গালা বা লাক্ষা একধরনের কীটজ পণ্য যার প্লাস্টিকের মত ধর্ম আছে। গাছের ডালে স্ত্রী লাক্ষাকীটের (Coccus lacca) ক্ষরিত আঠালো নির্যাসকে জৈব দ্রাবক দ্বারা শুদ্ধ করে লাক্ষা প্রস্তুত হয়। একে গলিয়ে ছাচে ঢালাই করা যায় (thermoplastic)। কঠিন গালা কমলা/খয়েরী রঙের ভঙ্গুর পদার্থ। এটি ভক্ষণ করলে কোন ক্ষতি হয় না তাই খাবার ঔষধ বা লজেন্চুষে দেওয়া যায় (food additive E number E904)।রাসায়নিকভাবে, এটি মূলত অ্যালিউরিটিক অ্যাসিড, জালারিক অ্যাসিড, শেলোলিক অ্যাসিড এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক মোমের সমন্বয়ে গঠিত।[১]
ভারত ও চিনের লাক্ষা শিল্প প্রায় তিন হাজার বছরের পুরানো। লাক্ষা উৎপাদনে ভারতের স্থান পৃথিবীতে প্রথম। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়ার লাক্ষা শিল্প বেশ প্রাচীন। রঘুনাথপুর, মানবাজার, ঝালদা, বাঘমুণ্ডি এলাকার বহু মানুষ এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছেন। উপযুক্ত পরিকল্পনা ও উন্নয়নের অভাবে লাক্ষা শিল্প তার প্রাপ্য মর্যাদা হারাচ্ছে। লাক্ষার যে গুরুত্ব কতখানি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথর্ববেদে লাক্ষার বিবরণ আছে। ঔষধ হিসেবে লাক্ষার ব্যবহার প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। সংস্কৃত সাহিত্যে পলাশ গাছকে লাক্ষা তরু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। লাক্ষা বা ল্যাক কথাটি সম্ভবত লক্ষ (১০০০০০) কথা থেকে এসেছে।
লক্ষ লক্ষ লার্ভা একসাথে থেকে লাক্ষা উৎপাদন করে। পলাশ গাছে যে লাক্ষা কীট জন্মায় তার বিজ্ঞান সম্মত নাম কমব্রিটান কোয়াড্রানুলার। পলাশ গাছ ছাড়াও কুল গাছেও লাক্ষা জন্মায়। এই লাক্ষা কীটের লার্ভা গাছের কাণ্ড ঘিরে অবস্থান করে। এদের দেহ নিঃসৃত রস শুকনো আবরণ তৈরি করে। শাখাসহ আবরণ সংগ্রহ করে তা থেকে লাক্ষা বা গালা তৈরি করা হয়। বর্তমানে লাক্ষা শিল্প যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লাক্ষার ভেষজ গুণ অপরিসীম।[২]
১) ভারত ছাড়াও ম্যাক্সিকো এবং থাইল্যান্ডে লাক্ষা বা গালা ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ঔষধের সাথে লাক্ষা মেশানো হয়। থাইল্যান্ডে জ্বর সারাতে লাক্ষা ব্যবহার করা হচ্ছে। পাকস্থলীর অসুখে লাক্ষা কাজে লাগে। গোমিয়া নামে যে ঔষধ তৈরি হয় তার মূল উপাদান লাক্ষা।
২) লাক্ষা জলে ভিজিয়ে যে রঙীন দ্রবণ পাওয়া যায় তা ক্ষত স্থানে লাগালে ক্ষত তাড়াতাড়ি সেরে যায়।
৩) দুধ বা ঘিয়ের সাথে লাক্ষা লেই খেলে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যায়।
৪) মধুর সাথে লাক্ষা গুড়ো খেলে রক্ত পরিষ্কার হয়। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
৫) শরীর অতিরিক্ত মোটা হওয়ার হাত থেকে লাক্ষা রক্ষা করে।
৬) রোগ জীবাণু প্রতিরোধে লাক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।
৭) মশলা সহযোগে লাক্ষা পাউডার গরু ঘোড়ার খুরের গর্ত ভরাট করতে কাজে লাগে।
৮) কয়েকরকম ট্যাবলেট ও ক্যাপসুলের কোটিং বা বাইরের আবরণ তৈরিতে লাক্ষা ব্যবহার করা হয়। ঔষধ শিল্পে লাক্ষার গুরুত্ব আছে। রসুন, ভিটামিন সি, পুদিনা ট্যাবলেটের বাইরের আবরণ অনেক সময় লাক্ষা দিয়ে করা হয়।
৯) লাক্ষা থেকে যে চাঁচ গালা পাওয়া যায় তা পুতুল, খেলনা, কাঠের আসবাবপত্র বার্নিশ করতে কাজে লাগে।
১০) লাক্ষা বা গালা দিয়ে নানারকম মূর্তি তৈরি করা হয়। খেলনা, পুতুল, চুড়ি তৈরিতে গালা কাজে লাগে।
লাক্ষার বহুবিধ ব্যবহার এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখার অন্যতম হাতিয়ার। প্রাকৃতিক লাক্ষার উপযোগিতা সম্পকে মানুষের উপযুক্ত জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। লাক্ষা চাষের জন্য বা এই শিল্পের প্রসারে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনা দরকার। লাক্ষা শিল্প উন্নীত করার লক্ষ্যে এখনই কাজ জরুরী। সঠিক পদক্ষেপে এই শিল্প অর্থের জোয়ার আনতে পারে। গরিব মানুষের মুখে ফোটাতে পারে হাসি।[৩]
প্রাচীন ভারতে লাক্ষা ব্যবহারের বিখ্যাত উদাহরণ মহাভারতের জতুগৃহ- একটি সুরম্য প্রাসাদ যা দাহ্য মোম ও গালা দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল।