বিশ্বকোষীয় পর্যায়ে যেতে এই নিবন্ধে আরো বেশি অন্য নিবন্ধের সাথে সংযোগ করা প্রয়োজন। |
যৌক্তিকতা হল যুক্তিসঙ্গত হওয়ার গুণ বা অবস্থা – অর্থাৎ কারণের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া অথবা কারণসম্মত হওয়া।[১][২] যৌক্তিকতার দ্বারা একজনের বিশ্বাসের সাথে তার বিশ্বাসের কারণের এবং একজনের কাজের সাথে তার কাজের কারণের সৌসাদৃশ্য বোঝানো হয়। দর্শন,[৩] অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান, ক্রীড়া তত্ত্ব এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে "যৌক্তিকতার" বিভিন্ন নির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে।
জার্মান পণ্ডিত মাক্স ভেবার সামাজিক কাজের একটি ব্যাখ্যা করেছিলেন যাতে যৌক্তিকতার চারটে পৃথক আদর্শগত প্রকৃতিকে তিনি আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছিলেন।[৪]
প্রথমটি যাকে তিনি জোয়েকর্যাশানাল অথবা উদ্দেশ্যমূলক/যান্ত্রিক যৌক্তিকতা বলেন, সেটি পরিবেশে অন্যান্য মানুষ বা বস্তুর ব্যবহারের প্রত্যাশার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই প্রত্যাশাগুলি একজন নির্দিষ্ট কর্তার লক্ষ্যের সীমা পর্যন্ত পৌঁছোনোর উপায় হিসেবে কাজে লাগে, ভেবার এক্ষেত্রে “যৌক্তিকভাবে অন্বেষণ করে এবং হিসেব করে” অর্জিত সীমার কথা বলেছেন। দ্বিতীয়টিকে ভেবার বলেছেন ওয়েট্রার্যাশানাল অথবা মূল্যবোধ/বিশ্বাস ভিত্তিক। এখানে কাজটি এমন পরিস্থিতিতে করা হয় যেখানে যুক্তি কর্তার মধ্যে অন্তর্নিহিত থাকে: কিছু নৈতিক, নান্দনিক, ধর্মীয় অথবা অন্যান্য কারণ যুক্ত থাকে তাতে সাফল্য আসুক বা না-ই আসুক। তৃতীয়টি হল অ্যাফেকচুয়াল বা প্রভাবশালী, যা কর্তার নির্দিষ্ট প্রভাব, অনুভূতি, বা আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় যাকে ভেবার নিজে বলেছেন এটি এমন এক ধরনের যৌক্তিকতা যার কেবল সীমারেখাটুকুকে তিনি “অর্থপূর্ণ ভিত্তিযুক্ত” বলে মনে করতে পারেন। চতুর্থটি হল ঐতিহ্যবাহী বা চিরাচরিত, যা অভ্যাসের মধ্যে প্রোথিত রয়েছে। ভেবার এটা জোর দিয়ে বলেছিলেন যে এইসকল অভিমুখগুলোর কেবলমাত্র একটিকে খোঁজা অস্বাভাবিক: এর প্রকৃতিই হল এরা যুগপৎ সহাবস্থান করে। তাঁর এইধরণের চিহ্নিতকরণ থেকে এটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে তিনি অন্যান্যগুলোর তুলনায় প্রথম দুটিকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এবং তৃতীয় ও চতুর্থগুলোকে প্রথম দুটির সাবটাইপ মনে করেন।
