উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চল | |
---|---|
ভারত, পাকিস্তান | |
ভাষা | |
হিন্দি/উর্দু • পশতুন | |
ধর্ম | |
ইসলাম | |
সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী | |
অন্যান্য পশতুন সম্প্রদায় |
রোহিলা হলো ঐতিহাসিকভাবে ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের রোহিলখণ্ডে বসবাসকারী একটি পশতুন-জাতীয় সম্প্রদায়।[১] এরা ভারতে বসবাসকারী বৃহত্তম পশতুন সম্প্রদায় এবং এদের নাম অনুসারে অঞ্চলটির নাম রোহিলখণ্ড রাখা হয়েছে। [১] রোহিলা সামরিক প্রধানরা ১৭২০ এর দশকে উত্তর ভারতের এই অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেন এবং তাদের মধ্যে ১ম দাউদ খান উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন।[১][২]
রোহিলারা সমগ্র উত্তর প্রদেশ জুড়ে বাস করে। তবে বেরেলি ও মোরাদাবাদ বিভাগের রোহিলখণ্ড অঞ্চলে তাদের ঘনত্ব বেশি। ১৮৩৮ থেকে ১৯১৬ সালের মধ্যে কিছু রোহিলা আমেরিকার ক্যারিবীয় অঞ্চলের গায়ানা, সুরিনাম ও ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে তারা ইন্দো-ক্যারিবীয় জাতিগোষ্ঠীর মুসলিম সংখ্যালঘুদের একটি সম্প্রদায় গঠন করেছে।[৩] ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর অনেক রোহিলা মুহাজির জনগোষ্ঠীর অংশ হিসাবে পাকিস্তানের করাচিতে চলে যায়।
রোহিলা শব্দটি প্রথম প্রচলিত হয় ১৭ শতকে। রোহ ভূমি থেকে আগত লোকদের বোঝাতে রোহিলা শব্দটি ব্যবহৃত হত। রোহ মূলত একটি ভৌগোলিক শব্দ, যা এর সীমিত অর্থে উত্তরে সোয়াত এবং বাজাউর থেকে দক্ষিণে সিবি পর্যন্ত ; পূর্বে হাসান আবদাল ( এটক ) থেকে পশ্চিমে কাবুল ও কান্দাহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। [৪] হিন্দু কুশের দক্ষিণ পাদদেশে অবস্থিত রোহ ছিল পশতুনদের জন্মভূমি। ঐতিহাসিকভাবে রোহ অঞ্চলটি "পশতুনখওয়া" এবং 'আফগানিস্তান' নামেও পরিচিত ছিল। এই উপত্যকায় বসবাসকারী পশতুনরা; বিশেষ করে মান্দার ইউসুফজাই উপজাতিও রোহিলা নামে পরিচিত ছিল এবং তখন তারা কাতেহর নামে পরিচিত এলাকাটিতে বসতি স্থাপন করেছিল। এটি পরবর্তীতে রোহিলখণ্ড নামে পরিচিত হয়, যার অর্থ রোহিলাদের দেশ । ১৭ এবং ১৮ শতকের মধ্যে বেশিরভাগ রোহিলা পশতুনিস্তান থেকে উত্তর ভারতে চলে আসে। [৫] [৬]
রোহিলখণ্ডে পশতুন রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দাউদ খান এবং তার দত্তক পুত্র আলী মুহাম্মদ খান । দাউদ খান ১৭০৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় আসেন। তিনি তার গোত্রের একটি দল বারেসকে তার সঙ্গে নিয়ে আসেন। রাজপুত বিদ্রোহ দমন করার জন্য ক্রুর মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব ( ১৬৫৮-১৭০৭ ) দাউদ খানকে উত্তর ভারতের কাতেহর অঞ্চল জায়গির হিসেবে দিয়ে দেন। মূলত বিভিন্ন পশতুন উপজাতি যেমন ( ইউসাফজাই, ঘোরি, ঘিলজাই, বারেস, মারওয়াত, দুররানি, তারিন , কাকার, নাঘর, আফ্রিদি, বাঙ্গাশ ও খট্টক) থেকে প্রায় ২০,০০০ সৈন্য নিয়ে এসে বিদ্রোহ দমন করা হয়। এটি আওরঙ্গজেবের প্রশংসা লাভ করে এবং এই সৈন্যদের মুঘল সেনাবাহিনীতে সম্মানিত পদ দেওয়া হয়।
