যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতা বলতে সাধারণত যুদ্ধ, সশস্ত্র সংঘাত অথবা সামরিক দখলদারিত্বের সময় যোদ্ধাদের দ্বারা সংঘটিত ধর্ষণ এবং অন্যান্য যৌন সহিংসতাকে বুঝানো হয়। সাধারণত যুদ্ধলব্ধ সামগ্রীর অংশ হিসেবে এটা ঘটে থাকে, তবে জাতিগত সংঘাতের ক্ষেত্রে এর বৃহত্তর সমাজতাত্ত্বিক উদ্দেশ্য থাকে। যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতায় গণধর্ষণ এবং বস্তুর সাহায্যে ধর্ষণও অন্তর্ভুক্ত হয়। এটি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সংঘটিত যৌন সহিংসতার ঘটনা থেকে পৃথক[১][২][৩]। কোনো দখলদার শক্তি কর্তৃক দখলকৃত ভূখণ্ডের নারীদের পতিতাবৃত্তি কিংবা যৌন দাসত্বে বাধ্য করাটাও যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতার অন্তর্গত।
যুদ্ধ বা সশস্ত্র সংঘাতের সময় প্রায়ই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অংশ হিসেবে শত্রুকে অপমানিত করার উদ্দেশ্যে ধর্ষণকে অস্ত্রর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠিকে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার জন্য ধর্ষণকে ব্যবহার করা হলে সেটিকে গণহত্যা এবং জাতিগত নির্মূলকরণ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ধরনের অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির জন্য আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে, কিন্তু সবেমাত্র ১৯৯০-এর দশক থেকে এই আইনের ব্যবহার শুরু হয়েছে[৪]।
১৬৩৫ সালে মুঘল সম্রাট শাহজাহান বুন্দেলখণ্ড আক্রমণ ও দখল করেন। বুন্দেলখণ্ড দখলের পর বুন্দেলা রাজা বীর সিংহের পরিবারের নারীরা মুঘল বাহিনীর হাতে বন্দি হন[৫]। এসব বন্দি নারীদেরকে জোরপূর্বক ধর্ম পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয় এবং তারা মুঘল সৈন্য বা সেনা কর্মকর্তাদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন[৫]।
১৭৪২ সাল থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত মারাঠা নেতা রঘুজীর সৈন্যরা ক্রমাগত বাংলা আক্রমণ করে। এসময় বাংলার অসংখ্য নারী মারাঠাদের দ্বারা ধর্ষিত হন। মারাঠারা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সুন্দরী নারীদের অপহরণ ও ধর্ষণ করে[৬][৭]। অসংখ্য নারী মারাঠা সৈন্যদের হাতে গণধর্ষণের শিকার হয়। সমসাময়িক সূত্রসমূহের বর্ণনানুযায়ী, মারাঠা সৈন্যরা হিন্দু নারীদের মুখে বালি ভরে দিত, তাঁদের হাত ভেঙ্গে দিত এবং পিছমোড়া করে বেঁধে তাদেরকে গণধর্ষণ করত[৬][৮]। সমসাময়িক বাঙালি কবি গঙ্গারাম বাংলার নারীদের ওপর মারাঠাদের অত্যাচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, তারা সুন্দরী নারীদের টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেত এবং দড়ি দিয়ে তাদের আঙ্গুলগুলো তাদের ঘাড়ের সঙ্গে বেঁধে দিত। একজন বর্গি (মারাঠা সৈন্য) একজন নারীর সম্ভ্রমহানি করার পরপরই আরেকজন বর্গি তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। এসব নারীরা যন্ত্রণায় চিৎকার করতেন। এইসব পাপপূর্ণ কার্যকলাপের পর তারা এসব নারীদেরকে মুক্ত করে দিত[৯]। সমসাময়িক বর্ধমানের মহারাজার রাজসভার পণ্ডিত বনেশ্বর বিদ্যালঙ্কারও মারাঠা সৈন্যদের সম্পর্কে লিখেছেন, তারা সমস্ত সম্পত্তি লুণ্ঠন করে এবং সতী স্ত্রীদের অপহরণ করে[১০]।
