শম্ভুনাথ দে | |
---|---|
জন্ম | ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৫ |
মৃত্যু | ১৫ এপ্রিল ১৯৮৫ | (বয়স ৭০)
মাতৃশিক্ষায়তন |
|
পরিচিতির কারণ |
|
পুরস্কার |
|
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন | |
কর্মক্ষেত্র | |
প্রতিষ্ঠানসমূহ | |
ডক্টরাল উপদেষ্টা | রয় ক্যামেরন |
শম্ভুনাথ দে (১ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৫ – ১৫ এপ্রিল, ১৯৮৫) একজন বাঙালি হিন্দু বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক। তিনি কলেরা রোগের সংক্রমণ পদ্ধতি ও কলেরা টক্সিনের আবিষ্কারক। বিজ্ঞানী রবার্ট কখ কলেরা রোগের জীবাণু আবিষ্কার করলেও তাঁর সংক্রমণ পদ্ধতি সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারেননি। ডঃ দে'র কলেরা টক্সিন আবিষ্কারের পর ভারত থেকে কলেরা রোগের মতো মহামারী রোগ সম্পূর্ণ রূপে নিরাময় করা সম্ভব হয়েছে।[১]
শম্ভুনাথ দে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি হুগলি জেলার গড়বতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ও মাতার নাম দাশুরথি দে ও চট্টেশ্বরী দেবী। দাশুরথিদের পিতার মৃত্যু হওয়ার পর জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে তাঁর শৈশব থেকেই সাংসারিক ব্যয়ভার গ্রহণ করতে হয়। বাল্যকাল থেকেই তিনি গ্রামের এক মুদি দোকানের সহকারীর কাজ করা আরম্ভ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নিজে একটা ছোটখাট ব্যবসা আরম্ভ করলেও উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। তবে দাশুরথি ও চট্টেশ্বরী দেবীর জ্যেষ্ঠ পুত্র হওয়ায় শম্ভুনাথ শৈশব থেকেই খুবই আদরে ও মমতায় বড়ো হয়। শম্ভুনাথ দে'র কাকার নাম ছিল আশুতোষ দে। তাঁর ঠাকুরদার প্রভূত সম্পত্তি থাকলেও বন্যায় সবই ডুবে গেলে আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়ে শম্ভুনাথের পরিবার।
তৎকালীন সময়ে তাদের পরিবারে শম্ভুনাথের কাকা শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন। কাকার অনুপ্রেরণায় শম্ভুনাথ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। গরিবাটি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি ডিস্টিংশন সহ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। মাধ্যমিকে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ায় তিনি হুগলি মহসিন কলেজে পড়বার জন্যে বৃত্তি পান। উচ্চ মাধ্যমিকেও তিনি তার কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন এবং ফলস্বরূপ কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়বার সুযোগ পান এবং ডি. পি. আই. বৃত্তি লাভ করেন। সেই সময়ে তাদের পরিবারে আর্থিক অনটন শুরু হলে সেই সময়কার কলকাতার একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কে সি শেঠ তাঁকে সাহায্য করেন। তাঁর আর্থিক সাহায্যে ও ব্যক্তিগত স্কলারশিপে শম্ভুনাথ ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে সক্ষম হন।
মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রথম থেকেই মেধাবী ও ধীরস্থির প্রকৃতির শম্ভুনাথ শিক্ষকদের নজর কাড়তে সক্ষম হন এবং রোগবিদ্যা বিভাগে অনুজীব বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও শিক্ষক মণীন্দ্রনাথ দে’র স্নেহের পাত্রে পরিণত হন তিনি। ফলে আর্থিক দিক থেকে দুই পরিবারের মধ্যে বৈষম্য থাকলেও তিনি তাঁর কন্যা তরুবালা দেবীর সঙ্গে শম্ভুনাথের বিয়ে দেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে শম্ভুনাথ এম. বি. এবং ১৯৪২ সালে ট্রপিক্যাল চিকিৎসাবিদ্যায় ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজের রোগবিদ্যা ও অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগে প্রদর্শক পদে নিযুক্ত হন। অধ্যাপক বি. পি. ত্রিবেদীর অধীনে তিনি তার গবেষণা কার্য শুরু করেন। অধ্যাপক বি.পি. ত্রিবেদীর অধীনে গবেষণাকালে তারা যুগ্মভাবে বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
