মুদারাবা (আরবি: التكافل হল ইসলামি শরীয়াহ সম্মত এক ধরনের অংশীদারি ব্যবসায় পদ্ধতি, যেখানে একপক্ষ মূলধন সরবরাহ করে এবং অপর পক্ষ মেধা ও শ্রম দিয়ে উক্ত মূলধন দ্বারা ব্যবসা পরিচালনা করে। যে পক্ষ মূলধন সরবরাহ করে তাকে সাহিব-আল-মাল (صاحب المال) বলে এবং ব্যবসায় পরিচালনাকারীকে বলা হয় মুদারিব (مضارب) বলে। এক্ষেত্রে, ব্যবসায়ে মুনাফা হলে পূর্ব চুক্তি অনুসারে বা আনুপাতিক হারে উভয়পক্ষের মাঝে মুনাফা বণ্টিত হয় এবং ব্যবসায় লোকসান হলে মূলধন সরবরাহকারী বা সাহিব-আল-মাল উক্ত লোকসান বহন করে। অন্যদিকে, ব্যবসায় পরিচালনাকারী বা মুদারিব তার মেধা ও শ্রমের বিনিময়ে কোনো পারিশ্রমিক পায় না, যা তার লোকসান হিসেবে গণ্য হয়। তবে যদি মুদারিব কর্তৃক নিয়ম লঙ্ঘন, অবহেলা বা চুক্তিভঙ্গের কারণে লোকসান হয় তাহলে মুদারিবকেই লোকসানের দায় বহন করতে হয়।[১]
মুদারাবা (আরবি: مضاربة) শব্দটি আরবি দারব (আরবি: ضرب) শব্দ হতে উদ্ভূত। আরবি ভাষায় দারব (আরবি: ضرب) শব্দটির অর্থ প্রহার করা, আঘাত করা, অন্বেষণ করা, দৃষ্টান্ত দেয়া, পরিভ্রমণ করা ইত্যাদি। কুরআনে শব্দটি আল্লাহ্র রহমতের আশায় পরিভ্রমণ করা অর্থে বহু জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে। আবার দারব শব্দটির মূল অর্থ হলো আঘাত করা। ভ্রমণ করতে হলে ভূমিতে পদাঘাত আবশ্যক। যে কারণে ইসলামি পণ্ডিতগণ মনে করেন, ভ্রমণ করার সাথে পায়ের মাধ্যমে ভূমিতে মৃদু আঘাত করার সম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্কে কুরআন মাজিদে উল্লেখ রয়েছে:
“ | অন্যরা আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে পৃথিবীতে ভ্রমণ করে। | ” |
— সূরা আল-মুজাম্মিল, আয়াত-২০ |
উক্ত আয়াতে আল্লাহ ঐসব সাহাবাদের প্রশংসা করেছেন, যারা ব্যবসার উদ্দেশে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করতেন। এসব ব্যবসায়ীর অনেকেই মুদারাবার ভিত্তিতে সংগৃহীত পুঁজি নিয়ে মুনাফার লক্ষ্যে ব্যবসায়-বাণিজ্যে করার জন্য দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করতেন।
বর্তমানে, ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মুদারাবা পদ্ধতির ব্যবহার অনেক বেশি লক্ষ্য করা যায়। এই পদ্ধতিতে ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের কাছ থেকে তহবিল বা আমানত সংগ্রহ করে ব্যবসায় করে অর্জিত মুনফা চুক্তি অনুসারে ভাগ করে নেয়। এক্ষেত্রে আমানতকারিদের বলা হয় সাহিব-আল-মাল এবং ব্যাংক মুদারিবের ভুমিকা পালন করে। ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও মুদারাবা নীতির প্রয়োগ লক্ষণীয়। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংক সাহিব-আল-মাল এবং গ্রাহক মুদারিবের ভুমিকায় থাকে। এক্ষেত্রেও মুনাফা পূর্ব নির্ধারিত হারে বা চুক্তি অনুসারে ভাগ হয় এবং লোকসান ব্যাংক বহন করে। ইসলামি ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহের ও বিনিয়োগের জন্য এই মুদারাবা নীতি এত বেশি ব্যবহার করে যে অনেক মুদারাবা বলতে ব্যাংক ব্যবসায়ের একটা চুক্তি হিসেবেই বুঝে থাকে। যদিও মুদারাবা চুক্তি যেকোনো ইসলামি শরীয়াহ সম্মত ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।[২]
