শিরাণ খলজী

মুহাম্মদ শিরান খলজী
محمد شيران خلجی
বাংলার গভর্নর
কাজের মেয়াদ
১২০৬ – ১২০৮
সার্বভৌম শাসককুতুবউদ্দিন আইবেক
পূর্বসূরীইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজী
উত্তরসূরীইওজ খলজী
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্ম১১৫০
মৃত্যুআনু. ১২০৮
সমাধিস্থলমাহীসন্তোষ, ধামইরহাট, নওগাঁ জেলা, বাংলাদেশ

মালিক ইজ্জুদ্দীন মুহাম্মদ শিরান খলজী ছিলেন খলজি বংশের দ্বিতীয় শাসক, যিনি বাংলার লক্ষনৌতিতে ভিত্তি স্থাপন করে ১২০৬ থেকে ১২০৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন।[]

প্রারম্ভিক জীবন

[সম্পাদনা]

মালিক ইজ্জুদ্দীন মুহাম্মদ শিরান খলজীর সঠিক জন্ম তারিখ জানা যায় নি। তার জন্ম আফগানিস্থানে। তিনি খলজ গোত্রের লোক ছিলেন[][][][] যা ছিল তুর্কি গোত্র। তারা দক্ষিণ এশিয়ায় আসার প্রায় ২০০ বছর আগে আফগানিস্থানে বসতি স্থাপন করেন।[][][] শিরান বখতিয়ার খলজী অধীনে নাগৌর প্রশাসক ছিলেন।[] তার ভাই আহমেদ শিরান। দুই ভাই খলজী আমির ছিলেন। তিনিও ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজীর অধীনে কাজ করতেন।

বাংলার গভর্নর

[সম্পাদনা]

বখতিয়ার খিলজির মৃত্যুর পর অভিজাতবৃন্দ শিরান খিলজিকে শাসক হিসেবে মনোনীত করেন। ক্ষমতারোহণের পর তিনি আলি মর্দান খিলজির অনুগত বিদ্রোহী বাহিনীর উপর আক্রমণ করেন। আলি মর্দান খিলজি দিল্লী পালিয়ে যান এবং দিল্লীর সুলতানকে বাংলা আক্রমণ করতে প্ররোচিত করেন। আলি মর্দান খিলজির অযোধ্যার গভর্নর কায়মাজ রুমির সঙ্গী হয়ে বাংলা আক্রমণ করেন। ফলে শিরান খিলজি ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর তিনি দিনাজপুর (ধারণা করা হয় এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা, বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলা নয়) পালিয়ে যান। কিছুকাল পর তিনি সেখানে মৃত্যুবরণ করেন।[১০]

বখতিয়ার খলজীর সাথে সম্পর্ক

[সম্পাদনা]

মালিক ইজ্জুদ্দীন মুহাম্মদ শিরান খলজী ছিলেন বখতিয়ার খলজীর সামরিক সহযোগী। বখতিয়ার খলজী কামরূদ ও তিব্বত অভিযানে বের হলে মুহাম্মদ শিরান খলজী এবং তার ভাই আহম্মদ শিরান খলজীকে সেনাবাহিনীসহ লখনোর ও জাজনগরে পাঠান। কিন্তু অভিযানে বখতিয়ার খলজীর পরাজয় ঘটে এবং তিনি মারা যান। বখতিয়ার খলজীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে মুহাম্মদ শিরান খলজী এবং আহম্মদ শিরান খলজী রাজধানী দেবকোটে ফিরে আসেন। এর পূর্বে বখতিয়ার খলজী যখন নদীয়া দখল করেন, তখন রায় লখমনিয়া নদীয়া থেকে পলায়ন করেন। তার সেনাবাহিনী ও হাতীর পাল ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। মুহাম্মদ শিরান খলজী লখমনিয়ার পিছু নেন। কথিত আছে যে, তিনি একাই আঠারোটি হাতি মাহুতসহ বন্দী করেন। এই ঘটনার পর থেকে তার সুনাম ও সাহসের পরিচয় সমগ্র রাজ্যে ছড়িয়ে যায়।

লখনৌতির শাসনভার গ্রহণ

[সম্পাদনা]

বখতিয়ার খলজীর মৃত্যুর পর লখনৌতির শাসনভার নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তখন দেবকোটের ক্ষ্মতা দখল করেছিলেন আলী মর্দান। মুহাম্মদ শিরান খলজী দেবকোটে ফিরে আসার খবর পেয়ে আলী মর্দান ঘোড়াঘাটে চলে যান। দেবকোটে সমস্ত খলজী আমীরদের মধ্যে একতা প্রতিষ্ঠা করে মুহাম্মদ শিরান খলজী নতুন নেতা নির্বাচিত হন। সমস্ত খলজী আমীর তাকে সমর্থন দেয়। তাদের সমর্থন পেয়ে তিনি আলী মর্দানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং তার অভিমুখে রওনা হন। যুদ্ধে আলী মর্দান পরাজিত হন। তাকে জেলে বন্দী করে রাখা হয়। এই ঘটনার পর সকল খলজী আমীর তার আনুগত্য স্বীকার করে এবং প্রত্যেক আমীর নিজ নিজ জায়গীর এলাকা শাসন করতে শুরু করে। মুহাম্মদ শিরান খলজীর রাজধানী হিসেবে দেবকোট বহাল থাকে।

বিদ্রোহ

[সম্পাদনা]

আলী মর্দান কৌশলে জেল থেকে পালিয়ে দিল্লী চলে যায়। তখন সুলতান ছিলেন কুতুবউদ্দিন আইবেক। আলী মর্দান সুলতানকে মুহাম্মদ শিরান খলজীর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেন। তার চক্রান্তে কুতুবউদ্দিন আইবেক কায়মেজ রূমীকে অযোধ্যা থেকে লখনৌতিতে পাঠিয়ে দেন। এসময় হুসামুদ্দীন ইওজ খলজি, যিনি বখতিয়ার খলজীর কাছ থেকে গঙ্গাতরী অঞ্চল পেয়েছিলে, কায়মাজ রূমীকে অভ্যর্থনা জানাতে গেলেন। কায়মেজ রূমী তাকে দেবকোটের জায়গীর প্রদান করলেন। ফলে মুহাম্মদ শিরান খলজী অন্যান্য খলজী আমীরদের সাথে নিয়ে দেবকোট আক্রমণ করেন। কায়মেজ রূমীর সাথে খলজী আমীরদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং খলজী আমীররা যুদ্ধে পরাজিত হন। যুদ্ধে পরাজয়ের পর খলজী আমীরদের মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত শুরু হয়। অনেক আমীর শিরান খলজীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। মাসেদা -সন্তোষের কাছে বিদ্রোহ শুরু হলে মুহাম্মদ শিরান খলজী পরাজিত হন এবং বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন।

কিংবদন্তি

[সম্পাদনা]

বর্তমান নওগাঁ জেলার ধামুর হাট উপজেলার মহিসন্তোষে একটি প্রাচীন সমাধি সেনাপতি শিরান খিলজির সমাধি বলে পরিচিত। সমাধিটি ১৪ ফুট দীর্ঘ। এর পাশে একটি প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার থেকে প্রায় ২৫ কিমি. উত্তর পশ্চিমে এই স্থানটি অবস্থিত।

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. এ.বি.এম শামসুদ্দীন আহমদ (২০১২)। "শিরাণ খলজী"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৮-১১ 
  2. Minhāju-s Sirāj (১৮৮১)। Tabaḳāt-i-nāsiri: a general history of the Muhammadan dynastics of Asia, including Hindustān, from A.H. 194 (810 A.D.) to A.H. 658 (1260 A.D.) and the irruption of the infidel Mughals into Islām। Bibliotheca Indica #78। 1Henry George Raverty কর্তৃক অনূদিত। Calcutta, India: Royal Asiatic Society of Bengal (printed by Gilbert & Rivington)। পৃষ্ঠা 548। 
  3. the Khiljī tribe had long been settled in what is now Afghanistan ... Khalji Dynasty. Encyclopædia Britannica. 2010. Encyclopædia Britannica. 23 August 2010.
  4. Satish Chandra (২০০৪)। Medieval India: From Sultanat to the Mughals-Delhi Sultanat (1206-1526) - Part One। Har-Anand। পৃষ্ঠা 41। আইএসবিএন 978-81-241-1064-5The Khaljis were a Turkish tribe from southwest Ghur. However, Bakhtiyar was ungainly in appearance... 
  5. Sarkar, Jadunath, সম্পাদক (১৯৭৩) [First published 1948]। The History of Bengal। Volume II: Muslim Period, 1200-1757। Patna: Academica Asiatica। পৃষ্ঠা 3, 8। ওসিএলসি 924890 
  6. Ashirbadi Lal Srivastava (১৯৬৬)। The History of India, 1000 A.D.-1707 A.D. (Second সংস্করণ)। Shiva Lal Agarwala। পৃষ্ঠা 98। ওসিএলসি 575452554:"His ancestors, after having migrated from Turkistan, had lived for over 200 years in the Helmand valley and Lamghan, parts of Afghanistan called Garmasir or the hot region, and had adopted Afghan manners and customs. They were, therefore, wrongly looked upon as Afghans by the Turkish nobles in India as they had intermarried with local Afghans and adopted their customs and manners. They were looked down as non Turks by Turks." 
  7. Abraham Eraly (২০১৫)। The Age of Wrath: A History of the Delhi Sultanate। Penguin Books। পৃষ্ঠা 126। আইএসবিএন 978-93-5118-658-8:"The prejudice of Turks was however misplaced in this case, for Khaljis were actually ethnic Turks. But they had settled in Afghanistan long before the Turkish rule was established there, and had over the centuries adopted Afghan customs and practices, intermarried with the local people, and were therefore looked down on as non-Turks by pure-bred Turks." 
  8. Radhey Shyam Chaurasia (২০০২)। History of medieval India: from 1000 A.D. to 1707 A.D.। Atlantic। পৃষ্ঠা 28। আইএসবিএন 81-269-0123-3:"The Khaljis were a Turkish tribe but having been long domiciled in Afghanistan, had adopted some Afghan habits and customs. They were treated as Afghans in Delhi Court. They were regarded as barbarians. The Turkish nobles had opposed the ascent of Jalal-ud-din to the throne of Delhi." 
  9. এ.বি.এম শামসুদ্দীন আহমদ (২০১২)। "আলী মর্দান খলজী"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  10. Khilji Malik
পূর্বসূরী
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী
বাংলার খিলজি রাজবংশ
১২০৬-১২০৮
উত্তরসূরী
গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ শাহ