ওয়েবারের এই ধরনের ব্যাখ্যার একটি সুবিধা হল এই যে এটি মূল্যবোধ যুক্ত মূল্যায়নকে এড়িয়ে চলে, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কিছু ধরনের বিশ্বাস অযৌক্তিক। পরিবর্তে, ভেবার বলেন অবলম্বিত উপায় এবং লক্ষ্যবিন্দুর জোয়েকর্যাশানাল অভিমুখের সাথে মিল না হলেও ভিত্তি অথবা কারণ প্রদর্শন করা যেতে পারে - উদাহরণস্বরূপ, ধর্মীয় ও প্রভাবগত ক্ষেত্রে – যেটি ব্যাখ্যা অথবা ন্যায্যতার মানদণ্ড মেনে চলে। একইভাবে বিপরীতটিও সত্য: কোন কোন সময়ে ওয়েট্রার্যাশানাল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত কিছু কাজের উপায়-লক্ষ্যবিন্দু ব্যাখ্যা করা যায় না।
ওয়েবারের যৌক্তিকতার এই নির্মাণ হেবারম্যাসিয়ান (১৯৮৪) দৃষ্টিভঙ্গী কর্তৃক (যেহেতু এটি সামাজিক প্রেক্ষিত বিচ্যুত এবং সামাজিক ক্ষমতার বিচারে এটিকে তত্ত্ব বলা যায় না)[৫] এবং নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গী কর্তৃক (ইগলেটন, ২০০৩) (যেখানে ওয়েবারের যৌক্তিক গঠনকে পুরুষ মূল্যবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং পুরুষ শক্তির রক্ষণাবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা হয়েছে) সমালোচিত হয়েছে।[৬] যৌক্তিকতার বিকল্প অবস্থা (যার মধ্যে রয়েছে বাউন্ডেড র্যাশানালিটি বা বদ্ধ যৌক্তিকতা[৭] এবং ওয়েবারের প্রভাবশালী এবং মূল্যবোধ ভিত্তিক যুক্তি) এটজিওনির (১৯৮৮)[৮] সমালোচনাতেও পাওয়া যায়, যিনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার চিন্তাকে পুনর্নির্মিত করেছেন যেখানে ভেবার প্রদর্শিত বিপরীত অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রমাণ এনেছেন। এটজিওনি ব্যাখা করেছেন যে কীভাবে উদ্দেশ্যমূলক/যান্ত্রিক কারণ আদর্শিক বিবেচনা (মানুষের কেমন ব্যবহার করা ‘উচিত’ সেই ধারণা) এবং প্রভাবশালী বিবেচনার (মানুষের সম্পর্কের বিকাশের একটি সমর্থনকারী ব্যবস্থা) অধীনস্থ হতে পারে।
যুক্তির মনস্তত্ত্বের ক্ষেত্রে, মনস্তাত্ত্বিক এবং সংজ্ঞান বিজ্ঞানীরা মানব যুক্তি নানা অবস্থান দেখিয়েছেন। অন্যান্যদের মধ্যে ফিলিপ জনসন লেয়ার্ড এবং রুথ এম. জে. বায়ার্নের একটি লক্ষণীয় মত হল, মানুষ নীতিগতভাবে যৌক্তিক, কিন্তু বাস্তবে তারা ভুল করে, অর্থাৎ মানুষের যৌক্তিক হবার গুণ রয়েছে, কিন্তু তাদের কর্ম বিভিন্ন কারণের দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে।[৯] তবে, এটা বলা হয় যে, যুক্তির অনেক মানক পরীক্ষার পদ্ধতিগত এবং ধারণাগত সমস্যা রয়েছে; যেমন সংযোগ ভ্রান্তি, ওয়াসন নির্বাচন কাজ অথবা ভিত্তি হার ভ্রান্তি। এর থেকে মনস্তত্ত্বে একটি বিতর্কের জন্ম নিয়েছে যে গবেষকরা তবে কি (কেবল) যুক্তি, সম্ভাবনা এবং পরিসংখ্যানই ব্যবহার করবেন, নাকি ভাল যুক্তির নিয়মানুসারে যৌক্তিক চয়ন তত্ত্বকেই ব্যবহার করবেন। গার্ড গিগেরেঞ্জারের মতো বিরুদ্ধবাদীরা, উচ্চ অনিশ্চয়তাযুক্ত কাজের ক্ষেত্রে বদ্ধ যৌক্তিকতার ধারণাকেই পছন্দ করেন।[১০]
