রোগীভিত্তিক গবেষণা বলতে সেইসব চিকিৎসাবৈজ্ঞানিক গবেষণাকে বোঝায় যেগুলি মূলত স্বেচ্ছাসেবক অসুস্থ রোগী বা রোগের উপসর্গবিশিষ্ট ব্যক্তি এবং কখনও কখনও স্বেচ্ছাসেবক সুস্থ ব্যক্তিদের উপরে পরিচালনা করা হয়, যাদের উদ্দেশ্য কোনও রোগ সম্পর্কে চিকিৎসাবৈজ্ঞানিক জ্ঞান বৃদ্ধি ও উন্নত করা এবং এর মাধ্যমে রোগীকে উন্নততর অর্থাৎ অধিকতর কার্যকর, নিরাপদ, বাস্তবমুখী, প্রয়োগযোগ্য ও যথাযথ সেবা দানের লক্ষ্যে নতুন ও উন্নততর রোগ শনাক্ত ও নির্ণয়ের পদ্ধতি আবিষ্কার করা এবং প্রতিকার, উপসর্গ উপশম ও প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ঔষধ, সেবাদান পদ্ধতি ও চিকিৎসা-যন্ত্র উদ্ভাবন করা। অনেক সময় অংশগ্রহণকারী রোগীদের বা ব্যক্তিদের স্বশরীরে অন্তর্ভুক্ত না করে বরং তাদের থেকে সংগৃহীত উপাত্ত, নমুনা বা দেহকলা গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে অধ্যয়ন করা হয়। রোগীভিত্তিক গবেষণা রোগী বা ব্যক্তির বাসগৃহ, চিকিৎসকের কার্যালয়, গবেষণা কেন্দ্র, হাসপাতাল, চিকিৎসা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি বর্তমানে ইন্টারনেটেও পরিচালিত হয়ে থাকে। একজন মূল গবেষকের পাশাপাশি সহকারী চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, স্থানীয় গবেষণা সমন্বয়ক, পরিচর্যাকারী (নার্স), পরীক্ষাগারের কর্মচারী, উপদেষ্টা, যান্ত্রিক কারিগর, স্বাস্থ্যসেবাকর্মী, সমাজকর্মী ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার লোকের সমন্বয়ে তৈরি একটি দলের উপর চিকিৎসাবৈজ্ঞানিক গবেষণার সুষ্ঠু সম্পাদনা নির্ভর করে। নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করতে রোগীভিত্তিক গবেষণার পরিধি সুসংজ্ঞায়িত থাকে, এটি একটি সুস্পষ্ট গবেষণাবিধি মেনে চলে এবং কেবলমাত্র নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করলে তবেই এটি বাস্তবায়ন করা হয়। কিছু সাধারণ শর্ত হল গবেষণাকর্মটিকে অবশ্যই চিকিৎসাবৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বৃদ্ধি বা উন্নতিসাধন করতে হয়, এটি অবশ্যই যথাযথ যোগ্যতাবিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ দ্বারা সম্পাদিত হয়, পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী রোগী বা সুস্থ ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয় ও তাদের সম্মতি সংগ্রহ করতে হয়, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের বা পর্যালোচনাকারী পরিষদের কাছ থেকে অনুমোদন পেতে হয় ও সমস্ত প্রয়োজনীয় আইনি ও নৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়।[১][২]
রোগীভিত্তিক গবেষণায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এরা হল আর্থিক পৃষ্ঠপোষক, গবেষণা সংস্থা, গবেষক, অংশগ্রহণকারী, পর্যবেক্ষক সংস্থা এবং স্বত্বভোগী বা ভোক্তা। রোগীভিত্তিক গবেষণা সরকারী ও বেসরকারী খাতের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পন্ন হয়ে থাকে। এদের মধ্যে আছ জাতীয় স্বাস্থ্য গবেষণা কেন্দ্র, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা কেন্দ্র, ঔষধ নির্মাতা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা-যন্ত্র প্রস্তুতকারক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জীব-প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যক্তিগত তহবিল, জাতীয় বিদ্বান সমিতি, ইত্যাদি। একক ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, বরং একটি গবেষণা সংস্থা বা সংগঠনের অধীনে রোগীভিত্তিক গবেষণা সম্পন্ন হয়, যেমন উচ্চশিক্ষায়তনিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান, জরিপ গবেষণা সংস্থা, সরকারী গবেষণা কর্মসূচি, এবং ঠিকাদারি গবেষণা সংস্থা। বিভিন্ন উচ্চশিক্ষায়তনিক উপাধিবিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী (যেমন এমডি, পিএইচডি, আরএন, ফার্মডি, ইত্যাদি) গবেষণা সম্পাদন করেন, যাদেরকে গবেষক বা অনুসন্ধানকারী বলে। গবেষণায় যেসব রোগী, রোগের উপসর্গ প্রদর্শনকারী ব্যক্তি বা সুস্থ ব্যক্তি স্বেচ্ছায় অংশ নেন, তাদেরকে অংশগ্রহণকারী বলে। পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলির মধ্যে স্থানীয় বা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, পর্যালোচনা পরিষদ বা মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য বীমা প্রতিষ্ঠান, মুনাফাভিত্তিক বা মুনাফাবিহীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারী ব্যক্তি, ইত্যাদি গবেষণার স্বত্বভোগী বা ভোক্তা শ্রেণীটি গঠন করে।[৩]
রোগীভিত্তিক গবেষণাকে দুইই প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা যায়: রোগীভিত্তিক পরীক্ষণ (বা হস্তক্ষেপমূলক গবেষণা) এবং পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা।[৪]
রোগীভিত্তিক পরীক্ষণ বা হস্তক্ষেপমূলক গবেষণাতে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা গবেষকদের দ্বারা পূর্বপরিকল্পিত প্রয়োগবিধি অনুযায়ী তাদের স্বাস্থ্যের উপরে হস্তক্ষেপমূলক কোনও বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করেন, যেমন নতুন কোনও ওষুধ গ্রহণ, কোনও চিকিৎসা-যন্ত্র ব্যবহার, আচরণ বা খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, ইত্যাদি। রোগীভিত্তিক পরীক্ষণে নতুন প্রতিকারমূলক চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত আদর্শ চিকিৎসা পদ্ধতি, সান্ত্বনামূলক ঔষধকল্প (প্লাসিবো) কিংবা অনুপস্থিত চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে তুলনা করা হতে পরে। রোগীভিত্তিক পরীক্ষণগুলি একাধিক ধাপে বা দশায় সম্পাদন করা হয়ে থাকে। এই গবেষণার উদ্দেশ্য নতুন ঔষধ বা পদ্ধতির কার্যকারিতা, নিরাপত্তা ও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াগুলি অধ্যয়ন করা।[৪]
পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণাতে কোনও নির্দিষ্ট ঔষধ বা প্রতিকারমূলক চিকিৎসা পদ্ধতির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয় না, বরং নির্দিষ্ট গবেষণাবিধি অনুযায়ী অংশগ্রহণকারীদের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা হয়।[৪] যেমন স্বাভাবিক ইতিহাস গবেষণাতে রোগীদের স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ ও অধ্যয়ন করা হয়, যার উদ্দেশ্য সময়ের সাথে কীভাবে রোগের উদ্ভব ও অগ্রগতি হয়, তা বোঝার চেষ্টা করা।