রেল পরিবহন |
---|
এক ধারাবাহিকের অংশ |
|
সাধারণ |
|
পরিষেবা ও রোলিং স্টক |
|
বিশেষ ধরন |
যাত্রীবাহী রেলপথ ও সরঞ্জামের জন্য বিভিন্ন পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে এবং অঞ্চল অনুযায়ী এইসব পরিভাষার ব্যবহার অনেকাংশে ভিন্ন হয়।
দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থাতে বৈদ্যুতিক রেলগাড়িগুলি প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিছু চক্রপথ (বা লাইনের) এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যেতে ও ফেরত আসতে থাকে এবং নির্দিষ্টসংখ্যক বিরতস্থল বা স্টেশনে স্বল্প সময়ের জন্য থামে; এ সময় যাত্রীরা রেলগাড়িতে ওঠা-নামা করেন। এই ব্যবস্থায় সাধারণত বৈদ্যুতিক বহু-এককবিশিষ্ট রেলগাড়ি (Electric Multiple Unit Train ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট ট্রেইন) ব্যবহৃত হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে রবারের টায়ার, চৌম্বক উত্তোলন বা মনোরেলও ব্যবহৃত হয়। দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থার রেলগাড়িগুলি অন্যান্য গণপরিবহন ব্যবস্থাগুলির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলে। সাধারণত একটি গণপরিবহন পরিচালনা সংস্থা এই ব্যবস্থার পরিচালনার দায়িত্বে থাকে।
দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থার রেলগাড়িগুলি ট্রাম বা লাইট রেলের থেকে দ্রুতগামী ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন, কিন্তু দুরপাল্লার যাত্রীবাহী সাধারণ রেলগাড়ির তুলনায় দ্রুতগামী নয়। দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থায় খুব কম পরিমাণ জমি ব্যবহার করে অনেক বেশি পরিমাণে যাত্রী পরিবহন করা যায়। দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থার অন্যান্য রূপগুলি হল পিপল মুভার, ছোটো আকারের হাল্কা মেট্রো ও যাত্রীবাহী রেল সংকর এস-বান (S-Bahn)।আন্তর্জাতিক গণপরিবহন সঙ্ঘের (ইউআইটিপি) সংজ্ঞা অনুযায়ী, মেট্রো (মেট্রোপলিটান রেলওয়ে শব্দের সংক্ষেপ) হলো একধরনের পৌর পরিবহন ব্যবস্থা যা নিজ গমনের অধিকার নিয়ে পরিচালিত হয় এবং সাধারণ সড়ক ও পদব্রজ ট্র্যাফিক থেকে পৃথককৃত। এর জন্য মেট্রো রেলকে সুড়ঙ্গ, ভায়াডাক্ট বা বিচ্ছিন্নভাবে ভূতলের উপর দিয়ে পরিচালনার জন্য তৈরি করা হয় যাতে করে অহেতুক প্রবেশাধিকার সম্ভব না হয়। নির্দিষ্ট নির্মাণ সমস্যাসহ পৃথক রেলপথে (যেমন মনোরেল, র্যাক রেলওয়ে) কাজ করে এমন রেল ব্যবস্থাকেও মেট্রো বলা যায় যদি এটি পৌর গণপরিবহন নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে নির্ধারিত।[১]
ইউরোপের প্যারিস, রোম, মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, লিসবন, কোপেনহেগেন, হেলসিঙ্কি, ওয়ারশ, সেন্ট পিটার্সবার্গ, আমস্টারডাম, রটারডাম, মস্কো, ইত্যাদি শহরে মেট্রো ব্যবস্থা আছে এবং এটি স্থানীয়ভাবে "মেট্রো" বা "মেত্রো" নামে পরিচিত।[২][৩][৪]
পাতালরেল বলতে ভূগর্ভের মধ্য দিয়ে পরিচালিত দ্রুতগামী ভারী রেল ব্যবস্থাকে বোঝায়। বিভিন্ন ইংরেজিভাষী অঞ্চলে এটি "সাবওয়ে", "আন্ডারগ্রাউন্ড", বা "টিউব" নামে পরিচিত।
সাবওয়ে (ইংরেজি: subway) শব্দটি সাধারণত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার ইংরেজিভাষী অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত, যদিও এই শব্দটি অন্যত্রও ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো সাবওয়ে। এছাড়া কিছু এশীয় ও লাতিন আমেরিকান শহরের দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থাটির নাম ও বিবরণে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। "সাবওয়ে" শব্দটি কেবল ব্যবস্থাটির ভূগর্ভস্থ অংশকে বা সম্পূর্ণ ব্যবস্থাকে বোঝাতে পারে।