রিচার্ড ব্রান্ডট্ যৌক্তিকতার একটি “সংস্কার করা সংজ্ঞা” দিয়েছিলেন, তিনি যুক্তি দেন যে যদি কারুর ধারণাগুলো সংজ্ঞান-সাইকোথেরাপি দ্বারা সফল হয়, তবে তাকে যুক্তিবাদী বলা যায়।[১১]
রবার্ট অডি যৌক্তিকতার একটি ব্যাপকতর ক্ষেত্র দেখিয়েছিলেন যা যৌক্তিকতার তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক উভয় দিকই অন্তর্ভুক্ত করে।[১২][১৩] এই ক্ষেত্রটি একটি ধারণার ভিত্তিকে কেন্দ্র করে রয়েছে: একটি মানসিক অবস্থাকে তখনই যৌক্তিক বলা যেতে পারে যখন এটি ন্যায্যতার উৎসে “ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত” হয়।[১৩]:১৯ অযৌক্তিক মানসিক অবস্থার, উল্টোদিকে, ভিত্তির যথেষ্ট অভাব থাকে। উদাহরণস্বরূপ, জানালা দিয়ে বাইরে একটা গাছের দিকে তাকালে বোধগম্য অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের মনে বিশ্বাসের যৌক্তিকতার ভিত্তি তৈরি হয় যে একটা গাছ বাইরে রয়েছে।
অডি ভিত্তিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন: তাঁর ধারণায় ন্যায্য বিশ্বাস, অথবা তাঁর ক্ষেত্রে সাধারণভাবে যৌক্তিক অবস্থা দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত করা যেতে পারে: ভিত্তি এবং অতিগঠন।[১৩]:১৩,২৯-৩১ অতিগঠনের ক্ষেত্রে মানসিক অবস্থাটি তার ন্যায্যতা লাভ করে অন্য মানসিক অবস্থা থেকে, এবং ভিত্তিমূলক মানসিক অবস্থা আরো বেশি ভিত্তিমূলক উৎস থেকে ন্যায্যতা লাভ করে।[১৩]১৬-১৮ উদাহরণস্বরূপ, প্রাগুক্ত বিশ্বাস যাতে মনে করা হয়েছিল বাইরে একটি গাছ আছে, তা হল ভিত্তিমূলক যেহেতু এটার একটি ভিত্তিমূলক উৎস রয়েছে – বোধগম্য অভিজ্ঞতা। গাছ মাটিতে বড়ো হয়, এটা জানলে আমরা এখান থেকে ধারণা করতে পারি যে মাটিও বাইরে রয়েছে। এই বিশ্বাসটিও একইভাবে যৌক্তিক যেহেতু এর দৃঢ় ভিত্তি রয়েছে, কিন্তু এটি অতিগঠনের মধ্যে পড়ে যেহেতু এর যৌক্তিকতা অন্য একটি বিশ্বাসের যৌক্তিকতা ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। চাহিদা: বিশ্বাসের মত, একটি শ্রেণিবিন্যাস তৈরি করে: অভ্যন্তরীণ চাহিদাগুলো ভিত্তির মধ্যে পড়ে, কিন্তু যান্ত্রিক চাহিদাগুলো অতিগঠনের মধ্যে পড়ে। যান্ত্রিক চাহিদার সাথে অভ্যন্তরীণ চাহিদার সংযোগ করতে গেলে আরো একটি অতিরিক্ত জিনিসের প্রয়োজন: এমন একটি বিশ্বাস যে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের উপায় হল যান্ত্রিক চাহিদা পূরণ।[১৪]
