মুঘল অস্ত্রশস্ত্রের বিবর্তন শুরু হয় মুঘল বাদশাহ বাবর, আকবর, আওরঙ্গজেব এবং শের-ই-মহীশূর (মহীশূরের বাঘ) টিপু সুলতানের আমলে। কয়েক শতাব্দী ধরে চলা মুঘল জয়রথ টেনে নিয়ে চলা মুঘল সেনাবাহিনী নানান ধরনের অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেছে- যার মধ্যে তরবারি, তীর-ধনুক, ঘোড়া, হাতি, পৃথিবীর বৃহত্তর কামানগুলোর একাংশ, মাস্কেট বন্দুক (muskets) ও 'ফ্লিন্টলক ব্লান্ডারবাস' বন্দুক (flintlock blunderbusses) উল্লেখযোগ্য।
বেশিরভাগ অশ্বারোহী সৈনিকগণ কাছাকাছি দূরত্বে যুদ্ধ করার জন্য মূলত খাটো অস্ত্রশস্ত্রের (kotah-yaraq) উপর নির্ভরশীল ছিল। এই খাটো অস্ত্রসমূহ মূলত ৫টি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল: ঢাল-তলোয়ার, গদা, যুদ্ধ-কুঠার, বল্লম এবং খঞ্জর। বেশি দূরত্বের আক্রমণের জন্য ব্যবহৃত হতো তীর-কামান, বন্দুক বা তিফাংক এবং পিস্তল। গোলন্দাজ (তোপখানা) বাহিনীতে ব্যবহৃত হতো ক্ষেপণাস্ত্র। স্বাভাবিকভাবেই কোনো ব্যক্তিই একা এসব অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে যেত না বরং একটি বিশাল সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অংশে এসকল অস্ত্রই কারো না কারো দ্বারা ব্যবহৃত হতো। যে পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র একজন মুঘল সেনা ব্যবহার করতো তার বর্ণনা পাওয়া যায় ফ্লিটজক্ল্যারেন্সের জবানিতে। ফ্লিটজক্ল্যারেন্স ছিলেন নিজামের সেনাবাহিনীর একজন ক্ষুদ্র প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা।
তিনি তার প্রতিরক্ষা সহচরকে বলেন:
“চমৎকার অশ্বসজ্জাবিশিষ্ট দুইটি অতীব দৃষ্টিনন্দন ঘোড়া আছে এই জমাদারের, যে কিনা নিজে সোনার লেস দেয়া সবুজ ইংলিশ ব্রড কাপড়ের (দ্বিগুণ চওড়া উন্নতমানের পশমি বস্ত্র) তৈরি পোশাকে শোভিত ছিল এবং তার পরনে আরও ছিল খুবই জাঁকালো কারুকার্যখচিত বেল্ট। মহিষের চামড়ায় তৈরি ও স্বর্ণমণ্ডিত গম্বুজের ন্যায় প্রতিরক্ষাংশযুক্ত একটি ঢাল ছিল তার পিঠে, তার হাতে অস্ত্রহিসেবে ছিল দুইটি তরবারি ও একটি খঞ্জর, ইংলিশ পিস্তল (রিভলভার) রাখার অস্ত্রবন্ধনী, এবং তার বন্দুকটি তার নফরের দ্বারা তার সামনে পরিবাহিত হচ্ছিল।”
তরবারি রাখার কোমরবন্ধনীসমূহগুলো সাধারণত ছিল চওড়া এবং খুব সুন্দরভাবে কারুকাজ করা। মুঘল যুগের প্রকৃত সৌন্দর্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ এর তরবারিগুলো। অশ্বারোহীরা কাঁধে ঝোলানো বেল্টের মাধ্যমে তরবারি বহন করতো। তবে বাকীরা তাদের তরবারি তিনটি ফিতেওয়ালা একটি কোমরবন্ধনীতে করেই বহন করতো।
বিভিন্ন রকমের ফলা (ব্লেড)
