মুলক রাজ আনন্দ (১২ই ডিসেম্বর ১৯০৫ - ২৮শে সেপ্টেম্বর ২০০৪) একজন ভারতীয় ইংরেজি লেখক ছিলেন। তিনি চিরাচরিত ভারতীয় সমাজে দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের জীবন চিত্রকর হিসেবে স্বীকৃত। আর কে নারায়ণ, আহমদ আলী এবং রাজা রাও- এর সাথে তিনি ছিলেন ইন্দো-অ্যাংলিয়ান কথাসাহিত্যের পথপ্রদর্শকদের মধ্যে একজন। তিনি ছিলেন ইংরেজিতে প্রথম ভারত-ভিত্তিক লেখকদের মধ্যে একজন, যিনি আন্তর্জাতিকভাবে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। আনন্দ তাঁর উপন্যাস এবং ছোটগল্পের জন্য প্রশংসিত, সেগুলি আধুনিক ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের অতুলনীয় মর্যাদা অর্জন করেছে। তাঁর লেখাগুলি নিপীড়িতদের জীবন সম্পর্কে উপলব্ধিমূলক অন্তর্দৃষ্টি এবং তাদের দারিদ্র্য, শোষণ ও দুর্ভাগ্যের বিশ্লেষণের জন্য সুপরিচিত।[১][২][৩] তিনি তাঁর প্রতিবাদী উপন্যাস আনটাচেবল (১৯৩৫) এর জন্য পরিচিত হন। এরপরে ভারতীয় দরিদ্রদের উপর তাঁর অন্যান্য লেখাগুলি হলো কুলি (১৯৩৬) এবং টু লীভস অ্যাণ্ড এ বাড (১৯৩৭)।[৪] তিনি তাঁর ইংরেজি লেখাতে পাঞ্জাবি এবং হিন্দুস্তানি বাগধারা যুক্ত করা প্রথম লেখকদের মধ্যে একজন হিসেবেও সুপরিচিত।[৫] তিনি পদ্মভূষণ নাগরিক সম্মানের প্রাপক ছিলেন।[৬]
আনন্দ ১৯৩৮ সালে ইংরেজ অভিনেত্রী এবং সাম্যবাদী (কমিউনিস্ট) ক্যাথলিন ভ্যান গেল্ডারকে বিয়ে করেন; তাঁদের সুশীলা নামে একটি কন্যা ছিল। ১৯৪৮ সালে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়।[৯]
ভারতের জাতিভেদ ব্যবস্থার অনমনীয়তা থেকে উদ্ভূত পারিবারিক একটি দুঃখজনক ঘটনা থেকে মুলক রাজ আনন্দের সাহিত্যজীবনের সূচনা হয়েছিল। একজন মুসলিম মহিলার সাথে খাবার ভাগ করে নেওয়ার জন্য তাঁর পরিবার তাঁর এক পিসিকে বহিষ্কার করেছিল। তার ফলে সেই পিসি আত্মহত্যা করেছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় আনন্দ তাঁর প্রথম গদ্য রচনা করেন।[১০][১১] ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস, আনটাচেবল, ভারতের অস্পৃশ্য শ্রেণীর মানুষের জীবনের হাড় হিম করা একটি উন্মোচন যা সেই সময়ে অবহেলিত ছিল। উপন্যাসটি বখার জীবনের একটি দিনকে প্রকাশ করে। সে ছিল একজন মল-পরিষ্কারক। দুর্ঘটনাক্রমে উচ্চ বর্ণের একজন সদস্যের সাথে তার ধাক্কা লেগেছিল, যার ফলে একের পর এক তাকে অপমানের সম্মুখীন হতে হয়। বখা যে দুর্ভাগ্যের ট্র্যাজেডি নিয়ে জন্মেছিল তার থেকে সে উদ্ধারের সন্ধান করতে থাকে। সে একজন খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকের সাথে কথা বলে, মহাত্মা গান্ধীর অস্পৃশ্যতা সম্পর্কে একটি বক্তৃতা শোনে এবং পরবর্তীতে দুই শিক্ষিত ভারতীয়ের মধ্যে একটি কথোপকথন শোনে। কিন্তু বইয়ের শেষে আনন্দ ইঙ্গিত দেন যে প্রযুক্তির ফলে সদ্য প্রবর্তিত ফ্লাশ টয়লেট (যেখানে মল হাতে করে পরিষ্কার করতে হয়না) তার ত্রাণকর্তা হতে পারে। এই প্রযুক্তি মল-পরিষ্কারকদের মতো কোন শ্রেণীর প্রয়োজনীয়তা দূর করে।