অডি এটা বলেছেন যে ভিত্তিমূলক মানসিক অবস্থার ন্যায্যতা প্রদানকারী সমস্ত মৌলিক উৎস অভিজ্ঞতা থেকে আসে। বিশ্বাসের ক্ষেত্রে, চার ধরনের অভিজ্ঞতা উৎস হিসেবে কাজ করে: ধারণা, স্মৃতি, অন্তর্বীক্ষণ, এবং যৌক্তিক স্বজ্ঞা।[১৫] অন্যদিকে, চাহিদার যৌক্তিকতার মূল মৌলিক উৎস হেডোনিক অভিজ্ঞতা থেকে আসে: আনন্দ এবং যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা।[১৬]:২০ তাই, উদাহরণস্বরূপ, আইসক্রিম খাওয়ার চাহিদাটা তখনই যৌক্তিক হয় যখন ব্যক্তিটির আইসক্রিমের স্বাদ উপভোগ করবার পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকে, এবং তা যদি না থাকে তবে এটা অযৌক্তিক হয়ে যায়। অভিজ্ঞতার নির্ভরশীলতার ওপর ভিত্তি করে, যৌক্তিকতাকে একধরনের অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে।[১৬]:২১
বিশ্বাস এবং চাহিদার বিপরীতে, ক্রিয়ার কিন্তু কোন নিজস্ব ন্যায্যতার উৎস থাকে না। পরিবর্তে এর যৌক্তিকতা অন্য অবস্থার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়: বিশ্বাস এবং চাহিদার যৌক্তিকতার ওপর। চাহিদাই ক্রিয়াকে পরিচালিত করে। এখানে বিশ্বাস জরুরী, যান্ত্রিক চাহিদার ক্ষেত্রে এই দুটি বিষয়ের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতে।[১৩]:৬২ অডি একক ব্যক্তির মানসিক অবস্থার ফোকাল বা কেন্দ্রী-যৌক্তিকতার সাথে ব্যক্তিসমষ্টির গ্লোবাল বা বিশ্ব যৌক্তিকতার পার্থক্য করেছেন। বিশ্ব যৌক্তিকতা একটি লব্ধ অবস্থা: এটি ফোকাল বা কেন্দ্রী যৌক্তিকতার ওপর নির্ভরশীল।[১২] আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, “বিশ্ব যৌক্তিকতায় তখনই পৌঁছোনো যায় যখন একজন ব্যক্তির যথেষ্ট পরিমাণে দৃঢ় ভিত্তিযুক্ত প্রতিজ্ঞামূলক মনোভাব, আবেগ এবং কর্মের একটি পর্যাপ্ত সংহত ব্যবস্থা থাকে।”[১৩]:২৩২ যৌক্তিকতাকে এই বোধে আপেক্ষিক বলা হয় যে এটা নির্দিষ্ট ব্যক্তির অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে। যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়, তাই যা এক ব্যক্তির কাছে যৌক্তিক সেটা অন্য ব্যক্তির কাছে অযৌক্তিকও হতে পারে।[১২] তাই, একটা বিশ্বাস যৌক্তিক মানেই এই নয় যে সেটা সত্যি।[১৪]
আবুলোফ বলেছেন যৌক্তিকতা একটি “অপরিহার্যরূপে বিবাদিত ধারণা”, যেহেতু এর “যথাযথ ব্যবহার…. অন্তহীন বিতর্কের সাথে যুক্ত।” যৌক্তিকতার অর্থ সংক্রান্ত বিতর্কের ক্ষেত্রে তিনি “চারটি দিক” চিহ্নিত করেছেন:
কোন আচরণটা সবথেকে যুক্তিবাদী, তা নির্ণয় করতে হলে, কয়েকটা মৌলিক অনুমান এবং সমস্যার যৌক্তিক সূত্রায়নের প্রয়োজন আছে। যখন কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য লক্ষ্য বিন্দু স্থির করা হয় বা সেখানে কোন সমস্যা হয়, তখন সমস্তরকম উপলব্ধ তথ্যের মধ্যে (যেমন, সম্পূর্ণ বা অসম্পূর্ণ জ্ঞান) যৌক্তিকতা একটি বড়ো নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়ায়। সবমিলিয়ে, যৌক্তিকতার যার মধ্যে প্রয়োগ করা হয়, সেখানে সূত্রায়ন এবং পটভূমি অনুমান হল আদর্শ। যৌক্তিকতা কিছু দার্শনিকের কাছে আপেক্ষিক:[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] যদি কেউ এমন একটি আদর্শ গ্রহণ করে যেখানে তারই শুধু উপকার হয়, তবে সেই যৌক্তিকতা যে আচরণের সাথে সমতাবিধান করে তা স্বার্থপরতারই সমতুল, অন্যদিকে যদি কেউ এমন একটি আদর্শ গ্রহণ করে যেখানে একটি গোষ্ঠীর সার্বিক উপকার হয়, তবে বিশুদ্ধ স্বার্থপর আচরণ কিন্তু সেখানে অযৌক্তিক হয়ে যায়। তাই এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখলে, যৌক্তিকতা কিন্তু অর্থহীন যদি তার পটভূমির আদর্শ অনুমানকে উল্লেখ করা না হয়; সমস্যাটি কীভাবে তৈরি হচ্ছে এবং গড়ে উঠছে তার আদর্শ অনুমান বিচার অবশ্য প্রয়োজনীয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
কিছু দার্শনিকের মতে, (বিশেষ করে এ. সি. গ্রেলিং) একটা ভালো যুক্রি অবশ্যই আবেগ, ব্যক্তিগত অনুভূতি অথবা যেকোন রকম প্রবৃত্তিরহিত হবে। বিশ্লেষণের যেকোন মূল্যায়ন উচ্চমানের বস্তুগত, যৌক্তিক এবং “যান্ত্রিক” হবে বলেই প্রত্যাশিত। যদি এইসকল ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তার অভাব থাকে অর্থাৎ যদি কোন ব্যক্তি, খুব সামান্য হলেও, ব্যক্তিগত আবেগ, অনুভূতি, প্রবৃত্তি অথবা সাংস্কৃতিক নীতিনৈতিকতার দ্বারা প্রভাবিত হয়, তবে তার বিশ্লেষণকে আত্মগত পক্ষপাত প্রবেশ করানোর কারণে অযৌক্তিক বলা হবে। আধুনিক সংজ্ঞান বিজ্ঞানে এবং স্নায়ুবিজ্ঞানে মানসিক কাজে আবেগের ভূমিকার পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে কোন মানুষই এইসকল মানদন্ড মেনে চলতে সক্ষম নয়, যদি না তার কোন ব্যক্তিগত অনুভূতি না থাকে অথবা তার মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা ভয়ানকরকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে অথবা সে গুরুতর এক মানসিক রোগী হয়। তাই যৌক্তিকতার এই আদর্শবাদী রূপটির সবথেকে ভালো উদাহরণ কম্পিউটার হতে পারে, কোন মানুষ নয়। তবে, পণ্ডিতেরা আদর্শগত দিকটিকে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করার ব্যাপারে আবেদন করতে পারেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
কান্ট তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক কারণের মধ্যে তফাৎ নির্ণয় করেছিলেন। যৌক্তিক তাত্ত্বিক জেসাস মস্টেরিন তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক যৌক্তিকতার মধ্যে সমান্তরাল পার্থক্য নিরুপণ করেছিলেন, যদিও তার মতে, যৌক্তিকতা এবং কারণ একই নয়: কারণ একটি মনস্তাত্ত্বিক শক্তি, অন্যদিকে যৌক্তিকতা হল এমন একটি পন্থা যার দ্বারা আমরা সর্বোত্তম অবস্থায় পৌঁছোতে পারি।[১৮] সংজ্ঞানুযায়ী মানুষ যৌক্তিক নয়, কিন্তু তারা যুক্তিসঙ্গতভাবে চিন্তা করতেও পারে, নাও পারে, এটা নির্ভর করে তারা তাদের গৃহীত চিন্তায় এবং কৃত কর্মে তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক যৌক্তিকতার কোন পন্থা স্পষ্টভাবে অথবা অন্তর্নিহিতভাবে অবলম্বন করছে, তার ওপর।
জ্ঞানমূলক যৌক্তিকতা, অর্থাৎ পক্ষপাতহীন আচরণ দ্বারা বিশ্বাস গড়ার চেষ্টা এবং ইনস্ট্রুমেন্টাল যৌক্তিকতার মধ্যেও তফাৎ নির্ণয় করা হয়।
তাত্ত্বিক যৌক্তিকতার একটি নিয়মানুগ অংশ থাকে যা যৌক্তিক সঙ্গতিতে পরিণত হয় এবং একটি বস্তুগত অংশ থাকে যা স্থুল সহায়তায় পরিণত হয়; এটি নির্ভর করে আমাদের সংকেত শনাক্তকরণ এবং তার ব্যাখ্যা নির্ণয়ের জন্মগত প্রক্রিয়ার ওপর। মোস্টেরিন একদিকে অনিচ্ছাকৃত এবং অন্তর্নিহিত বিশ্বাসের এবং অন্যদিকে ইচ্ছাকৃত এবং স্পষ্ট স্বীকার্যের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন।[১৯] তাত্ত্বিক যৌক্তিকতা আমাদের বিশ্বাসের চেয়ে আমাদের স্বীকার্যগুলোকেই অধিকতর সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। প্রায়োগিক যৌক্তিকতা হল এমন একটি পন্থা যার দ্বারা একজন তার সেরা সম্ভাব্য জীবন পেতে পারে, আপনি আপনার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যে এবং আপনার নিজস্ব পছন্দে যতদূর সম্ভব পৌঁছোতে পারেন।
তর্কের চর্চা তার নিজের গঠনের কারণেই সত্য, যৌক্তিকতার চর্চায় তর্কশাস্ত্রের মৌলিক গুরুত্ব রয়েছে। তর্কশাস্ত্রে যে যৌক্তিকতার চর্চা করা হয়, তা যান্ত্রিক যৌক্তিকতার চেয়ে জ্ঞানমূলক যৌক্তিকতার সঙ্গে অধিকতর সংশ্লিষ্ট অর্থাৎ যৌক্তিক আচরণের দ্বারা বিশ্বাস অর্জনের সাথেই বেশি যুক্ত।
অর্থনীতিতে যৌক্তিকতা একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে এবং এতে এর বেশ কিছু অবস্থান রয়েছে।[২০] প্রথমত, যান্ত্রিক ধারণা – মূলত এই ধারণায় এটা মনে করা হয় যে মানুষ এবং সংগঠনগুলো যান্ত্রিকভাবে যৌক্তিক – অর্থাৎ লক্ষ্যে পৌঁছোতে তারা শুধুমাত্র সেরা কর্মটি গ্রহণ করে। দ্বিতীয়ত একটি অ্যাক্সিওমেটিক বা স্বতঃসিদ্ধমূলক ধারণা যাতে করে মনে করা হয় যে আপনার পছন্দানুসারে এবং বিশ্বাসে যেটা যুক্তিসঙ্গত মনে হবে সেটাই যৌক্তিক। তৃতীয়ত, মানুষ বিশ্বাসের নির্ভুলতার ওপর এবং তথ্যের পূর্ণ ব্যবহারের ওপর নিবদ্ধ হয় – এই দৃষ্টিভঙ্গীতে, একজন ব্যক্তি যদি তার কাছে উপলব্ধ তথ্যের পূর্ণ ব্যবহার না করে বিশ্বাস করে তবে তার বিশ্বাস কখনোই যৌক্তিক হতে পারে না।
মানুষ অথবা সংগঠন “সত্যিই” যৌক্তিক কিনা এবং এইসকল আদর্শকে নিয়মমাফিক আদর্শের মতো ব্যবহার করলে তা আদৌ অর্থপূর্ণ হবে কিনা তা নিয়ে অর্থনৈতিক সমাজবিজ্ঞানে বিতর্ক উত্থাপিত হয়। কেউ কেউ বলে থাকেন, এই ধরনের আদর্শ বদ্ধ যৌক্তিকতার একটি প্রকারস্বরূপ হিসেবেই অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে থাকে।
