মেরি সোমারভিল | |
---|---|
জন্ম | মেরি ফেয়ারফ্যাক্স ২৬ ডিসেম্বর ১৭৮০ জেডবার্গ, স্কটল্যান্ড |
মৃত্যু | ২৯ নভেম্বর ১৮৭২ | (বয়স ৯১)
জাতীয়তা | স্কটল্যান্ডীয় |
নাগরিকত্ব | স্কটল্যান্ডীয় |
পিতা-মাতা | উইলিয়াম জর্জ ফেয়ারফ্যাক্স মার্গারেট চার্টার্স |
পুরস্কার | প্যাট্রনের মেডেল (1869) |
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন | |
কর্মক্ষেত্র | বৈজ্ঞানিক সাংবাদিকতা,গণিতবিদ |
মেরি সমারভিল (ইংরেজি: Mary Somerville; ২৬ ডিসেম্বর ১৭৮০ – ২৯ নভেম্বর ১৮৭২)[১] স্কটল্যান্ডের বৈজ্ঞানিক সাংবাদিক এবং বহুবিদ্যাবিশারদ ছিলেন।
উনি গণিতবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। ক্যারোলাইন হেরশ্ছেলের সঙ্গে তিনি প্রথম মহিলা যাকে রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিতে মনোনীত করা হয়েছিল।
রয়্যাল ব্যাংক অফ স্কটল্যান্ডের দ্বারা জারি ১০ পাউন্ড নোটের অভিমুখে তাঁর ছবি এবং তাঁর লেখা 'দা কানেকশন অফ দা ফিজিক্যাল সাইন্সেস' থেকে একটি উদ্ধৃতি আছে।[২]
২৬ ডিসেম্বর ১৭৮০। খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় উৎসব বড় দিনের এক দিন পরেই ফেয়ারফ্যাক্স পরিবারে একটি ফুটফুটে মেয়ের জন্ম হল। মেয়েটির নাম রাখা হল মেরি ফেয়ারফ্যাক্স সামারভিল।[৩][৪] মেরির জন্ম স্কটল্যান্ডের জেডবার্গের একটি চার্চে খালার বাড়িতে। মেরির বাবা উইলিয়াম জর্জ ফেয়ারফ্যাক্স নেভির কমান্ডার এবং ভাইস এডমিরাল ছিলেন। উইলিয়াম জর্জ ১৭৬৭ সালে হাননা স্পিয়ার্স নামের এক নারীকে বিয়ে করেন। ১৭৭২ সালে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। মেরি দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। মেরির মায়ের নাম জ্যানেট মার্গারেট কার্টার।[৪] মেরিরা মোট সাত ভাইবোন ছিল। মেরির জন্মের আগে দুইজন এবং পরে একজন মারা যায়। জীবিত চারজনের মধ্যে মেরি দ্বিতীয়। এক ভাই তাঁর চেয়ে ৩ বছরের বড়। অন্যজন ১০ বছরের ছোট। আর বোনটি সাত বছরের ছোট।
মেরির দুই ভাই পড়ালেখার যে সুযোগ পেয়েছিল তাঁর ছিটেফোঁটাও পাননি মেরি। পড়ালেখার জন্য মায়ের থেকেও কোন সাহায্য পায়নি। একমাত্র বাবা চেষ্টা করেছিলেন তাকে পড়াতে। তাকে ভর্তি করিয়েছিলেন মুসেলবার্গের স্কুলে। আগেই বলেছি স্কুলে ভর্তি করে কোন লাভ হয়নি। বরং স্কুলের ঐ একটি বছর মেরির জন্য জেলখানা ছিল। এই সময়ে মেরি কিছুই শিখতে পারেননি। না পড়তে আর না লিখতে। বছর শেষ হতেই তাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয়। ছাড়া পেয়ে মেরি যেন মুক্ত পাখির মত উড়তে লাগল। এ সম্পর্কে মেরি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, বন্য পাখি খাঁচা থেকে পালিয়ে গেলে পাখিটির যে আনন্দ হয়, বাড়ি ফিরে আমার সে রকম আনন্দ হয়েছিল।[৫]
বাড়ি ফিরে মেরি বাবার কাছে পড়তে শিখেছিলেন। মেরিদের বাড়িতে তাঁর বাবার বেশ কিছু বই ছিল। এর মধ্যে সেক্সপিয়রের বইও ছিল। মেরি সেই বই পড়তে শুরু করেন। বই পড়ে ভালো লাগে মেরির। তাঁদের বাসায় যত বই ছিল সব গুলোই পড়া আরম্ভ করল।[৬]