অধ্যাপক দে'র জীবনে মণীন্দ্রনাথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি শম্ভুনাথকে অধ্যাপক জি. আর. ক্যামেরনের অধীনে হাইড্রোসেফালাস রোগের দ্বারা মস্তিষ্কে কী ধরনের পরিবর্তন হয় সেই সম্পর্কিত গবেষণার জন্য ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ হসপিটাল মেডিকাল বিদ্যালয়ে প্রেরণ করেন।
গবেষণাকালে শম্ভুনাথকে একটি অন্যরকম বাধার সম্মুখীন হতে হয়। তিনি লক্ষ্য করেন, যে ইঁদুরটি নিয়েই তিনি গবেষণা করতে যাচ্ছেন সেটিই দুর্ভাগ্যজনকভাবে পালমোনারী রক্তসঞ্চালনে বাধার কারণে ফুসফুস স্ফীত হয়ে মারা যাচ্ছে। এই ঘটনার ফলে তিনি হাইড্রোসেফালাস ও পালমোনারী রক্তসঞ্চালনের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয় নিয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী হন। তিনি Pulmonary edema and experimental hydrocephalus বিষয়ে তাঁর বৈজ্ঞানিক সন্দর্ভ রচনা করেন এবং ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসলেও অধ্যাপক ক্যামেরনের সাথে তাঁর আমৃত্যু যোগাযোগ ছিল।
দেশে ফিরে তিনি নীল রতন সরকার মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি ও ব্যাক্টিরিয়লজি বিভাগে যোগ দেন এবং কলেরা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তার কলেরা নিয়ে গবেষণার অনেক আগে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী রবার্ট কখ কলেরা জীবাণু নিয়ে কাজ করতে কলকাতাতে আসেন। সেই সময় অবিভক্ত বাংলার পূর্ব ও পশ্চিমের বিভিন্ন জেলা গুলিতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। যার ফলে খুব অল্প দিনের মধ্যেই মহামারিতে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। কলকাতায় কলেরা রোগ নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানী কখ কলেরা জীবাণুকে চিহ্নিত করলেন ও ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি তার গবেষণা পত্র প্রকাশ করলেন। কিন্তু কখ রোগের জীবাণু (Vibrio cholerae) আলাদা করলেও কোনভাবেই এই জীবাণু দ্বারা সুস্থ প্রাণীর শরীরে রোগ সৃষ্টি করতে পারলেন না। ফলে রোগের জীবাণু আবিষ্কার হলেও রোগ প্রতিরোধ সম্ভব হচ্ছিল না। তিনি মনে করেছিলেন জীবাণুটি দ্বারা নিঃসৃত বিষ হলো একধরনের এন্ডোটক্সিন, যা ব্যাকটেরিয়াটির কোশপ্রাচীরের সাথে যুক্ত থাকে এবং সেটিই কোশকে পুরোপুরি মেরে ফেলে। অথচ এই প্রক্রিয়ারও কোনো সঠিক বর্ণনা দিতে তিনি অসমর্থ হন। বিজ্ঞানী শম্ভুনাথ কখ প্রবর্তিত এই কলেরা রোগ সংক্রমণ পদ্ধতির বিরোধিতা করেন। তিনি একটি প্রাণী মডেল তৈরি করার চেষ্টা করেন যার দ্বারা সংক্রমণ পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা যায়। পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে তিনি প্রাণী মডেলটি তৈরি করতে সক্ষম হন। তার এই গবেষণাপত্রটি An experimental study of the mechanism of action of Vibrio cholerae on the intestinal mucous membrane শিরোনামে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। তার এই বৈজ্ঞানিক সন্দর্ভটিকে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারি একটি দৃষ্টান্তমূলক সন্দর্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।[২]
পরবর্তীকালে এই বিষয়ে গবেষণাকালে বিজ্ঞানী শম্ভুনাথ কখ প্রবর্তিত কলেরা রোগ সংক্রমণ পদ্ধতির বিরোধিতা করেন। পুরোনো ধ্যানধারণাকে পাল্টে তিনি বলেন কলেরার বিষটি একপ্রকার এক্সোটক্সিন প্রকৃতির। তার এই মতামতের সপক্ষে তিনি একটি পরীক্ষা করলেন- বিচ্ছিন্ন আন্ত্রিক ফাঁস পরীক্ষণ বা Ligated Intestinal Loop Experiment। তিনি একটি খরগোশের ক্ষুদ্রান্ত্রের কিছুটা অংশ ওপর নিচে সুতো দিয়ে বেঁধে তার মধ্যে ইঞ্জেকশন করে কলেরার জীবাণু প্রবেশ করলেন। পরদিন দেখা যায়, ক্ষুদ্রান্ত্রের ওই অংশ চাল ধোয়া জলের মত তরল পদার্থে (যা কলেরা রোগীর মলের মত দেখতে) ভরে গেছে। এর পর তিনি গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে কলেরা জীবাণুর বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে কোশ নিঃসৃত তরল পদার্থ খরগোশের ক্ষুদ্রান্ত্রে প্রবেশ করিয়ে একই ফল পেলেন।