১৭৫৭ সালে আফগান সম্রাট আহমদ শাহ আবদালী মু্ঘল-শাসিত ভারত আক্রমণ করেন। এসময় আফগান সৈন্যরা দিল্লি ও মথুরাসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে হাজার নারীকে ধর্ষণ করে এবং আরো বহুসংখ্যক নারীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়[১১]। সম্ভ্রমহানির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বহু নারী আত্মহত্যা করেন[১১]।
বক্সার বিদ্রোহের সময় আট-জাতির জোটের সৈন্যরা চীনা জনসাধারণের বিরুদ্ধে ব্যাপক হারে হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণে লিপ্ত হয়। হাজার হাজার চীনা নারী আক্রমণকারী সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন, এবং আরো হাজার হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে বাঁচার জন্য আত্মহত্যা করেন[১২]। জর্জ লিঞ্চ নামক একজন পশ্চিমা সাংবাদিক বলেন, এমন অনেককিছু আছে যেগুলো আমি লিখতে পারব না এবং যা হয়ত গ্রেট ব্রিটেনে ছাপা হবে না, কারণ এগুলো দেখাবে যে আমাদের পশ্চিমা সভ্যতা বর্বরতার ওপর একটি পাতলা আস্তরণ মাত্র[১৩]। লুয়েল্লা মাইনার লিখেছেন যে, রুশ ও ফরাসি সৈন্যদের আচরণ ছিল বিশেষভাবে নিষ্ঠুর। ফরাসি সেনাপতি ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে তুচ্ছ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং সেগুলোকে ফরাসি সৈন্যদের বীরত্ব হিসেবে আখ্যা দেন[১৪]।
১৯০৪–১৯০৫ সালে রুশ–জাপান যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধের অন্যতম প্রধান রণাঙ্গন ছিল চীন সাম্রাজ্যের মাঞ্চুরিয়া। এই যুদ্ধের সময় রুশ সৈন্যরা মাঞ্চুরিয়ায় বহু চীনা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, অসংখ্য চীনা নারীকে ধর্ষণ করে এবং যারা তাদের এসব কর্মকাণ্ডে বাধা দিয়েছিল তাদের মেরে ফেলে[১৫]।
১৯৩৯ সালে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ ও দখল করে এবং ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত দেশটি জার্মান সামরিক দখলদারিত্বের অধীনে থাকে। এই সময়ে জার্মান সৈন্যরা অসংখ্য পোলিশ ইহুদি নারীকে ধর্ষণ করে[১৬]। এছাড়া জার্মান সৈন্যরা ইহুদি ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বী হাজার হাজার পোলিশ নারীকেও ধর্ষণ করে। অসংখ্য পোলিশ নারীকে ধর্ষণের পর গুলি করে হত্যা করা হয়[১৭]।
১৯৪১ সালের ২২ জুন জার্মানি এবং এর মিত্ররাষ্ট্রসমূহ (ইতালি, রুমানিয়া, হাঙ্গেরি ও অন্যান্য রাষ্ট্র) অতর্কিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করার পর সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীতে কর্মরত হাজার হাজার মহিলা ডাক্তার, সেবিকা এবং ফিল্ড মেডিক আগ্রাসী সৈন্যদের হাতে বন্দি হন। তারা জার্মান ও অন্যান্য আক্রমণকারী সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত হন, এবং প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ধর্ষণের পর তাদেরকে হত্যা করা হয়[১৮]। এছাড়া জার্মান সৈন্যরা সোভিয়েত ইউনিয়নে তাদের দখলকৃত অঞ্চলসমূহে অসংখ্য বেসামরিক নারীকে ধর্ষণ করে। জার্মান সৈন্যরা বন্দি সোভিয়েত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের এবং অন্যান্য নারীদের দেহে হিটলারের সৈন্যদের যৌনদাসী শব্দগুচ্ছ লিখে দিত এবং তাদেরকে ধর্ষণ করত[১৯]। পরবর্তীতে সোভিয়েত সৈন্যদের হাতে বন্দি হওয়ার পর কিছু জার্মান সৈন্য সোভিয়েত নারীদের ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যায় অংশ নেয়ার বিষয়ে গর্ব করেছিল[২০]।
জার্মান সৈন্যরা ইহুদি ও স্লাভ জাতিভুক্ত মানুষদেরকে তাদের তুলনায় নিচুশ্রেণির বলে মনে করত, এবং এজন্য এসব জাতির নারীদের ধর্ষণ করাকে তারা অপরাধ বলে মনে করত না[২১]। তারা ধর্ষণকে দখলকৃত অঞ্চলের অধিবাসীদের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল[২২]।
সোভিয়েত ইউনিয়নের স্মোলেনস্ক শহরে জার্মান দখলদার বাহিনী একটি পতিতালয় খুলেছিল, যেখানে শত শত বন্দি সোভিয়েত নারীকে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হত[২৩]। লভিভ শহরে একটি পার্কে জার্মান সৈন্যরা একটি পোশাক কারখানার ৩২ জন নারী শ্রমিককে জনসম্মুখে ধর্ষণ করে। একজন পাদ্রী তাদের অপকর্মে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে তারা তাকে হত্যা করে। বারিসাভ শহরে অগ্রসরমান জার্মান সৈন্যদের কাছ থেকে পলায়নরত ৭৫ জন নারী জার্মান সৈন্যদের হাতে বন্দি হন। জার্মান সৈন্যরা তাদেরকে ধর্ষণ করে এবং এরপর তাদের মধ্যে থেকে ৩৬ জনকে হত্যা করে। এছাড়া হাম্মার নামক একজন জার্মান অফিসারের নির্দেশে জার্মান সৈন্যরা এল. আই. মেলচুকোভা নাম্নী ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীকে একটি জঙ্গলে নিয়ে যায় এবং সেখানে তাকে ধর্ষণ করে। এরপর অন্য যেসব মহিলাকে জঙ্গলের মধ্যে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের সামনে মেলচুকোভার স্তন কেটে ফেলা হয়। কের্চ শহরে জার্মান সৈন্যরা বন্দি নারীদের ওপর বর্বর নির্যাতন ও ধর্ষণ চালায়, তাদের স্তন কেটে ফেলে, পেট চিরে ফেলে, হাত ছিঁড়ে নেয় এবং চোখ উপড়ে ফেলে। পরবর্তীতে সোভিয়েত সৈন্যরা শহরটি মুক্ত করার পর সেখানে তরুণী মেয়েদের ছিন্নভিন্ন দেহে পরিপূর্ণ একটি গণকবর পাওয়া যায়[২৪]।
বিশেষজ্ঞদের ধারণামতে, জার্মানির সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণকালে এক কোটিরও বেশি সংখ্যক সোভিয়েত নারী জার্মান সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন এবং এর ফলে ৭,৫০,০০০ থেকে ১০,০০,০০০ যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়[২৫]:৫৬ [২৬][২৭][২৮]।
১৯৪৪ সালে সোভিয়েত বাহিনী পোল্যান্ড থেকে দখলদার জার্মান বাহিনীকে বিতাড়িত করে সাময়িকভাবে পোল্যান্ড দখল করে। এসময় সোভিয়েত সৈন্যরা অসংখ্য পোলিশ নারীকে ধর্ষণ ও করে[২৯][৩০][৩১][৩২]। ১৯৪৪–১৯৪৭ সালে এক লক্ষেরও বেশি পোলিশ নারী সোভিয়েত সৈন্যদের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়[৩৩]।
১৯৪৫ সালে অগ্রসরমান সোভিয়েত সৈন্যরা হাঙ্গেরি দখল করে। এসময় প্রায় ২,০০,০০০ হাঙ্গেরীয় নারী সোভিয়েত সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন[৩৪][৩৫][৩৬]। হাঙ্গেরীয় মেয়েদের অপহরণ করে সোভিয়েত সেনাঘাঁটিগুলোতে নিয়ে যাওয়া হত, যেখানে তাদের বারবার ধর্ষণ করা হত এবং কখনো কখনো হত্যা করা হত[৩৭]। সোভিয়েত সৈন্যরা এমনকি বুদাপেস্টে অবস্থিত নিরপেক্ষ দেশগুলোর দূতাবাস কর্মীদেরও গ্রেপ্তার ও ধর্ষণ করে, উদাহরণস্বরূপ, সোভিয়েত সৈন্যরা শহরটিতে অবস্থিত সুইডিশ দূতাবাসে আক্রমণ চালিয়ে দূতাবাসের একজন নারী কর্মীকে ধর্ষণ করেছিল[৩৮]।