শমশের- এটি অনেকটা নিমচার (আরব, পারসিক ও তুর্কীদের পুরনো আমলের খাটো, বাঁকা একধারী তলোয়ারবিশেষ ) ন্যায় একটি বাঁকানো অস্ত্র। এর আকৃতি ও এটির হাতলের ক্ষুদ্রাকারই নির্দেশ করে এটি পুরোপুরিই কাটাকাটির উপযুক্ত একটি অস্ত্র। এটি তৈরি হতো স্টিল দিয়ে।
ধূপ- ধূপ একপ্রকার সোজা তরবারি। দক্ষিণাঞ্চল এর এই তরবারিকে মুঘলবাহিনীতে স্থান দেয়া হয়। এই তরবারিটি প্রায় চার ফুট লম্বা এবং বেশ চওড়া ফলার অধিকারী ছিল এবং এর হাতল এর দুইদিকে ছিল আনুভূমিক অতিরিক্ত অংশ যার জন্য এটিকে অনেকটা ক্রসের মতো দেখাতো। সার্বভৌমত্ব ও উচ্চমর্যাদার প্রতীক এই অস্ত্রটিকে নানান রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত করা হতো, যেখানে একজন মানুষ তার মনিবের সামনে মখমলে মোড়া এই তলোয়ারটিকে উঁচুতে তুলে ধরে রাখতো। এছাড়াও দরবারে আসীন ক্ষমতাশালী ব্যক্তির বালিশেও শোভা পেত এই তরবারিটি। এই ধরনের তরবারি সফল সৈনিক, মহান ও অভিজাত ব্যক্তি এবং দরবারের প্রিয়পাত্রদের জন্য উচ্চমর্যাদার বিষয় ছিল। এটিও স্টিল দিয়ে তৈরি ছিল।
একজন তলোয়ারবাজের সরঞ্জামাদির অবিচ্ছেদ্য অংশ তরবারি ও এর সঙ্গী ঢাল। যুদ্ধের সময় বাম হাতে ধরা ঢাল এর এই ব্যবহার শেষ হলে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো। সাধারণত ঢালগুলো চামড়া কিংবা ইস্পাতের তৈরি এবং এর ব্যাস ছিল ১৭-২৪ ইঞ্চির (৪৩০-৬১০ মিলিমিটার) মধ্যে। ইস্পাতের তৈরি ঢালগুলো খুবই জমকালো কারুকার্যপূর্ণ ছিল এবং এই কাজগুলো ছিল সোনা দিয়ে করা। অপরপক্ষে চামড়ার তৈরি ঢালগুলোয় স্বর্ণ ও রৌপ্যমণ্ডিত উঁচু অংশ, অর্ধচন্দ্র অথবা তারকা আকৃতির উঁচু অংশ বসানো থাকতো।কিছু কছু ঢাল সাম্বার হরিণ, মহিষ, নিলগাই, হাতি অথবা গণ্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরি হতো যার মধ্যে গণ্ডারের চামড়ানির্মিত ঢালই বেশি মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত ছিল। ব্রাহ্মণ সেনারা নানান রঙ করা ৪০-৫০ পরত চওড়া সিল্কের তৈরি ঢাল ব্যবহার করতো।
ঢালের নানান প্রকারভেদঃ
ছোট গোলাকৃতির এর ঢালগুলি কঞ্চি অথবা বাঁশের তৈরি। এর আকৃতি অনেকটা মসুরডাল এর হওয়ায় এটিকে ডাল হিসেবে ডাকা হতো এটিকে ডাল হিসেবে ডাকা হতো। এছাড়াও মারু বা সিংগৌটা নামক অদ্ভুতুড়ে ঢালগুলো তৈরি হতো কৃষ্ণসার হরিণের শিং ও ইস্পাত সহযোগে। হরিণের শিং মোড়া হতো ইস্পাতে এবং শিংদুটো মিলিত হতো এর ভোঁতা প্রান্তভাগে। সাইন্তি একপ্রকার ঢাল যা অসিযুদ্ধে প্রতিপক্ষের আঘাত ঠেকাতে ব্যবহৃত হতো।
এই ধরনের অস্ত্রের নানান ধরনের প্রকরণ ছিল। অশ্বারোহী সেনারা সাধারণত ঘোড়সওয়ারদের বিশেষ শর ব্যবহার করতো এবং পদাতিক সেনা ও সম্রাটের দরবার ঘিরে থাকা রক্ষীরা অন্য ধরনের বর্শা ব্যবহার করতো। এছাড়াও জ্যাভেলিন বা খাটো বর্শা, যা ছুঁড়ে মারা যেতো, তারও ব্যবহার থাকার প্রমাণ মিলেছে, বিশেষত মারাঠাদের মধ্যে।
এগুলো ছিলো নানান আকৃতি ও প্রকারের, যার প্রত্যেকটিই পৃথক পৃথক নামে অভিহিত ছিল।
এই অস্ত্রগুলির কিছু কিছু ছিল হালকা বাঁকানো আবার কিছু ছিলো কাঁটাচামচের ন্যায় ভাগ করা অংশযুক্ত কিংবা দুইটি ফলাযুক্ত। ফলাগুলি হতো নানান রকমের যার দৈর্ঘ্য ৯-১৭.৫ ইঞ্চির (২৩০-৪৪০ মিলিমিটার) এর মধ্যে হতো।
তীর-ধনুক, ম্যাচলক বন্দুক, পিস্তল এবং কামানসহ চার ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের অস্তিত্ব ছিল। অশ্বারোহী সৈন্যদের কাছে প্রধানত ধনুক থাকতো কেননা মুঘল অশ্বারোহী সেনারা তাদের ধনুর্বিদ্যার জন্য সর্বজনবিদিত ছিল। কথিত কিংবদন্তি আছে যে, তীর ও ধনুক সরাসরি জান্নাত থেকে ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল (আ.) এর মাধ্যমে আনিত হয় এবং তিনি সেটি হযরত আদম (আ.) কে দেন। ব্যক্তিগত অস্ত্রগুলো পদমর্যাদার বলে ছিলো এরূপে নিম্ন থেকে উচ্চস্তরে বিভক্ত ছিল: ছোরা, তরবারি, বর্শা এবং সর্বোচ্চ মর্যাদার অস্ত্র তীর-ধনুকবিশিষ্ট সেনা।
যদিও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার তখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, তীর-ধনুকের ব্যবহার এর চমৎকার নির্মাণ কাঠামো ও সহজে ব্যবহার্যতার দরুণ অস্টাদশ শতাব্দী জুড়ে বিরাজ করেছিল। ১৮৫৭ সালে ভারতীয় বিপ্লবের (সিপাহী বিদ্রোহ) সময় বিপ্লবীরা বেশমাত্রায় তীর-ধনুকের ব্যবহার করেছিল।
ম্যাচলক- এটি একপ্রকার ভারী এবং নিঃসন্দেহে কার্যকরী সমরাস্ত্র যা পদাতিক সৈন্যের জন্য বরাদ্দ ছিল যেখানে পিস্তলের উপস্থিতি ছিল খুবই কম।
মুঘল গোলন্দাজ যুদ্ধাঙ্গনবাহিনী- যদিও এর খরচাপাতির অঙ্কটা অনেক বেশি ছিল তবুও শত্রুপক্ষের লড়াকু যুদ্ধহাতির বিরুদ্ধে এটি অত্যন্ত কার্যকরী ছিল এবং এটির ব্যবহার অনেকগুলি দোদুল্যমান বিজয়কে নিশ্চিত করেছিল। বাবুরের গোলন্দাজবাহিনী ষোড়শ শতাব্দীতে ইব্রাহীম লোদীর সেনাবাহিনীকে পরাভূত করার পর থেকে পরবর্তী মুঘল সম্রাটগণ যুদ্ধাঙ্গনে গোলন্দাজবাহিনীর ব্যবহারকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানসূচক রণাস্ত্র হিসেবে দেখতে শুরু করেন।
নিজস্ব অস্ত্রচালনায় পারদর্শী হিসেবে সুবিদিত মুঘল অশ্বসেনারা তীর-ধনুকে সজ্জিতাবস্থায় বন্দুকধারী সৈন্যদের চেয়ে নিক্ষেপক অস্ত্রছোঁড়ায় প্রায় তিনগুণ দ্রুত ছিলেন।
আদর্শ মুঘল তীর-কামান (ধনুক) ছিল প্রায় ৪ ফুট (১.২ মিটার) লম্বা এবং দ্বিবাঁকযুক্ত আকৃতির, যার হাতে ধরার স্থল ছিল মখমলে মোড়া। প্রাণীর শিং, কাঠ, বাঁশ, হাতির দাঁত এবং কখনো কখনো ইস্পাত দিয়েও এটি তৈরি করা হতো।