১৩ বছর বয়সে মেরি গণিতের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এর পিছনে একটি ঘটনা রয়েছে। একদিন মেরি ও তাঁর বন্ধুরা একটি পার্টিতে যায়। সেখানে একটি ফ্যাশন ম্যাগাজিন রাখা ছিল। মেরি সেই ম্যাগাজিনটি উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখতে লাগল। হটাৎ তাঁর চোখ আটকে গেল একটি ধাঁধায়। ধাঁধার উত্তর x ও y মাধ্যমে দেওয়া। মেরি তাঁর বন্ধুর কাছে এই ধাঁধা সম্পর্কে জানতে চায়। মেরির বন্ধু তাকে জানায়, এটি বীজগণিতের একটি ধাঁধা। ঐ ধাঁধা দেখার পর থেকে বীজগণিতের প্রতি আগ্রহ জন্মায় মেরির। একদিন মেরির ছোট ভাইয়ের শিক্ষক পড়াতে এসেছেন। মেরি সেই শিক্ষককে বীজগণিতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। গৃহশিক্ষক তাকে বিজগণিতের ব্যাপারে ধারণা দেন এবং বেসিক বীজগণিতের কয়েকটি বইও সংগ্রহ করে দেন। মেরি সেই বই গ্রোগ্রাসে গিলতে লাগলেন। এরপর মেরিকে ইউক্লিডের এলিমেন্টস গ্রন্থের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ততদিনে মেরি গণিতে মজেছেন। রাতের পর রাত জেগে সেই বই পড়তে লাগলেন মেরি। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়লে মেরি মোমবাতি জ্বালিয়ে এলিমেন্টস পড়তেন। এ ব্যাপারটা নজরে পড়ে মেরির মায়ের। জ্যানেট ভাবলেন মেরি হয়তো প্রেমে পড়েছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে রাত জেগে সে চিঠি পড়ে। জ্যানেট চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মেরির বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন।
মেরিদের বাসা ছিল এডিনবার্গে। গ্রীষ্মে এখানে থাকা বড় মুশকিল। তাই গ্রীষ্মকালের জন্য বার্টিসল্যান্ডে একটি বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। এক বড় দিনের এক ছুটিতে মেরির খালা এবং খালু তাঁদের বাসায় বেড়াতে আসলেন। মেরিকে পড়ালেখা করতে দেখে তাঁর খালা অবাক হয়ে গেলেন। মেরির মাকে বললো, তুমি এখনো মেরিকে পড়াশোনা করাচ্ছ? বিয়ের বয়সতো হয়ে গেল। মেরি এখনো ভালো করে সেলাই করতে পারেনা। শরীর স্বাস্থের অবস্থাও তো ভালোনা। তাই পড়ালেখা বাদ দিয়ে মেরিকে এমন কিছু শেখানো হলো যাতে দেখতে যুবতীদের উপযুক্ত বলে মনে হয়। মেরিকে একটি সুমিং স্কুলে ভর্তি করানো হলো। বাইবেল শেখার জন্য নিয়মিত যেতে হতো চার্চে। অ্যালেকজান্ডার ন্যাসমিথের কাছে চিত্রকর্ম শেখেন। এই সময়ে পিয়ানো বাজানও শিখেছিলেন তিনি। কিন্তু মেরির খালু ড. থমাস সামারভিলের মনে অন্য কিছু ছিল। সে মেরিকে জানায়, প্রাচীন কালে অনেক নারী পণ্ডিত ছিল। তাঁরা গণিত ও বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করেছেন। মেরিরও সেই সুযোগ আছে। সেই গবেষণা করতে হলে মেরিকে ল্যাটিন ভাষা শিখতে হবে। কিন্তু চাইলেই তো আর ল্যাটিন শেখা যায়না। সে সময়কার স্কুলে শুধু পুরুষদের ল্যাটিং শেখানো হতো। লাটিনের পরিবর্তে মেয়েদের শেখানো হতো বাইবেল। মেরিকে ল্যাটিন শেখানোর দায়িত্ব নেয় ড. সামারভিল।
