জীববিজ্ঞানে ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে আদি এবং ব্যাপকতর অর্থে রোগ সংক্রামক জীবাণু বা সংক্ষেপে রোগজীবাণু হচ্ছে এমন যেকোন কিছু যা রোগ উৎপন্ন করতে পারে। এর পশ্চিমা পরিভাষা প্যাথোজেন (গ্রিক: πάθος pathos "যন্ত্রণা, আবেগ," ও -γενής -genēs "উৎপাদক") ১৮৮০ সালে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল।[১] সাধারণত রোগ সংক্রমণ সংঘটক (এজেন্ট) যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, প্রিয়ন, এমনকি অন্য কিছু অণুজীবকে বোঝাতেও এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়।[২][৩]
একটি জীবাণু বিক্রিয়াপথ-সহ (pathway পাথওয়ে) বিভিন্ন যৌগক (substrate) অবলম্বন করে একটি পোষক (Host, হোস্ট) জীবকে (যে রোগাক্রান্ত হবে) আক্রমণ করতে পারে। প্রধান বিক্রিয়াপথসমূহের বিভিন্ন অনিয়মিত সময়সূচি আছে, কিন্তু একটি রোগসংক্রামক জীবাণুকে লালিত করার ক্ষেত্রে মাটি দূষণ দীর্ঘতম বা সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অবলম্বন প্রদান করে। মানবদেহে জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট ব্যাধিকে জীবাণুঘটিত রোগ বলা হয়।
জীবাণুসমূহের রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতাকে পারিভাষিকভাবে রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষমতা বা রোগজনিতা (ইংরেজিতে প্যাথোজেনেসিটি Pathogenicity) বলা হয়। যেসব জীবাণু রোগ সৃষ্টি করতে পারে, তাদেরকে "রোগজনক" (Pathogenic) হিসেবে চরিত্রায়িত করা হয়। রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষমতা কথাটির অর্থ প্রকোপ (virulence) নামক আরেকটি পরিভাষার সাথে সম্পর্কিত। কিছু স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ "রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষমতা" পরিভাষাটিকে গুণগত অর্থে ব্যবহার করেন, এবং প্রকোপ পরিভাষাটিকে পরিমাণগত অর্থে ব্যবহার করেন। এই মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি জীবাণু একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে রোগজনক (Pathogenic প্যাথোজেনিক) বা অ-রোগজনক (Non-pathogenic নন-প্যাথোজেনিক) হতে পারে, কিন্তু একটি জীবাণু আরেকটির চেয়ে "অধিক রোগজনক" হতে পারে না। বরং এইরূপ তুলনা জীবাণুগুলির আপেক্ষিক তীব্রতা বা প্রকোপের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়। এছাড়া রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষমতার সাথে সংবহনযোগ্যতার (transmissibility) পার্থক্য আছে, কেননা সংবহনযোগ্যতা সংক্রমণের ঝুঁকিকে পরিমাপ করে।[৪]
একটি রোগ সংক্রামক জীবাণুকে তার প্রতিবিষ (Toxin টক্সিন) উৎপাদন, দেহকলার অভ্যন্তরে প্রবেশ, উপনিবেশ (Colony কলোনি) তৈরি ও পুষ্টি অপহরণের ক্ষমতা এবং পোষক (হোস্ট) প্রাণীটির শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা দমন (immunosuppression) ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে বর্ণনা করা হতে পারে।
একটি ব্যাকটেরিয়াকে যখন একটি রোগের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় তখন সাধারণত ঐ ব্যাকটেরিয়ার সম্পূর্ণ প্রজাতিকে "রোগজনক" আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে (কখের স্বীকার্য)। তবে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয় যে, রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষমতা সামগ্রিক অণুজৈবিক বাস্তুতন্ত্রের (Microbial ecosystem) উপর নির্ভর করে। একটি ব্যাকটেরিয়া অবদমিত-অনাক্রম্যতাবিশিষ্ট পোষকের দেহে (immunocompromised host) সুযোগসন্ধানী সংক্রমণ (opportunistic infection) ঘটাতে পারে, প্লাসমিড (plasmid) সংক্রমণ দ্বারা বিভিন্ন প্রকোপ উপাদান (virulence factor) অর্জন করতে