বেদসমূহ ও সেগুলির সংশ্লিষ্ট শাখাসমূহ |
---|
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ-সংক্রান্ত একটি সিরিজের অংশ |
Hinduism portal |
শাখা (সংস্কৃত:शाखा) হল হিন্দু ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায়। এক-একটি শাখা এক-একটি নির্দিষ্ট বৈদিক ধর্মগ্রন্থ শিক্ষায় বিশেষজ্ঞ অথবা এক-একটি শাখা এক-একটি নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থকে অনুসরণ করে।[৩][৪] নির্দিষ্ট শাখার অনুগামীকে বলে ‘শাখী’।[৫] হিন্দু দর্শনে নাস্তিক শাখার অনুগামীকেও একই নামে ডাকা হয়।[৬]
এই ধরনের বৈদিক সম্প্রদায়কে বোঝাতে চরণ (অর্থাৎ, জীবনচর্যা বা ব্যবহার) শব্দটিও ব্যবহার করা হয়:[৭] "’চরণ’ ও ‘শাখা’ শব্দদুটি কখনও কখনও সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার হলেও, ‘চরণ’ শব্দটির দ্বারা একটি শাখায় আবদ্ধ একটি সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে বোঝায় এবং ‘শাখা’ শব্দটির ধারা তারা যে ধর্মগ্রন্থটিকে অনুসরণ করে তাকে বোঝায়। যেমন ‘শাখাং অধিতে’ শব্দটিতে (অর্থাৎ, ‘তিনি বেদের একটি নির্দিষ্ট সংস্করণ অধ্যয়ন করেন’) বোঝানো হয়েছে।"[৪] প্রত্যেকটি শাখার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এগুলিকে ‘শাখাভেদঃ’ বা ‘বিভিন্ন (বৈদিক) শাখার ভেদ’ বলা হয়। প্রতিটি শাখা একটি নির্দিষ্ট বৈদিক সংহিতা শিক্ষা করে। সেই সঙ্গে তার সঙ্গে সংযুক্ত ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, শ্রৌতশাস্ত্র, গার্হ্যসূত্র ও উপনিষদ্গুলিও শিক্ষা করে।[৩][৪]
হিন্দু সমাজের প্রথাগত নিয়মানুসারে, নির্দিষ্ট শাখার সঙ্গে সম্পর্কটি বর্ণ-পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ঋগ্বৈদিক যুগের শেষে ব্রাহ্মণ শব্দটি পুরোহিত শ্রেণীর সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। কিন্তু এই বর্ণের মধ্যেও জাতি ও শাখার বিভাজন অনুসারে উপবিভাগ থেকে যায়।[৮] যে ব্রাহ্মণ নিজের শাখা পরিবর্তন করতেন তাঁকে ‘শাখারণ্ডঃ’ বা ‘শাখাদ্রোহী’ বলা হত।[৩]
প্রত্যেক বেদের সঙ্গে যুক্ত শাখা-সংক্রান্ত তথ্যের প্রথাগত সূত্র হল চরণব্যূহ। এর দুটি সংস্করণ পাওয়া যায়। এগুলি মোটামুটি একই রকমের। একটি হল অথর্ববেদের ৪৯তম পরিশিষ্ট (যা শৌনকের লেখা বলে কথিত) এবং শুক্ল যজুর্বেদের পঞ্চম পরিশিষ্ট (যা কাত্যায়নের লেখা বলে পরিচিত)। এখানে বেশ কিছু শাখার উল্লেখ আছে যেগুলি অস্তিত্ব আগে ছিল এবং এই বইগুলি রচনার সময়ও ছিল। তবে বর্তমান যুগে অল্প কিছু সংখ্যক শাখারই অস্তিত্ব আছে।[৯]
