]
অধোগমন অঞ্চল এবং সম্পর্কিত মিশ্র আগ্নেয়গিরির প্রস্থচ্ছেদ

মিশ্র আগ্নেয়গিরিগুলি অধোগমন অঞ্চলে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। ভূপাত সংস্থানের সীমানায় যেখানে মহাসাগরীয় ভূত্বক মহাদেশীয় ভূত্বকের নিচে চলে গেছে (মহাদেশীয় চাপ আগ্নেয়গিরি, যেমন ক্যাসকেড রেঞ্জ, আন্দিজ পর্বতমালা, ক্যাম্পানিয়া) বা অন্য মহাসাগরীয় পাতের নিচে চলে গেছে (দ্বীপ চাপ আগ্নেয়গিরি, যেমন জাপান, ফিলিপাইন, আলেউশিয়ান দ্বীপপুঞ্জ) সেখানে এগুলির অস্তিত্ব বেশি। জলপূর্ণ খনিজ এবং উপরি মহাসাগরীয় ভূত্বকের ছিদ্রযুক্ত বেসাল্ট শিলা উভয় অঞ্চলে আবদ্ধ জল যখন ডুবন্ত মহাসাগরীয় পাতের উপরে আস্থেনোস্ফিয়ারের ম্যান্টল শিলায় মুক্ত হয়, তখন মিশ্র আগ্নেয়গিরি তৈরি করা ম্যাগমা ওপর দিকে উঠে আসে। জলীয় খনিজগুলি থেকে জল নিঃসরণকে "জলাপসারণ" বলা হয়, এবং যখন পাতটি আরও গভীরতায় নেমে যায়, প্রতিটি খনিজের জন্য নির্দিষ্ট চাপ এবং তাপমাত্রায় জলাপসারণ ঘটে। শিলা থেকে মুক্ত হওয়া জল ওপরের ম্যান্টল শিলাটির গলনাঙ্ক কমিয়ে দেয়, যেটি তখন আংশিক গলে যায়। আশেপাশের ম্যান্টল শিলার তুলনায় হালকা ঘনত্বের কারণে এটি ওপর দিকে ভেসে ওঠে, এবং অশ্মমণ্ডলের তলদেশে সাময়িকভাবে জমা হয়। ম্যাগমা তখন ভূত্বকের মধ্য দিয়ে সিলিকা সমৃদ্ধ ভূত্বকীয় শিলা সংযুক্ত করে ওপর দিকে ওঠে এবং একটি চূড়ান্ত অন্তর্বর্তী গঠনের দিকে অগ্রসর হয়। যখন ম্যাগমা শীর্ষ পৃষ্ঠের কাছাকাছি আসে, তখন এটি মিশ্র আগ্নেয়গিরির নীচে ভূপৃষ্ঠের মধ্যেই একটি ম্যাগমা কক্ষে এসে জমা হয়।

সেখানে অপেক্ষাকৃত কম চাপ থাকার ফলে, ম্যাগমার মধ্যে দ্রবীভূত জল এবং অন্যান্য উদ্বায়ী (প্রধানত কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, ক্লোরিন, এবং হাইড্রোজেন) দ্রবন থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে যায়। এমনটি ঘটে যখন সোডার একটি বোতল খোলা হয় কার্বন ডাই অক্সাইড মুক্ত হয়ে বেরিয়ে যায়। ম্যাগমা এবং গ্যাসের আয়তন যখন একটি ক্রান্তিক বিন্দুতে পৌঁছে যায়, আগ্নেয়গিরির মুখে জমে থাকা কঠিন অংশটি ভেঙে গিয়ে, হঠাৎ বিধ্বংসী অগ্ন্যুৎপাত হয়।[]

বিপত্তি

[সম্পাদনা]
দক্ষিণ ইতালির সিসিলি দ্বীপের এটনা পর্বত
হোনশুতে ফুজি পর্বত (উপরে) এবং কিউশুতে উনজেন পর্বত (নিচে), জাপানের দুটি মিশ্র আগ্নেয়গিরি।

লিপিবদ্ধ ইতিহাস অনুযায়ী, অধোগমন অঞ্চলে, যেখানে দুই বা ততোধিক অশ্মমণ্ডলীয় পাতের মধ্যে অভিঘাত হয় (কনভার্জেন্ট সীমা), সেখানে বিস্ফোরক অগ্ন্যুৎপাত আগ্নেয়গিরি সভ্যতার সবচেয়ে বড় বিপদ ডেকে এনেছে।[] অধোগমন অঞ্চলে মিশ্র আগ্নেয়গিরিগুলি, যেমন সেন্ট হেলেনস পর্বত, এটনা পর্বত এবং পিনাটুবো পর্বত, সাধারণত বিস্ফোরক শক্তি দিয়ে ফেটে যায়: এখানে ম্যাগমা খুব শক্ত থাকায় আগ্নেয়গিরির গ্যাসগুলি সহজে বার হতে পারেনা।। ফলস্বরূপ, আটকা পড়া আগ্নেয়গিরির গ্যাসের প্রচণ্ড অভ্যন্তরীণ চাপ থাকে এবং সেগুলি পঙ্কিল ম্যাগমাতে মিশ্রিত হতে থাকে। জ্বালামুখ খুলে যাবার পরে, ম্যাগমায় বিস্ফোরকভাবে গ্যাস মুক্তি হতে থাকে। ম্যাগমা এবং ওই গ্যাসগুলি দ্রুত গতি এবং পুরো শক্তি দিয়ে বিস্ফোরিত হয়।[]

১৬০০ সাল থেকে, আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে প্রায় ৩০০,০০০ মানুষ নিহত হয়েছেন।[] বেশিরভাগ মৃত্যু হয়েছিল পাইরোক্লাস্টিক প্রবাহ এবং লহরের কারণে, এগুলি হল অধোগমন অঞ্চলে মিশ্র আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের মারাত্মক বিপত্তি, যা প্রায়শই ঘটে। পাইরোক্লাস্টিক প্রবাহ হল দ্রুতগামী, তুষারপাতের মতো, মাটি ঘেঁষা প্রচণ্ড উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরির ধ্বংসাবশেষের প্রবাহ। সূক্ষ্ম ছাই, গলিত লাভা এবং অতি উত্তপ্ত গ্যাস ১৬০ কিমি/ঘ (১০০ মা/ঘ) গতিতে প্রবাহিত পারে। ১৯০২ সালে ক্যারিবীয় অঞ্চলের মার্তিনিক দ্বীপের পিলি পর্বতে বিস্ফোরণের সময় পাইরোক্লাস্টিক প্রবাহে প্রায় ৩০,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল।[] ১৯৮২ সালের মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত, দক্ষিণ-পূর্ব মেক্সিকোয় চিয়াপাস রাজ্যে এল চিচোন আগ্নেয়গিরিতে তিনটি ভয়ংকর বিস্ফোরণ হয়েছিল, এটি সে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ আগ্নেয়গিরির বিপর্যয় ছিল।আগ্নেয়গিরির ৮ কিমি (৫ মা) দূরত্বের মধ্যে গ্রামফুলি পাইরোক্লাস্টিক প্রবাহে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, ২,০০০ এরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। []

১৯৯১ সালে যে দুটি ডেকাড আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাত করেছিল সেগুলি মিশ্র আগ্নেয়গিরির বিপদের উদাহরণ দেয়। ১৫ই জুন, পিনাটুবো পর্বত ছাইয়ের মেঘ উদ্গীরণ করেছিল, যে মেঘ পরিবেশে ৪০ কিমি (২৫ মা) অবধি ছড়িয়ে গিয়েছিল এবং বিশাল মাত্রায় পাইরোক্লাস্টিক এবং লহর প্রবাহিত হয়েছিল, যার প্রভাবে আগ্নেয়গিরির আশেপাশের বিরাট এলাকা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। মধ্য লুজনের পিনাটুবো পর্বত ম্যানিলার মাত্র ৯০ কিমি (৫৬ মা) পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। পিনাটুবো পর্বত ১৯৯১ সালের বিস্ফোরণের আগে ৬ শতাব্দী ধরে সুপ্ত ছিল। এর বিস্ফোরণ বিশ শতকের বৃহত্তম বিস্ফোরণগুলির মধ্যে একটি ছিল।[] ১৯৯১ সালেই, জাপানের কিউশু দ্বীপে নাগাসাকির ৪০ কিমি (২৫ মা) পূর্বে অবস্থিত উনজেন আগ্নেয়গিরি, ২০০ বছরের ঘুম ভেঙে উঠে এর শীর্ষে একটি নতুন লাভা গম্বুজ সৃষ্টি করেছিল। এরপর জুন মাস থেকে শুরু করে, এই গম্বুজ বারবার ধসে ছাইয়ের প্রবাহ সৃষ্টি করেছিল। এই প্রবাহ ২০০ কিমি/ঘ (১২০ মা/ঘ) গতিবেগে পাড়ের ঢালকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। উনজেন জাপানের ৭৫টিরও বেশি সক্রিয় আগ্নেয়গিরিগুলির মধ্যে একটি; ১৯৭২ সালের বিস্ফোরণে ১৫,০০০ জনেরও বেশি লোক মারা গিয়েছিল। এটি ছিল জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ আগ্নেয়গিরি বিপর্যয়।[]

৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভিসুভিয়াস পর্বতে অগ্ন্যুৎপাত প্রাচীন পম্পেই এবং হেরকুলেনিয়াম শহরদুটিকে সম্পূর্ণভাবে শেষ করে দিয়েছিল, পাইরোক্লাস্টিক এবং লাভা প্রবাহের পুরু অবশেষ শহরদুটিকে ঢেকে ফেলেছিল। যদিও অনুমান করা হয় মৃতের সংখ্যা ১৩,০০০ থেকে ২৬,০০০ এর মধ্যে ছিল, সঠিক সংখ্যা এখনও অস্পষ্ট। শক্তিশালী বিস্ফোরণের ক্ষমতার কারণে ভিসুভিয়াস পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক আগ্নেয়গিরিগুলির মধ্যে একটি বলে স্বীকৃত।

তালিকা

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. টেমপ্লেট:USGS
  2. "Garibaldi volcanic belt: Garibaldi Lake volcanic field"Catalogue of Canadian volcanoesGeological Survey of Canada। ২০০৯-০৪-০১। ২০০৯-০৬-২৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৬-২৭ 
  3. Barlow, Nadine (২০০৮)। Mars : an introduction to its interior, surface and atmosphere। Cambridge, UK: Cambridge University Press। আইএসবিএন 9780521852265 
  4. Stewart, Emily M.; Head, James W. (১ আগস্ট ২০০১)। "Ancient Martian volcanoes in the Aeolis region: New evidence from MOLA data"। Journal of Geophysical Research106 (E8): 17505। ডিওআই:10.1029/2000JE001322 
  5. "Volcanic Vents: Habits, Hazards, and Brief Histories" (পিডিএফ)। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ 
  6. টেমপ্লেট:USGS