লন্ডনের পাতালরেল ব্যবস্থাকে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড বলা হয়, যা চলতি ভাষায় "টিউব" (tube) নামে পরিচিত; এমনকি সরকারি সংস্থা ট্রান্সপোর্ট ফর লন্ডনও এই অর্থে "টিউব" শব্দটি ব্যবহার করে।[৬][৭]
লন্ডনের ভূতল শহরতলি রেল ব্যবস্থাকে বোঝানোর জন্য ট্রান্সপোর্ট ফর লন্ডন ২০০৭ সালে ওভারগ্রাউন্ড (overground) শব্দটি চয়ন করেছিল। এই লন্ডন ওভারগ্রাউন্ড ব্যবস্থাটি সিলভারলিঙ্ক মেট্রো রুটকে প্রতিস্থাপিত করেছে।[৮]
জার্মানভাষী অঞ্চলে (জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ও সুইজারল্যান্ডের কিছু অংশ) মেট্রো ব্যবস্থাকে বোঝানোর জন্য "মেট্রো" শব্দটি সাধারণত ব্যবহৃত হয় না। বরং সেখানে "ইউ-বান" ও "এস বান" শব্দদুটি ব্যবহৃত হয়। "ইউ-বান" হলো "উন্টারগ্রুন্টবান" (Untergrundbahn) শব্দের সংক্ষেপ, যার অর্থ "ভূগর্ভ ট্রেন"। "এস-বান" হলো "স্টাটস্নেলবান" (Stadtschnellbahn, আক্ষ. 'শহর দ্রুত ট্রেন') বা "স্নেলবান" (Schnellbahn, আক্ষ. 'দ্রুত ট্রেন') শব্দের সংক্ষেপ। সুতরাং, জার্মানির রাজধানী বার্লিনের ভূগর্ভ রেল ব্যবস্থাটি বার্লিন ইউ-বান নামে পরিচিত, যা বার্লিন এস-বান নামক ভূতল রেল ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত। ফ্রাঙ্কফুর্ট ইউ-বান এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম এবং এই ব্যবস্থাটি সাধারণত এক হাল্কা রেল ব্যবস্থা, যার বিভিন্ন অংশ ভূগর্ভস্থ।
বিশ্বজুড়ে ভারী রেল শব্দটির বিভিন্ন অর্থ আছে।
যুক্তরাজ্যে "ভারী রেল" (heavy rail) বলতে প্রচলিত রেল ব্যবস্থাকে বোঝায়, যা জাতীয় রেল নেটওয়ার্কের অংশ। এর মধ্যে কমিউটার ট্রেন, আন্তঃনগর ট্রেন, উচ্চ-গতির রেল, আঞ্চলিক রেল, ও মালবাহী ট্রেন পরিষেবা অন্তর্গত, যা মেট্রো রেল, হাল্কা রেল, ট্রাম, পিপল মুভার, বা অনুরূপ ব্যবস্থার থেকে পৃথক।[৯][১০]
জার্মান ভাষায় ভারী রেলকে "ফলবান" (Vollbahn) এবং এর বিপরীত হলো "ক্লাইনবান" (Kleinbahn)। এই শব্দদুটি বিভিন্ন অক্ষদণ্ড ভার ও সংযুক্ত নির্মাণ নিয়মের মধ্যে পার্থক্যের জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে বর্তমানে "ফলবান" সুপরিচিত নয় এবং "ক্লাইনবান" শব্দটি সরু-গেজ রেলপথের জন্য ব্যবহৃত হয়।
আন্তর্জাতিক রেল সঙ্ঘ (ইউআইসি) অনুযায়ী, "ভারী রেল" বলতে উচ্চ-ধারণক্ষমতার মেট্রো রেল ব্যতীত যাত্রীবাহী (কমিউটার, আঞ্চলিক, আন্তঃনগর, ও উচ্চ-গতির) ও মালবাহী রেল পরিষেবাকে বোঝায়।
প্রচলিত রেলের সর্বোচ্চ গতি সাধারণত ১৬০ কিমি/ঘ বা তার কম হয়। বেশিরভাগ কমিউটার, আঞ্চলিক, ও এক্সপ্রেস যাত্রীবাহী ট্রেন, এবং প্রায় সমস্ত মালবাহী ট্রেন এই শ্রেণির অন্তর্গত।
যেসব দেশে প্রচলিত রেল ও উচ্চতর-গতির রেলের মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না তাদের ক্ষেত্রে প্রচলিত রেলের সর্বোচ্চ বেগ ২০০ কিমি/ঘ পর্যন্ত হতে পারে, এবং এর এর বেশি বেগে পরিচালিত রেল ব্যবস্থাকে উচ্চ-গতির রেল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।[১১] যেসব দেশে উচ্চতর-গতির রেলের জন্য পৃথক শ্রেণিবিভাগ বর্তমান (যেমন কানাডা) তাদের ক্ষেত্রে প্রচলিত রেলের সর্বোচ্চ বেগ ১৬০ কিমি/ঘ পর্যন্ত হতে পারে[১২]
