লল্লেশ্বরী বা লাল দেদ (১৩২০-১৩৯২), ছিলেন কাশ্মীরের শৈববাদী হিন্দু দর্শন শিক্ষাকেন্দ্রের এক অতীন্দ্রি়য়বাদী।[১][২] তিনি ছিলেন বৎসুন বা বাক্স নামক রহস্যময় কবিতা শৈলীর স্রষ্টা যার আক্ষরিক অর্থে "বক্তৃতা" (সংস্কৃত বাক থেকে যার উৎপত্তি)। লাল বাক্স নামে পরিচিত, তার কবিতাগুলি কাশ্মীরি ভাষার প্রাচীনতম রচনা এবং আধুনিক কাশ্মীরি সাহিত্যের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।[৩][৪]
লাল দেদ (লাল মাতা বা মা লালা) অন্যান্য বিভিন্ন নামেও পরিচিত ছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে লাল দিয়াদ (দিয়াদের অর্থ দিদিমা), লাল্লা আরিফ, লাল দিদ্দি, লল্লেশ্বরী, লাল্লা যোগেশ্বরী/যোগেশ্বরী এবং লালশ্রী।[৫][৬][৭][৮]
লাল দেদের জীবনের বেশিরভাগ তথ্য পাওয়া যায় স্থানীয় লোক কথা ও লোকগাথা থেকে যা ভিন্ন ভিন্ন লোকমুখে আলাদা আলাদাভাবে কথিত ও ব্যক্ত হয়েছে। তার ফলে তার জীবনীর বিবরণ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে।[৯] অসংখ্য সমসাময়িক কাশ্মীরি ইতিহাসকার, যেমন জোনারাজা, শ্রীভারা, প্রজ্যভট্ট এবং হায়দার মালিক চাদুরা তাদের লিখিত নথিতে লাল দেদের উল্লেখ করেননি।[৯] লাল দেদের জীবনের প্রথম লিখিত নথিটি তাদকিরাত-উল-আরিফিন (১৫৮৭) থেকে পাওয়া যায় যা মুল্লা আলী রৈনা দ্বারা লিখিত সাধু ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের জীবনী সংকলন। এছাড়াও বাবা দাউদ মিশকাতি -র আসরার উল-আকবর (১৬৫৪) এ তার জীবনের বিবরণ পাওয়া গেছে। এই গ্রন্থগুলিতে, লাল দেদকে একজন রহস্যময় সাধিকা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে যিনি প্রধানত বন ভ্রমণকারীদের প্রায়শই দর্শন দেন।[৯] ১৭৩৬ সালে রচিত খাজা আজম দিদ্দামারি র তারিখ-ই-আজামী -তে লাল দেদের জীবনের আরও বিশদ বিবরণ রয়েছে।[৯] ফার্সি ধারাবিবরণী ওয়াকিয়াতি-ই-কাশ্মীরতে (১৭৪৬) তার কথা উল্লেখ করা আছে। সেই গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি সুলতান আলাউ-উদ-দিনের (১৩৪৩-৫৪) শাসনকালে বিখ্যাত হন এবং সুলতান শিহাব উদ্দীনের শাসনকালে তিনি মারা যান (১৩৫৪-৭৩)।[১০]
লাল দেদকে ইরানী সুফি পন্ডিত ও কবি মীর সৈয়দ আলী-হামদানি -র সমসাময়িক বলে মনে করা হয়। তিনি কাশ্মীর ভ্রমণের সময় তার নিজের কবিতায় তার ভ্রমনের গল্প লিপিবদ্ধ করেছিলেন।[১১]
বেশিরভাগ আধুনিক পণ্ডিতদের মত অনুযায়ী লাল দেদের জন্ম ১৩০১ এবং ১৩২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, সেম্পোর বা পান্দ্রেন্থানের কাছে।[১০][২] তিনি ১৩৭৩ সালে মারা গেছেন বলে অনুমান করা হয় এবং বলা হয় বিজবেহারার কাছে তাকে সামাধিস্থ করা হয়েছে যদিও কোন নিশ্চিতকরণ নেই। অনুমান করা হয় লাল দেদ এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং স্থানীয় রীতিনীতি অনুসারে বারো বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল।[৯] বিয়ের পর, প্রথা অনুযায়ী তার নাম পরিবর্তন করে পদ্মাবতী রাখা হয়, কিন্তু লালা বা লাল দেদ নামেই তার পরিচিতি অব্যাহত থাকে।[১০] কিছু রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে তার বৈবাহিক জীবন অসুখী ছিল,[১০] এবং তিনি ২৪ এবং ২৬ বছর বয়সের মধ্যে একজন শিব উপাসক সিদ্ধপুরুষ সিদ্ধ শ্রীকান্ত বা সেদ বয়ুর শিষ্য হওয়ার জন্য বাড়ি ছেড়েছিলেন।[৯] তার ধর্মীয় শিক্ষার অংশ হিসাবে, তিনি একাকী বিভিন্ন স্থানে পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করেছিলেন এবং ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনযাপন করেছেন। একজন শিক্ষক এবং আধ্যাত্মিক নেতা হওয়ার আগে এরকমই ছিল তার জীবন।[৯]
লাল দেদের কবিতাগুলি কাশ্মীরি সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন এবং করে সেই সময়কালের অন্তর্ভুক্ত যখন উত্তর ভারতে কথিত অপভ্রংশ-প্রাকৃত থেকে পৃথক হয়ে কাশ্মীরি ভাষা একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে।[১২] বলা হয় বাকস নামে পরিচিত মোট ২৮৫টি কবিতা লাল দেদের রচনা।[৯]
লাল দেদের রচনাগুলি ভারতীয় উপ-মহাদেশের সংস্কৃত, ইসলামিক, সুফি, শিখ প্রভূত ভাষা সংস্কৃতি থেকে প্রভাবিত এবং এই বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনকারী এক সূত্র।[৯]
তিনি কাশ্মীরে শৈবধর্মের রহস্যময় ঐতিহ্যের বাহক ছিলেন, যা ১৯০০ সালের আগে ত্রিকা নামে পরিচিত ছিল।[১৩]
লাল দেদের বাক্সের বেশ কয়েকটি নতুন অনুবাদ সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত হয়েছে। লাল দেদের জীবন ও কবিতার উপর ভিত্তি করে সমসাময়িক অনেক নাটিকা প্রস্তুত হয়েছে। সমসাময়িক কিছু গানে লাল দেদের কবিতার অনুকরন অথবা অনুবাদিত অংশ ব্যাবহার হয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে সারা ভারত জুড়ে ইংরেজি, হিন্দি এবং কাশ্মীরি ভাষায় লাল দেদের জীবনের উপর ভিত্তি করে একটি একক নাটক অনুষ্ঠিত হয়েছে যাতে মুখ্য চরিত্রে অভিনেত্রী মিতা বশিষ্ট অভিনয় করেছেন।[১৪][১৫]
লাল দেদের রচনাগুলি প্রথম বিংশ শতাব্দীতে লিখিতভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল এবং তারপর থেকে প্রায়শই কাশ্মীরি এবং ভাষা অনুবাদে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। ১৯১৪ সালে, স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন, একজন বেসামরিক কর্মচারী এবং লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সুপারিনটেনডেন্ট, লাল দেদের বাক্সগুলির একটি অনুলিপি অনুমোদিত করেছিলেন। তার আগে বাক্সগুলির কোনোরকম লিখিত নথি অনুপলব্ধ ছিল। কাশ্মীরের গুশ শহরে বসবাসকারী গল্পকার ধর্ম-দাসা দরবেশের দ্বারা সম্পাদিত বাক্সগুলির একটি মৌখিক বর্ণনার প্রতিলিপি করে একটি প্রস্তুত করা হয়েছিল। এই পাণ্ডুলিপিটি গ্রিয়ারসন দ্বারা ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছিল এবং লালা-বাক্যানি, বা লাল দেদের জ্ঞানী উক্তি হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল।[১৬] গ্রিয়ারসন হাঙ্গেরীয়-ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক এবং পণ্ডিত স্যার মার্ক অরেল স্টেইন দ্বারা প্রস্তুতকৃত আংশিক অনুবাদকে একত্রিত ও প্রসারিত করেন এবং কাশ্মীরি প্রবাদ ও উক্তিগুলির অভিধানে অন্তর্ভুক্ত কিছু সংগ্রহ করা কবিতাও তার মধ্যে যোগ করেন (১৮৮৮)।[৯]