অন্যান্যরা মনে করেন যে যৌক্তিক নির্বাচন তত্ত্বের অনুসারী কোন যৌক্তিকতা মানব আচরণ বোঝার ক্ষেত্রে একেবারেই অর্থহীন; এই ধারণাটিকে সম্মান দেওয়ার জন্য একটি শব্দ বের করা হয়েছে – হোমো ইকোনমিকাস (অর্থনৈতিক মানুষ: অর্থনৈতিক মডেলে থাকা একটি কাল্পনিক মানুষ যে যুক্তিসঙ্গত উপায়ে সর্বদা কাজ করে কিন্তু নীতিহীন)। আচরণমূলক অর্থনীতির মাধ্যমে অর্থনীতির ক্রিয়াকারীদের মানসিক পক্ষপাতকে স্বীকার করে তারা প্রকৃতই কেমন তার হিসাব রাখা হয়, যান্ত্রিক যৌক্তিকতার মতো একটা আদর্শকে অনুমান করে নেওয়া হয় না।
কৃত্রিম বুদ্ধিতে, একজন যৌক্তিক কর্তা তাকেই বলা হয় যে তার প্রদত্ত জ্ঞান নিয়ে প্রত্যাশিত উপযোগিতাকে সর্বোত্তম পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবেন। এর কাজের ফলাফলের উপকারীতাকেই উপযোগিতা বলা হয়। উপযোগিতা কাজটি নকশাকার কর্তৃক যথেচ্ছভাবে স্থিরীকৃত হয়, কিন্তু এটি একটি “সুসংসাধিত” কাজ হওয়া উচিত, যা সরাসরি পরিমাপযোগ্য ফল, যেমন টাকা জেতা অথবা হারা। প্রতিরক্ষামূলক খেলার জন্য একটি নিরাপদ কর্তা তৈরী করতে, সুসংসাধিত একটি অরৈখিক কাজের প্রয়োজন যাতে হারবার শাস্তির তুলনায় জেতার পুরস্কারের পরিমাণ কম হয়। একটি কর্তা হয়ত তার নিজের সমস্যা ক্ষেত্রের মধ্যে যৌক্তিক, কিন্তু যথেচ্ছ জটিল বিবিধ সমস্যার ক্ষেত্রে কোন যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া বাস্তবে সম্ভব নাও হতে পারে। যুক্তির মনস্তত্ত্বে মানুষের চিন্তার যৌক্তিকতা একটা প্রধান সমস্যা।[২১]
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের চর্চায় “যৌক্তিকতা” ব্যবহারের ভালো দিক নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে। কিছু পণ্ডিতেরা এটিকে অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেছেন।[২২] অন্যান্যরা এর আরো সমালোচনা করেছেন।[২৩] তবুও, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে “যৌক্তিকতার” ব্যাপক এবং অবিরাম ব্যবহার তর্কাতীত। এই ক্ষেত্রে “যৌক্তিকতার” ব্যবহার সর্বব্যাপী। আবুলোফ দেখেছেন “বিদেশ নীতির” ৪০% জ্ঞানধর্মী উল্লেখেই “যৌক্তিকতার” কথা বলা আছে – এবং একবিংশ শতকের প্রাসঙ্গিক শিক্ষাসংক্রান্ত প্রকাশনীর অর্ধেক ক্ষেত্রেই এই উল্লেখ রয়েছে। তিনি আরো বলেছেন যে যখন নির্ভেজাল নিরাপত্তা ও বিদেশ নীতির ক্ষেত্রের কথা বলা হয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে যৌক্তিকতার প্রয়োগ “দুর্নীতি” অর্থে ব্যবহৃত হয়: যৌক্তিকতা ভিত্তিক বর্ণনা প্রধানত হয় মিথ্যে অথবা তাকে মিথ্যে করা যায় না; অনেকে “যৌক্তিকতা” কথাটির ব্যবহার করে তাকে ঠিকমত ব্যাখ্যা করতে পারে না; এবং রাজনীতিতে এই ধারণাটি “আমরা এবং ওরা”র মধ্যে প্রভেদ করতে হামেশাই ব্যবহার করা হয়।[১৭]