উচ্চতর-গতির রেল বা হাইয়ার-স্পিড রেল (ইংরেজি: higher-speed rail)[১৩] একধরনের আন্তঃনগর যাত্রীবাহী রেল পরিষেবা, যা প্রচলিত রেলের চেয়ে বেশি গতিসম্পন্ন কিন্তু তাকে উচ্চ গতির রেল পরিষেবা বলা সম্ভব নয়।[১৪] এটি উচ্চ-কর্মক্ষমতার রেল,[১৫] উচ্চতর-কর্মক্ষমতার রেল,[১৬] বা প্রায়-উচ্চ-গতির রেল,[১৭] নামেও পরিচিত। এই শব্দটি উচ্চ-গতির রেল নেটওয়ার্ক তৈরি বা প্রসারিত করার বৃহত্তর প্রচেষ্টার বিকল্প হিসাবে ট্রেনের গতি বাড়ানো ও ভ্রমণের সময় হ্রাস করার জন্য ক্রমবর্ধমান রেল উন্নতিসমূহকে চিহ্নিত করতেও ব্যবহৃত হয়।[১৮] এর পরিবর্তে কিছু দেশ মাঝারি-গতির রেল, বা আধা-উচ্চ-গতির রেল শব্দটি ব্যবহার করে।[১৯]
যদিও উচ্চতর-গতির রেলের সংজ্ঞা দেশভেদে পরিবর্তিত হয়, তবে বেশিরভাগ দেশ ২০০ কিমি/ঘ পর্যন্ত গতিতে পরিচালিত রেল পরিষেবাগুলিকে উচ্চতর-গতির রেল হিসাবে উল্লেখ করে।[২০]
একে সাধারণত একটি বিদ্যমান রেলপথকে উচ্চ-গতির রেলের সংজ্ঞা (২৫০ কিমি/ঘণ্টার বেশি গতিতে) সংস্কার করার প্রচেষ্টা থেকে উদ্ভূত হিসাবে দেখা হয়, তবে সাধারণত অভিপ্রেত গতিতের থেকে কম গতিতে রেল পরিচালিত হয়। নতুন রোলিং স্টক যেমন টিল্টিং ট্রেন, অগভীর বক্ররেলপথ সহ ট্র্যাক সংস্কার করা, বিদ্যুতায়ন, ইন-ক্যাব সিগন্যালিং, এবং কম ঘন ঘন থামা/স্টপ সহ বিভিন্ন উপায়ে দ্রুত গতি অর্জন করা হয়।[২১]উচ্চ-গতির রেল বা হাই-স্পিড রেল (ইংরেজি: high-speed rail) সাধারণত কমপক্ষে ২৫০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা (১৬০ মাইল প্রতি ঘণ্টা) গতিতে চলে। অবশ্য পুরনো রেললাইনে ২০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা (১২০ মাইল প্রতি ঘণ্টা) গতিতে চললে এগুলোকেও উচ্চগতির রেল গণ্য করা হয়। পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে এই গতি এখনও বেশ নিম্ন গতির হিসেবে বিবেচিত। প্রকৃতপক্ষে সর্বনিম্ন কোন গতিকে চললে উচ্চ-গতির রেল বলা হবে তার কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই।[২২]
প্রথম উচ্চগতির রেল ১৯৬৪ সালে জাপানে চলাচল শুরু এবং এটি ব্যাপকভাবে বুলেট ট্রেন হিসাবে পরিচিত। এর গতিবেগ বর্তমানে ৩২০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা (২০০ মাইল প্রতি ঘণ্টা)। অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, সুইডেন, তাইওয়ান, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং উজবেকিস্তানসহ বহু দেশ প্রধান শহরগুলির মধ্যে সংযোগ তৈরি করতে উচ্চ গতির রেল তৈরি করেছে। শুধুমাত্র ইউরোপে। উচ্চগতির রেল বা এইচএসআর আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করেছে। প্যারিস থেকে ব্রাসেলস হয়ে আমস্টারডাম অবধি থ্যালিস ট্রেনটি ৩০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা (১৯০ মাইল প্রতি ঘণ্টা) গতিতে চলে। লন্ডন-প্যারিস বা প্যারিস-ব্রাসেলস ইউরোস্টার ট্রেনের গতি ২৯৯ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা (১৮৬ মাইল প্রতি ঘণ্টা)।
ডিসেম্বর ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ চীনে ২২,০০০ কিলোমিটার (১৪,০০০ মাইল) এইচএসআর বা উচ্চ-গতির রেলপথ রয়েছে, যা বিশ্বের মোট উচ্চ-গতির রেলপথের দুই-তৃতীয়াংশ।[২৩] সব উচ্চগতির রেল বিদ্যুৎ চালিত। উচ্চ গতির ট্রেন সাধারণত পথের ডানদিকে গ্রেড-বিচ্ছেদ রেলপথকে ক্রমাগত ঝালাই দ্বারা সংযুক্ত করে সাধারণ গেজ ট্র্যাকগুলিতে পরিচালনা করা হয় যা রেলপথের নকশায় একটি বড় ব্যাসার্ধের বাঁক সংযোজন করে।