রোগবিস্তার বিজ্ঞান বা মহামারী বিজ্ঞান (ইংরেজি: Epidemiology) চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি শাখা, যেখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে বৃহৎ আকারের মানব জনসমষ্টিতে রোগসমূহের প্রাদুর্ভাব ও বণ্টন (কে, কখন, কোথায় রোগাক্রান্ত) ও এগুলির বিস্তার ও তীব্রতা নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ামক শর্তসমূহের প্রামাণ্য উপাত্তভিত্তিক অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করা হয় এবং এ-সংক্রান্ত গবেষণালব্ধ জ্ঞানের প্রেক্ষিতে ঐসব রোগ প্রতিরোধ ও সেগুলির বিস্তার নিয়ন্ত্রণের উপায়সমূহ অধ্যয়ন করা হয়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সাথে রোগবিস্তার বিজ্ঞানের পার্থক্য এই যে এখানে স্বতন্ত্র বা একক রোগীর পরিবর্তে বহুসংখ্যক রোগী বা মানুষের সমষ্টি নিয়ে অধ্যয়ন করা হয়, যা প্রায়শই অতীতমুখী ও ঐতিহাসিক প্রকৃতির। ১৯শ শতকে মানুষে সংঘটিত বিভিন্ন রোগ, বিশেষত মহামারীর আকার ধারণকারী রোগসমূহের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে রোগবিস্তার বিজ্ঞানের উদ্ভব হয়। আজও রোগবিস্তার বিজ্ঞানের একটি প্রধান লক্ষ্য হল কোনও প্রদত্ত রোগের জন্য উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা জনসমষ্টিসমূহকে চিহ্নিত করা, যাতে সেই রোগের কারণ শনাক্ত করা সম্ভব হয় এবং রোগটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা যায়।
রোগবিস্তারবৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলি থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি কেবলমাত্র বিভিন্ন রোগের কারণ নির্ণয়েই ব্যবহার করা হয় না। এগুলি প্রায়শই নতুন স্বাস্থ্যসেবাসমূহের পরিকল্পনা প্রণয়ন, সেবাগ্রহণকারী জনসমষ্টির মধ্যে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণের পরিমাণ নির্ণয় এবং কোনও প্রদত্ত জনসমষ্টিতে বিরাজমান সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি পর্যালোচনার কাজে ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের সিংহভাগ দেশে জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষসমূহ নিয়মিতভাবে বিশেষ বিশেষ রোগ এবং তাদের দেশের জনসাধারণের মধ্যে ঐসব রোগের কারণে মৃত্যুর হার বিষয়ক রোগবিস্তারবৈজ্ঞানিক উপাত্ত সংগ্রহ করে। কোনও নির্দিষ্ট জনসমষ্টির অভ্যন্তরে এবং একাধিক জনসমষ্টির মধ্যে কোনও রোগের বৈশিষ্ট্যাবলি আরও ভালোভাবে অনুধাবন করার জন্য রোগবিস্তার বিজ্ঞান ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের উপকরণ ব্যবহার করা হয়, যাদের মধ্যে মৃত্যুহার, নতুন রোগ সংক্রমণ হার এবং বিদ্যমান সংক্রমিত রোগীর হার উল্লেখযোগ্য।
প্রাথমিকভাবে রোগবিস্তার বিজ্ঞানে সংক্রামক ব্যাধিসমূহ আলোচিত হত। ইংরেজ চিকিৎসক জন স্নো ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম সুপরিচিত একটি রোগবিস্তারবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকর্ম সম্পাদন করেন। তিনি লক্ষ করেন যে লন্ডন নগরীতে যে ওলাওঠা (কলেরা) রোগের মহামারী হয়েছিল, তা মূলত ব্রড স্ট্রিট পাম্প নামক একটি পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থার সেবা গ্রহণকারী অঞ্চলের মধ্যে ঘটেছিল। পাম্পটি বন্ধ করে দেবার পরে মহামারীর প্রকোপ কমে যায়। আধুনিক যুগে এসে সংক্রামক রোগ ছাড়াও যেকোনও দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন হৃদরোগ বা কর্কটরোগের (ক্যান্সার) প্রাদুর্ভাব ও বিস্তার রোগবিস্তার বিজ্ঞানের পরিধিতে পড়েছে। শুধুমাত্র মহামারী কিংবা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত রোগের ক্ষেত্রেই নয়, বরং যেকোন রোগের জন্যই রোগবিস্তার বিজ্ঞান প্রযুক্ত হতে পারে। অধিকন্তু রোগ নয় এমন বহু ধরনের স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত অবস্থা যেমন উচ্চ রক্তচাপ, অতিস্থুলতা, মানসিক বিষন্নতা, ইত্যাদিও রোগবিস্তার বিজ্ঞানে অধ্যয়ন করা হতে পারে।
