হযরত লোকমান হাকীম (এছাড়াও লোকমান প্রজ্ঞাবান, এবং লুকমান, নামেও পরিচিত; আরবি: لقمان) ছিলেন একজন বিজ্ঞ লোক যার নামে আল কুরআনের একত্রিশতম সূরা, সূরা লুকমান (আরবি: سورة لقمان) এর নামকরণ করা হয়। লোকমান (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব একাদশ শতাব্দী) বর্তমান সুদানের নুবিয়ায় বসবাস করতেন বলে ধারণা করা হয়।[১][২] ফার্সি, আরবি ও তুর্কি সাহিত্য এবং প্রাথমিক ঐতিহাসিক গ্রন্থ কুরআনের তাফসীর তাফসীরে ইবনে কাসীরে লোকমান সম্বন্ধে অনেক ঘটনা বর্ণিত রয়েছে। কুরআনে বর্ণিত নেই যে লোকমান নবী ছিলেন কি না, তবে কিছু লোক তাকে নবী হিসাবে বিশ্বাস করে এবং নামের শেষে আলাইহিস সালাম (আঃ) লিখেন।
লোকমানকে একজন উপলব্ধি পূর্ণ ব্যক্তি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল, যিনি সর্বদা তার চারপাশের প্রাণী এবং গাছপালা দেখতেন এবং তিনি যা দেখেন তার ভিত্তিতে বিশ্বকে বোঝার চেষ্টা করতেন। একদিন, যখন তিনি গাছের নীচে ঘুমাচ্ছিলেন, একজন ফেরেশতা তার কাছে এসে বললেন যে আল্লাহ লোকমানকে একটি উপহার দিতে চান: হয় তিনি জ্ঞান পাবেন অথবা তিনি একজন রাজা হবেন। লোকমান জ্ঞান বেছে নেন। যখন ঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠেন, তিনি লক্ষ্য করেন তার জ্ঞান এবং বোধশত্তি অনেক তীক্ষ্ণ হয়ে গেছে। তিনি প্রকৃতির সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য অনুভব করেন এবং বিভিন্ন জিনিসের বস্তুগত অস্তিত্বের বাইরে, তার অন্তরীণ গভীর সত্য বুঝতে পারেন। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি এই মহান উপহারের জন্য সিজদায় লুটিয়ে পড়েন এবং আল্লাহকে ধন্যবাদ ও প্রশংসা জানান।
লোকমান দাস ব্যবসায়ীদের হাতে ধরা পড়েছিলেন এবং তারা তাঁকে দাস হিসাবে বিক্রি করে দিয়েছিল। তিনি তার চলাফেরা এবং বাকস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, কিন্তু তার দাসত্বকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে মেনে নিয়ে তিনি ধৈর্য সহকারে আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে তার সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
যে লোকটি লোকমানকে কিনেছিলেন তিনি একজন বুদ্ধিমান ও সুহৃদ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি লোকমানের সাথে সদয় আচরণ করতেন। তিনি বুঝতে পারেন লুকমান কোনও সাধারণ মানুষ নন, তাই তাঁকে পরীক্ষা করার জন্য একটি ভেড়া জবাই করে তার নিকৃষ্টতম অংশটি তার কাছে আনার নির্দেশ দেন। লোকমান ভেড়া জবাই করে তার হৃদয় (হৃৎপিণ্ড) ও জিহ্বাকে তার মনিবের কাছে নিয়ে যান। এগুলো দেখে তার মনিব মৃদু হাসেন, তিনি লোকমানের "সবচেয়ে খারাপ" অংশের বিচার দেখে মুগ্ধ হন। তিনি বুঝতে পারেন লোকমান কোনো গভীর অর্থ বোঝানোর চেষ্টা করছেন, যদিও তিনি তার অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করতে পারেননি। তখন থেকেই তার মালিক লোকমানের প্রতি আরও আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং তার প্রতি আরও দয়ালু আচরণ করতে থাকেন।
কিছুদিন পরে, তিনি লোকমানকে আবার একটি ভেড়া জবাই করে, পশুর সেরা অংশগুলি তার কাছে নিয়ে যেতে বলেন। লোকমান তার মনিবকে অবাক করে দিয়ে আবার একই অঙ্গ (হৃদয় ও জিহ্বা) নিয়ে আসলেন। তার মনিব লোকমানকে জিজ্ঞাসা করলেন কীভাবে হৃদয় এবং জিহ্বা উভয়ই সর্বোৎকৃষ্ট এবং নিকৃষ্টতম অংশ হতে পারে। বুদ্ধিমান লোকমান উত্তর দেন, "জিহ্বা এবং হৃদয় মধুরতম অংশ যদি এর মালিক খাঁটি হয়। আর যদি সে খারাপ হয় তবে এগুলোও তেমনি খারাপ হবে!" এরপর থেকে লোকমানের মনিব তাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে নিজের কাছে রাখতেন। বহু লোক লোকমানের নিকট পরামর্শ নিতে আসেন এবং তার জ্ঞানের খ্যাতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
হাদীস শিক্ষা দেয় যে কিছু বান্দাদের জন্য একটি উচ্চ পদ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে কখনও কখনও, সেইসব বান্দারা এত উচ্চ পদে পৌঁছানোর জন্য ভাল কাজ করে তা অর্জন করতে পারেনি। সুতরাং আল্লাহ তাকে কিছু বিপর্যয়ের সাথে জড়িত করে দেন, যদি তিনি ধৈর্য সহকারে তা গ্রহণ এবং বহন করেন তবে তিনি সেই উচ্চ অবস্থানে পৌঁছাতে সক্ষম হবেন। হাদীস অনুসারে, লোকমান যখন শিক্ষা দিচ্ছিলেন, তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, "আপনি এতো দূর কীভাবে এলেন?" মানে সে কীভাবে এই উচ্চ পদ পেলেন। লোকমান বলেন, "সত্য কথা বলা,ওয়াদা পূরণ করা, এবং যা আমাকে চিন্তিত করে না তা ঝেড়ে ফেলে দেওয়া।"
কুরআনে বর্ণনার অনেক আগে লোকমান একটি আরবীয় পৌরাণিক ব্যক্তির নাম ছিল। দুটি চরিত্রের সম্পর্ক নিয়ে ধর্মতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকভাবে অনেক বিতর্ক ও আলোচনা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে এটি একই ব্যক্তি, অন্যরা কেবল বলে যে তাদের শুধু একই নাম ছিল। আরবি প্রবাদ সংকলন আসলে দুটি চরিত্রকেই মিশ্রিত করে, কুরআন ও পূর্ব-ইসলামিক বর্ণনা থেকে দেখা যায় তাকে অতিমানবীয় শক্তি দেয়া হয়েছিল। পূর্ব-ইসলামিক লোকমান ছিলেন সেই আদ জাতির অন্তর্ভুক্ত যারা বর্তমান ইয়েমেনের নিকটবর্তী আরব উপদ্বীপে আল-আহকাফে বাস করতেন। [৩]