অন্যান্য নাম | লোকুমাদেস, লোকমাদেস, লুকমাত, লোকমাত আলকাদি |
---|---|
ধরন | মিষ্টান্ন |
প্রধান উপকরণ | ঈস্টের খামির, তেল; চিনির শিরা অথবা মধু |
লোকমা (তুর্কী), লুকমা (আরবি: لقمة), লোকুমাদেস (গ্রিক: λουκουμάδες), এছাড়াও অন্যান্য ভাষায় অন্য নামের সাথে পরিচিত খামিরযুক্ত এবং কড়া ভাজা ময়দার তৈরি এক প্রকার মিষ্টান্ন, যা চিনির সিরা বা মধুতে ডুবিয়ে রাখা হয়, আবার কখনও দারচিনি বা অন্যান্য উপাদান দিয়েও প্রলেপ দেওয়া হয়ে থাকে।[১] ১৩শ শতাব্দীর প্রথমদিকে আল-বাগদাদী খাবারটিকে লুকমাত আল-ক্বাদি (لقمة القاضي) বা "কাজীর এক গাল খাদ্য" হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।[২][৩][৪]
আরবি শব্দ লুকমা (لقمة) (বহুবচন লুকমাত এবং তুর্কি শব্দ লোকমা যা খাবারটির আকারের কারণের করা হয়েছে৷ এটা একবারে মুখে দেয়া যায় বলে একে এক গাল খাবার বলা হয়।[৫][৬] বাংলাতেও মুখে একবার যে খাবার দেয়া যায় তাকে এক লোকমা খাবার বলা হয়ে থাকে।
লুকমাত আল-ক্বাদির রন্ধনপ্রণালীটি হলো ঈস্টযুক্ত ময়দার খামির গরম ডুবো তেলে কড়া ভাজার পর গোলাপজলের সাথে মধু বা চিনির সিরায় ডুবিয়ে রাখা হয়। মধ্যযুগের প্রথম দিকে এবং ১৩শ শতাব্দীর আব্বাসীয় খিলাফতের যুগে সেসময়কার কিছু রান্নার বইয়ে খাবারটির রন্ধনপ্রণালী উল্লেখ করা হয়েছিল। খাবারটির কথা আরব্য রজনীর পোর্টার এবং বাগদাদের তিন নারী গল্পেও উল্লেখ করা হয়েছিল।[২][৪] বর্তমানে পারস্য উপসাগরীয় আরব দেশগুলিতে লুকমাতে এলাচ বা জাফরান যুক্ত করায় মশলাদারও হয়ে থাকে।[৪] মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশে খাবারটিকে আওয়ামাত (عوامة) অর্থ "সাঁতারু" বা জেলেবিয়া (زلابيا) নামে বলা হতে পারে, যদিও পরবর্তী শব্দটি পেঁচানো বা সোজা রুলের আকারে তৈরি একই ধরনের খাবারকে (জিলাপি) বোঝায়।[৭][৮][৯]
এগুলি ঐতিহ্যগতভাবে বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠান পালনের সময় অন্যান্য খাবারের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে; যেমন: লেভ্যান্ট রমজানে মুসলমানরা, হনুক্কায় ইহুদিরা এবং এপিফানিতে খ্রিস্টানরা একইভাবে খাবারটিকে তাদের ধর্মানুষ্ঠানের একটি অংশ করে নেয়।[৭][৯][১০]
মধ্যযুগীয় ভারতে ভ্রমণের সময় ১৪শ শতাব্দীতে বিখ্যাত পরিব্রাজক এবং পণ্ডিত ইবনে বতুতা মুলতানে একটি নৈশভোজে লুকমাত আল-ক্বাদী নামে পরিচিত খাবারটি খুঁজে পেয়েছিলেন, যেখানে তার আয়োজকরা খাবারটিকে আল-হাশিমি বলে অভিহিত করেছিলেন।[৪]