রোগবিস্তারবৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলিকে বর্ণনামূলক কিংবা বিশ্লেষণী --- এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। বর্ণনামূলক রোগবিস্তার বিজ্ঞান হল রোগবিস্তারবৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রথম ধাপ, যাতে উদ্ভূত রোগটিকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। বর্ণনামূলক রোগবিস্তারবিজ্ঞানে কোনও প্রদত্ত জনসমষ্টির মধ্যে জরিপ চালানো হয় এবং বয়স, লিঙ্গ, নৃগোষ্ঠী, পেশা, ইত্যাদির ভিত্তিতে জনসম্প্রদায়ের কোন্ অংশ আলোচনাধীন রোগে আক্রান্ত, তা নির্ণয় করা হয়। আরেক ধরনের বর্ণনামূলক গবেষণাতে বহু বছর ধরে সময়ের সাথে সাথে কিংবা ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী নতুন রোগীর হার ও মৃত্যুহারের পরিবর্তন বা ভেদ পর্যবেক্ষণ করা হয়। বর্ণনামূলক গবেষণাগুলি আলোচ্য রোগের নতুন নতুন লক্ষণসমষ্টি শনাক্ত করতে সাহায্য করে কিংবা রোগ ও ঝুঁকি-সৃষ্টিকারী কারণের মধ্যে সম্পর্ক প্রস্তাব করা হতে পারে, যেগুলি অতীতে অজানা ছিল। সাধারণত বর্ণনামূলক রোগবিস্তার বিজ্ঞানের গবেষণা শেষে কিছু বৈজ্ঞানিক অনুমান সূত্রায়ন করা হয়।
বিশ্লেষণী রোগবিস্তার বিজ্ঞান হল রোগবিস্তারবৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্বিতীয় ধাপ। এখানে বর্ণনামূলক রোগবিস্তার বৈজ্ঞানিক জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যাবলি বা পরীক্ষাগারের গবেষণায় প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণসমূহ থেকে লব্ধ বৈজ্ঞানিক অনুমানগুলি পরীক্ষা করা হয়। বিশ্লেষণী গবেষণাগুলিতে একটি নমুনা জনসমষ্টিকে রোগের অনুমিত কারণের উপর ভিত্তি করে দুই বা ততোধিক দলে বিভক্ত করা হয় এবং তার পর এই দলগুলির মধ্যে নতুন রোগীর হার, মৃত্যুহার ও অন্যান্য চলরাশিগুলি পর্যবেক্ষণ করা হয়। ভবিষ্যাপেক্ষ-দলগত গবেষণা (Prospective-cohort study) নামক এক ধরনের বিশ্লেষণী গবেষণাতে সময়ের সাথে সাথে নতুন রোগীর হারের পার্থক্য পর্যবেক্ষণ করার জন্য কোনও জনসমষ্টির সদস্যদেরকে অনুসরণ করা হয়।
রোগবিস্তারবৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রধান উপক্ষেত্রগুলির মধ্যে রোগের কারণ নির্ণয়, রোগের সংবহন, রোগের প্রাদুর্ভাব অনুসন্ধান, রোগ নজরদারি, পরিবেশগত রোগবিস্তারবিজ্ঞান, আদালতি রোগবিস্তারবিজ্ঞান, কর্মস্থলীয় রোগবিস্তারবিজ্ঞান, যাচাই পরীক্ষা, জৈব-নজরদারি এবং রোগীভিত্তিক পরীক্ষণের মাধ্যমে একাধিক চিকিৎসার ফলাফলের তুলনা, ইত্যাদি উল্লেখ্য।
রোগবিস্তার বিজ্ঞানের গবেষণাগুলি অন্য বহুসংখ্যক বিজ্ঞানের উপরে গভীরভাবে নির্ভরশীল। প্রথমত, সংজ্ঞানুযায়ী পরিসংখ্যানবিদ্যা, বিশেষত জৈব পরিসংখ্যানবিদ্যার সাথে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে; রোগবিস্তারবিজ্ঞানীরা পরিসংখ্যানবিদ্যার সাহায্যে সংগৃহীত উপাত্তগুলি বিশ্লেষণ করেন ও এগুলি থেকে যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হন। দ্বিতীয়ত, রোগবিস্তারবিজ্ঞানীরা স্বাস্থ্য ও জৈবচিকিৎসাবিজ্ঞানসমূহের কিছু শাখা যেমন জীববিজ্ঞান, রোগবিজ্ঞান ও শারীরবিজ্ঞানের তত্ত্ব ব্যবহার করে রোগ সৃষ্টি, সংক্রমণ ও সংবহনের জৈবিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করেন। তৃতীয়ত, রোগবিস্তারবিজ্ঞানীরা আচরণীয় ও সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের কিছু শাখা যেমন নৃবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারণা ও তত্ত্ব প্রয়োগ করে সন্নিহিত ও দূরবর্তী কারণসমূহ আরও ভালভাবে অনুধাবন করার চেষ্টা করেন। অধিকন্তু অরক্ষিত অবস্থা যাচাই করার জন্য প্রকৌশলের সহায়তা নেওয়া হতে পারে।
রোগবিস্তার বিজ্ঞানীরা গবেষণা নকশাকরণ, উপাত্ত সংগ্রহ ও সেগুলির পরিসংখ্যানিক বিশ্লেষণ, ফলাফলের ব্যাখ্যা প্রদান ও বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের মধ্যে এগুলি ভাগাভাগি করে নেওয়া (সহকর্মীদের পর্যালোচনা ও কদাচিৎ প্রণালীবদ্ধ পর্যালোচনা যার অন্তর্ভুক্ত), ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে ভূমিকা পালন করেন। রোগবিস্তারবিজ্ঞানের গবেষণার পদ্ধতিগুলি রোগীভিত্তিক গবেষণা ও জনস্বাস্থ্য গবেষণাতে কাজে লেগেছে। রোগবিস্তার বিজ্ঞানীরা রোগ, আঘাত বা মৃত্যুর ঝুঁকি-সৃষ্টিকারী কারণগুলি শনাক্ত করেন; সময়ের সাথে সাথে রোগ বা অন্যান্য স্বাস্থ্যহানিকর ঘটনাসমূহ পর্যবেক্ষণ ও অনুসরণ করেন; রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা কর্মসূচিসমূহের কার্যকারিতা ও দক্ষতা পর্যালোচনা করেন; স্বাস্থ্য পরিকল্পনা ও যথোপযুক্ত অগ্রাধিকারভিত্তিক স্বাস্থ্য কর্মসূচি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উপকারী তথ্য সরবরাহ করেন; জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি নির্বাহ করার ক্ষেত্রে সহায়তা করেন; জনস্বাস্থ্যমূলক তথ্য প্রচারে সহায়তা করেন।
আধুনিক রোগবিস্তার বিজ্ঞানে বয়স, লিঙ্গ, জাতীয়তা, আর্থসামাজিক কারণ ইত্যাদির প্রভাবের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হতে পারে। যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জার মহামারীর সময় বৃদ্ধ বা বয়স্ক ব্যক্তিদের শ্বাসকষ্টজনিত মৃত্যুর ঝুঁকি, পুরুষদের মধ্যে উচ্চতর হৃদাঘাতের হার, আইরীয় পিতামাতার সন্তানদের মধ্যে দ্বিধামেরু (স্পাইনা বাইফিডা) নামক জন্মগত বৈকল্য, ঘনবসতিপূর্ণ নগরীতে গৃহহীন ও দরিদ্র শ্রেণীর লোকদের মাঝে যক্ষ্মা রোগের সংক্রমণ, ইত্যাদি। রোগবিস্তার বিজ্ঞানীরা জনসমষ্টিসমূহের রোগের সাধারণ কারণ অনুসন্ধান করার পাশাপাশি কোনও বিশেষ রোগের একটি বিশেষ প্রাদুর্ভাবের উৎস শনাক্ত করার দায়িত্বেও নিয়োজিত হতে পারেন।
জীবাণু ও সংক্রামক রোগসমূহের মধ্যে যে অকাট্য পরিষ্কার সম্পর্ক বিদ্যমান, তার বিপরীতে দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন হৃদরোগ বা কর্কটরোগ (ক্যান্সার) বিষয়ক রোগবিস্তার বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রাপ্ত সিদ্ধান্তগুলি ততোটা চূড়ান্ত বা তর্কাতীত হয় না। তা সত্ত্বেও বহুসংখ্যক গবেষণাতে বেরিয়ে এসেছে যে ধূমপানের সাথে ফুসফুসের কর্কটরোগ ও অন্যান্য ব্যাধির সম্পর্ক আছে, যার ফলে বহু দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সিগারেটের মোড়কে ও বিজ্ঞাপনে সতর্কবাণী যুক্ত করা বাধ্যতামূলক করেছে। এছাড়া হৃদরোগের প্রাদুর্ভাব কমানোর জন্য কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার কম খাওয়ার ব্যাপারেও বেশ কিছু স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৃহদান্ত্র ও মলাশয়ের কর্কটরোগের পেছনে খাদ্যে গবাদি পশুর মাংস অতিমাত্রায় গ্রহণকে একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।