রামগোপাল ঘোষ | |
---|---|
![]() | |
জন্ম | ১৮১৫ |
মৃত্যু | ২৫ জানুয়ারি ১৮৬৮ |
পেশা | সমাজ সংস্কারক |
রামগোপাল ঘোষ (১৮১৫ - ২৫ জানুয়ারি, ১৮৬৮) ছিলেন ইয়ং বেঙ্গল গ্রুপের একজন নেতা, একজন সফল ব্যবসায়ী, বাগ্মী ও একজন সমাজ সংস্কারক। তাঁকে ভারতের ডেমোস্থেনেস বলা হয়।[১][২] ঘোষ জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটনকে মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠায় সাহায্যকারী অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন।[৩]
রামগোপাল ঘোষের আদিনিবাস অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার মগরার নিকটে বাগাটিতে।[৪] তার বাবা গোবিন্দচন্দ্র ঘোষের কলকাতার চায়না বাজারে একটি ছোট দোকান ছিল। তার মাতামহ দেওয়ান রামপ্রসাদ সিংহ, কলকাতার কিং হ্যামিলটন অ্যান্ড কোম্পানির অফিসে কাজ করতেন। রামগোপাল ঘোষ মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।.[৫]
তার ছোটবেলা নিয়ে দুটি মত প্রচলিত আছে। প্রথম মতানুসারে, তিনি প্রথমে শেরবোর্নস স্কুলে যোগদান করেন ইংরেজি শিক্ষালাভের জন্য। এ সময়ে হরচন্দ্র ঘোষ, যিনি পরবর্তীতে অগ্রগণ্য ডিরোজিও সদস্য হয়ে ওঠেন, হিন্দু কলেজের শিক্ষার্থী থাকাবস্থায় তার এক আত্মীয়কে বিয়ে করেন। তরুণ রামগোপালের আগ্রহ দেখে হরচন্দ্র তার বাবাকে রামগোপালকে হিন্দু কলেজে ভর্তি করে দিতে বলেন। তার বাবার সন্তানকে হিন্দু কলেজে পড়ানোর সঙ্গতি ছিল না। তবে, কিং হ্যামিল্টন এণ্ড কোম্পানি জনাব রজার্স তার ভর্তির জন্য অর্থ দিতে রাজি হলে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। অন্যমতে, জনাব রজার্স শুরু থেকেই তাকে হিন্দু কলেজে পড়ার টাকা দেন।[৫]
রামগোপাল ঘোষকে এভাবে বেশিদিন চলতে হয় নি। তার মেধা ডেভিড হেয়ারের নজরে পড়ে এবং তিনি তাকে বিনামূল্যে অধ্যয়নের সুযোগ করে দেন। এ সময়ে তিনি ডিরোজিওর ক্লাসে যোগ দেন। তিনি রামতনু লাহিড়ীসহ অন্যান্য ডিরোজিও শিষ্যদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন। তার দায়িত্বশীলতা ডিরোজিওর নজর কাড়ে এবং তিনি রামগোপালকে শ্রেণীর নির্ধারিত সময়ের বাইরে দর্শন ও কবিতা পড়ান।[৫]
ডিরোজিও অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠার পর রামগোপাল ঘোষ এর অগ্রণী সদস্য হয়ে ওঠেন। অ্যাসোসিয়েশনের বৈঠকে তিনি ইংরেজি বলায় স্বচ্ছন্দ হয়ে ওঠেন। এই বৈঠকগুলোতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক স্যার এডওয়ার্ড রায়ান ও বাংলার লেফটেনেণ্ট গভর্নর ডব্লিউডব্লিউ বার্ডের মত ব্যক্তিত্ব যোগ দিতেন। তারা রাজগোপালের প্রতিভার উষ্ণ প্রশংসা করতেন।[৫]
রামগোপাল ঘোষকে লেখাপড়া অসমাপ্ত রেখেই কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হয়। ডেভিড হেয়ারের তদবিরে, তিনি জোসেফ নামের এক ইহুদি ব্যবসায়ীর সাথে কাজ করতে শুরু করেন। পরে কেলসান নামে আরেক ইহুদি ব্যক্তি ফার্মে যোগ দিলে ঘোষ “মধ্য-ব্যক্তি” হিসেবে তাদের সাথে কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি কেলসালের সাথে কেলসাল, ঘোষ অ্যাণ্ড কোং নামে ব্যবসা শুরু করেন এবং ১৮৪৮ সালে একাই আর.জি.ঘোষ অ্যাণ্ড কোম্পানি নামে ব্যবসা শুরু করেন। এভাবে তিনি প্রচুর সম্পদের মালিক হন।[৫]
অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করলেও রামগোপাল ঘোষ তার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখেন এবং প্রয়োজনের সময় তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতেন। তিনি বন্ধু রামতনু লাহিড়ী ও রসিককৃষ্ণ মল্লিককে সাহায্য করেন।[৫]
তার দাদার মৃত্যুর সময়ে লোকজন তাকে হিন্দু ধর্ম না পালনের জন্য দোষারোপ করে এবং তাকে একঘরে করে রাখার কথা বলে। এ সময় তার পিতা তাকে জনসমক্ষে হিন্দু ধর্মের প্রতি তার আস্থার কথা ঘোষণা করতে বলেন। উত্তরে তিনি বলেন, "আমি আপনার কথা মান্য করার জন্য সর্বদা রাজি ও এজন্য কষ্ট সহ্য করতেও প্রস্তুত, তবে আমি মিথ্যা বলতে পারব না"। আরেকবার, তার ব্যবসা বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়ে এবং দেউলিয়া হয়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। বন্ধুরা তাকে তার সম্পত্তি অন্যদের কাছে সরিয়ে দেবার পরামর্শ দিলেও তিনি অসৎ উপায় অবলম্বন করতে চান নি। তার ব্যক্তিগত আত্মসম্মানবোধকে আধুনিক ইতিহাসবেত্তারাও প্রশংসা করেন।[৫][৬]
ব্ল্যাক অ্যাক্টের ওপর রামগোপালের বক্তৃতায় এশীয় ও ইউরোপীয় মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করে। বক্তৃতায় বিচার ব্যবস্থায় এশীয় ও ইউরোপীয়দের এক শ্রেণীতে আনার আহ্বান জানানো হয় যা ছিল একটি মাইলফলক।[২] ১৮৫৩ সালে তিনি প্রথম ব্যক্তি হিসেবে সরকারি চাকুরিতে ভারতীয়দের প্রবেশাধিকারের দাবি তুলে ধরেন। ১৮৫৪ সালের ২৯ মার্চ তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব করেন। তিনি দ্বারকানাথ ঠাকুরের চার শিক্ষার্থীকে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য ইংল্যান্ডে পাঠানোকে সমর্থন করেন।[১]
ঘোষ জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেবার পাশাপাশি লেখালেখি করেন। তার পুস্তিকা "এ ফিউ রিমার্কস অন সার্টেইন ড্রাফ্ট এ্যাক্টস, কমনলি কল্ড ব্ল্যাক এ্যাক্টস" ইংরেজদের ক্ষুব্ধ করে এবং অ্যাগ্রি-হর্টিকালচারাল সোসাইটির সহ-সভাপতির পথ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়।[৫] তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের গঠনে ভুমিকা রাখেন এবং কমিটির একজন সদস্য ছিলেন।[৭]
রাজনৈতিক সক্রিয়তার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য কাজেও যুক্ত ছিলেন। তার কারণে ডেভিড হেয়ারের একটি মূর্তি ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পায়, যা আজও প্রেসিডেন্সি কলেজের আঙ্গিনায় রয়েছে। কোন উদ্দেশ্যে এক মাসের বেতন দান করা প্রথম ব্যক্তিত্ব তিনি।[৫] শেষ জীবনে তিনি বন্ধুদের দেয়া ৪০,০০০ টাকা মওকুফ করে দেন।[৫]