১৮০৪ সালে মেরির বাবা ইউলিয়াম জর্জ নাইট উপাধিতে ভূষিত হন। মেরির পরিবারের সম্মান বেড়ে যায় অনেকটা। মেরির বয়স ২৪। বিয়ে দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করলেন মেরির পরিবার। নাইট পরিবারের মেয়েকে যারতার হাতে তো তুলে দেওয়া যায়না। মেরিকে অনেকে বিয়ে করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর চাচাতো ভাই সেমুয়েল জর্জের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়। সেমুয়েল রাশিয়ান নৌবাহিনীর অফিসার ছিলেন। বিয়ের আগে এই নিয়ে একটু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। মেরির বাবা কিছুতেই মেয়েকে রাশিয়া পাঠাবেন না। সেমুয়েলকে শর্ত দেওয়া হলো, রাশিয়া থাকে ট্র্যান্সফার হয়ে লন্ডনে আসতে পারলে মেরিকে তাঁর সাথে বিয়ে দেওয়া হবে। শশুড়ের কথা মতো বিয়ের পরে তাঁরা লন্ডনে বসবাস শুরু করেন।
মেরির বিবাহিত জীবন সুখি ছিলনা। সেমুয়েল চাইত না মেরি আর পড়ালেখা করুক। এরমধ্যে তাঁদের দুটি সন্তান হয়। তাঁদের মধ্যে একজন ওয়ারনজ গ্রেগ যিনি পরে বিজ্ঞানী হয়েছিলেন। স্বামীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেরি ফ্রেন্স ভাষা শিখতে শুরু করেন। সারাদিন ঘরের কাজ করে সন্তানদের ঘুম পাড়িয়ে অধ্যায়ন করতেন। তিনি একহাতে পরিবার সামলেছেন আবার অধ্যায়নও করেছেন। শৈশবে মায়ের সাথে অনেক কাজ করেছেন বলেই হয়তো তাঁর পক্ষে এভাবে কাজ ও পড়াশোনা করা সম্ভব হয়েছে। যাইহোক, বিয়ের তিন বছর পর ১৮০৭ সালে সেমুয়েল জর্জ মারা যায়। ফলে মেরি লন্ডন ছেড়ে আবার এডিনবার্গে চলে আসেন। স্বামীর মৃত্যুর পরে মেরি অনেক সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন।
মেরি স্কটল্যান্ডে ফিরে আবার গণিত নিয়ে পড়ে রইলেন। প্রথমে তিনি ত্রিকোণমিতি এবং জেমস ফার্গুসনের জ্যোর্তিবিজ্ঞান পড়তে শুরু করেন। এরপরে পড়েন স্যার আইজ্যাক নিউটনের প্রিন্সিপিয়া অব ম্যাথেমেটিকা। এরপর এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক দর্শনের প্রফেসর জন প্লেফেয়ারের সাথে পরিচয় হয় মেরির। তিনি তাকে গণিতের প্রতি আরো উৎসাহী করে তোলেন। প্লেফেয়ারের মাধ্যমে মেরি রয়েল মিলেটারি কলেজের গণিতের অধ্যাপক ইউলিয়াম ওয়ালেসের সাথে পরিচিত হন। ওয়ালেস মেরির সাথে মেশ কয়েকটি গাণিতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ডায়োফনটাইন সমীকরণ। মেরি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে রয়েল মিলেটেরি কলেজের গণিত বিষয়ক জার্ণালে প্রকাশ করেন। ফলে মেরিকে তাঁর নাম সংবলিত একটি রৌপ্য পদক দেওয়া হয়। মেরির উৎসাহ আরো বেড়ে যায়। নিজের বাড়িতে গণিতের ছোটখাট একটি লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন। স্কটল্যান্ডে তাঁর বেশ কিছু বন্ধু হয়েছিল যারা গণিত ও বিজ্ঞানে পারদর্শী। মেরির এই বন্ধু বান্ধব দেখে তাঁর পরিবার আবার বিয়ের আয়োজন করে।
১৮১২ সালে মেরি তাঁর খালাতো ভাই (ড. থমাস সামারভিলের ছেলে) উইলিয়াম সামারভিলকে বিয়ে করেন। এই পরিবারেই জন্মেছিলেন মেরি। উইলিয়াম সামারভিল হাঁসপাতালের পরিদর্শক ছিলেন। তবে প্রথম স্বামীর তুলনায় দ্বিতীয় স্বামী ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। উইলিয়াম স্ত্রীকে পড়ালেখার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। সেই সাথে বিজ্ঞানের ও গণিতের প্রতিও ছিল তাঁর ভালোবাসা। এবার যেন মেরি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। উইলিয়াম ও মেরি এডিনবার্গে বাস করতেন। এডিনবার্গে থাকার কারণে উইলিয়াম ওয়ালেসের সাথে মেরির যোগাযোগ ছিল। ওয়ালেস তাকে বিখ্যাত সব ফরাসী বইয়ের সন্ধান দেন। মেরি সেগুলো অধ্যায়ন করেন। স্বামীর সাহায্য নিয়ে শিখতে শুরু করেন রসায়ন, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা।
মেরি ও উইলিয়াম দম্পতির ৪ টি সন্তান হয়। তিনটি মেয়ে ও একটি ছেলে সন্তান। ১৮১৪ সালে মেরির প্রথম পক্ষের বড় মেয়টি অসুস্থ হয়ে মারা যায়। একই বছর দ্বিতীয় পক্ষের একমাত্র ছেলেটিও মারা যায়। মেরি হতাশ হয়ে পড়েন। এই সময় মেরির পড়ালেখা ও গবেষণায় বিরতি পরে।
১৮১৬ সালে মেরির স্বামী আর্মি মেডিকেল বোর্ডের পরিদর্শক হিসেবে নিযুক্ত হন। এছাড়া রয়েল সোসাইটিতেও নির্বাচিত হয়েছিলেন উইলিয়াম। তাঁরা এডিনবার্গ ছেড়ে লন্ডনে চলে আসেন। এ সময় লন্ডনে তাঁদের অনেক বিজ্ঞানীর সাথে পরিচয় হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে জন হার্শেল, উইলিয়াম হার্শেল, জন এয়রি, চার্লস ব্যাবেজ, ল্যাপলেস এবং মাইকেল ফ্যারাডে অন্যতম। মেরি তাঁর আত্নজীবনীতে লিখেছেন, চার্লস ব্যাবেজ যখন তাঁর অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন আবিষ্কার করছিলেন তখন আমরা প্রায় তাঁর সাথে দেখা করতে যেতাম।
১৮১৯ সাল। মেরির বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিলেন অ্যানা ইসাবেল। আডা লাভলেসের মা। অ্যানা মেরিকে নিজের মেয়ের গৃহ শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন। এরমধ্যেই গণিত নিয়ে লেখাপড়া শুরু করেছিলেন মেরি। এ সময় মেরি নিউটন, অয়লার ও ল্যাপ্লাসের বই নিয়ে অধ্যায়ন করছিলেন। মেরি আডার গণিতের প্রতি উৎসাহ দেখে চার্লস ব্যাবেজের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ভিন্ন মতোবাদও আছে। অনেকের মতে, মেরি সামারভিল নয় বরং গণিতের মেধা দেখে চার্লস ব্যাবেজই নাকি আডা লাভলেসকে ডেকেছিলেন তাঁর সাথে কাজ করার জন্য। ঘটনা যাই হোক, মেরি সামারভিল আডা লাভলেসকে অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন।
মেরি আলোক এবং চৌম্বকবিদ্যা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তাঁর প্রেক্ষিতে ১৮২৬ সালে প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণা পত্র ‘দ্য প্রসেডিংস অব দ্য রয়াল সোসাইটি’। ১৮২৭ সালে লর্ড ব্রাউগহাম ‘দ্য সোসাইটি ফর দ্য ডিফিউশন অব ইউজফুল নলেজের’ পক্ষ থেকে মেরি সামারভিলকে ল্যাপলাসের মেকানিক সেলেস্তে বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করতে অনুরোধ করেন। মেরি বইটির ইংরেজি অনুবাদ করতে শুরু করেন। ল্যাপলাসের গণিত বিষয়ক এই বইটি এতই দূর্বেদ্ধ ছিল যে সে সময়কার ইংল্যান্ডের অনেক গণিতবিদও তা বুঝতে পারতেন না। অনুবাদ করতে গিয়ে যেখানে মেরির কাছে দূর্বেধ্য মনে হল সেখানে নিজের মতামত দিলেন। কঠিন গণিতকে আরো সহজ ভাবে উপস্থাপন করলেন। ফলে মূল বইয়ের চেয়ে এই বইটি দ্বিগুন হয়ে গেল। বইটিকে শুধু ল্যাপলাসের মেকানিক সেলেস্তের অনুবাদ বললে ভুল হবে। বইটি শুধু অনুবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলনা। চার বছর পরিশ্রমের পরে বইটির কাজ শেষ হলো। দ্য মেকানিজম অব দ্য হ্যাভেনস নামে বইটি ১৮৩১ সালে প্রকাশ করে ‘দ্য সোসাইটি ফর দ্য ডিফিউশন অব ইউজফুল নলেজ’। ১৮৮০ এর দশক পর্যন্ত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরদের জন্য বইটি পাঠ্যপুস্তক হিসাবে পড়ানো হত। মেরির সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর বিখ্যাত হতে আর বেশিদিন সময় লাগেনি মেরির। বইটি প্রকাশের পর ল্যাপলাস মেরির সম্পর্কে মন্তব্য করেন, বিশ্বের ছয়জন বেক্তির মধ্যে মেরি সামারভিল একজন, যিনি আমার বইটি বুঝতে পেরেছেন।
১৮৩২-৩৩ এই এক বছর মেরি বিদেশে কাটিয়েছেন। অধিকাংশ সময় ছিলেন প্যারিসে। প্যারিসে মেরির কয়েকজন গণিতবিদ বন্ধু ছিলেন। তাঁদের সাথে যোগাযোগ করেন। গণিতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরামর্শ করেন। প্রথম বইয়ের সফলতার পর লর্ড ব্রাউগহাম তাকে আমার একটি বই লিখতে অনুরোধ জানায়। ১৮৩৪ সালে দ্য কানেকশন অব ফিজিক্যাল সায়েন্স নামে মেরির প্রথম মৌলিক বই প্রকাশিত হয়। এই বইটিও ব্যাপক ভাবে সারা ফেলে। উনিশ শতকে ১৫,০০০ কপি বিজ্ঞানের বই বিক্রি- ভাবা যায়? এক বছর পর ১৮৩৫ সালে মেরি সামারভিল প্রথম মহিলা হিসেবে ক্যারোলিন হার্শেলের সাথে রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সম্মানসূচক সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ সময় মেরিকে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে ২০০ পাউন্ড পেনশন দেওয়া হতো। উইলিয়াম ল্যাম্ব ১৮৩৭ সালে পেনশন বাড়িয়ে ৩০০ পাউন্ড করেছিলেন।
১৮৩৮ সালে উইলিয়াম সামারভিলের দৈহিক অবনতি দেখা দেয়। ফলে তাঁরা ইতালিতে পারি জমান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর তাঁরা ইতালিতেই থাকেন (১৮৬০ সালে উইলিয়াম সামারভিল মারা যান)। ইতালিতে অবস্থানকালে মেরি সামারভিল বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। মেরির কয়েকটি প্রবন্ধ জেমস ম্যক্সোওয়েলকে প্রভাবিত করেছিল।
১৮৪২ সালে কানেকশন জার্নালের ষষ্ঠ সংস্করণে মেরি ইউরেনাস নিয়ে ভবিষ্যৎবানী করেছিলেন। লিখেছিলেন একটি প্রবন্ধ। সেই প্রবন্ধে পৃথিবী থেকে ইউরেনাসের দূরত, ইউরেনাসের ভর, মহাকাশে ইউরেনাসের কক্ষপথ সম্পর্কে লিখেছিলেন। তাঁর ধারণা পুরোপুরি না মিললে বেশকিছু ভবিষৎবানী ঠিক ছিল। ১৭৮১ সালে ইউরেনাস গ্রহ আবিষ্কার করেন উইলিয়াম হার্শেল। তখন দেখা যায় পৃথিবী থেকে ইউরেনাসের দূরত্ব সম্পর্কে মেরির ধারণা একদম ঠিক। কানেকশন জার্নালে মেরির লেখা প্রকাশিত হলে পাঠক তা লুফে নেয়। সে বার কানেকশন জার্নাল সর্বাধিক ৯০০০ কপি বিক্রি হয়েছিল। ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিস বের হওয়ার আগে ঐ প্রকাশনীর এটিই ছিল সর্বাধিক বিক্রির রেকর্ড।
এদিকে লর্ড ব্রাউগহাম মেরিকে তাড়া দিচ্ছেন নতুন বই লেখার জন্য। বই লিখলেই তাঁর প্রকাশনীর রমরমা অবস্থা। মেরির বই পেলেই পাঠক লুফে নেয়। বিক্রি বেশি হলেও মেরির লাভ হয় না। প্রকাশক মেরিকে এককালীন কিছু টাকা দিতেন। পরে আর নতুন বইয়ের আবদার করার আগ পর্যন্ত লর্ড ব্রাউগহামের টিকিটিও দেখা যেত না। অবশ্য এ নিয়ে মেরির কণ আফসোস ছিলনা। তিনি একবার বলেছিলেন, আমি বই লিখি ভালো লাগার জন্য। আমি মানুষের মাঝে গণিতকে ছড়িয়ে দিতে চাই।
১৮৪৮ সালে আসে মেরির ফিজিক্যাল জিওগ্রাফী বইটি। এই বিষয়ের ওপর এটিই ইংরেজিতে লেখা প্রথম বই। বইটি বিশ শতকের শুরুর দিক পর্যন্ত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ছিল। এই বইটি মেরিকে আরো খ্যাতি এনে দিল। এই বইটি মেরির লেখা সবচেয়ে সফল বই। এই বইয়ের কারণেই রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল স্যোসাইটি থেকে ভিক্টোরিয়া স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন।
মেরির চতুর্থ বই মলিকুলার এন্ড মাইক্রোস্কোপিক সায়েন্স ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত হয়। এ সময় তাঁর বয়স ৮৯ বছর। বইটি লিখতে ১০ বছর সময় নিয়েছিলেন মেরি। এই বইয়ে তিনি সর্বশেষ আবিষ্কারগুলোর যুগোপযোগী বিবরণ দিয়েছিলেন। বইটি দুইটি খন্ড ও তিনটি অংশে প্রকাশিত হয়। প্রথম অংশে অণু ও পরমাণু নিয়ে ব্যখ্যা করেছেন। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অংশে যথাক্রমে উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জীবন নিয়ে লিখেছেন। বইটিতে ১৮০ টি ছবি ছিল। বইটি প্রকাশ করতে প্রকাশকের বেশ টাকা ঝাড়তে হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
মেরি শেষ বয়সে লেখেন নিজের আত্মজীবনী পারসোনাল রিকালেকশন । মেরির মৃত্যুর পর বইটি প্রকাশিত হয়।
প্রথম দিকে মেরি সামারভিল গণিত নিয়ে গবেষণা শুরু করলেও ধীরেধীরে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করতে কাজ করেন। লিখেছেন একের পর এক বেষ্ট সেলার বই। গণিতেকে বিজ্ঞানের ভাষা হিসেবে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। নারী শিক্ষার প্রতি ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি। নারীদের ভোটাধিকারের জন্য করেছেন আন্দোলন। ব্রিটিশ দার্শনিক এবং অর্থনিতীবিদ স্টুয়ার্ট মিল নারীদের ভোটাধিকারের জন্য গণস্বাক্ষরের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই গণস্বাক্ষরের প্রথম নামটি মেরি সামারভিল।
মেরি সামারভিল ১৮৫৭ সালে অ্যামেরিকান জিওগ্রাফিক্যাল অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক সোসাইটিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৮৭০ সালে ইতালিয়ান জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটিতে পেয়েছিলেন সদস্যপদ। এছাড়া আরো অনেক সোসাইটি থেকে পদক ও সদস্যপদ লাভ করেছেন।
২৯ নভেম্বর ১৮৭২ সালে মেরি সামারভিল ইতালির নেপলসে মৃত্যুবরণ করেন। সেখানেই তাকে কবর দেওয়া হয়। ৯১ বছরের বৈচিত্রময় জীবন ছিল মেরি ফেয়ারফ্যাক্স সামারভিলের।
সামারভিলের নামে অক্সফোর্ডে সামারভিল কলেজ তৈরি করা হয়েছে।
এই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। |