কোরীয় সংঘাতেরের অংশ | |
তারিখ | ৯ অক্টোবর ১৯৮৩ |
---|---|
সময় | সকাল ১০:২৫ (ইউটিসি+৬:৩০) |
অবস্থান | শহিদ সমাধিসৌধ, রেঙ্গুন, বার্মা |
স্থানাঙ্ক | ১৬°৪৮′০৯″ উত্তর ৯৬°০৮′৫২″ পূর্ব / ১৬.৮০২৫৩৬° উত্তর ৯৬.১৪৭৬৫৮° পূর্ব |
নিহত | ২১ |
আহত | ৪৬ |
সন্দেহভাজন | সম্ভাব্য ৩ জন উত্তর কোরীয় আততায়ী (কাং মিন-চুলসহ আরও দুইজন) |
দণ্ডাজ্ঞা | কাং মিন-চুল: যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অন্যান্য: মৃত্যুদণ্ড |
রেঙ্গুন বোমাহামলা হলো দক্ষিণ কোরিয়ার পঞ্চম রাষ্ট্রপতি চান ডু-হোয়ানকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি বোমা হামলা।[১] বার্মার রেঙ্গুন শহরে ১৯৮৩ সালের ৯ অক্টোবর এই ঘটনা ঘটে। হামলার ঘটনায় উত্তর কোরিয়া সম্পৃক্ত ছিল।[২] হামলায় চা ডু-হোয়ান ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও ২১ জন নিহত ও ৪৬ জন আহত হন। বোমা হামলায় সন্দেহভাজন একজন পরবর্তীতে মারা যান। আটককৃত অপর দুইজনের একজন উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনীর সদস্য হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন।[২]
১৯৮৩ সালের ৯ অক্টোবর, দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি চান ডু-হোয়ান রাষ্ট্রীয় সফরে বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনে অবতরণ করেন। সফরসূচিতে ১৯৪৭ সালে নিহত বার্মার জাতির জনক অং সানের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত শহিদ সমাধিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের কথা ছিল।[৩] রাষ্ট্রপতির সফরসঙ্গীদের অনেকে একত্রিত হওয়ার সময় সমাধিসৌধ প্রাঙ্গণে নির্মিত মঞ্চের ছাদে লাগানো তিনটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের আঘাতে ছাদের নিচে থাকা ২১ জন নিহত হন এবং ৪৬ জন আহত হন।[৩] এই হামলায় দক্ষিণ কোরিয়ার চারজন শীর্ষ নেতা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী লি বুম সুক, জ্বালানিসম্পদ মন্ত্রী সুহ সাং-চুল, উপ-প্রধানমন্ত্রী ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনামন্ত্রী সুহ সুক-জুন এবং বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী কিম ডং-হুই নিহত হন।[৪] এছাড়াও রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, সাংবাদিক ও নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যসহ আরও ১৪ জন দক্ষিণ কোরীয় কর্মকর্তা এবং তিনজন সাংবাদিকসহ চারজন বর্মী নাগরিক নিহত হন।[৫] রেঙ্গুন শহরে যানজটের কারণে রাষ্ট্রপতি চান ডু-হোয়ানের গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। রাষ্ট্রপতির আগমনের পূর্বেই তার সম্মানার্থে বিউগল বাজানো শুরু করায় ভুলক্রমে আগেই বোমা বিস্ফোরণের সংকেত পাঠানো হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।[৩]
বার্মা পুলিশ হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন তিনজনকে শনাক্ত করে। এদের মধ্যে একজন উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনীর মেজর এবং অপর দুইজন ক্যাপ্টেন বলে শনাক্ত করে। পুলিশের তদন্ত থেকে জানা যায়, তারা রেঙ্গুন বন্দরে নোঙর করা একটি জাহাজ থেকে গোপনে মিয়ানমারে প্রবেশ করে এবং উত্তর কোরিয়ার কূটনৈতিক মিশন বিস্ফোরক সরবরাহ করে। সন্দেহভাজন কাং মিন-চুল ও অপর একজন হামলার দিনেই গ্রেনেড বিস্ফোরণে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তবে দুইজনই প্রাণে বেঁচে যায় এবং পুলিশের হাতে আটক হয়। বিস্ফোরণে কাং ডানহাত হারায় এবং কিম জিন-সু নামের অপর হামলাকারী একটি চোখ ও একটি হাত হারায়। ডার সান ইয়ে নামের একজন মহিলা এবং বো গ্যি ও শ্যোয়ে মিন থারসহ চারজনের সহায়তায় পুলিশ কিম জিন-সুকে ধরতে সক্ষম হয়।[৬] তৃতীয় সন্দেহভাজন শিন কি-চুল সাময়িকভাবে পালাতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে ধরা পড়লেও তার হাতে আরও তিনজন সৈন্য নিহত হন। কাং মি-চুল তার উদ্দেশ্য এবং উত্তর কোরিয়ার সাথে তার সম্পৃক্ততা স্বীকার করে। এর বিনিময়ে মৃত্যুদণ্ডের সাজা মওকুফ করা হয় এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। অপর হামলাকারী কিম জিন-সু স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় এবং তদন্তে সহায়তা না করায় তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।[৩] কাংকে রেঙ্গুনের উত্তরে ইঁসেইঁ কারাগারে পাঠানো হয়। উত্তর কোরিয়া তার সাথে সম্পৃক্ততার বিষয় অস্বীকার করে।[৭]
ঘটনাস্থল থেকে বেঁচে ফেরা কোরীয় নাগরিক ও নিহতদের দেহাবশেষ নিরাপদে কোরিয়ায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোপনে সামরিক ও লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করে। একাডেমিক ও হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের এশিয়া বিষয়ক সাবেক পরিচালক ভিক্টর চা বলেন, একজন দক্ষিণ কোরীয় কর্মকর্তা তার কাছে এইভাবে মনোভাব প্রকাশ করেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রকৃত মিত্রই কেবল এমন কাজ করতে সক্ষম। এইক্ষেত্রে জনগণ প্রকাশ্যে কিছুই জানবে না, কিন্তু আজীবন তা স্মরণ রাখা হবে।”[৮]
বোমা হামলায় সম্পৃক্ততার কারণে বার্মা উত্তর কোরিয়ার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করে। চীন বোমা হামলার কিছুদিন আগেই উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের অনুরোধ জানিয়ে একটি কূটনৈতিক নোট জারি করেছিল। হামলার পর চীন তার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে উত্তর কোরিয়ার সমালোচনা করে। চীনা কর্মকর্তারা বোমা হামলার পর বেশ কয়েক মাস উত্তর কোরিয়ার কোনো কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ এবং আলোচনায় অস্বীকৃতি জানায়।[৯]
১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিনিধি এই ঘটনাকে কোরিয়ান এয়ার ফ্লাইট ৮৫৮-এর সাথে তুলনা করেন। দুইটি ঘটনাকে উত্তর কোরিয়ার দায়মুক্ত থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসী কাজে মদদ দেওয়ার অভিযোগ তোলেন।[১০] ফলাফলস্বরূপ, তখন থেকে উত্তর কোরিয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা রাষ্ট্রের তালিকায় স্থান পায় (ব্যতিক্রম হিসেবে ২০০৮ থেকে ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত উত্তর কোরিয়া এই তালিকার বাইরে ছিল)।[১১]
হামলায় সন্দেহভাজন কাং মিন-চুল মিয়ানমারের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় কারাভোগ করা আসামীদের মধ্যে অন্যতম। কারাগারে তার সাথে অন্যান্য বন্দিদের ভাষ্য থেকে জানা যায়, কারাবন্দি থাকা অবস্থায় কাং বর্মী ভাষা রপ্ত করেছিলেন। তিনি এক হাতে আমগাছে চড়া আয়ত্ত করেন এবং খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হন। বাপ্তিস্মকরণের পর তিনি বাইবেলোক্ত নাম “ম্যাথিউ” ধারণ করেন।[১২] উত্তর কোরিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে ইয়াঙ্গুন পুনঃপ্রচেষ্টা শুরু করলে কাং-এর পরিণতি নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। উত্তর কোরিয়া কাং-এর নাগরিকত্ব অস্বীকার করায় আনুষ্ঠানিকভাবে তখন কাং রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিতে পরিণত হন। কাং উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া উভয় রাষ্ট্রে ফেরত যেতেই অস্বীকৃতি জানান বলে ধারণা করা হয়। কাং-এর ধারণা ছিল, উত্তর কোরিয়ার সম্পৃক্ততা স্বীকার করে নেওয়ায় সেই দেশের সরকার তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করবে এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ফিরে গেলে রাষ্ট্রীয় নেতাদের আততায়ী হিসেবে দেশটি তাকে বিচারের সম্মুখীন করবে। কাং উত্তর কোরিয়ায় তার মা ও বোনের নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তিত ছিল।[১২]
২০০৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার গ্র্যান্ড ন্যাশনাল পার্টির সদস্য ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা চুং হিয়ুং-কেয়ুন কাংকে দক্ষিণ কোরিয়ায় ফেরত আনতে একটি বিল উত্থাপন করেন।[১৩] কাং যকৃতের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৮ সালের ১৮ মে ৫৩ বছর বয়সে কারাগার থেকে ইয়াঙ্গুনের হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন।[১৪] মৃত্যুর পর তার দেহাবশেষের কী ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তা জানা যায় না।[১২]