কয়েক ছড়া মোটা তার দিয়ে টানা হতো মুঘল ধনুকের অবতল পার্শ্ব (টানাবস্থায় উত্তল) যেন তা স্থিতিস্থাপকতা ও বলের যোগান দেয়। তীরের পেটের অংশটি ছিলো সুন্দরভাবে ঘন কালো রঙে পালিশ করা মহিষ কিংবা জংলি ছাগলের শিং দিয়ে তৈরি। এর সাথে শক্ত কাঠের পাতলা পাতের ন্যায় অংশ আঠা দিয়ে লাগানো থাকতো। ধনুকের অগ্র ও পশ্চাত্ শীর্ষে চল অনুসারে সাপের মাথার আকৃতি দেয়া হতো, শিং এর তৈরি অংশটিতে কোনো কারুকার্য করা হতো না এবং কাঠের তৈরি পিঠের অংশ সোনায় মোড়ানো পাখি, ফুল-ফল, লতাপাতা ইত্যাদির চিত্রবিচিত্র বক্ররেখা-বিজাড়িত অলংকরণে শোভিত ছিল। পর্যটকদের বহনকৃত ভারতীয় ধনুক প্রদর্শনী কিংবা বিনোদনকার্যে ব্যবহৃত হতো। এই ধরনের ধনুকগুলো মহিষের শিং দিয়ে তৈরি হতো, দুইটি একই রকমভাবে বাঁকা শিং বাঁকিয়ে এটি তৈরি করা হতো যার প্রতিটির বাইরের দিকের প্রান্তভাগে কাঠের তৈরি সূক্ষ অগ্রভাগ ছিল জ্যা পরাবার কাজে ব্যবহারের জন্য। শিং দুটির অপর প্রান্তভাগের অংশদুটি একসাথে এনে শক্ত কাঠের টুকরোর সাথে কষে বেঁধে ফেলা হতো। এই কাঠের টুকরোটি ধনুকের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতো এবং এটিকে বাম হাত দিয়ে ধরা হতো। ধনুক তৈরির পর এগুলোকে মাপমতো প্রাণীজ তন্তুওতে মোড়ানো হতো এবং তার ওপর মিহি দড়ি মুড়ে পাতলা আবরণ দেয়া হতো অন্তিম কার্য হিসেবে রঙ ও বার্নিশের চূড়ান্ত প্রলেপ দেয়ার পূর্বে। ধনুর্গুণ বা জ্যাগুলো কখনো কখনো সাদা সিল্কের শক্তিশালী সুতো দিয়ে তৈরি হতো যা পরষ্পর পেঁচিয়ে ১.২৫ সেন্টিমিটার (০.৪৯ ইঞ্চি) ব্যাসার্ধের সিলিন্ডারের ন্যায় আকৃতি তৈরি করতো। একই বস্তু দ্বারা মধ্যিখানে তিন থেকে চার ইঞ্চি পেঁচানো হতো এবং এই মধ্যভাগেই রক্তাভ লাল কিংবা অন্যরঙের বড় বড় ফাঁসযুক্ত বস্তু জটিল গিঁটের মাধ্যমে যুক্ত থাকতো। এই জাঁকালো ফাঁসগুলো তখন সাদা সিল্কের বিপরীতে লক্ষণীয় রঙবৈচিত্র্য প্রকাশ করতো।
ধনুকের জ্যা যেখানে লাগানো হতো সেই অংশটি মূল্যবান রত্নপাথরখচিত বড় রিং আকৃতির হতো এবং এই মূল্যবান রত্নটি পদমর্যাদার পদাধিকারবল অনুসারে নানাবিধ হতো যেমন: স্ফটিক, জেডপাথর, হাতির দাঁত, শিং, মাছের কাঁটা/হাড়, সোনা কিংবা লৌহ।
তীরগুলো ছিল দুই প্রকৃতির: সাধারণকার্যে ব্যবহার্যগুলি তৈরির নিমিত্তে নলখাগড়ার ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং যেগুলো বাঘের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতো সেগুলি ছিলো কাঠের হাতলবিশিষ্ট। নলখাগড়াভিত্তিক তীরগুলির মাথা রজনের মাধ্যমে হাতলে লাগানো থাকতো এবং কাঠের হাতলযুক্ত তীরের ক্ষেত্রে হাতলে ছিদ্র করে লোহিত-তপ্ত তীরের মাথা সেখানে বলপূর্বক ঢুকিয়ে দেয়া হতো। ভারতীয় জাদুঘরের কিছু কিছু তীর. (ব্যাখ্যা প্রয়োজন কোনগুলির) ২.৪ ফুট (০.৭৩ মিটার) লম্বা, একটি উদাহরণস্বরূপ, ১৮৫৭ সালে লখনৌতে পাওয়া একটি তীর, ছয় ফুট (১.৮ মিটার) পর্যন্ত লম্বা ছিল এবং এর জন্য স্বাভাবিক গড়পড়তা ধনুকের চেয়ে বড় আকৃতির ধনুক প্রয়োজন ছিল। তীরে যে পালকগুলি ব্যবহার করা হতো তা প্রায়শই কালো সাদার মিশেলে হতো (আবলাক), যেখানে তীরের মাথা বা ফলা হতো সাধারণত ইস্পাতের যদিও ভীলরা হাড়নির্মিত তীরের মাথা ব্যবহার করতো।
তুংফাং হিসেবে পরিচিত ম্যাচলক বন্দুকটির আদি অবস্থা থেকে তার প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেন মুঘল সম্রাট আকবর। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এটিকে তীর ধনুকের চেয়ে কম গুরুত্বের চোখে দেখা হতো। ম্যাচলক বন্দুক সাধারণত পদাতিক সেনার এখতিয়ারাধীনই রাখা হতো, যারা কিনা মুঘল সেনাপতিদের তথ্যানুসারে ঘোড়সওয়ার সেনাদের তুলনায় নিম্নস্তরভুক্ত সৈন্য হিসেবে বিবেচিত ছিল। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগের পূর্বে যতদিন না ফরাসী এবং ইংরেজ সেনারা পদাতিক সেনাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং শৃঙ্খলাচর্চা উন্নতির পদক্ষেপ নিলে সেটিকে পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করে ভারতেও এর চল শুরু হয়। সম্রাট আকবরের ম্যাচলক বন্দুকগুলোর দুটি ব্যারেলের দৈর্ঘ্য ছিল দু দুরকম: ৬৬ ইঞ্চি (১,৭০০ মিলিমিটার) এবং ৪১ ইঞ্চি (১,০০০ মিলিমিটার)। গোটানো ইস্পাতের পাত দুইপ্রান্ত ঝালাইয়ের মাধ্যমে একত্রিত করে এগুলোকে তৈরি করা হতো। সম্ভবত এরও আগে দাক্ষিণাত্য মালভূমিতে ফরাসি ও ইংরেজদের সংসর্গে আসার জন্য ফ্লিন্ট-লক অস্ত্র ব্যবহারের সূচনা হয়েছিল।
ম্যাচলকের ব্যারেলগুলোর ধাতব শরীর আরো বিশদ স্বর্ণ ও রৌপ্যের কারুকাজপূর্ণ ছিল, যে অংশটি শরীরে ভর দিয়ে রেখে তা চালাতে হতো (অস্ত্রের হাতল কিংবা ভিত্তি) সেখানে ধাতব নকশা খচিত ছিল কিংবা বার্ণিশ, রঙ কিংবা বিভিন্ন জিনিসের টুকরো দিয়ে তা সাজানো হতো। কখনো কখনো অস্ত্রটির ভিত্তিতে সোনার স্ফীত অংশ খচিত বা শোভিত থাকতো কিংবা পেছনভাগে হাতির দাঁত অথবা আবলুস কাঠের ঢাকনির ন্যায় আবরণ লাগানো থাকতো। ব্যারেল সাধারণত হাতলের সাথে ধাতব চওড়া বন্ধনী কিংবা ইস্পাত, পিতল, রূপা অথবা স্বর্ণের তারের মাধ্যমে যুক্ত থাকতো। চওড়া বন্ধনীগুলো অনেকসময় হতো ছিদ্রযুক্ত কিংবা কখনোবা তাতে খোদাইয়ের কাজ করা থাকতো। ভিত্তি কিংবা হাতলগুলো হতো দুই ধরনের: প্রথমত, সরু, কিঞ্চিত বাঁকা এবং সকল অংশেই সমান প্রস্থযুক্ত এবং দ্বিতীয়ত, নিখুঁতভাবে অনেকটা বাঁকানো এবং হাতে ধরার স্থানে সরু, তবে পশ্চাত্ভাগে কিছুটা চওড়া। ব্যবহার ব্যতিরেকে ম্যাচলকগুলোকে রক্তলাল কিংবা সবুজরঙা খোলসে ভরে বহন করা হতো।
পুরো সরঞ্জামাদির সেটটিতে থাকতো একটি পাউডার ধারক, গুলি রাখার থলে, যুদ্ধশিঙা (সিঙ্গরা), পোড়াবার দড়ি, চকমকি পাথর এবং ইস্পাত যেখানে সবমিলিয়ে সম্পূর্ণ জিনিসটি প্রায়শই একটি মখমলের বেল্টে রাখা হতো যাতে করা থাকতো সোনার সূচিকর্ম। যেসব আধারে করে পাউডার এবং মাস্কেট বলসমূহ (একপ্রকারের গুলি) বহন করা হতো সেগুলো ছিল বেশ ভারী এবং তাই বহনের পক্ষে বেশ কস্টকর, এবং যেহেতু মুঘলসেনারা কখনোই কার্তুজ ব্যবহার করেনি তাদের অস্ত্র লোড করতে অপেক্ষাকৃত দেরী হতো। কোনো কোনো সৈন্য একাই প্রায় বিশ গজেরও বেশি আগুন ধরাবার ফিতে বা দড়ি বহন করতো যা কিনা দেখতে অনেকটা প্যাঁচানো সুতোর বলের মতো ছিল।
জিনযাল বা ভারী ম্যাচলক আগ্নেয়াস্ত্রগুলি সাধারণত দুর্গ প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহৃত হতো। এগুলো এক থেকে তিন আউন্স ওজনের গোলা বহনে সক্ষম ছিল। এগুলোর ব্যারেল বা নলগুলো ছিল বৃহদাকার, মধ্যবর্তী কালক্ষেপন ব্যতীত একেবারে ব্যবহার করার পক্ষে বেশ ভারী। অনেকগুলিরই লোহার তৈরি প্রায় এক ফুট লম্বা দাঁড়ার ন্যায় অংশ ছিল, যা সরু মুখনলের অদূরে ক্ষুদ্র পিভটের ওপর যুক্ত ছিল। দেয়াল, ঝোপ কিংবা মাটি যেখানেই রাখা হোক না কেনো এটি ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে কাজ করতো। মাটিনির্মিত দুর্গ বিশেষত বুন্দেলখন্ডে, অবরুদ্ধ সেনারা অসাধারণ করদক্ষতার সাথে কাজ করেছিল, এমনকি বেশ অনেক দূরত্বও তারা প্রায় নির্ভুলভাবে মাথায় কিংবা হৃদপিণ্ডের নিকটে নিশানাবিদ্ধ করেছিল যা প্রায় লক্ষ্যচ্যুত হয়নি বললেই চলে। ভারতীয়দের ব্যবহৃত সকল আগ্নেয়াস্ত্রের ছোট বেলনাকৃতির প্রকোষ্ঠ ছিল এবং সেগুলোর ছিদ্র হতো ছোট, বল আকৃতির গুলিগুলো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভরবেগপ্রাপ্ত হতো।
ঘোর-দাহান এক ধরনের জাযাইলের প্রকরণ। এই নাম এর নলের উল্টানো কিংবা চওড়াকৃত মুখকেই নির্দেশ করে।
পিস্তলগুলিকে ‘তামানচাহ্’ নামে ডাকা হতো। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে পিস্তল ভারতে ব্যবহৃত হতো, কিছুক্ষেত্রে যে কোনো মূল্যে এর ব্যবহারই প্রচলিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৭২০ সালের অক্টোবর মাসে হুসেইন আলি খানের আত্মীয়- এক তরুণ সৈয়দ, তাঁরই হত্যার উদ্দেশ্যে প্রেরিত এক গুপ্তঘাতককে পিস্তলের এক গুলিতে হত্যা করেন। পিস্তল উচ্চপদস্থ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, খুব কম সংখ্যক সৈন্যেরই ইউরোপীয় পিস্তল এবং তাবানচাহ্ ব্যবহারের সুযোগ ছিল।