শৌনকের চরণব্যূহ-এ ঋগ্বেদের পাঁচটি শাখার তালিকা আছে। এগুলি হল: শাকল, বাষ্কল, অশ্বলায়ন, সংখ্যায়ন ও মাণ্ডুক্যায়ন। এগুলির মধ্যে শাকল ও বাষ্কল শাখাদুটিই এখন প্রচলিত আছে। ঋগ্বেদের বাষ্কল শাখায় খিলানি রয়েছে, যা শাকল শাখায় নেই। তবে বর্তমানে পুনেতে রক্ষিত একটি শাকল শাখার কাশ্মীরী পাণ্ডুলিপিতে খিলানি দেখা যায়। শাকল শাখায় ঐতরেয় ব্রাহ্মণ এবং বাষ্কল শাখায় কৌষীতকী ব্রাহ্মণ রয়েছে। যদিও অশ্বলায়ন শখার সূত্র সাহিত্য গর্গ্য নারায়ণের একটি ‘বৃত্তি’ বা ভাষ্য পাওয়া যায়। এই সূত্রে একটি শ্রৌত ও একটি গৃহ্য সূত্র আছে। গর্গ্য নারায়ণের এই ভাষ্যটি ১১শ শতাব্দীতে রচিত দেবস্বামীর একটি দীর্ঘ ভাষ্যের ভিত্তিতে রচিত।[১০]
ঋষিদের নাম হতে এসব শাখার নামকরণ হয়েছে। বর্তমানে অধিকাংশ শাখাই বিলুপ্ত। কেবল কয়েকটি শাখা পাওয়া যায়। কাশিকাবৃত্তি গ্রন্থ ও কল্পসূত্রে ঋক্শাখার যেসব নাম দৃষ্ট হয় সেগুলো হল:
|
|
|
|
|
|
|
|
শৌনকের চরণব্যূহ-এ যজুর্বেদের ৮৬টি শাখার ৪২টি বা ৪৪টির তালিকা পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে মাত্র পাঁচটিই এখনও রয়েছে; আর একটি রয়েছে আংশিকভাবে। এই শাখাগুলি হল: বাজসনেয়ী মাধ্যন্দিন, কাণ্ব, তৈত্তিরীয়, মৈত্রেয়ানি, চরক-কঠ ও কপিষ্ঠল কঠ।
যজুর্বেদীয় শাখাগুলি শুক্ল ও কৃষ্ণ – এই দুই ভাগে বিভক্ত। শুক্ল শাখাগুলির পৃথক ব্রাহ্মণ রয়েছে। অন্যদিকে কৃষ্ণ শাখাগুলির প্রাচীন ব্রাহ্মণগুলি মন্ত্রের সঙ্গে মিশে গেছে।
শাখা | সংহিতা | ব্রাহ্মণ | আরণ্যক | উপনিষদ্ |
---|---|---|---|---|
মাধ্যন্দিন (বাজসনেয়ী সংহিতা মধ্যণ্ডিন) | বর্তমানে উত্তরভারতের সকল ব্রাহ্মণ ও দেশস্থ ব্রাহ্মণদের দ্বারা পঠিত | মাধ্যন্দিন শতপথ (শুক্ল যজুর্বেদীয় বাজসনেয়ী মাধ্যন্দিন) | শতপথ চোদ্দ, ১-৮-এ রক্ষিত (উচ্চারণভঙ্গি সহ)। | বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ = শুক্ল যজুর্বেদীয় বাজসনেয়ী মাধ্যন্দিন চৌদ্দ. ৩-৮, (উচ্চারণভঙ্গি সহ), ঈশাবাস্য উপনিষদ্ = বাজসনেয়ী সংহিতা মাধ্যন্দিন ৪০ |
কাণ্ব (বাজসনেয়ী সংহিতা কান্ব) | বর্তমানে উৎকল ব্রাহ্মণ, কন্নড় ব্রাহ্মণ, কড়ডে ব্রাহ্মণ ও কিছু আয়ার ব্রাহ্মণদের দ্বারা পঠিত। | কাণ্ব শতপথ (শুক্ল যজুর্বেদীয় বাজসনেয়ী কান্ব) (মধ্যণ্ডিনের থেকে পৃথক) | শুক্ল যজুর্বেদীয় বাজসনেয়ী কাণ্বের ষোলো অধ্যায়ে রক্ষিত | বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ = শুক্ল যজুর্বেদীয় বাজসনেয়ী কাণ্ব, (উচ্চারণভঙ্গি সহ), ঈশাবাস্য উপনিষদ্ = শুক্ল যজুর্বেদীয় বাজসনেয়ী কাণ্ব ৪০ |
কাত্যায়ন | - | - |
শাখা | সংহিতা | ব্রাহ্মণ | আরণ্যক | উপনিষদ্ |
---|---|---|---|---|