১৭২১ সালে দাউদ খান মুহাম্মদ খানের স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কর রাজস্ব পাঠাতে অস্বীকার করে বসেন। আওধের নবাব সফদর জং [৭] মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহকে [৮] রোহিলাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। এর ফলে মোহাম্মদ শাহ তার বিরুদ্ধে একটি অভিযান পাঠান এবং ফলস্বরূপ তিনি সাম্রাজ্যের বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাকে বন্দী হিসেবে দিল্লীতে নিয়ে যাওয়া হয় ; কিন্তু পরে তাকে ক্ষমা করে সিরহিন্দের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। ১৭৩৯ সালে নাদির শাহ কর্তৃক উত্তর ভারত আক্রমণের সময় তার বেশিরভাগ সৈন্য কাটহার অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল এবং এই এলাকার রোহিলা জনসংখ্যা ১০০,০০০-এ উন্নীত হয়েছে। রোহিলা পশতুনদের বৃহৎ বসতির কারণে এই অংশের কাটহার অঞ্চলটি রোহিলখণ্ড নামে পরিচিতি লাভ করে। বেরেলিকে এই নবগঠিত রোহিলখণ্ড রাজ্যের রাজধানী করা হয়। [৯]
আলী মুহাম্মদ খান ছয় ছেলে রেখে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর সময় তাঁর দুই বড় ছেলে আফগানিস্তানে ছিলেন এবং বাকি চারজন রোহিলখণ্ডের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য খুব কম বয়সী ছিলেন। এর ফলে ক্ষমতা অন্য রোহিলা সর্দারদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন হাফিজ রহমত খান বারেস, নজিব-উদ-দৌলা ও দুন্ডি খান। ১৯০১ সালে ভারতের আদমশুমারি অনুসারে বেরেলি জেলার মোট পাঠান (পশতুন) জনসংখ্যা ছিল ৪০,৭৭৯ জন, যেখানে মোট জনসংখ্যা ছিল ১,০৯০,১১৭ জন। [১০]
পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে (১৭৬১) রোহিলা সর্দারদের একজন নাজিব উল দৌলা মারাঠাদের বিরুদ্ধে [১১] আহমদ শাহ আবদালীর সাথে মিত্রতা করেন। তিনি মিত্রবাহিনীকে কেবল ৪০,০০০ রোহিলা সৈন্যই নয়, এদের সাথে ৭০টি বন্দুকও দেন। তিনি আওধের নবাব সুজা-উল-দৌলাকেও মারাঠাদের বিরুদ্ধে আহমদ শাহ আবদালীর বাহিনীতে যোগ দিতে রাজি করান এবং এ যুদ্ধে মারাঠারা পরাজিত হয়। এর ফলে রোহিলাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
পানিপথের যুদ্ধে রোহিলাদের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে মারাঠারা রোহিলখণ্ড আক্রমণ করে। মারাঠা শাসক মহাদজি সিন্ধিয়ার নেতৃত্বে মারাঠাবাহিনী সর্দার নাজিব-উদ-দৌলার জায়গীরে প্রবেশ করে, যা সর্দারের মৃত্যুর পর তার পুত্র জাবিতা খানের দখলে ছিল। জাবিতা খান প্রথমে আক্রমণ প্রতিহত করলেও শেষ পর্যন্ত মারাঠাদের কাছে পরাজিত হন এবং সুজা-উদ-দৌলার শিবিরে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। মারাঠারা তার দেশ ধ্বংস করে দেয়। মারাঠা শাসক মাহাদজি সিন্ধিয়া জাবিতা খানের পরিবারকে বন্দী করে এবং নাজিব উদ-দৌলার কবর অপবিত্র করে তার দুর্গ লুট করেন।[১২] যুদ্ধের পর অবশিষ্ট প্রধান রোহিলা সর্দার ছিলেন হাফিজ রহমত খান বারেস। তাঁর মাধ্যমে অবধের নবাব সুজা-উদ-দৌলার সাথে একটি চুক্তি হয়। এতে আগ্রাসী মারাঠা শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক সাহায্যের বিনিময়ে রোহিলারা চল্লিশ লক্ষ টাকা দিতে রাজি হয়। তবে অবধ আক্রমণ করার পর, তারা অর্থ দিতে অস্বীকার করে।
পরবর্তীতে রোহিলারা প্রতিবেশী অবধ রাজ্য কর্তৃক আক্রান্ত হয়, যারা কর্নেল আলেকজান্ডার চ্যাম্পিয়নের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনী থেকে সহায়তা পেয়েছিল। এই সংঘাত রোহিলা যুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধে হাফিজ রহমত খান বারেস নিহত হলে ১৭৭৪ সালের এপ্রিল মাসে রোহিলা প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। রোহিলখণ্ড তখন আওধ রাজ্যের সাথে সংযুক্ত হয়। অধিকাংশ রোহিলা হয় দেশত্যাগ করে বা অধিভুক্তির বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। এই সংঘাতে ওয়ারেন হেস্টিংসের ভূমিকা তার অভিশংসনের সময় প্রচারিত হয়েছিল। [১৩]
