মেন্ডেলীয় বংশগতি (মেন্ডেলিজম নামেও পরিচিত) হলো এক প্রকার জৈবিক বংশগতি যা মূলত গ্রেগর মেন্ডেল কর্তৃক ১৮৬৫ ও ১৮৬৬ সালে প্রস্তাবিত নীতিসমূহ অনুসরণ করে চলে। ১৯০০ সালে হুগো দ্য ভ্রিস ও কার্ল করেন্স কর্তৃক এই নীতিগুলো পুনঃআবিষ্কৃত হয় এবং পরবর্তীতে উইলিয়াম বেটসন এগুলোকে জনপ্রিয় করে তোলেন।[১] প্রাথমিকভাবে এই নীতিগুলো বিতর্কিত হয়েছিল। ১৯১৫ সালে টমাস হান্ট মর্গান মেন্ডেলের তত্ত্বসমূহকে বোভেরি–সাটনের বংশগতির ক্রোমোজোম তত্ত্বের সঙ্গে একীভূত করেন, ফলে এগুলো শাস্ত্রীয় বংশাণুবিজ্ঞানের মূলে পরিণত হয়। রোনাল্ড ফিশার তাঁর ১৯৩০ সালের বই দ্য জেনেটিকাল থিওরি অফ ন্যাচারাল সিলেকশন-এ প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের সঙ্গে এই ধারণাগুলোকে একীভূত করেন, যা বিবর্তনকে একটি গাণিতিক ভিত্তির উপর দাঁড় করায় এবং আধুনিক বিবর্তনিক সংশ্লেষণের মধ্যে জনসংখ্যা বংশাণুবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করে।[২]
মেন্ডেলিয় বংশগতির নীতিগুলোর নামকরণ করা হয়েছে গ্রেগর ইয়োহান মেন্ডেলের নামে। [৩] উনিশ শতকে এই মোরোভিয়ান ধর্ম যাজক নিজ মঠের বাগানে রোপণকৃত মটর গাছের(পিসাম স্যাটিভিম ) উপর কিছু সাধারণ সঙ্করায়ন পরীক্ষা চালান। [৪] ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৩ সালের মধ্যে তিনি প্রায় পাঁচ হাজার মটর গাছের উপর পরীক্ষা চালান। এই পরীক্ষাগুলো থেলে তিনি দুইটি সাধারণ নীতির প্রবর্তন করেন। এই নীতগুলৈ পরবর্তীকালে মেন্ডেলের বংশগতীয় নীতি নামে প্রচলিত হয়। তিনি তার গবেষণা "ভেরসুখে উবার ফ্লানৎযেন-হুব্রিডেন ( প্ল্যান্ট হাইব্রিডাইজেশন সম্পর্কিত পরীক্ষা ) দুই ভাগে গবেষণাপত্র আকারে প্রকাশ করেন। চেক প্রজাতন্ত্রের বারনো শহরের ন্যাচারাল হিস্টরি সোসাইটিতে ১৮৬৫ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি ও ৮ই মার্চে তিনি দুই দফায় তার গবেষণা পত্র উপস্থাপন করেন। যা ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয়।
মেন্ডেলের গবেষণার ফলাফল সেই সময়ের সংখ্যাগরিষ্ঠদের দ্বারা উপেক্ষিত হয়েছিল। যদিও সে সময়কার জীববিজ্ঞানীদের কাছে এগুলি পুরোপুরি অজানা ছিল না, তবুও তার প্রস্তাবিত সাধারণভাবে প্রযোজ্য হিসাবে মেনে নেয়া হয়নি। এমনকি মেন্ডেল নিজেও মনে করেছিলেন যে, কেবলমাত্র কয়েকটি প্রজাতি বা বৈশিষ্ট্য়ের জন্য তার প্রস্তাবিত নীতিগুলো প্রযোজ্য। মেন্ডেলের বংশগতীয় নীতির তাৎপর্য অনুধাবনের পথে প্রধান বাধা ছিলো "কমপ্লেক্স ট্রেইটস"। কমপ্লেক্স ট্রেইটস হল উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জিনগত বৈশিষ্ট্য যা শুধুমাত্র একটি জিন দ্বারা বর্ণনা করা যায় না। অবশ্য বর্তমানে এই ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলো একাধিক জিনের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়।[৪]