পারে, পোষকের দেহের মধ্যে ভিন্ন অবস্থানে স্থানান্তরিত হতে পারে বা শরীরে উপস্থিত অন্যান্য ব্যাকটেরিয়ার সামগ্রিক সংখ্যার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ইয়েরসিনিয়া (Yersinia) ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত ইঁদুরের অন্ত্রধারক (mesenteric) লসিকা গ্রন্থির সংক্রমণের ফলে ঐ অংশে সম্ভবত "অনাক্রম্য ক্ষতচিহ্ন সৃষ্টিকরণ" (immunological scarring) প্রক্রিয়া দ্বারা ল্যাক্টোবেসিলাস (Lactobacillus) ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের পথ সুগম হয়।[৫]
যখন একটি রোগ সংক্রামক জীবাণু একটি অসুস্থ পোষক প্রাণী নির্বল হওয়া সত্ত্বেও তার দেহ থেকে অন্য দেহে ছড়িয়ে যেতে সক্ষম হয় তখন এর প্রকোপের (কোনও রোগ সংক্রামক জীবাণুর একটি পোষক প্রাণীর বংশবিস্তার ক্ষমতা বা "ডারউইনীয় ফিটনেসের" ক্ষতি করার প্রবণতা) বিবর্তন ঘটেছে বলা হয়। একই প্রজাতির পোষক প্রাণীর (যারা মাতা-সন্তান সম্পর্কে আবদ্ধ নয়) মধ্যে অনুভূমিক সংবহন ঘটে, বিপরীতে উল্লম্ব সংক্রমণ সংক্রমিত মায়ের থেকে ভ্রূণে অভিব্যক্ত (পোষক প্রাণীর জনসংখ্যার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে উচ্চ অসুস্হতা ও মৃত্যুর হার বিদ্যমান হওয়ার পরে) হয় এবং পোষক জীবের বিবর্তনীয় সাফল্যের সঙ্গে রোগ সংক্রামক জীবাণুটির বিবর্তনীয় সাফল্যের সংযুক্তি নির্দেশ করে। বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানে প্রস্তাব করা হয়েছে যে বহু রোগ সংক্রামক জীবাণুতে এক ধরনের সর্বাপেক্ষা সন্তোষজনক প্রকোপের বিবর্তন ঘটে, যাতে জীবাণুটি বর্ধিত পুনর্লিপিকরণ হারের বদৌলতে বংশবিস্তার ক্ষমতা লাভ করে, কিন্তু ভারসাম্য বজায় রাখতে এর বিপরীতে জীবাণুটির সংবহনযোগ্যতা হ্রাস পেতে হয়; তবে এই সম্পর্কগুলির অন্তর্নিহিত কর্মপদ্ধতিগুলি কী, তা নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে।[৬]
বিভিন্ন উপায়ে যেমন বায়ুবাহিত হয়ে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংস্পর্শ দ্বারা, যৌন সংস্পর্শ দ্বারা, রক্ত, মাতৃদুগ্ধ বা অন্যান্য শারীরিক তরলের মাধ্যমে এবং মল-থেকে-মুখ পথে রোগ সংক্রামক জীবাণুর সংবহন ঘটে।)
যদিও অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়া হয় নিরীহ বা উপকারী কিন্তু একটি অপেক্ষাকৃত ছোট রোগ সংক্রামক ব্যাকটেরিয়ার শ্রেণী সংক্রামক রোগের কারণ হতে পারে। মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা যক্ষ্মা রোগের সৃষ্টি হয় যার ফলে প্রতি বছর প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ মূলত সাব-সাহারান আফ্রিকাতে মৃত্যুবরণ করেন। রোগ সংক্রামক ব্যাকটেরিয়া অন্য কিছু বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ রোগের কারণ যেমন স্ট্রেপ্টোককাস (Streptococcus) এবং সিউডোমোনাস (Pseudomonas) ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট নিউমোনিয়া; শিগেলা (Shigella), ক্যাম্পাইলোব্যাকটার (Campylobacter) এবং সালমোনেলা (Salmonella) ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট ফুডবোর্ন (foodborne) অসুস্থতা। রোগ সংক্রামক ব্যাকটেরিয়া টিটেনাস, টাইফয়েড, জ্বর, ডিপথেরিয়া, সিফিলিস, এবং কুষ্ঠ ইত্যাদি সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে।
ব্যাকটেরিয়া নিরোধক ঔষধ (অ্যান্টিবায়োটিক) দিয়ে ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করা যেতে পারে কারণ অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগে ব্যাকটেরিয়ার কোষের বাইরের প্রাচীর ধ্বংস হয়ে যায়, ফলে ডিএনএ কোষাবরণ থেকে বের হয়ে যায় এবং ফলস্বরূপ রোগ সংক্রামক জীবাণু প্রয়োজনীয় প্রোটিন এবং রঞ্জক পদার্থ (ডাই) উৎপাদন করতে অসমর্থ হয়। ব্যাকটেরিয়া সাধারণত ১ থেকে ৫ মাইক্রোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট হয়। কোষপ্রাচীরহীন একপ্রকার ব্যাকটেরিয়ার শ্রেণীকে মাইকোপ্লাজমা (mycoplasma) বলে (এটি ফুসফুসের সংক্রমণের কারণ)। এক শ্রেণীর ব্যাকটেরিয়া যাকে বাধ্যতামূলকভাবে অন্যান্য কোষের মধ্যে বাস করতে হয় (বাধ্যতামূলক আন্তঃকোষীয় পরাশ্রয়ী) হচ্ছে ক্ল্যামাইডিয়া বর্গ (chlamydia genus)। এরা বিশ্বব্যাপী যৌনবাহিত সংক্রমণ (এসটিডির) অন্যতম কারণ।
ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট ব্যাধির মধ্যে বসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা, মাম্পস, হাম, জলবসন্ত, ইবোলা, এবং রুবেলা উল্লেখযোগ্য।
রোগ সংক্রামক ভাইরাসের মধ্যে নিম্নলিখিত ভাইরাস গোত্রগুলি বিশেষভাবে উল্লেখ্য: অ্যাডিনোভাইরিডি (Adenoviridae), পিকর্নাভাইরিডি (Picornaviridae), হার্পিসসভাইরিডি (Herpesviridae), হেপাড্নাভাইরিডি (Hepadnaviridae), ফ্ল্যাভিভাইরিডি (Flaviviridae), রেট্রোভাইরিডি (Retroviridae), অর্থোমিক্সোভাইরিডি (Orthomyxoviridae), প্যারামিক্সোভাইরিডি (Paramyxoviridae), প্যাপোভাভাইরিডি (Papovaviridae), পোলিওমাভাইরাস (Polyomavirus), রাবডোভাইরিডি(Rhabdoviridae), টোগাভাইরিডি (Togaviridae)। ভাইরাস সাধারণত ২০ থেকে ৩০০ ন্যানোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট।[৭]
মাইক্রোবের একপ্রকার ইউক্যারিওটিক রাজ্য (কিংডম) নিয়ে ছত্রাক গঠিত ও এরা সাধারণত মৃতভোজী (saprophytes) (মৃত প্রাণীর দেহাংশ খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে)। কিন্তু এরা মানুষ, অন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের রোগের কারণও হতে পারে। ছত্রাক হল ফসল এবং অন্যান্য গাছপালার রোগের সবচেয়ে বড় কারণ। সাধারণত ফাংগাল বীজগুটি ১ থেকে ৪০ মাইক্রোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট হয়।
প্রিয়ন তত্ত্ব (prion theory) অনুযায়ী প্রিয়ন হচ্ছে এমন এক ধরনের সংক্রামক জীবাণু যার নিউক্লিয়িক অ্যাসিড থাকে না। কিছু রোগ যেমন স্ক্র্যাপি (scrapie), বোভাইন স্পঞ্জিফর্ম এন্সেফ্যালপ্যাথি (bovine spongiform encephalopathy) (উন্মত্ত গরু ব্যাধি), ক্রেউট্জফেল্ড্ট-জেকব রোগ (Creutzfeldt–Jakob disease) ইত্যাদিতে গুণগতভাবে এই অস্বাভাবিক ভাঁজবিশিষ্ট প্রোটিন পাওয়া যায়।[৮]
কিছু সুকেন্দ্রিক (ইউক্যারিওটিক) জীব যেমন প্রোটিস্ট (protists) এবং হেলমিন্থ (helminths) রোগ সৃষ্টি করে থাকে।
স্তন্যপায়ী প্রাণীর শৈবাল বা শেত্তলাজাত রোগ সংক্রামক জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট পরিচিত রোগগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রোগ হল প্রোটোথিকোসিস (protothecosis)। প্রোটোথিকোসিস প্রোটোথিকা (prototheca) নামক এক ধরনের ক্লোরোফিলবিহীন সবুজ শৈবাল দ্বারা সৃষ্ট এবং এই রোগ কুকুর, বিড়াল, গরু, এবং মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়।
সাধারণত ব্যাকটেরিয়া নিরোধক (অ্যান্টিবায়োটিক) দ্বারা ব্যাকটেরিয়ার চিকিৎসা করা হয়। অন্যদিকে ভাইরাস নিরোধক (অ্যান্টিভাইরাল) যৌগ দিয়ে ভাইরাসের চিকিৎসা করা হয়। সুকেন্দ্রিক (ইউক্যারিওটিক) রোগ সংক্রামক জীবাণু সাধারণত ব্যাকটেরিয়া নিরোধক ঔষধ দ্বারা নির্মূলযোগ্য নয় এবং এদের বিরুদ্ধে বিশেষ ঔষধের প্রয়োজন হয়। টিকা দ্বারা অনেক রোগ সংক্রামক জীবাণুর সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। টিকার মাধ্যমে দুর্বল রোগ সংক্রামক জীবাণু স্বল্প পরিমাণে দেহে প্রবেশ করানো হয় যাতে শরীরের অনাক্রম্যতন্ত্র বা প্রতিরক্ষাতন্ত্র সতর্ক থাকে এবং একটি বৃহত্তর পরিমাণের ভাইরাস যাতে কোনদিনও শরীরে প্রবেশ করতে সক্ষম না হয় তার জন্য প্রতিরক্ষা জোরদার হয়। রোগ সংক্রামক জীবাণুর দ্বারা সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।