তৈত্তিরীয় | তৈত্তিরীয় সংহিতা, সমগ্র দক্ষিণ ভারত ও কোঙ্কণে প্রচলিত | তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ও বধূলা ব্রাহ্মণ (বধূলা শ্রৌত্রশাস্ত্রের অন্তর্গত) | তৈত্তিরীয় আরণ্যক | তৈত্তিরীয় উপনিষদ্ |
মৈত্রেয়ানী | মৈত্রেয়ানী সংহিতা, নাসিকের কিছু ব্রাহ্মণ পাঠ করেন | প্রকৃতভাবে উপনিষদ্টির অনুরূপ | মৈত্রেয়ানীয় উপনিষদ্ | |
চরক-কঠ | কঠ আরণ্যক (প্রায় সম্পূর্ণ বইটি একটি মাত্র পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায়) | কঠক উপনিষদ্, কঠ-শিক্ষা উপনিষদ্[১১] | ||
কপিষ্ঠল | কপিষ্ঠল-কঠ সংহিতা (খণ্ডিত পাণ্ডুলিপি, শুধুমাত্র প্রথম অংশের উচ্চারণভঙ্গি পাওয়া যায়) রঘুবীর কর্তৃক সম্পাদিত (উচ্চারণভঙ্গি ছাড়া) | - | - |
শৌনকের চরকব্যূহ-এ সামবেদের বারোটি শাখার উল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও কথিত আছে সামবেদের শাখার সংখ্যার ১,০০০। এগুলির মধ্যে মাত্র একটি অথবা দুটিই এখনও পর্যন্ত টিকে আছে।
সামবেদের শাখাদুটি হল জৈমিনীয় ও কৌথুম। কৌথুম শাখায় ৮টি এবং জৈমিনীয় শাখায় জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ রয়েছে।
শাখা | সংহিতা | ব্রাহ্মণ | আরণ্যক | উপনিষদ্ |
---|---|---|---|---|
কৌথুম | কৌথুম সংহিতা | ৮টি ব্রাহ্মণ (উচ্চারণভঙ্গি পাওয়া যায় না) | নেই। সংহিতাটিই একটি আরণ্যক। | ছান্দোগ্য উপনিষদ্ |
রণয়নীয় | কৌথুম শাখার মতো। কিঞ্চিৎ পার্থক্য রয়েছে। | নেই। সংহিতাটিই একটি আরণ্যক। | কৌথুম শাখার মতো। | |
জৈমিনীয়/তলবকার | প্রকাশিত ব্রাহ্মণ (উচ্চারণভঙ্গি নেই) – জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ, আর্ষেয় ব্রাহ্মণ | কেন উপনিষদ্ | ||
শাত্যায়ন | - | - |
অথর্ববেদের ৯টি শাখা ছিল। এগুলি হল: পৈপ্পলাদ,অলাদ,তৌড়, মৌড়, শৌনকীয়, জজল, ব্রহ্মবাদ, দেবদর্শ ও চরণ-বৈদ্য। এগুলির মধ্যে একমাত্র শৌনকীয় শাখাটিই মুদ্রিত ও মৌখিক প্রথায় এখনও পর্যন্ত টিকে আছে।
অথর্ববেদে শৌনকীয় ও পৈপ্পলাদ শাখায় বহু গ্রন্থগত ভুল আছে। অথর্ববেদের মূল গ্রন্থটিকে বিচার করলে এই ভুলগুলি ধরা পড়ে।
শাখা | সংহিতা | ব্রাহ্মণ | আরণ্যক | উপনিষদ্ |
---|---|---|---|---|
শৌনক | অথর্ববেদ সংহিতা, সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সম্পাদিত ও পঠিত। | অংশত গোপথ ব্রাহ্মণ (প্রকাশিত, উচ্চারণভঙ্গি নেই) | - | মুণ্ডক উপনিষদ্ (?) প্রকাশিত |
পৈপ্পলাদ | অথর্ববেদ পৈপ্পলাদ। উৎকল ব্রাহ্মণরা সংহিতা পাঠ করেন মাত্র। অন্যত্র দুটি পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়: কাশ্মীরী (অধিকাংশই সম্পাদিত) ও ওড়িয়া (আংশিক সম্পাদিত, উচ্চারণভঙ্গি নেই) | হারিয়ে গেছে, গোপথ ব্রাহ্মণের মতো | - | প্রশ্ন উপনিষদ্ |