১৯৪৫ সালের এপ্রিলে সোভিয়েত সৈন্যরা জার্মান-অধিকৃত অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা দখল করে। ভিয়েনা দখলের পরপরই সোভিয়েত সৈন্যরা শহরটিতে অসংখ্য অস্ট্রীয় নারীকে ধর্ষণ করে[৩৯][৪০]।
১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দারাবাদ আক্রমণ ও দখল করে। হায়দারাবাদ দখলের পর ভারতীয় সৈন্যরা বহুসংখ্যক স্থানীয় মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করে[৪১]। ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দারাবাদে ধর্ষণকে যুদ্ধের একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল[৪২]। হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্য হায়দারাবাদের গ্রামগুলোর ওপর চড়াও হত এবং নারীদের ধর্ষণ করত। ভারতীয় সৈন্য হাজির হয়েছিল এমন প্রতিটি গ্রামে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল[৪২][৪৩][৪৪][৪৫]। একটি ঘটনায় ৬ থেকে ৭ হাজার ভারতীয় সৈন্য ও পুলিশ বরাঙ্গল জেলার গ্রামগুলোতে হানা দেয় এবং তিন শত নারীকে ধর্ষণ করে। এদের মধ্যে ৪০ জনকে গণধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়[৪৬][৪৭]।
কোরীয় যুদ্ধ চলাকালে দক্ষিণ কোরীয় সৈন্যরা কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল দক্ষিণ কোরীয় নারীদের ধর্ষণ করত। পরবর্তীতে মার্কিন ও অন্যান্য জাতিসংঘ বাহিনীর সৈন্যরাও বন্দি উত্তর কোরীয় নারীদের ধর্ষণে লিপ্ত হয়। অন্যদিকে, ১৯৫২ সালের ১১ মাসব্যাপী সময়ে উত্তর কোরিয়ায় অবস্থানরত ১,১০,০০০ সদস্যবিশিষ্ট চীনা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ৪১ জন সদস্যকে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল[৪৯]।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন সৈন্যরা ভিয়েতনামী নারীদের ওপর ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের যৌন নির্যাতন চালিয়েছিল[৫০][৫১]।
পশ্চিম পাপুয়ায় ইন্দোনেশীয় আক্রমণের ফলে প্রায় ৩,০০,০০০ থেকে ৪,০০,০০০ পশ্চিম পাপুয়ান নিহত হয় এবং অসংখ্য নারী ইন্দোনেশীয় সৈন্যদের হাতে ধর্ষিত হন[৫২]।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের সহযোগী আধা-সামরিক বাহিনীগুলোর সদস্যরা ২,০০,০০০[৫৩]—৪,০০,০০০[৫৪] বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করে।
১৯৭৪ সালে তুরস্ক কর্তৃক সাইপ্রাস আক্রমণের সময় তুর্কি সৈন্যরা এবং তুর্কি সাইপ্রিয়টরা বহুসংখ্যক গ্রিক সাইপ্রিয়ট নারীকে ধর্ষণ করেছিল[৫৫]।
১৯৭৫ সালে ইন্দোনেশিয়া পূর্ব তিমুর আক্রমণ ও দখল করে এবং ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সেখানে ইন্দোনেশীয় দখলদারিত্ব অব্যাহত থাকে। এসময় হাজার হাজার পূর্ব তিমুরীয় নারী ইন্দোনেশীয় সৈন্য ও পুলিশদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন। পূর্ব তিমুরীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের স্ত্রী, নারী বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং সন্দেহভাজন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নারী সহযোগীরা ছিলেন ধর্ষিত নারীদের একটি বড় অংশ। অনেক সময় ইন্দোনেশীয় সৈন্য বা পুলিশরা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের না পেয়ে তাদের স্ত্রী, বোন বা অন্যান্য নারী আত্মীয়দের ধর্ষণ করত[৫৬]। বন্দি নারীদের অর্ধনগ্ন করে তাদের ওপর নির্যাতন ও ধর্ষণ চালানো হত এবং তাদেরকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হত[৫৭]। বহু নারীকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে বন্দি করে রেখে বারবার ধর্ষণ করা হত[৫৮]।