১৭৭৪ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত আওধ (অধরাজ্য) শাসকদের প্রতিনিধি হিসাবে এই অঞ্চলটি হরিয়ানার একজন মেও খাজা আলমাস খান দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। এই সময়টি রোহিলাদের জন্য বিশেষভাবে কঠিন ছিল। কারণ আলমাস খান রোহিলাদের দুর্বল করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। ১৭৯৯ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলটিকে সংযুক্ত করে এবং হাফিজ রহমত খান বারেসের পরিবারকে পেনশন দিতে শুরু করে। [১৪]
রোহিলখণ্ডের প্রায় অধিকাংশ অংশ সংযুক্ত করার পর ১৭৭৪ সালের ৭ অক্টোবর কর্নেল আলেকজান্ডার চ্যাম্পিয়নের উপস্থিতিতে নবাব ফয়জুল্লাহ খান রাম পুর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তারপরে ব্রিটিশ সুরক্ষার অধীনে এটি একটি অনুগত রাজ্য হয়। ১৭৭৫ সালে নবাব ফয়জুল্লাহ খান রামপুরে নতুন দুর্গের প্রথম প্রস্তর স্থাপন করেন। প্রথম নবাব ফৈজাবাদ শহরের নাম পরিবর্তন করার প্রস্তাব করেছিলেন; কিন্তু অন্যান্য অনেক জায়গা এই নামে পরিচিত ছিল, তাই এর নাম পরিবর্তন করে মুস্তাফাবাদ রাখা হয়েছিল।
১৭৭৬ সালে রুস্তম আলী বিজনোরির লেখা কিসা ও আহওয়াল-ই-রোহিলা রোহিলখণ্ড এবং কাতেহরের মুসলিম রোহিলা অভিজাতদের পরিমার্জিত উর্দু গদ্যের উদাহরণ প্রদান করে। [১৫]
নবাব ফয়জুল্লাহ খান ২০ বছর রাজত্ব করেন। তিনি শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং আরবি, ফার্সি, তুর্কি ও হিন্দুস্তানি পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ শুরু করেন, যা এখনো রামপুরের রাজা লাইব্রেরিতে রাখা আছে। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র মোহাম্মদ আলী খান দায়িত্ব নেন। ২৪ দিন রাজত্ব করার পর তিনি রোহিলা প্রবীণদের হাতে নিহত হন এবং তার ভাই গোলাম মোহাম্মদ খানকে নবাব ঘোষণা করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এটির বিরোধীতা করে এবং মাত্র ৩ মাস ২২ দিনের রাজত্বের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনী গোলাম মুহাম্মদ খানকে অবরোধ ও পরাজিত করে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুহাম্মদ আলী খানের পুত্র আহমদ আলী খানকে নতুন নবাব হতে সমর্থন করে। তিনি ৪৪ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তার কোন পুত্রসন্তান ছিল না, তাই গোলাম মুহাম্মদ খানের পুত্র মুহাম্মদ সাঈদ খান তার মৃত্যুর পর নতুন নবাব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি আদালত প্রতিষ্ঠা করেন এবং স্থানীয় কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মুহাম্মদ ইউসুফ আলী খান দায়িত্ব নেন এবং ১৮৬৫ সালে তার মুত্যুর তাঁর পুত্র কাল আলী খান নতুন নবাব হন [১৬]
রামপুরের নবাব | রাজত্ব শুরু হয় | রাজত্ব শেষ | |
---|---|---|---|
১ | ফয়জুল্লাহ খান | ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৭৭৪ | ২৪ জুলাই, ১৭৯৩ |
২ | মোহাম্মদ আলী খান বাহাদুর | ২৪ জুলাই, ১৭৯৩ | ১১ আগস্ট, ১৭৯৩ |
৩ | গোলাম মুহাম্মদ খান বাহাদুর | ১১ আগস্ট, ১৭৯৩ | ২৪ অক্টোবর, ১৭৯৪ |
৪ | আহমদ আলী খান বাহাদুর | ২৪ অক্টোবর, ১৭৯৪ | ৫ জুলাই, ১৮৪০ |
৫ | নসরুল্লাহ খান - রাজপ্রতিনিধি | ২৪ অক্টোবর, ১৭৯৪ | ১৮১১ |
৬ | মুহাম্মদ সৈয়দ খান বাহাদুর | ৫ জুলাই, ১৮৪০ | ১ এপ্রিল, ১৮৫৫ |
৭ | ইউসেফ আলী খান বাহাদুর | ১ এপ্রিল, ১৮৫৫ | ২১ এপ্রিল, ১৮৬৫ |