[৩] যারদ্বারা তিনি প্রমাণ করলেন কলেরার জীবাণু যে বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে তা এক্সোটক্সিন প্রকৃতির এবং এন্টেরোটক্সিনধর্মী। তিনিই প্রথম কলেরা গবেষণায় খরগোশকে ব্যবহার করে সফলভাবে রোগ সংক্রমণ পদ্ধতি উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। তার এই পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত নেচার গবেষণা পত্রিকায় Enterotoxicity of bacteria-free culture-filtrate of Vibrio cholerae শিরোনামে প্রকাশিত হয়। সেই সময়ে এই সন্দর্ভটি পরিচিতি না পেলেও বতর্মানে এই থিসিস পেপারকে কলেরা গবেষণার মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।[৪] তার গবেষণার ফলে Vibrio cholerae-এর বিষের প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন হওয়ায় ও কলেরা টক্সিন আবিষ্কার পরবর্তীতে কলেরা রোগের প্রতিষেধক প্রস্তুতি ও নিরাময় সম্ভব হয়।[৫]
১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তার গবেষণা জীবনের পথপ্রদর্শক অধ্যাপক ক্যামেরন মারা গেলে তিনি ভীষণভাবে আঘাত পান। তিনি বলেছিলেন- His death put the last nail on my struggle against all these odds. ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন ও কাজের উপযুক্ত স্বীকৃতি না পাওয়ায় ভীষণভাবে হতাশ হয়ে পরেন।[৬]
পরবর্তীতে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে নোবেল ফাউন্ডেশন তাঁকে কলেরা ও ডায়রিয়ার উপর অনুষ্ঠিত ৪৩তম বার্ষিক সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানালে তিনি মানসিকভাবে কিছুটা শক্তি ফিরে পান। সম্মেলনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বলেন,
(ইংরেজি)
«I have been dead since the early 1960’s, I have been exhumed by the Nobel Symposium Committee |
(বাংলা)
«১৯৬০-এর গোড়ার দিক থেকে আমি ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়ি, নোবেল সিম্পোজিয়াম কমিটি আমাকে উদ্ধার করেছে। এবং আপনাদের সঙ্গে এই দু'দিন থেকে আমি অনুভব করতে পারছি যে আমি এখন জীবিত।» |
(শম্ভুনাথ দে, নোবেল ফাউন্ডেশন সম্মেলন) |
তিনি তার পরবর্তী জীবনে আবার গবেষণায় মনোনিবেশ করেন ও গবেষণাতেই নিজেকে উতসর্গ করেন।
নোবেলজয়ী প্রফেসর যোশুয়া লেন্ডারবার্গ প্রফেসর দে'র গবেষণা সম্পর্কে বলেন[৭]
(ইংরেজি)
«De's clinical observations led him to the bold thought that dehydration was a sufficient cause of pathology of cholera that the cholera toxin can kill merely by stimulating the secretion of water into the bowel» |
(বাংলা)
«প্রফেসর দে'র রোগশয্যাসম্বন্ধীয় পর্যবেক্ষণ তাঁকে সপ্রতিভভাবে নিশ্চিত করে যে ডিহাইড্রেশনই হল কলেরা রোগের পর্যাপ্ত কারণ; কলেরা বিষটি কেবলমাত্র অন্ত্রের মধ্যে জলের স্রাবকে উদ্দীপনা দিয়ে মৃত্যু ঘটাতে পারে» |
(যোশুয়া লেন্ডারবার্গ) |
তিনি একাধিকবার নোবেল কমিটির কাছে বিজ্ঞানী শম্ভুনাথ দে’র নাম মনোনয়ন করলেও কোন অজ্ঞাত কারণে তা কোনবারই গ্রাহ্য হয়নি।[৬] কলেরা রোগীদের ব্যাপক তরল ক্ষয় পূরণের জন্য হেমেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় আবিষ্কৃত মৌখিক পুনরুদন থেরাপি বা ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি (ওআরটি), যা অসংখ্য রোগীর জীবন বাঁচিয়েছে, বিজ্ঞানী দে'র কলেরা টক্সিন আবিষ্কারের প্রত্যক্ষ ফলাফল হিসাবে বিবেচনা করা হয়।[৪] বিজ্ঞানী শম্ভুনাথ দে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ এপ্রিল কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।