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সংঘাত চলাকালে ১৯৮১ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশি সৈন্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামের ২,৫০০-এরও বেশি সংখ্যক উপজাতীয় নারীকে ধর্ষণ করে। কবিতা চাকমা এবং গ্লেন হিলের মতে, উপজাতীয় নারীদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতার মাত্রা ব্যাপক[৫৯]। সংঘাত চলাকালে বাংলাদেশি নিরাপত্তারক্ষীরা ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্ষণকে যুদ্ধের একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে[৬০]।
১৯৭৯—১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান দখলকালে সোভিয়েত সৈন্যরা অসংখ্য আফগান নারীকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে[৬১]। যেসব নারী সোভিয়েত সৈন্যদের দ্বারা অপহৃত ও ধর্ষিত হন, তারা বাড়ি ফিরলে তাদের পরিবার তাদেরকে 'অসম্মানিত' হিসেবে বিবেচনা করে এবং তারা সামাজিক লাঞ্ছনার শিকার হন[৬২][৬৩]।
১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে ইরাক ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় এবং নভেম্বরে ইরাকি বাহিনী ইরানের খুজেস্তান প্রদেশের খুররমশহর দখল করে নেয়। এসময় ইরাকি সৈন্যরা বহুসংখ্যক ইরানি নারীকে ধর্ষণ করে।
১৯৮৭ সালে শ্রীলঙ্কায় চলমান গৃহযুদ্ধে ভারত সামরিক হস্তক্ষেপ করে এবং দেশটির বিদ্রোহী তামিল দলগুলোকে নিরস্ত্র করার জন্য দেশটিতে 'ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী' মোতায়েন করে। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলমান তিন বছরব্যাপী এই অভিযানকালে ভারতীয় সৈন্যরা অসংখ্য শ্রীলঙ্কান তামিল নারীকে ধর্ষণ করে[৬৪][৬৫][৬৬]।
১৯৯০ সালে ইরাক কুয়েত আক্রমণ ও দখল করে এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত দখল করে রাখে। এসময় প্রায় ৫,০০০ কুয়েতি নারী ইরাকি সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন[৬৭]।
১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ চলাকালে মার্কিন বিমানবাহিনীর ফ্লাইট সার্জন (পরবর্তীতে জেনারেল) রোন্ডা কর্নাম একটি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার পর ইরাকি বাহিনীর হাতে বন্দি হন। বন্দি অবস্থায় তিনি ইরাকি সৈন্যদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হন[৬৮]।
১৯৯৫ সালের প্রথমদিকে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের কর্তৃত্ব নিয়ে আফগান সরকার ও অন্যান্য দলের মধ্যে যুদ্ধ হয়। দলের যোদ্ধারা কাবুলের হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ করে[৬৯]।
১৯৯১ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে সংঘটিত সিয়েরা লিয়নের গৃহযুদ্ধের সময় ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব এবং জোরপূর্বক বিবাহ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা[৭০]। বিদ্রোহী আরইউএফ দলের সদস্যরা অধিকাংশ ধর্ষণের জন্য দায়ী ছিল। এছাড়া এএফআরসি, সিডিএফ এবং সিয়েরা লিয়ন সেনাবাহিনীর সদস্যরা ধর্ষণে লিপ্ত হয়েছিল। আরইউএফ সদস্যরা বহুসংখ্যক নারীকে অপহরণ করে যৌনদাসী কিংবা যোদ্ধা হিসেবে ব্যবহার করে। এছাড়া আরইউএফ সদস্যরা প্রায়ই বেসামরিক নারীদের ধর্ষণ করত[৭১]। আরইউএফ-এর নারী সদস্যরা বাহিনীটির পুরুষ সদস্যদের যৌনসেবা দিতে বাধ্য ছিল। গণধর্ষণ এবং একক ধর্ষণ ছিল দৈনন্দিন ঘটনা[৭২]। পিএইচআর-এর প্রতিবেদন অনুসারে, এই যুদ্ধের সময় সংঘটিত ধর্ষণের ৯৩ শতাংশ আরইউএফ সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল[৭৩]। এক হিসাব অনুযায়ী, সিয়েরা লিয়নের গৃহযুদ্ধের সময় ২,১৫,০০০ থেকে ২,৫৭,০০০ নারী ধর্ষিত হন[৭৪][৭৫][৭৬]।
২০১৬—১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে মিয়ানমার সরকারি বাহিনীর সঙ্গে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সংঘর্ষের ফলশ্রুতিতে মিয়ানমার সৈন্যরা রোহিঙ্গা জনসাধারণের বিরুদ্ধে 'শুদ্ধি অভিযান' আরম্ভ করে। এসময় হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী মিয়ানমার সৈন্যদের হাতে ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হন[৭৭]।
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; Obozy podlegle organom policyjnym
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; SDatner
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; seifert1992
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; Wendy
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; implementing
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; gegenwind
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নিWhat makes this particular memoir unusual is that Soviet officials confirmed at the diplomatic level one of his descriptions – the rape of a woman servant at the Swedish Legation
দেশটিতে যখন সামরিক অভিযান চলছিল, তখন নারীরা অপহৃত হন। মুজাহিদিনদের সন্ধান করার সময় হেলিকপ্টারগুলো আফগান নারীদের দেখতে পেলে শস্যক্ষেত্রে অবতরণ করত। আফগান নারীরা প্রধানত গৃহস্থালির কাজ করলেও তাঁরা ক্ষেতের কাজও নিজেরা করেন অথবা কাজে স্বামীদের সাহায্য করেন। রুশরা এসব নারীদের অপহরণ করে নিয়ে যেত। ১৯৮০ সালের নভেম্বরের মধ্যে লাঘমান ও কামাসহ দেশটির বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের অনেকগুলো ঘটনা ঘটে। কাবুল শহরেও সাধারণত সন্ধ্যার পর রুশরা নারীদের অপহরণ করত এবং ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য সাঁজোয়া যানে নিয়ে যেত। প্রধানত দারুল আমান ও খাইর খান অঞ্চলে সোভিয়েত সেনানাবাসগুলোর কাছে এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটে।
সোভিয়েতরা মুজাহিদিনদের বিরুদ্ধে যে সর্বশেষ অস্ত্রটি প্রয়োগ করে সেটি হলো আফগান নারীদের অপহরণ। হেলিকপ্টারে আসীন সৈন্যরা পুরুষদের অনুপস্থিতিতে শস্যক্ষেত্রে কাজ করা আফগান নারীদের খুঁজে বেড়াত, অবতরণ করত এবং সেসব নারীদের বন্দি করে নিয়ে যেত। কাবুল শহরেও রুশ সৈন্যরা তরুণী মেয়েদের অপহরণ করত। এসবের উদ্দেশ্য ছিল ধর্ষণ, তবে মাঝে মাঝে অপহৃত নারীদের মেরেও ফেলা হত। যেসব নারী বাড়ি ফিরতেন তাঁদের অসম্মানিত বিবেচনা করা হত।