৮ | কাল আলী খান বাহাদুর | ২১ এপ্রিল, ১৮৬৫ | ২৩ মার্চ, ১৮৮৭ |
৯ | মুহাম্মদ মোশতাক আলী খান বাহাদুর | ২৩ মার্চ, ১৮৮৭ | ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৯ |
১০ | হামিদ আলী খান বাহাদুর | ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৯ | ২০ জুন, ১৯৩০ |
১১ | জেনারেল আজিমুদ্দিন খান - রিজেন্ট | ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৯ | ৪ এপ্রিল, ১৮৯৪ |
১২ | রাজা আলী খান বাহাদুর | ২০ জুন, ১৯৩০ | ৬ মার্চ, ১৯৬৬ |
১৩ | মুর্তজা আলী খান বাহাদুর - ১৯৭১ সালে নবাবি বিলুপ্ত হয় | ৬ মার্চ, ১৯৬৬ | ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২ |
১৪ | মুরাদ আলী খান বাহাদুর | ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২ | আলম্বিত |
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ও ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন হওয়ার মধ্যবর্তী সময় রোহিলা সম্প্রদায়ের জন্য বেশ স্থিতিশীলতার সময় ছিল। ১৮৫৮ সালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় বিদ্রোহে যারা অংশ নিয়েছিল এবং কিছু অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেছিল তাদের সকলের জন্যে সাধারণ ক্ষমা জারি করেছিল। তবে বিদ্রোহীদের সাহায্য করার জন্য কয়েকটি উপজাতিগোষ্ঠীকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। কিছু উপজাতি দিল্লি ও গুরগাঁওতে স্থানান্তরিত হতে হয়েছিল; অন্যরা দাক্ষিণাত্যে চলে গিয়েছিল। কয়েক বছর পর যখন পরিস্থিতি উন্নত হয় এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে অভিবাসন পুনরায় শুরু হয়, ঠিক তখন রোহিলা জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাক। এই সময়ে রোহিলারাও স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের সংস্কারবাদী আন্দোলনে প্রভাবিত হয়েছিল এবং অনেকে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিল। সুন্নি ইসলামের বেরেলভি শাখার প্রতিষ্ঠাতা আহমদ রেজা খান রোহিলা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং বেরেলি শহর তখন উত্তর ভারতে ইসলামীশিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ছিল।[১৭]
যদিও অধিকাংশ রোহিলা জমির মালিক ও চাষী ছিল; তবে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘু পশ্চিমাশিক্ষা গ্রহণ করে এবং আইন ও চিকিৎসার মতো পেশায় প্রবেশ করে। ১৯ শতকের শেষের দশকে তারা রাজনৈতিক বিতর্কেও আগ্রহী হতে শুরু করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নবগঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেয় এবং অন্যরা সর্ব-ইসলামবাদে আকৃষ্ট হয়। এই সময়ে তাদের মাঝে উত্তর ভারতীয় মুসলিম সংস্কৃতির একটি পাইকারি গ্রহণধারাও দেখা যায়। উর্দু তখন রোহিলা লোকদের মাতৃভাষা হয়ে ওঠে। আসলে তখন রোহিলা শব্দটি ধীরে ধীরে "পাঠান" শব্দের সাথে প্রতিস্থাপিত হচ্ছিল, যা তাদের জন্য একটি নতুন আত্মপরিচয় ছিল । তাদের মাঝে স্বতন্ত্র পরিচয়ের ধারণা সুদৃঢ় ছিল এবং তখন রোহিলারা শহরের বিভিন্ন স্থান; যেমন : কাকর টোলা, পানিটোলা ও ব্রেলির গালি নওয়াবানে বসবাস করত, যেটি হাফিজ রহমত খানের বংশধরদের বাড়ি ছিল। প্রতিবেশী মুসলিম সম্প্রদায় যেমন শেখ, মুসলিম রাজপুত ও কাম্বোহদের সাথে তাদের আন্তঃবিবাহও হয়েছিল। এভাবে স্বাধীনতার ভোরে রোহিলারা তাদের স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ের মর্যাদা হারাচ্ছিল। [১৭]