মুসলমান পণ্ডিতগণ ও এদের সংগঠন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মুদারাবার সংজ্ঞা দিয়েছেন। এরূপ কয়েকটি সংজ্ঞা নিচে উল্লেখ করা হলো:
“ | মুদারাবা এক ধরনের অংশীদারিত্ব যেখানে একপক্ষ (সাহিবুল মাল/রাব্বুল মাল) তহবিল বা পুঁজি সরবরাহ করেন এবং অন্যপক্ষ তার দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনা নিয়োজিত করেন। তাকে বলা হয় মুদারিব বা ব্যবস্থাপক। ব্যবসায়ের লাভ দু’পক্ষের মাঝে পূর্ব নির্ধারিত অনুপাতে ভাগ হয়। পুঁজির লোকসান হলে তা মূলধন সরবরাহকারী (সাহিবুল মাল) বহন করেন। | ” |
— ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক |
“ | মুদারাবা হলো মুনাফার অংশীদারিত্ব , যেখানে এক পক্ষ (রাব্বুল মাল) মূলধন যোগায় এবং অপর পক্ষ (মুদারিব) মেহনত করে। | ” |
— ইসলামি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য অ্যাকাউন্টিং এবং অডিটিং সংস্থা (এএওআইএফআই) |
“ | মুদারাবা (Mudaraba) বলিতে এমন এক ব্যবসায়িক দ্বিপাক্ষিক চুক্তিকে বুঝাইবে, যাহাতে একপক্ষ মূলধন যোগান দিবে আর অন্যপক্ষ তাহার দক্ষতা, শ্রম ও প্রচেষ্টা কাজে লাগাইয়া ব্যবসায় পরিচালনা করিবে। মূলধন সরবরাহকারীকে সাহিব-আল-মাল ও ব্যবহারকারীকে মুদারিব বলা হয়। প্রাপ্ত মুনাফা চুক্তিতে উল্লেখিত অনুপাতের ভিত্তিতে উভয় পক্ষের মধ্যে বণ্টিত হইবে। কোন ক্ষতি হইলে সাহিব-আল-মাল ক্ষতি বহন করিবে, তবে যদি সে ক্ষতি মুদারিব কর্তৃক নিয়ম লঙ্ঘন, অবহেলা বা চুক্তিভঙ্গের কারণে হইয়া থাকে তাহা হইলে মুদারিবকে ক্ষতির দায়-দায়িত্ব বহন করিতে হইবে। সাহিব-আল-মাল মুদারাবা চুক্তির অধীনে পরিচালিত ব্যবসায়ের ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করিতে পারিবে না। | ” |
— সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ |
উপর্যুক্ত বিবৃতি থেকে এটা প্রতিমান যে, মুদারাবা হচ্ছে ইসলামি শরীয়াহ সম্মত এক প্রকার ব্যবসায়িক চুক্তি, যেখানে একপক্ষ মূলধন যোগান দেয় এবং অন্যপক্ষ শ্রম ও মেধা বিনিয়োগ করে ব্যবসায় পরিচালনা করে। মূলধন যোগানদাতা ব্যবসায় পরিচালনায় অংশ নিতে পারে না। ব্যবসায় থেকে মুনাফা হলে উভয়পক্ষ চুক্তি অনুসারে ভাগ করে নেই। কিন্তু লোকসান হলে শুধু মূলধন যোগানদাতা লোকসান বহন করে এবং ব্যবসায় পরিচালনাকারী বিনিয়োজিত শ্রম ও মেধা থেকে কিছুই পায় না যা তার লোকসান হিসেবে ধরা হয়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে একে লাভ-লোকসান ভাগাভাগি নীতি হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
মুদারাবা এক ধরনের ব্যবসায়িক চুক্তি। এই চুক্তি সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে।[৩] যথা:
ইসলামি শরীয়াহ সম্মত ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মুদারাবা পদ্ধতির ব্যবহার হয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই। ধারণা করা হয়, ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের পূর্বেই এক ধরনের চুক্তিভিত্তিক ব্যবসায় পদ্ধতির মাধ্যমে মানুষ তহবিল সংগ্রহ করে ব্যবসায় করতো এবং লাভ ভাগাভাগি করে নিতো। যদিও মুসলিম বিশ্বে এই পদ্ধতির ব্যবহার খুব জনপ্রিয়তা পায়। এটা এক প্রকার শরীয়াহ সম্মত বিনিয়োগ ব্যবস্থা। যেহেতু এখানে মুনাফা হলে পূর্ব নির্ধারিত হারে ভাগ হয় এবং লোকসান বহন করে মূলধন যোগানদাতা। মুসলমান পণ্ডিতগণ মনে করেন যদি লোকসান হওয়া সত্ত্বেও ব্যবসায়ীকে লোকসান বহন করতে হয়। তারতো মূলধনই নেই তার উপর তার শ্রম, মেহনত সবই লোকসানেরই নামান্তর। এর পরেও যদি তার লোকসান বহন করতে হয় তবে আরও দেনায় নিমজ্জিত হবে। সেটা হবে জুলুম। আর ইসলামে জুলুমের কোন স্থান নেই। বর্তমান ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মুদারাবা পদ্ধতির খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয়।[৪]
ইসলাম ধর্মে সুদকে হারাম বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে অর্থাৎ সুদ ভিত্তিক যে কোন ব্যবসায় হারাম। এজন্য ইসলামি ব্যাংকগুলো মুদারাবা পদ্ধতিকে বেছে নেয় আমানত সংগ্রহ ও বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মুদারাবা পদ্ধতি ব্যপকভাবে ব্যবহার করছে। ইসলামি ব্যাংকগুলোতে মুদারাবা পদ্ধতি ব্যবহারের কয়েকটি উদাহরণ নিচে উল্লেখ করা হলো:[৫]
বর্তমানে ইসলামি ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি অনেক সাধারণ ব্যাংকও ইসলামি ব্যাংকিং শাখার মাধ্যমে বিভিন্ন হিসাব খুলে ব্যবসায় পরিচালনা করে।[৬] ব্যাংকগুলো মুদারাবা নীতি অনুযায়ী হিসাব পরিচালিত করে যেটি ব্যাংক ও গ্রাহকের মধ্যে একটি অংশীদারত্বের চুক্তি বা মুদারাবা হিসাব নামে পরিচিত। এই হিসাবের প্রধান বিবেচ্য হলো গ্রাহক শর্ত দিয়ে অথবা কোন শর্ত ছাড়াই ব্যাংককে আমানত প্রদান করে এবং ব্যাংক শরীয়াহ সম্মত ব্যবসায় উক্ত আমানতি অর্থ বিনিয়োগ করে। বিনিয়োগ থেকে মুনাফা অর্জিত হলে গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে চুক্তি অনুপাতে অনুযায়ী বণ্টন করা হয়। কিন্তু লোকসান হলে চুক্তি অনুযায়ী গ্রাহক বহন করেন আর ব্যাংক তার সেবার বিপরীতে পারিশ্রমিক পান না। যদিও ব্যাংক উক্তি হিসেবের বিপরীতে বাৎসরিক সার্ভিস চার্জ কেটে নেয়। মুদারাবা নীটিতে পরিচালিত কয়েকটি ব্যাংক হিসাব নিচে উল্লেখ করা হলো:
ব্যাংকগুলো মুদারাবা পদ্ধতিতে বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এই হিসাবের মাধ্যমে ব্যাংক তার বিনিয়োগ গ্রাহককে মূলধন যোগান দেয় এবং গ্রাহক তার শ্রম ও মেধা দিয়ে ব্যবসায় পরিচালনা করে। এক্ষেত্রে ব্যাংক সাহিব-আল-মাল এবং গ্রাহক মুদারিব হিসেবে পরিচিত। এক্ষেত্রেও বিনিয়োগ থেকে মুনাফা অর্জিত হলে গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে চুক্তি অনুপাতে অনুযায়ী বন্টিত হয়। কিন্তু লোকসান হলে ব্যাংক বহন করেন আর গ্রাহক তার শ্রমের বিনিময়ে কিছুই পায় না।[৭] মুদারাবা নীতিতে পরিচালিত কয়েকটি বিনিয়োগ নিচে উল্লেখ করা হলো-
ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে মুদারাবা নীতির আলোকে যে সকল আমানত সংগ্রহ করা হয়। সেই সব আমানতের বিপরীতে আমানতকারীকে মুনাফা প্রদান করা হয়। কিন্তু ইসলামি ব্যাংকগুলো প্রথমে সব হিসাবে শর্তাধীন বা সাময়িক হারে মুনাফা প্রদান করে থাকে। ব্যাংকগুলো সাধারণত মেয়াদী আমানতের ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষে এবং সাধারণ সঞ্চয়ী আমানতের ক্ষেত্রে ছয় মাস পরপর বা বাৎসরিক ভিত্তিতে মুনাফা দিয়ে থাকে। তবে সব ক্ষেত্রেই বছর শেষে পরিপূর্ণ হিসাব-নিকাশ করে মুনাফা বা ক্ষতি নিরূপণ করা হয়। যদি কোন আমানত হিসাবের বিপরীতে মুনাফা বেশি হয়, তবে উক্ত হিসেবে অতিরিক্ত মুনাফার অংশ দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় যে সব আমানত হিসাবে ঠিকভাবে মুনাফা বণ্টিত হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়: এক ব্যক্তি কোন ইসলামি ব্যাংককে তিন মাস মেয়াদী একটা আমানত রাখল যখন তাকে বলা হল যে সাময়িক মুনাফার হার ৬%। তিন মাস পরে সে তার আমানত ভেঙ্গে নিল এবং ব্যাংক তাকে সেই ৬% ঘোষিত মুনাফাই দিল। কিন্তু বছর শেষে পরিপূর্ণ হিসাব করে দেখা গেল ওই ধরনের (তিন মাস মেয়াদী) আমানতের বিপরীতে লাভ হয়েছে ৭.২৫%। এখন ব্যাংক যখন উক্ত আমানত হিসাবের বিপরীতে অতিরিক্ত ১.২৫% মুনাফা দিতে গেল, তখন দেখল যে ওই ব্যাংক সেই আমানতকারীর আর কোন হিসাব নেই বা তাকে খুঁজেও পাওয়া সম্ভব না। ফলে তাকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়াও সম্ভব না। এই সমস্যাকে অনেক মুসলমান পণ্ডিত শরীয়াহ লঙ্ঘন বলে মনে করে। এছাড়া, বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলো সবসময় মুদারাবা নীতির পরিপূর্ণ ব্যবহার করতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রেই বিচ্যুতি দেখা যায়। ইসলামি ব্যাংকগুলো তাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক সুদী ব্যাংকের সাথে লেনদেন করতে হয় এবং সেখান থেকেও একটা বড় অংকের মুনাফা অর্জন করে। অনেকে এটাকেও শরীয়াহ লঙ্ঘন বলে মনে করে।[৮][৯]