শতরঞ্জ (আরবি: شطرنج; ফার্সি: شترنج; পারসিক থেকে চতরঙ্গ چترنگ) হল দাবার একটি পুরানো রূপ, যেমনটি সাসানীয় সাম্রাজ্যে খেলা হত। এর উৎস ভারতের চতুরঙ্গ খেলা থেকে।[১] আধুনিক দাবা ধীরে ধীরে এই ক্রীড়াটি থেকে বিকশিত হয়েছিল। দশম শতাব্দীতে, এটি মুসলিম আন্দালুসিয়া (আধুনিক স্পেন) এবং সিসিলি থেকে যোগাযোগের মাধ্যমে পশ্চিমী বিশ্বে পরিচিত হয়েছিল।
পার্সিয়ান শব্দ শতরঞ্জ এসেছে সংস্কৃত শব্দ (সংস্কৃত: चतुरङ्ग থেকে; (চতুঃ: "চার"; অঙ্গ: "বাহু"), এই শব্দটি দিয়ে চতুরঙ্গ খেলাকে বোঝায়। পারসিকে শব্দটি হয়েছে চতরঙ্গ্, সিনকোপ (শব্দের হ্রস্বীকৃত বানান বা উচ্চারণ) এর কারণে 'উ'কার লুপ্ত হয়েছে এবং শেষের 'অ'কার লুপ্ত হয়েছে অ্যাপোকপ (শব্দের শেষাংশ বর্জন) এর কারণে। পারসিক লোক ব্যুৎপত্তিতে, একটি পারসিক লেখায়, শাহ প্রথম অর্দশিরকে (যিনি ২২৪–২৪১ পর্যন্ত শাসন করেছিলেন) এই খেলায় অত্যন্ত দক্ষ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে:
"দূরদর্শিতার ফলে, অর্দশির, পোলো, ঘোড়সওয়াড়ি, চতরঙ্গ এবং ভাইন-আরতাখশির ইত্যাদি যুদ্ধের মত খেলায় সব চেয়ে বেশি জয়যুক্ত হয়ে উঠেছিলেন এবং অন্যান্য বিভিন্ন শিল্পেও পারদর্শী ছিলেন।"[২]
তবে কর্ণমাকয়ে অনেকগুলি উপকথা ও কিংবদন্তি রয়েছে এবং তা থেকে এটি রচনার সময় চতরঙ্গের জনপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়।[৩]
পরবর্তী সাসানীয় রাজা প্রথম খুসরুর রাজত্বকালে (৫৩১–৫৭৯), কোনও ভারতীয় রাজার উপহারের (সম্ভবত কনৌজের মৌখরি রাজবংশ)[৪] মধ্যে ছিল পান্নার ষোলটি এবং রুবির ষোলটি ঘুঁটির (সবুজ বনাম লাল) একটি দাবা।[৩] দাবাখেলার প্রতিস্পর্ধাটি খুসরুর দরবারীরা সফলভাবে সমাধান করেছিল। এই ঘটনার উল্লেখ ফেরদৌসীর শাহনামাতেও (আনুমানিক ১০১০) রয়েছে।
ভারতে আজ দেখা চতুরঙ্গের বিধিবিধানের প্রচুর প্রকরণ রয়েছে, তবে সবগুলিই সেনাবাহিনীর চারটি শাখার (অঙ্গ) সঙ্গে জড়িত: ঘোড়া (নাইট), হাতি (বিশপ), রথ (রুক) এবং পদাতিক সৈনিক (পন), এগুলি দিয়ে একটি ৮×৮ বোর্ডে খেলা হয়। চতুরঙ্গের মতো অনেকটা একই নিয়মে শতরঞ্জ খেলাটি হয়, এবং এতেও মূল ১৬টি ঘুঁটি আছে। একটি বৃহত্তর ১০×১১ বোর্ডও রয়েছে, যেটি হল চতুর্দশ শতাব্দীর টেমরলেন দাবা, বা শতরঞ্জ কামিল (নিখুঁত দাবা), এর ঘুঁটিগুলির আকার একটু ভিন্ন।
কিছু পরবর্তী রূপগুলিতে গাঢ় বর্গক্ষেত্রগুলি খোদাই করা হয়েছিল। খেলাটি মুসলিমদের পারস্য বিজয়ের পরে পশ্চিম অভিমুখে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং ৮ম শতাব্দী থেকে খেলার কৌশল এবং পরিকল্পনা সম্পর্কিত প্রচুর লেখা তৈরি হয়েছিল।
শুরুর দিকের ভারতীয় চতুরঙ্গে (আনুমানিক ৫০০–৭০০), রাজাকে বন্দী করা যেত এবং তার পরেই খেলাটি শেষ হয়ে যেত। ইরানীয় শতরঞ্জে (আনুমানিক ৭০০-৮০০) সতর্ক করার ধারণাটি চালু হয়েছিল, যে রাজা আক্রমণের মুখে আছে (আধুনিক পরিভাষায় কিস্তি) ঘোষণা করে। খুব তাড়াতাড়ি এবং আকস্মিকভাবে যাতে খেলাটি শেষ না হয় সেই উদ্দেশ্যে এটি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ইরানীয়রা অতিরিক্ত নিয়ম যোগ করে যে কোনও রাজাকে কিস্তি হতে পারে এমন স্থানে স্থানান্তরিত করা যায় না সেইভাবে রেখেও দেওয়া যায় না। ফলস্বরূপ, রাজাকে বন্দী করা যায়না,[৫] এবং কিস্তিমাত হল খেলা শেষ করার একমাত্র সিদ্ধান্তমূলক উপায়।[৬]
ইসলামের প্রসারের সাথে, দাবাখেলা মাগরেব এবং তারপরে আন্দালুসীয় স্পেনে ছড়িয়ে গিয়েছিল। ভারতবর্ষে ইসলামি সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় (আনুমানিক দ্বাদশ শতাব্দী), খেলার কিছু প্রকার আবার ভারতে ফিরে এসেছিল, কিছু শব্দ থেকে এটি প্রমাণিত হয়, যেমন উত্তর ভারতীয় শব্দ মাত (মেট, ফার্সি ভাষা মাৎ থেকে প্রাপ্ত) বা বাংলায় বোড়ে (পন, আরবি শব্দ বৈড়াক থেকে উদ্ভূত)।[৭] পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে, দাবা খেলা ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, শেষ পর্যন্ত তার থেকেই আধুনিক দাবার উৎপত্তি হয়েছিল।
গ্রন্থপঞ্জি