মুঘল সৈন্যবাহিনী বেশ বড় পরিসরের গান পাউডার বা বারুদভিত্তিক অস্ত্র ব্যবহার করতো যেগুলো ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রের চেয়ে বড় ছিল। এর মধ্যে রকেট ক্ষেপণাস্ত্র থেকে শুরু করে চলমান বন্দুক এমনকি চৌদ্দ ফুটেরও (৪.৩ মিটার) বেশি লম্বা সুবিশাল কামানও ছিল যা কিনা একদা "বিশ্বের সর্বাধিক বিশালকায় অস্ত্র"[২] হিসেবে বিবেচিত ছিল। এই ধরনের অস্ত্রসস্ত্রসমূহ ভারী এবং হালকা গোলন্দাজবাহিনী আকারে বিভক্ত ছিল।[৩]
যুদ্ধময়দানে ব্যবহৃত চলমান গোলন্দাজবাহিনীকে কিছু কিছু ইতিহাসবিদ মুঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় সামরিক শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং এসকল সেনাদলকে তাদের অধিকাংশ প্রতিপক্ষের তুলনায় অনন্যভাবে আলাদা হিসেবে গণ্য করেছেন। এছাড়াও এটি ছিল সম্রাটের পদমর্যাদার প্রতীক, তাই সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ যাত্রাগুলোতে গোলন্দাজবাহিনীর একাংশ সর্বদা মুঘল সম্রাটের সঙ্গে সঙ্গে চলতো।[৪] প্রতিপক্ষের হাতিসমূহ যেগুলো কিনা ভারতীয় উপমহাদেশের যুদ্ধগুলোতে অত্যধিক পরিমাণে দেখা যেতো, সেগুলোর মোকাবেলায় মুঘলরা মূলত যুদ্ধক্ষেত্রে গোলন্দাজ সেনাদের ব্যবহার করতো। তবে যদিও কামানের নিশানাভেদ আরো নিখুঁত করার উদ্দেশ্যে সম্রাট আকবর নিজেই ব্যক্তিগতভাবে তার কামানবাহী রথসমূহের নকশা করেন, তবুও মুঘল গোলন্দাজবাহিনীর ছোঁড়া গোলাসমূহ সবচেয়ে কার্যকরী ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের হাতিগুলোকে ভয় দেখাতেই। প্রতিপক্ষ সৈন্যদলে এভাবে সৃষ্টি হওয়া বিশৃঙ্খলাই মুঘল সেনাবাহিনীকে তাদের শত্রুর ওপর বিজয় হাসিলে ভূমিকা রাখতো। প্রাণীজ-উত্স থেকে তৈরি কব্জাসমৃদ্ধ ঘুরানো-বাঁকানোয় সক্ষম তোপগুলো মুঘল যুদ্ধবিগ্রহের একটি বৈশিষ্ট্যে পরিণত হতেছিল যার ভিত্তি ছিল ৬.৭ ফুটেরও (২ মিটার) বেশি লম্বা দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট, যা থেকে ছোঁড়া গোলার ব্যাস ৩.৮-৪.৭ ইঞ্চি (৯৯-১১৯ মিলিমিটার)।[৫]
এই নিবন্ধটি William Irvine এর লেখা 'The army of the Indian Moghuls: its organization and administration' শীর্ষক রচনা থেকে লেখা হয়েছে। এটি ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয় এবং বর্তমানে এটি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের নিকট উন্মুক্তকৃত।
Richards, J.F. (1995). The Mughal Empire. ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস. ISBN 9780521566032.