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা রোহিলা সম্প্রদায়ের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। তাদের অনেক সদস্য পাকিস্তানে চলে যায়। যারা ভারতে ছিল, তারা ১৯৪৯ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পাশাপাশি ভারত কর্তৃক রামপুর রাজ্য দখল করা হলে তারা প্রভাবিত হয় এবং তাদের মধ্যে অনেকেই পাকিস্তানের করাচিতে তাদের আত্মীয়দের সাথে যোগ দিতে চলে যায়। তারা বর্তমান পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ভারতে তারা একটি ছোট সংখ্যালঘু দল নিয়ে দুটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় গঠন করেছে।
রোহিলারা এখন উত্তরপ্রদেশের একটি বৃহত্তর মুসলিম সম্প্রদায় গঠন করেছে এবং উত্তরপ্রদেশ জুড়ে তাদের পাওয়া যায়। সেখানপ রোহিলখণ্ডের রামপুর, বেরেলি, শাহজাহানপুরে তাদের জনবসতি সবচেয়ে ঘন।
ইউপির পাঠান ( রোহিলা ) সম্প্রদায়ের ষোলটি উপ-গোষ্ঠী রয়েছে: ঘিলজাই, আফ্রিদি, বারাকজাই, বারেস, দাউদজাই, মারওয়াত, দুররানি, বেত্তানি, নাঘর, সুর পশতুন, কাকার, খলিল, মহমান্দ, ওরজাফজাই, ঘোর ঘুষ্টি এবং মোহাম্মদ উজির; এদের সবাই সুপরিচিত পশতুন উপজাতির বংশধর। কিছু রোহিলা মহারাষ্ট্রের ওয়াশিম, নান্দেড় জেলা এবং কিনওয়াত তহসিলে উপজাতীয় এলাকায় বাস করে। কিনওয়াত তালুকার বেন্দি এবং কোপড়া গ্রামেও একটি ছোট জনসংখ্যা রয়েছে। উত্তরপ্রদেশের শহরগুলোর মুসলিম এলাকার পুরনো অংশে পাঠানরা তাদের নিজস্ব আবাসিক এলাকা বজায় রেখেছে। তারা কোনো আন্তঃবিবাহী গোষ্ঠী নয় এবং একই ধরনের সামাজিক মর্যাদার অন্যান্য সুন্নি মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে সাজানো বিয়ে হয়। যেমন: মুঘল উপজাতি, মুসলিম রাজপুত ও শেখ; যদিও নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়েতে অগ্রাধিকার রয়েছে।
রোহিলারা ঐতিহাসিকভাবে জমির মালিক ও সৈনিক ছিল। তাই তাদের কিছু অংশ রোহিলখণ্ডে কৃষিকাজের সাথে যুক্ত। তবে ১৯৪০ - এর দশকে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত অনেক রোহিলা অফিসার পাকিস্তানে চলে এসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তাদের মধ্যে বিখ্যাত হলেন জেনারেল রহিমুদ্দিন খান ও জেনারেল আখতার আবদুর রহমান। এছাড়া তারা ইউপিতে মুসলিম ধর্মীয় ক্ষেত্রেও বিশিষ্ট অবদান রেখেছে। অনেক আলিম, হাফেজ তৈরি করেছে এবং অনেক মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ ও অর্থায়ন করেছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের এমন একটি সম্প্রদায় হিসাবে দেখা হয়, যাদের পশ্চিমা শিক্ষার প্রতি অনুকূল মনোভাব রয়েছে এবং তাদের অনেকেই পেশাদার ডাক্তার ও আইনজীবী। [১৮]
পাকিস্তানে রোহিলা এবং অন্যান্য উর্দুভাষী পাঠানরা এখন সম্পূর্ণরূপে বৃহত্তর উর্দুভাষী সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্তীকরণ হয়েছে। পাকিস্তানের রোহিলা পাঠানদের বংশধরদের মধ্যে অন্য মুসলিমদের সাথে উচ্চমাত্রার আন্তঃবিবাহের কোনো বোধ নেই। রোহিলারা প্রধানত করাচি, হায়দ্রাবাদ, সুক্কুর এবং সিন্ধুর অন্যান্য শহুরে এলাকায় বাস করে। [১৯] অনেকেই সরকারের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন ; বিশেষ করে সাহেবজাদা ইয়াকুব খান। তিনি একজন রোহিলা, যিনি ১৯৮০-এর দশকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।
আফগান প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দাউদ খান ও সাবেক রাজা জহির শাহ ছিলেন রোহিলা পাঠান।