গ্রিয়ারসনের অনুবাদ ছিল লাল দেদের রচনার প্রথম মুদ্রিত ও প্রকাশিত খণ্ড। তার অনুবাদের পর লাল দেদের রচনার বেশ কিছু ইংরেজি অনুবাদ তৈরি করা হয়েছে যার মধ্যে উল্লেখ্য পন্ডিত আনন্দ কৌল (১৯২১), স্যার রিচার্ড কারনাক টেম্পল (১৯২৪)[১৭] এবং জয়লাল কৌল (১৯৭৩) -এর অনুবাদ। আরও সাম্প্রতিক অনুবাদের মধ্যে রয়েছে কোলম্যান বার্কস,,[১৮] জয়শ্রী ওডিন কাক,[১৯] এবং রঞ্জিত হোসকোট -এর অনুবাদ।[৯]
তার কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন রিচার্ড টেম্পল, জয়লাল কৌল, কোলম্যান বার্কস,[২০] জয়শ্রী ওডিন এবং রঞ্জিত হোসকোট।[২১][২২][২৩][২৪]
নেতৃস্থানীয় কাশ্মীরি সুফি ব্যক্তিত্ব শেখ নূর-উদ-দীন ওয়ালি (নূরউদ্দিন ঋষি বা নুন্দা ঋষি নামেও পরিচিত) লাল দেদের দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত ছিলেন। তিনি সাধু সন্তদের সংগঠন ঋষি আদেশ -এর নেতৃত্ব দেন যা পরবর্তীকালে রেশ মীর সাইবের মতো অনেক সাধুসন্তের উত্থানের পটভূমি হয়ে ওঠে।[১] কাশ্মীরি লোককাহিনী অনুসারে শিশু অবস্থায় নুনদা ঋষি তার মায়ের দুগ্ধপান করতে অস্বীকার করেছিলেন, তখন লাল দেদ তাকে দুগ্ধপান করান।[২৫]
লাল দেদ এবং তার অতীন্দ্রিয় সঙ্গীতের প্রভাব এখনও কাশ্মীরিদের মনে গভীর প্রভাবশালী। ২০০০ সালে নয়াদিল্লিতে লাল দেদের স্মরনে অনুষ্ঠিত জাতীয় আলোচনাসভায় তার উপর রচিত আধুনিক স্মরনিকা বইটি প্রকাশিত হয়।[২৬] তার ট্রায়াডিক মিস্টিসিজম বইতে, পল ই. মারফি লাল দেদকে "ভক্তিমূলক বা আবেগ-ভিত্তিক ট্রায়াডিজমের প্রধান ব্যাখ্যাকারী" বলে অভিহিত করেছেন।[২৭][৪] তার মতে, নবম শতাব্দীর শেষার্ধ এবং চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ এই পাঁচশ বছরের সময়কালে কাশ্মীরে ভক্তিবাদের তিন উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধি আবির্ভূত হয়েছিল যার মধ্যে লাল দেদ ছিলেন একজন।[৪][২৮]
লাল দেদের রচিত গান ও কবিতা তাঁর আধ্যাত্মিক জীবনের অসাম্প্রদায়িক প্রকৃতির দিকে ইঙ্গিত করে। তার জীবন এবং কাজ সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। কবি রঞ্জিত হোসকোটের রচনা থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়।[৯]
২০০৪ সাল থেকে ভারত জুড়ে ইংরেজি, হিন্দি এবং কাশ্মীরি ভাষায় লাল দেদের জীবনের উপর ভিত্তি করে রচিত একটি একক নাটক প্রদর্শিত হচ্ছে যাতে মুখ্য চরিত্রে অভিনেত্রী মিতা বশিষ্ট অভিনয় করেছেন। [২৯][৩০]
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; আলাদা বিষয়বস্তুর সঙ্গে "lal" নামটি একাধিক বার সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে