জ্যামিতির ভাষায় রেখাংশ হলো কোনো রেখার এমন একটি অংশ বা খণ্ডাংশ যা ঐ রেখার উপর অবস্থিত দুটি স্বতন্ত্র প্রান্ত বিন্দুর মাধ্যমে আবদ্ধ এবং যেখানে রেখাটির এই বিন্দু দুটির মধ্যে থাকা প্রতিটি বিন্দুই উপস্থিত থাকে। রেখার এই স্বতন্ত্র বিন্দু দুটি যারা রেখাংশের সীমানা নির্ধারণ করে তাদেরকে রেখাংশের প্রান্তবিন্দু নামে অভিহিত করা হয়। একটি বদ্ধ রেখাংশ-এ এর উভয় প্রান্তবিন্দু অন্তর্ভুক্ত থাকে, অপরদিক একটি খোলা রেখাংশ-এ এর উভয় প্রান্তবিন্দু অনুপস্থিত থাকে এবং একটি অর্ধ-খোলা রেখাংশ কেবল একটিই প্রান্ত বিন্দু ধারণ করে। জ্যামিতিতে রেখাংশকে সাধারণত প্রান্তবিন্দু দুটির জন্য ব্যবহৃত প্রতীকের উপরে একটি রেখা বা টান চিহ্ন দিয়ে সূচিত করা হয় (যেমন: )।[১]
ত্রিভুজ বা বর্গক্ষেত্রের বাহুসমূহ রেখাংশের উদাহরণের মধ্যে পড়ে। আরো সাধারণভাবে বলা যায়, যদি কোন রেখাংশের উভয় প্রান্তবিন্দু একটি বহুভুজ বা একটি বহুতলকের দুটি শীর্ষবিন্দু হয় এবং এই শীর্ষবিন্দু দুটি পরস্পর সন্নিহিত হয় তাহলে এই রেখাংশটি সেই বহুভুজ বা বহুতলকটির হয় একটি কিনারা রেখা হবে অথবা এটি হবে একটি কর্ণ। যখন কোনো রেখাংশের উভয় প্রান্তবিন্দু একটি বক্ররেখার উপর (যেমন: বৃত্তের উপর) অবস্থান করে, তখন একে ঐ বক্ররেখার জ্যা বলা হয়।
যদি অথবা -এর উপর V একটি ভেক্টর স্পেস হয় এবং L উপসেটটি V-এর একটি উপসেট হয়, তাহলে L একটি রেখাংশ হবে যদি ভেক্টরগুলোর জন্য L-কে নিম্নোক্তভাবে পরামিতিকৃত করা যায়:
এই ক্ষেত্রে, u এবং u + v ভেক্টর দুটোকে বলা হবে L-এর প্রান্তবিন্দু।
কখনো কখনো "খোলা" ও "বদ্ধ" রেখাংশের মধ্যে পার্থক্য করার প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে, বদ্ধ রেখাংশ উপর্যুক্ত উপায়ে সংজ্ঞায়িত হবে আর খোলা রেখাংশকে বদ্ধ রেখাংশের একটি উপসেট হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হবে এবং একে ভেক্টরগুলোর জন্য নিম্নোক্তভাবে পরামিতিকরণ করা যাবে:
একইভাবে রেখাংশ হলো দুটি বিন্দুর Convex hull। তাই কোনো রেখাংশকে রেখাংশটির প্রান্তবিন্দুদ্বয়ের একটি উত্তল সমাবেশ হিসেবে প্রকাশ করা যায়।
জ্যামিতির শর্তানুসারে, কোনো বিন্দু B-কে ভিন্ন দুটি বিন্দু A এবং C-এর মধ্যে অবস্থিত এমন একটি বিন্দুরূপে সংজ্ঞায়িত করা যাবে, যদি AB দূরত্বের সাথে BC দূরত্বের সমষ্টি AC দূরত্বের সমান হয়। ফলে, সেটের অধীনে, A = (ax, ay) এবং C = (cx, cy) প্রান্তবিন্দুবিশিষ্ট রেখাংশ হচ্ছে বিন্দুসমূহের নিম্নোক্ত সমাবেশ:
জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধ সম্পর্কিত নাড়াঘাটায়-আলোচনায় মধ্যবর্তীতার ধারণাটিকে হয় একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক স্বতঃসিদ্ধকে পূরণের বা মেনে চলার নিমিত্তে অনুমান করা হয়, অথবা একে (একটি স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহৃত) কোনো রেখার একটি আইসোমেট্রির পরিপ্রেক্ষিতে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
রেখাংশসমূহ অন্যান্য তত্ত্বগুলোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি উত্তল সেটের ক্ষেত্রে, যে রেখাংশটি সেটটির যেকোনো দুটি বিন্দুকে সংযুক্ত করে সেই রেখাংশটি ঐ সেটের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত থাকে। এটি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এটি উত্তল সেটের কিছু বিশ্লেষণকে একটি রেখাংশের বিশ্লেষণে রূপান্তরিত করে। সর্বসম রেখাংশের সংযোজনে অথবা সমান দৈর্ঘ্যের রেখাংশের সংযোজনে রেখাংশ সংযোজনের স্বীকার্যটি ব্যবহার করা যেতে পারে এবং এর ফলে রেখাংশগুলোকে সর্বসম করতে অন্যান্য রেখাংশকে অন্য কোনো বিবৃতিতে প্রতিস্থাপনেও এই স্বীকার্যটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
একটি রেখাংশকে কোনো একটি উপবৃত্তের একটি ডিজেনারেট ঘটনারূপেও দেখা যেতে পারে, যেখানে উপবৃত্তের অর্ধগৌণ অক্ষটি শূন্যের দিকে, উপকেন্দ্রগুলো রেখাংশের প্রান্তবিন্দুগুলোর দিকে এবং উৎকেন্দ্রিকতা একের দিকে ধাবিত হয়। উপবৃত্তের একটি আদর্শ সংজ্ঞানুসারে, উপবৃত্ত হচ্ছে সেই সকল বিন্দুর সেট, যেখানে এই বিন্দুগুলোর ক্ষেত্রে, উপকেন্দ্রদ্বয় থেকে একটি বিন্দুর দূরত্বের যোগফল একটি ধ্রুবক হবে; এবং যে বিন্দুগুলোর ক্ষেত্রে এই ধ্রুবকটি উপকেন্দ্র দুটির মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান হয়, সেই ক্ষেত্রে এই দূরত্বটি হবে রেখাংশ। এই উপবৃত্তের একটি সম্পূর্ণ কক্ষপথ রেখাংশটিকে দুইবার অতিক্রম করে। এটা একটি ডিজেনারেট কক্ষপথ হলে, এটি একটি ব্যাসার্ধীয় উপবৃত্তাকার সঞ্চারপথ হবে।
বহুভুজ এবং বহুতলকের কিনারা রেখা ও কর্ণরূপে রেখাংশের অস্তিত্বের পাশাপাশি অন্যান্য জ্যামিতিক আকৃতি সংশ্লিষ্ট বহুবিধ স্থানে একে খুঁজে পাওয়া যায়।
একটি ত্রিভুজে নানাবিধ রেখাংশের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। বহুল প্রচলিত যেসব রেখাংশকে ত্রিভুজে অন্তর্ভুক্ত করা যায় সেগুলোর কয়েকটির মধ্যে রয়েছে: এর উচ্চতা রেখাংশ তিনটি (যাদের প্রত্যেকে ত্রিভুজের একটি বাহু বা বাহুর বর্ধিতাংশ এবং বিপরীত শীর্ষবিন্দুর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে), এর মধ্যমা তিনটি (যাদের প্রত্যেকে বাহুর মধ্যবিন্দুর সাথে বিপরীত শীর্ষবিন্দুর সংযোগ স্থাপন করে), এর বাহুগুলোর লম্ব সমদ্বিখণ্ডক তিনটি (বাহুর মধ্যবিন্দু থেকে অঙ্কিত এমন একটি লম্বরেখা যা বিপরীত বাহুকে কোন একটি বিন্দুতে ছেদ করে) এবং রয়েছে অন্তঃকোণের সমদ্বিখণ্ডক তিনটি (একটি শীর্ষবিন্দু থেকে বিপরীত বাহুর উপর টানা এমন রেখাংশ যা কোণটিকে সমদ্বিখণ্ডিত করে)। প্রতিটি ক্ষেত্রেই, এই রেখাংশগুলোর দৈর্ঘ্যের সাথে অন্যান্য রেখাংশের দৈর্ঘ্যের মধ্যে নানাবিধ সমতা রয়েছে, উপরন্তু রয়েছে নানাবিধ জ্যামিতিক অসমতা।
ত্রিভুজ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য যেসব রেখাংশ রয়েছে তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যায় বিভিন্ন ত্রিভুজ কেন্দ্রের একটির সাথে অপরটির সংযোগকারী রেখাংশসমূহকে। বিশেষ কয়েকটি ত্রিভুজ কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে অন্তঃকেন্দ্র, পরিকেন্দ্র, নববিন্দু কেন্দ্র, ভরকেন্দ্র, লম্বমেরু এবং লম্বকেন্দ্র ইত্যাদি।
চতুর্ভুজের বাহু এবং কর্ণ ছাড়াও আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ যেসব রেখাংশ রয়েছে তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যায় এর দ্বিমধ্যমা দুটিকে (বিপরীত বাহুগুলোর মধ্যবিন্দুর সংযোজক রেখাংশ) এবং এর উচ্চতা চারটিকে (প্রতিটি বাহুর মধ্যবিন্দু থেকে বিপরীত বাহুর উপর অঙ্কিত লম্ব রেখাংশ)।
কোনো সরল রেখার যে খণ্ডাংশ বৃত্তের বা উপবৃত্তের দুটি বিন্দুকে সংযুক্ত করে তাকে জ্যা বলা হয়। একটি বৃত্তের এমন যেকোনো জ্যা যে জ্যা অপেক্ষা আরও বড় কোনো জ্যা থাকে না তাদেরকে বলা হয় ব্যাস এবং বৃত্তের কেন্দ্রের (তথা ব্যাসের মধ্যবিন্দুর) সাথে বৃত্তের উপরস্থ একটি বিন্দুর সংযোগকারী যেকোনো রেখাংশকে বলা হয় ব্যাসার্ধ।
একটি উপবৃত্তের দীর্ঘতম জ্যা, যা দীর্ঘতম ব্যাসও, তাকে বলা হয় প্রধান অক্ষ এবং প্রধান অক্ষের মধ্যবিন্দু (উপবৃত্তের কেন্দ্র) থেকে প্রধান অক্ষের যে কোনও প্রান্তবিন্দু পর্যন্ত রেখাংশকে বলা হয় অর্ধ-প্রধান অক্ষ। একইভাবে, উপবৃত্তের ক্ষুদ্রতম ব্যাসকে বলা হয় গৌণ অক্ষ, এবং গৌণ অক্ষের মধ্যবিন্দু (উপবৃত্তের কেন্দ্র) থেকে এর যে কোনো একটি প্রান্তবিন্দু পর্যন্ত রেখাংশকে বলা হয় অর্ধ-গৌণ অক্ষ। একটি উপবৃত্তের যে সকল জ্যা প্রধান অক্ষের উপর লম্ব এবং উপবৃত্তটির উপকেন্দ্রগুলোর একটির মধ্য দিয়ে গমন করে তাদেরকে উপবৃত্তটির ল্যাটাস রেক্টাম বলা হয়। ইন্টারফোকাল রেখাংশ উপকেন্দ্র দুটির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।
যখন কোনো রেখাংশের উপর একটি ওরিয়েন্টেশন বা দিক আরোপ করা হয় তখন একে দিকযুক্ত রেখাংশ বলা হয়। এটি (সম্ভবত বল দ্বারা সৃষ্ট) একটি জ্যামিতিক অনুবাদের অথবা জ্যামিতিক সরণের কথা বলে। মাত্রা এবং দিক হলো একটি সম্ভাব্য পরিবর্তনের সূচক বা নির্দেশক। দিকযুক্ত কোনো রেখাংশকে যেকোনো এক দিকে অর্ধ-অসীমভাবে প্রসারিত করা হলে একটি রশ্মি এবং একে উভয় দিকে অসীমভাবে প্রসারিত করা হলে একটি দিকযুক্ত রেখা উৎপন্ন হয়। এই বিষয়টি ইউক্লিডীয় ভেক্টরের ধারণার মাধ্যমে গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে আত্মীয়করণ করা হয়েছে।[২][৩] সাধারণত একই দৈর্ঘ্য এবং ওরিয়েন্টেশনযুক্ত "সমতুল্য" যে কোনও জোড়া গঠনের মাধ্যমে দিকযুক্ত সকল রেখাংশের সমষ্টি বা সংকলনকে (collection) সংকুচিত করা হয়।[৪] দিকযুক্ত রেখাংশের জন্য ১৮৩৫ সালে ইটালীয় গণিতবিদ জিউস্তো বেলাভিটিসের ইকুইপোলেন্সের ধারণা সূচনা করার সময় থেকে সমতুল্যতার অন্বয়ের এই প্রয়োগ শুরু হয়েছে।
সরলরেখার খণ্ডাংশের (অর্থাৎ রেখাংশের) উপর্যুক্ত ধারণার অনুরূপভাবে জ্যামিতিক চাপ রেখাকেও (arc) একটি বক্ররেখার খণ্ডাংশরূপে সংজ্ঞায়িত করা যায়।
গণিতে বল হচ্ছে এমন একটি ঘনবস্তু বা ঘনবস্তুজাত কাঠামো যা একটি গোলক দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। এহেন বলকে একমাত্রিক স্থানের একটি রেখাংশরূপে সংজ্ঞায়িত করা যায়।