মেন্ডেল তার সময়ে নিজের প্রস্তাবিত বংশগতীয় নীতিগুলোর গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও ১৯০০ সালে তিন ইউরোপীয় বিজ্ঞানী হুগী দে ভ্রি, কার্ল করেন্স এবং এরিখ ফন শেমার্ক একই নীতি পুনঃআবিষ্কার করেন। " পুনঃআবিষ্কার" এর সঠিক প্রকৃতি নিয়ে অবশ্য বিতর্ক হয়েছে: দে ভ্রি বিষয়টিতে প্রথমে প্রকাশ করেছিলেন, একটি পাদটীকায় মেন্ডেলের কথা উল্লেখ করে।
বিজ্ঞানে করেন্স দে ভ্রির গবেষণাপত্রটি পড়ে মেন্ডেলের আবিষ্কারকে অগ্রাধিকার দেয়ার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। দে ভ্রির বুঝতে পারেন এই বংশগতীয় নীতি আবিষ্কারের তার তুলনায় মেন্ডেল অনেক এগিয়ে। দে ভ্রি হয়তো বা তার গবেষণা প্রকাশিত তথ্যে গড়মিল করেছিলেন। দে ভ্রি নিজের গবেষণা পত্রে কতটুকু নিজের জ্ঞান আর কতটুকু মেন্ডেলের গবেষণা থেকে আহরিত জ্ঞান লিপিবদ্ধ করেছিলেন সেই ব্যাপারে সন্দেহ থেকে গেছে। পরবর্তীতে অন্যান্য গবেষকেরা অভিযোগ করেন, ফন শেমার্ক বংশগতীয় নীতির ফলাফল নিজেই ঠিকভাবে বুঝতে পারেনি। [৫][৬][৭]
পানেট স্কয়ার হলো জিনতত্ত্বের একটি সুপরিচিত উপকরণ যা ইংরেজ জিনতত্ত্ববিদ রেজিনাল্ড পানেট কর্তৃক উদ্ভাবিত। এর মাধ্যমে পিতামাতার জিনোটাইপ অনুসারে সন্তানেরা যে সকল সম্ভাব্য জিনোটাইপ পেতে পারে তা দৃশ্যতভাবে প্রদর্শন করা যায়।[৮][৯][১০] প্রত্যেক পিতামাতা দুটি অ্যালিল বহন করে, যা চেকারবোর্ডের উপরে এবং পাশে দেখানো হয় এবং প্রজননের সময় প্রত্যেকে প্রতিবারে তাদের একটি করে অ্যালিল প্রদান করে। মাঝখানের প্রতিটি বর্গক্ষেত্র দেখায় যে সম্ভাব্য সন্তান তৈরি করতে প্রতিজোড়া প্যারেন্টাল অ্যালিল কতবার মিলিত হতে পারে। সম্ভাবনার সূত্র ব্যবহার করে যে কেউ তখন নির্ধারণ করতে পারে যে পিতামাতা কী কী জিনোটাইপ তৈরি করতে পারে এবং কোন অনুপাতে তা তৈরি করা যেতে পারে।[৮][১০] উদাহরণস্বরূপ, যদি দুই পিতামাতার উভয়েরই হেটেরোজাইগাস জিনোটাইপ থাকে, তাহলে তাদের সন্তানদের একই জিনোটাইপ হওয়ার ৫০% সম্ভাবনা থাকবে এবং তাদের হোমোজাইগাস জিনোটাইপ হওয়ার ৫০% সম্ভাবনা থাকবে। যেহেতু তারা সম্ভাব্য দুটি অভিন্ন অ্যালিলের বেশি প্রদান করতে পারে না, তাই প্রত্যেক ধরনের হোমোজাইগোটের জন্য ৫০%-এর অর্ধেক ২৫% হয়ে যাবে, তা একটি হোমোজাইগাস প্রকট জিনোটাইপ হোক বা একটি হোমোজাইগাস প্রচ্ছন্ন জিনোটাইপ হোক।[৮][৯][১০]
বংশতালিকা বা পেডিগ্রি চার্ট হলো দৃশ্যত বৃক্ষের মতো উপস্থাপনা যার মাধ্যমে কীভাবে অ্যালিলগুলো অতীত প্রজন্ম থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে চলে যাচ্ছে তা প্রদর্শন করা যায়।[১১] এর মাধ্যমে একটি কাঙ্ক্ষিত অ্যালিল বহনকারী প্রত্যেকটি জীবকে একটি ডায়াগ্রামের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হয় এবং এটি বংশগতির কোন দিক থেকে প্রাপ্ত হয়েছিল, তাদের মায়ের দিক থেকে নাকি তাদের পিতার দিক থেকে, তাও প্রদর্শন করা হয়।[১১] বংশতালিকার চার্ট গবেষকদের পছন্দসই অ্যালিলের জন্য বংশগতির পদ্ধতি নির্ধারণে সহায়তা করে, কারণ এগুলোর মাধ্যমে জানা যায় সকল জীবের লিঙ্গ, ফিনোটাইপ, একটি পূর্বাভাসিত জিনোটাইপ, অ্যালিলের সম্ভাব্য উৎস এবং এর ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে কীভাবে এটি ভবিষ্যতের প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে এরকম বিভিন্ন তথ্য। বংশতালিকার চার্ট ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা সময়ের সাথে সাথে অ্যালিলের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার উপায় খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছেন, যাতে সমস্যাযুক্ত অ্যালিলগুলো খুঁজে বের করে সমাধান করা যায়।[১২]
মেন্ডেলের আবিষ্কারের পাঁচটি অংশ তৎকালীন সাধারণ তত্ত্ব থেকে ভিন্ন ছিলো। তার বংশগতীয় নীতি প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত ছিলো এই পাঁচটি অংশ।
সূত্র | সংজ্ঞা |
---|---|
প্রকটতা ও অভিন্নতার সূত্র | কিছু অ্যালিল প্রকট এবং বাকিরা প্রচ্ছন্ন; একটি জীবে কমপক্ষে একটি প্রকট অ্যালিল উপস্থিত থাকলে ঐ প্রকট অ্যালিলের প্রভাব প্রকাশিত হবে।[১৩] |
পৃথকীকরণ সূত্র | জননকোষ সৃষ্টির সময় প্রত্যকটি জিনের অ্যালিল একে অপরের থেকে এমনইভাবে পৃথক হয়ে যায়, যাতে করে প্রত্যেকটি জননকোষ প্রত্যেকটি জিনের জন্য কেবল একটি করে অ্যালিল বহন করতে পারে। |
স্বাধীনভাবে বণ্টনের সূত্র | জননকোষ সৃষ্টির সময় ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জিনসমূহ স্বাধীনভাবে পৃথক হতে পারে। |
মেন্ডেলীয় বৈশিষ্ট্য হলো যার বংশগতি মেন্ডেলের নীতিসমূহ অনুসরণ করে চলে, উদাহরণস্বরূপ, এমন বৈশিষ্ট্য যা কেবল একটি একক লোকাসের উপর নির্ভরশীল, যার অ্যালিলসমূহ হয় প্রকট না হয় প্রচ্ছন্ন। অনেক বৈশিষ্ট্যই অমেন্ডেলীয় পদ্ধতিতে প্রাপ্ত হয়, যা মেন্ডেলের সূত্রের ব্যতিক্রম।[১৪]
মেন্ডেল নিজেই সতর্ক করেছিলেন যে তাঁর পদ্ধতিগুলো অন্যান্য জীবে বা বৈশিষ্ট্যে পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে সাবধান থাকা উচিৎ। প্রকৃতপক্ষে অনেক জীবের এমন বৈশিষ্ট্যাবলি আছে যাদের বংশগতি তাঁর বর্ণিত নীতিসমূহ থেকে ভিন্নভাবে কাজ করে; এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে অমেন্ডেলীয় বৈশিষ্ট্য বলে।[১৫][১৬] উদাহরণস্বরূপ, মেন্ডেল এমন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেন যাদের জিনে কেবল দুটি অ্যালিল রয়েছে, যেমন A ও a। তবে অনেক জিনের দুইয়ের অধিক অ্যালিল রয়েছে। তিনি আরও লক্ষ্য করেন সেসব বৈশিষ্ট্যে যেগুলো একটিমাত্র জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু কিছু বৈশিষ্ট্য, যেমন– উচ্চতা, একটি জিনের পরিবর্তে অনেকগুলো জিনের উপর নির্ভর করে। বহু জিনের উপর নির্ভরশীল বৈশিষ্ট্যগুলোকে পলিজেনিক বৈশিষ্ট্য বলে।