আনটাচেবল উপন্যাসটিতে, ইংরেজির মধ্যে পাঞ্জাবি এবং হিন্দি বাগধারার আঞ্চলিক উদ্ভাবনশীলতাকে নিয়ে আসাটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল, এবং আনন্দ ভারতের চার্লস ডিকেন্স হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। উপন্যাসটির ভূমিকাটি লিখেছিলেন তাঁর বন্ধু ইএম ফরস্টার, এঁর সাথে টিএস এলিয়টের ম্যাগাজিন ক্রাইটেরিয়নে কাজ করার সময় আনন্দের দেখা হয়েছিল।[১২] ফরস্টার লিখেছেন: "আলঙ্কারিক শব্দ এবং বাগাড়ম্বর এড়িয়ে, এটি সরাসরি তার বিষয়ের গভীরে চলে গেছে এবং এটিকে বিশোধিত করেছে।"
১৯৩০ এবং ৪০এর দশকে লণ্ডন এবং ভারতের মধ্যে বসবাস করার সময়,[৫] আনন্দ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছিলেন। লণ্ডনে থাকাকালীন, তিনি ভারতের ভবিষ্যত প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণ মেননের সাথে ভারতীয় উদ্দেশ্যের পক্ষে প্রচারপত্র লিখেছিলেন। পাশাপাশি তিনি একজন ঔপন্যাসিক এবং সাংবাদিক হিসাবে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।[১৩] একই সময়ে, তিনি বিশ্বের অন্যত্র বামপন্থীদের সমর্থন করেছিলেন, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে স্পেনে ভ্রমণ করেছিলেন, যদিও সংঘাতে তাঁর ভূমিকা সামরিকের তুলনায় বেশি সাংবাদিকতামূলক ছিল। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লণ্ডনে বিবিসির লিপিলেখক হিসাবে কাজ করে কাটিয়েছিলেন। সেই সময় জর্জ অরওয়েলের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। আনন্দের ১৯৪২ সালের উপন্যাস দ্য সোর্ড অ্যান্ড দ্য সিকল অরওয়েল পর্যালোচনা করেছিলেন। এটির প্রকাশনার তাৎপর্যের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি লিখেছিলেন: "যদিও মিঃ আনন্দের উপন্যাসটি কোনও ইংরেজ দ্বারা লেখা হলেও তার নিজস্ব যোগ্যতার জন্য আকর্ষণীয় হতো, কিন্তু প্রতি কয়েক পৃষ্ঠা পরপরই মনে হয় এটি একটি সাংস্কৃতিক কৌতূহলও বটে। ইংরেজি ভাষার ভারতীয় সাহিত্যের বৃদ্ধি একটি অদ্ভুত ঘটনা, এবং যুদ্ধোত্তর বিশ্বে এটির প্রভাব পড়বে"।[১৪] তিনি পিকাসোরও বন্ধু ছিলেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত শিল্প সংগ্রহে পিকাসোর আঁকা ছবি ছিল।
আনন্দ ১৯৪৭ সালে ভারতে ফিরে আসেন এবং সেখানে তাঁর অসাধারণ সাহিত্য কর্ম অব্যাহত রাখেন। তাঁর কাজের মধ্যে আছে বিস্তৃত বিষয়ের উপর কবিতা এবং প্রবন্ধ, সেইসাথে আত্মজীবনী, উপন্যাস এবং ছোট গল্প। তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দ্য ভিলেজ (১৯৩৯), অ্যাক্রস দ্য ব্ল্যাক ওয়াটারস (১৯৩৯), দ্য সোর্ড অ্যান্ড দ্য সিকল (১৯৪২), যার সবগুলোই ইংল্যাণ্ডে লেখা। কুলি (১৯৩৬) এবং দ্য প্রাইভেট লাইফ অফ অ্যান ইন্ডিয়ান প্রিন্স (১৯৫৩) সম্ভবত ভারতে লেখা তাঁর রচনাগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মার্গ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকাও প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭০-এর দশকে, বিভিন্ন দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক স্ব-সচেতনতা সমস্যা নিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক অগ্রগতি সংস্থার (আইপিও) সাথে কাজ করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে ইনসব্রুকে[১৫](অস্ট্রিয়া ) আইপিও সম্মেলনে তাঁর অবদান বিতর্কগুলির উপর বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। এটি পরে "সভ্যতার মধ্যে সংলাপ" (ডায়ালগ অ্যামঙ্গ সিভিলাইজেশন) শিরোনামে পরিচিত হয়। আনন্দ মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ বিশিষ্ট ভারতীয়দের উপর একাধিক বক্তৃতাও দিয়েছেন, তাঁদের কৃতিত্ব ও তাৎপর্যকে স্মরণ করে এবং তাঁদের স্বতন্ত্র শ্রেণীর মানবতাবাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন।
তাঁর ১৯৫৩ সালের উপন্যাস দ্য প্রাইভেট লাইফ অফ অ্যান ইন্ডিয়ান প্রিন্স হলো আত্মজীবনীমূলক। তাঁর এর পরের সাহিত্যসম্ভারের পরিপ্রেক্ষিতে এটি মনে হয়। ১৯৫০ সালে আনন্দ সেভেন এজেস অফ ম্যান নামে একটি সাত-খণ্ডের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস লেখার জন্য একটি প্রকল্প শুরু করেন। এর মধ্যে ১৯৫১ সালে সেভেন সামারস দিয়ে শুরু করে চারটি অংশ সম্পূর্ণ করতে তিনি সক্ষম হন। পরেরগুলি হলো মর্নিং ফেস (১৯৬৮), কনফেশন অফ আ লাভার (১৯৭৬) এবং দ্য বাবল (১৯৮৪)। [১৬] তাঁর পরবর্তী অনেক কাজের মতো, এটিতে তাঁর আধ্যাত্মিক যাত্রার উপাদান রয়েছে কারণ তিনি উচ্চতর আত্ম-সচেতনতা অর্জনের জন্য সংগ্রাম করছেন।[১৭] তাঁর ১৯৬৪ সালের উপন্যাস ডেথ অফ আ হিরো তৈরি হয়েছিল মকবুল শেরওয়ানির জীবনের উপর ভিত্তি করে। এটি ডিডি কাশিরে (কাশ্মীরের দূরদর্শন চ্যানেল) মকবুল কি ওয়াপসি নামে পরিবেশিত হয়েছিল।[১৮][১৯]
আনন্দ ১৯৪০-এর দশকে বিবিসিরইস্টার্ন সার্ভিস রেডিও স্টেশনের সাথে যুক্ত ছিলেন, যেখানে তিনি বইয়ের পর্যালোচনা, লেখকের জীবনী, এবং ইনেজ হোল্ডেন- এর মতো লেখকদের সাক্ষাৎকার সহ বিভিন্ন সাহিত্যিক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতেন।[২০] তাঁর উপস্থাপন করা একটি মাল্টি-পার্ট সম্প্রচার প্রোগ্রামে তিনি কবিতা এবং সাহিত্য সমালোচনা নিয়ে আলোচনা করেছেন, প্রায়ই কথাসাহিত্যে শ্রমিক শ্রেণীর বর্ণনার আহ্বান জানিয়েছেন।[২০]
আনন্দ আজীবন সমাজতান্ত্রিক ছিলেন। তাঁর উপন্যাসগুলি ভারতের সামাজিক কাঠামোর বিভিন্ন দিক এবং সেইসাথে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের উত্তরাধিকারকে আক্রমণ করে লেখা; এগুলিকে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিবৃতির পাশাপাশি সাহিত্যের নিদর্শন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আনন্দ নিজেও তাঁর বিশ্বাসে অটল ছিলেন যে রাজনীতি ও সাহিত্য একে অপরের থেকে অবিচ্ছেদ্য।[২১] তিনি প্রগতিশীল লেখক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন এবং তিনি সমিতির ইশতেহারের খসড়া তৈরিতেও সহায়তা করেছিলেন।[২২]
ইজ দেয়ার এ কন্টেম্পোরারি ইণ্ডিয়ান সিভিলাইজেশন? (১৯৬৩, বোম্বে: এশিয়া পাবলিশিং হাউস)
কনভারসেশন ইন ব্লুমসবারি (১৯৮১, লণ্ডন: ওয়াইল্ডউড হাউস এবং নতুন দিল্লি: আর্নল্ড-হেইনম্যান)
পিপালি সাহাব: স্টোরি অফ এ চাইল্ডহুড আণ্ডার দ্য রাজ (১৯৮৫, নতুন দিল্লি: আর্নল্ড-হেইনম্যান); পিপালি সাহাব: দ্য স্টোরি অফ এ বিগ ইগো ইন এ স্মল বয় (১৯৯০, লণ্ডন: আসপেক্ট)
ভয়েসেস অফ দ্য ক্রসিং - দ্য ইম্প্যাক্ট অফ ব্রিটেন অন রাইটারস অফ এশিয়া, দ্য ক্যারিবিয়ান অ্যাণ্ড আফ্রিকা। ফার্দিনান্দ ডেনিস, নাসিম খান (সম্পাদকদ্বয়), লণ্ডন: সার্পেন্টস টেইল, ১৯৯৮। মুলক রাজ আনন্দ: পৃ.77 "এ রাইটার ইন এক্সাইল।"
↑"...it can be said that they have taken over from British writers like E. M. Forster & Edward Thompson the task of interpreting modern India to itself & the world." The Oxford History of India, Vincent A. Smith (3rd edition, ed. Percival Spear), 1967, p. 838.
↑"Padma Awards"(পিডিএফ)। Ministry of Home Affairs, Government of India। ২০১৫। ১৫ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে মূল(পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জুলাই ২১, ২০১৫।
↑Cowasjee, Saros. So Many Freedoms: A Study of the Major Fiction of Mulk Raj Anand, New Delhi: Oxford University Press, 1977.
↑Orwell, George. The Collected Essays, Journalism and Letters of George Orwell – My Country Right or Left 1940–1943, London: Martin Secker & Warburg, 1968, pp. 216–220.
↑""Maqbool Ki Vaapsi" Title Song" (ইংরেজি ভাষায়)। M S Azaad। আগস্ট ২৮, ২০১২। Archived from the original on এপ্রিল ৯, ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ২, ২০২৩।উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: বট: আসল-ইউআরএলের অবস্থা অজানা (link)
↑Berry, Margaret (১৯৬৮–১৯৬৯)। "'Purpose' in Mulk Raj Anand's Fiction" (1/2 1968–1969)। Michigan State University, Asian Studies Center: 85–90। জেস্টোর40874218।
মুল্ক রাজ আনন্দ, "ভারতে জাতীয় পরিচয়ের জন্য অনুসন্ধান", ইন: হ্যান্স কোচলার (সম্পাদনা। ) জাতির সাংস্কৃতিক আত্ম-বোধ । Tübingen (জার্মানি): Erdmann, 1978, pp. 73-98।