শার্লট ব্রন্টি | |
---|---|
স্থানীয় নাম | Charlotte Brontë |
জন্ম | থর্নটন, ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ার, ইংল্যান্ড | ২১ এপ্রিল ১৮১৬
মৃত্যু | ৩১ মার্চ ১৮৫৫ হাওয়ার্থ, ইংল্যান্ড | (বয়স ৩৮)
সমাধিস্থল | সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড অল অ্যাঞ্জেল্স গির্জা, হাওয়ার্থ, ইংল্যান্ড |
ছদ্মনাম |
|
পেশা | ঔপন্যাসিক, কবি, গৃহশিক্ষিকা |
জাতীয়তা | ব্রিটিশ |
ধরন | কল্পসাহিত্য, কবিতা |
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি | |
দাম্পত্যসঙ্গী | আর্থার বেল নিকোলস (বি. ১৮৫৪) |
স্বাক্ষর |
শার্লট ব্রন্টি (ইংরেজি: Charlotte Brontë; ২১ এপ্রিল ১৮১৬ - ৩১ মার্চ ১৮৫৫)[১] ছিলেন একজন ইংরেজ ঔপন্যাসিক ও কবি। তিনি ব্রন্টি বোনদের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ ও প্রাপ্ত বয়স পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তার উপন্যাসগুলো ইংরেজি সাহিত্যের ধ্রুপদী সাহিত্যকর্ম হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।
১৮৩১ সালের জানুয়ারি মাসে ১৪ বছর বয়সে শার্লট রো হেডে বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি পরের বছর তার দুই বোন এমিলি ও অ্যানকে শিক্ষাদানের জন্য বাড়ি ফিরে আসেন এবং ১৮৩৫ সালে গৃহশিক্ষিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৩৯ সালে তিনি সিজউইক পরিবারের গৃহশিক্ষিকার দায়িত্ব নেন, কিন্তু কয়েক মাস পর তিনি হাওয়ার্থে ফিরে আসেন যেখানে তার বোনেরা একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু তার শিক্ষার্থী সংগ্রহে ব্যর্থ হয়। এর পরিবর্তে তারা লেখনী শুরু করেন এবং ১৮৪৬ সালে তারা যথাক্রমে কুরার, এলিস এবং অ্যাক্টন বেল ছদ্মনামে তাদের প্রথম কাজ প্রকাশ করেন। শার্লটের প্রথম উপন্যাস দ্য প্রফেসর প্রকাশকদের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয় এবং তার দ্বিতীয় উপন্যাস জেন আইয়ার ১৮৪৭ সালে প্রকাশিত হয়। এই বোনেরা ১৮৪৮ সালে তাদের বেল ছদ্মনাম উন্মোচন করেন এবং পরের বছর লন্ডন লিটারেরি সার্কেলের সাথে যোগ দেন।
শার্লটের বাকি বোনেরা অল্প বয়সে মারা যান। তিনি ১৮৫৪ সালের জুন মাসে বিয়ের কিছুদিন পর অন্তঃসত্ত্বা হন এবং ১৮৫৫ সালের ৩১শে মার্চ গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব ও বমিজনিত হাইপারমেসিস গ্র্যাভিডারামে রোগে মারা যান।
শার্লট ব্রন্টি ১৮১৬ সালের ২১শে এপ্রিল ওয়েস্ট রাইডিং অব ইয়র্কশায়ারের থর্নটনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আইরিশ অ্যাঞ্জেলিকান পাদ্রি প্যাট্রিক ব্রন্টি (পূর্বনাম ব্রান্টি) ও মারিয়া'র (প্রদত্ত নাম: ব্র্যানওয়েল) ছয় সন্তানের মধ্যে তৃতীয়। ১৮২০ সালে তার পরিবারে হাওয়ার্থ গ্রামে চলে যায় এবং সেখানে তার পিতা সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড অল অ্যাঞ্জেলস গির্জায় সহকারী পাদ্রি হিসেবে নিযুক্ত হন। মারিয়া ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৮২১ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর মারা যান। তার পাঁচ কন্যা - মারিয়া, এলিজাবেথ, শার্লট, এমিলি, ও অ্যান এবং এক পুত্র - ব্র্যানওয়েলকে তার বোন এলিজাবেথ ব্র্যানওয়েলের তত্ত্বাবধানে বড় হতে থাকে।[১]
১৮২৪ সালের আগস্ট মাসে প্যাট্রিক শার্লট, এমিলি, মারিয়া ও এলিজাবেথকে ল্যাঙ্কাশায়ারের কোওয়ান ব্রিজে ক্লার্জি ডটার্স স্কুলে পাঠান। এই বিদ্যালয়ের খাদ্যাভ্যাস ও কঠোর শৃঙ্খলা শার্লটের স্বাস্থ্য ও শারীরিক বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে এবং তার বড় দুইবোন মারিয়া ও এলিজাবেথ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৮২৫ সালের জুনে মারা যান। বড় দুই বোনের মৃত্যুর পর প্যাট্রিক শার্লট ও এমিলিকে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরত নিয়ে যান।[২] শার্লট এই স্কুলটিকে তার জেন আইয়ার বইয়ের মূলভিত্তি লোউড স্কুল হিসেবে ব্যবহার করেন, যেখানে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ রেভারেন্ড উইলিয়াম ক্যারাস উইলসনকে মিস্টার ব্রোকলহার্স্টের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখানো হয়েছে।[১]
১৮৪৬ সালে শার্লট, এমিলি ও অ্যান যৌথভাবে নিজেদের অর্থায়নে যথাক্রমে কুরার, এলিস এবং অ্যাক্টন বেল ছদ্মনামে তাদের প্রথম কাজ পোয়েমস বাই কুরার, এলিস অ্যান্ড অ্যাক্টন প্রকাশ করেন। বেল ছদ্মনামটি তাদের লিঙ্গ গোপন রাখে, কিন্তু তারা তাদের নামের প্রথম অক্ষরটি রেখে দেন, ফলে শার্লটের নাম ছিল কুরার। "বেল" ছিল হাওয়ার্থের সহকারী পাদ্রি আর্থার নিকোলস বেলের নামের মধ্যাংশ, যাকে শার্লট পরবর্তী কালে বিয়ে করেন; এবং "কুরার" ছিল ফ্রান্সেস ম্যারি রিচার্ডসন কুরারের নামের শেষাংশ, যিনি তাদের বিদ্যালয়ে অর্থায়ন করেছিলেন।[৩]
বইটি অল্প কিছু পর্যালোচনা লাভ করে ও মাত্র দুই কপি বিক্রি হয়। তদুপরি, তারা তিনজন লেখনী চালিয়ে যান এবং তাদের প্রথম উপন্যাস রচনার কাজ শুরু করেন, এবং তাদের ছদ্মনামেই সম্ভাব্য প্রকাশকদের কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠান।[১]
ব্রন্টির প্রথম পাণ্ডুলিপি, দ্য প্রফেসর, কোন প্রকাশকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। কর্নহিলের স্মিথ, এল্ডার অ্যান্ড কোং কুরার বেলের অন্য কোন দীর্ঘ কাজ যদি থাকে তাতে আগ্রহ দেখিয়ে তাকে উৎসাহ ব্যঞ্জক উত্তর পাঠালেও তিনি এতে কষ্ট পান।[৪] ব্রন্টি ১৮৪৭ সালের আগস্টে তার দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপি শেষ করেন এবং তা পাঠান। ছয় সপ্তাহ পরে জেন আইয়ার প্রকাশিত হয়। বইটিতে একজন গৃহশিক্ষিকার গল্প বর্ণিত হয়েছে, যেখানে গৃহশিক্ষিকা জেন তার শুরুর জীবনের প্রতিবন্ধকতা দূর করে তার নিয়োগকারী মিস্টার রোচেস্টারের প্রেমে পড়ে। তারা বিয়ে করে, তবে রোচেস্টারের পাগল প্রথম স্ত্রী বাড়িতে নাটকীয় অগ্নিকাণ্ডে মারা যাওয়ার পর, যার কথা জেন শুরুতে জানতেন না। বইটির ধরনে নতুনত্ব ছিল, গথিক আবেগপূর্ণ-নাট্যের সাথে স্বাভাবিকতার মিলন, এবং নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তম পুরুষে লেখার মাধ্যমে সাহিত্যে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে।[৫] ব্রন্টি মনে করেন শিল্প তখনই অধিক বোধগম্য যখন তা নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে হয়ে থাকে, জেন আইয়ার উপন্যাসে তিনি অভিজ্ঞতাকে সার্বজনীন আবেদনে রূপান্তরিত করেন।[৬]
ব্রন্টির তৃতীয় উপন্যাস ও তার জীবনকালে প্রকাশিত শেষ কর্ম ভিলেট ১৮৫৩ সালে প্রকাশিত হয়। এর মূল বিষয়বস্তু হল একাকিত্ব, কীভাবে এমন অবস্থা সহ্য করা যায়,[৭] এবং কোন ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষার ফলে বয়ে চলা অন্তর্দ্বন্দ্ব।[৮] এর মূল চরিত্র লুসি স্নো কল্পিত শহর ভিলেটের একটি বোর্ডিং স্কুলে পড়াতে যায়, যেখানে সে তার নিজের সংস্কৃতি ও ধর্ম থেকে ভিন্নমতের সাথে পরিচিত হয় এবং পল এমানুয়েল নামে এক ব্যক্তির প্রেমে পড়ে, যাকে সে বিয়ে করতে পারবে না। উপন্যাসের সংলাপের অনেকাংশই ফরাসি ভাষায়। ভিলেটের মাধ্যমে ব্রন্টি পুনরায় উত্তম পুরুষের দৃষ্টিকোণ (লুসি স্নো) থেকে লেখনীতে ফিরে আসেন; যা তিনি পূর্বে জেন আইয়ার উপন্যাসের ব্যবহার করেছিলেন। জেন আইয়ার-এর সাথে আরেকটি মিল হল এতেও তিনি তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে কল্পিত ঘটনাবলির সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন।[৮] ভিলেট বইটিকে সমালোচকেরা জোরালো ও আধুনিক লেখনী বলে উল্লেখ করেন, যদিও এটি "অমার্জিত" ও লুসির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশে খুব বেশি "নারীসুলভ" না হওয়ার জন্য সমালোচিত হয়েছিল।[৯]
ভিলেট প্রকাশিত হওয়ার আগে ব্রন্টি তার পিতার সহকারী পাদ্রি আর্থার বেল নিকোলসের নিকট থেকে বিবাহের প্রস্তাব পান, যিনি তাকে দীর্ঘদিন ধরে পছন্দ করতেন।[১০] তিনি শুরুতে এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন এবং নিকোলসের আর্থিক অবস্থার জন্য তার পিতার এই বিয়েতে কিছুটা অমত ছিল। এলিজাবেথ গাসকেল এই বিবাহকে একজন নারী জন্য উপকারী হিসেবে মনে করেন,[১১] এবং ব্রন্টিকে তাদের একত্র হওয়ার ইতিবাচক দিকগুলো বিবেচনার করতে উৎসাহ দেন এবং তার পরিচিতির সুবাদে নিকোলসের আর্থিক অবস্থার উন্নতির প্রয়াস নেন। ইতোমধ্যে, ব্রন্টি নিকোলসের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ১৮৫৪ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি তার প্রস্তাবে সম্মত হন। তারা এপ্রিল মাসে ব্রন্টির পিতার অনুমতি লাভ করেন এবং জুন মাসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।[১২] তার পিতা প্যাট্রিক শার্লটের কন্যাদানের সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ মুহূর্তে তিনি গির্জায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং শার্লট তাকে ছাড়াই বিয়ের উদ্দেশ্যে গির্জায় যান।[১৩] বিবাহ উত্তর এই দম্পতি আয়ারল্যান্ডের কাউন্টি অফালির ব্যানাগারে মধুচন্দ্রিমায় যান।[১৪] সর্বোপরি, ব্রন্টি এই বিয়েতে নিজেকে সুখী মনে করেন কারণ এই জীবন তার কাছে নতুন ছিল।[১০]
ব্রন্টি তার বিয়ের কিছুদিন পর অন্তঃসত্ত্বা হন, কিন্তু ধীরে ধীরে তার স্বাস্থ্য অবনতির দিকে যেতে শুরু করে। গাসকেলের মতে তিনি বিরামহীন বমি বমি ভাব ও চৈতন্য হারানোয় আক্রান্ত হন।[১৫] তিনি ১৮৫৫ সালের ৩১শে মার্চ তার ৩৯তম জন্মদিনের তিন সপ্তাহ আগে তার গর্ভে সন্তানসহ মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুসনদে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখানো হয় যক্ষ্মা, কিন্তু ক্লেয়ার হারম্যানসহ অন্যান্য জীবনীকারগণ মনে করেন তিনি অতিরিক্ত বমির কারণে পানিশূন্যতা ও অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।[১৬] তাকে হাওয়ার্থের সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড অল অ্যাঞ্জেলস গির্জায় পারিবারিক সমাধিতে সমাহিত করা হয়।