তুরস্কের পিসি বা তুজলু লোকমা (নোনতা লোকমা) নামে পরিচিত বোর্টসগ হলো লোকমার একটি প্রকার, যা কোনও চিনির সিরা বা মধুবিহীনভাবে তৈরি করা হয়, তুর্কি ও মঙ্গোলিয়ান রন্ধনশৈলীতে এটি একটি প্রধান খাদ্য। ময়দা, চিনি, ঈস্ট এবং লবণের সংমিশ্রণে তৈরি খামিরকে ছোট বলের আকারে তৈরি করে ডুবো তেলে ভাজা হয় এবং পরে চিনির সিরা বা মধুতে ডুবিয়ে রাখা হয়। বহু শতাব্দী ধরে উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রাসাদের রন্ধনশৈলীতে খাবারটি জায়গা করে নিয়েছিল এবং বলকানের উসমানীয় সাম্রাজ্য, মধ্য প্রাচ্য এবং ককেশাসের পূর্ববর্তী দেশগুলির রন্ধনশৈলী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। ইরাক ও গ্রিসের মতো পূর্ববর্তী উসমানীয় দেশগুলিতে এটি একটি সাধারণ মিষ্টান্ন হলেও তুরস্কে এটি বিশেষ দিন ব্যতীত প্রতিদিনের মিষ্টি হিসাবে খাওয়া হয়না। ঐতিহ্যগতভাবে, কেউ মারা যাওয়ার চল্লিশ দিন পরে নিহতের নিকটাত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবগণ প্রচুর পরিমাণে লোকমা তৈরি করে এবং প্রতিবেশী ও পথচারীদের মাঝে পরিবেশন করে থাকে। জনসাধারণ কাতার বানিয়ে থালা পেতে সারি আকারে অবস্থান করে এবং লোকমা খাওয়ার পরে বিনিময়ে মৃতের আত্মার জন্য দোয়া পাঠ করে থাকে।
গ্রীস এবং সাইপ্রাসে তাদের সাইপ্রিয়ট গ্রিক ভাষায় লোকুমাডেস (λουκουμάδες) এবং লোকমাদেস (λοκμάδες) বলা হয়। এগুলি সাধারণত একটি মধু বা চিনির সিরায় দারচিনি দিয়ে মশলাদার করা হয় এবং উপরে হালকাভাবে গুঁড়া চিনি ছিটিয়ে দেওয়া যায়।
গ্রীক ইহুদিরা এগুলিকে জাভেইংই (σβίγγοι) নামে অভিহিত করে, যারা এগুলিকে বিশেষত হনুক্কার উৎসবে তৈরি করে থাকে।[১১][১২] "স্পঞ্জ" এর আরবি ভাষার এই শব্দটি সম্ভবত প্রাথমিকভাবে বাইজেন্টাইনের মিষ্টান্নের নাম ছিল এবং পরে রোমানিয়টরা লোকুমাদেস নাম হিসাবে ব্যবহার করেছিল।[১২]
চিনির সিরায় ডুবানো ময়দা দিয়ে ভাজা বিভিন্ন ধরনের খাবার বিশেষত ভূমধ্যসাগর, মধ্য প্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ায় খুঁজে পাওয়া যায়, যেমন: ইতালীয় স্ট্রুফোলি (লোকমা তৈরির প্রণালীর সদৃশ), জিপ্পোল, ভারতীয় জিলাপি এবং গুলাব জামুন, ইত্যাদি।
সিসিলির গ্রিক কবি আর্কেস্ট্রাটাস বর্ণিত লোকমার অনুরূপ একটি খাবার ছিল এনক্রিস (গ্রিক: ἐγκρίς, এটি জলপাইয়ের তেলে ভাজা একটি ময়দার বল, যা তিনি তার গ্যাস্ট্রনোমিতে বিশদ বর্ণনা করেছেন; বইটি এখন হারিয়ে গেছে, তবে আংশিকভাবে এথেনিয়াসের ডেপনোসোফিস্টগুলিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে।