রাক্ষস হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী একপ্রকার মানুষরূপী মাংসভুক প্রাণী। রাক্ষসরা পরবর্তীকালে বৌদ্ধ পুরাণে স্থান লাভ করে। রাক্ষসদের মানুষ ভক্ষণ করার কথাও বর্ণিত আছে। স্ত্রী রাক্ষসকে রাক্ষসী বলা হয়। কখনো কখনো অসুর এবং রাক্ষসবৃন্দ একই রূপে আখ্যায়িত হয়।
বলা হয় যে, সত্য যুগের শেষের দিকে ব্রহ্মার নিদ্রাবস্থার নিঃশ্বাস থেকে রাক্ষসদের সৃষ্টি হয়েছিল। রাক্ষসরা জন্মানোর সাথে সাথেই এত রক্তপিপাসু হয়ে পড়ে যে, তারা তাদের সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে ভক্ষণ করতে উদ্যত হয়। ব্রহ্মা চিৎকার করেন 'রক্ষ মাম্!' , (সংস্কৃতে যার অর্থ রক্ষা করো) এবং বিষ্ণু তাকে রক্ষা করতে প্রকট হন। ব্রহ্মার এই আর্তনাদ থেকেই তাদের নাম হয় রাক্ষস। বিষ্ণু রাক্ষসদেরকে পৃথিবী থেকে বিতাড়িত করেন।
তাদের ভাষিক উৎস ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৮৭ নং সূক্তে পাওয়া যায়। তাতে তাদেরকে মানুষের মাংস ভক্ষণ করা যাতুধান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।[১]
কোনো কোনো জায়গায়, রাক্ষসদেরকে ঋষি কশ্যপের বংশজাত বলা হয়, তবুও শৈল্পিক কারণে বেদে তেমন কোনো উল্লেখ নেই। সম্ভবত, বেদ সৃষ্টির সময় রাক্ষসরা কশ্যপের বংশের হওয়ার কথা প্রচলিত ছিল যেহেতু বংশের ধারণা বেদের লিখনশৈলীর জন্য সম্পূর্ণ বাইরের ছিল, তাই হয়তো পুরাণাদিতে রাক্ষসদেরকে কশ্যপের বংশধর বলা হলেও বেদে সেই কথা নেই।
কশ্যপের বিবাহ প্রজাপতি দক্ষর ১৩ জন কন্যার সাথে হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল অদিতি, দিতি, দনু এবং সুরস।
রাক্ষসদেরকে দেখতে সর্বদাই কুৎসিত বলে দর্শানো হয় - তারা বিশাল দেহী, ভয়ংকর। তাদের মুখ থেকে দুটি বিষদাঁত বেরিয়ে থাকে এবং তাদের বড় বড় নখ আছে। তারা স্বার্থপর, জন্তুর মতো এবং মানব ভক্ষণকারী ছিল বলা হয়। তারা মাংসের গন্ধ সনাক্ত করতে পারত। অধিক ভয়ানক রাক্ষসদের চোখ এবং চুল জ্বলন্ত ছিল, এবং তারা হাতে করে মানুষের রক্ত গ্রহণ করত। তারা ওড়ার, অদৃশ্য হওয়ার কৌশল জানত। তারা মায়ার বলে আকার পরিবর্তন এবং বিভিন্ন জন্তুর রূপ ধারণ করতেও জানত। স্ত্রী রাক্ষসদেরকে রাক্ষসী বলা হয়।[২]
রামায়ণ এবং মহাভারতের যুগে রাক্ষসরা ছিল এক জনবহুল গোষ্ঠী। ভাল এবং মন্দ, দুই প্রকারের রাক্ষসের উদাহরণ পাওয়া যায়। রাক্ষসরা যুদ্ধে ভাল এবং মন্দ, দুই পক্ষের হয়েই যুদ্ধ করেছিল। তারা অতি শক্তিশালী যোদ্ধা, নিপুণ জাদুকর এবং মায়াবী ছিল। রাক্ষসরা মায়ার দ্বারা এমন দৃশ্য সৃষ্টি করত যা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠত বা সত্যি না জানার জন্য একেবারে সত্যিকারের মত লাগত। কিছু রাক্ষসকে মানব ভক্ষণকারী বলে আখ্যায়িত করা হয়।
রাক্ষসদেরকে প্রায়শই সৈনিকের রূপে দেখানো হয়েছে। পরবর্তীতে, কিছু রাক্ষস অত্যন্ত বল অর্জন করে নায়ক বা প্রতিনায়ক হিসাবে খ্যাতিলাভ করেছিল।
রাক্ষসদের সঙ্গে মানবদের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হত৷ মহর্ষি পুলস্তর পুত্র বিশ্রবা রাক্ষসী কৈকষীকে বিবাহ করেন৷ তাদের তিন পুত্র রাবণ, কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ এবং এক কন্যা শূর্পনখা৷
লঙ্কার যুদ্ধ রাবণের রাক্ষসসেনা এবং রামের বানরসেনার মধ্যে হয়েছিল।
রামায়ণে কবন্ধ, তাড়কা, শূর্পনখা, মারীচ, সুবাহু, খর, ইন্দ্রজিৎ ইত্যাদি রাক্ষসের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
মহাভারতের পাণ্ডব নায়ক ভীম হিড়িম্বা নামে এক রাক্ষসীর স্বামী ছিলেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ঘটোৎকচ পাণ্ডবদের হয়ে প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করে। কৌরবপক্ষীয় সেনাপতি কর্ণের ছোঁড়া দৈবী শক্তি অস্ত্রে তার মৃত্যু ঘটে। তার পত্নী ছিল অহিলাবতী এবং পুত্র বরবরিকা। হিমাচল প্রদেশ-এর মানালীতে ঘটোৎকচের একটি মন্দির আছে।
দুই পক্ষেই রাক্ষস নায়কদের বিশেষ ভূমিকা ছিল।
পদ্ম সূত্র-এ বুদ্ধদেবের কিছু রাক্ষসকন্যাকে সূত্রটির সুরক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করার কথা উল্লেখ আছে। তারা এটির সুরক্ষার জন্য শিষ্যবর্গকে জাদুকরী ধরনীও শিখিয়েছিল।[৭]
জাপানী পরম্পরায় রাক্ষসদেরকে রাচেৎচু(羅刹) এবং চীনা পরম্পরায় রাক্ষসদেরকে লুও সা (羅剎) বলা হয়।
ইন্দোনেশিয় এবং মালয় ভাষায় রাক্সাসাএর অর্থ "বিশালকায় দৈত্য", "প্রকাণ্ড" বা "বৃহৎ এবং শক্তিশালী" বা "রাক্ষস"।[৮]
বাংলা ভাষায় রাক্ষস-এর অর্থ এমন ব্যক্তি যে কোনো লাজলজ্জা বা থামবার প্রয়োজন অনুভব না করেই খায়। তেমনি ভাবেই, ইন্দোনেশিয় এবং মালয় ভাষায় " রাকুস "-এর অর্থ হয়েছে লোভী।[৮]