শৈলীবিজ্ঞান ফলিত ভাষাবিজ্ঞানের একটি শাখা। শৈলীবিজ্ঞানে সকল ধরনের লেখ্য এবং/অথবা কথ্য ভাষার শব্দচয়ন ও স্বরভঙ্গির অধ্যয়ন, আলোচনা ও ব্যাখ্যা করা হয়। শৈলী (বা ভাষাশৈলী) বলতে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি, ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিত বা পরিস্থিতিতে যে ভিন্ন ভিন্ন ধরন বা রীতির ভাষা ব্যবহার করে থাকে তার বৈচিত্র্যকে বোঝায়। উদাহরণস্বরূপ, বন্ধুস্থানীয়দের সাথে আমরা ভার্নাকুলার (Vernacular) বা স্থানীয় কথ্যরীতিতে যে আলাপচারিতা করে থাকি, সেটা এক ধরনের শৈলী। আবার অফিস আদালত বা তৎসংক্রান্ত বিভিন্ন চিঠিপত্রাদি আদান-প্রদানে, ব্যক্তিগত বিবরনীতে, অথবা চাকরির সাক্ষাৎকারে ব্যাকরণ অনুসরণ করে মার্জিত শব্দচয়নের মাধ্যমে আমরা ভাষার যে সর্বজনগ্রাহ্য লৌকিক রীতিটি অনুসরণ করে থাকি সেটাও এক ধরনের শৈলী। একইভাবে একটি ভাষায় এবং তার সাহিত্যে এইরকম অসংখ্য শৈলী বা রীতি পরিদৃষ্ট হয়। এই সকল বৈচিত্র্যপূর্ণ শৈলী বা রীতি বা স্টাইল গুলোই স্টাইলিস্টিকস বা শৈলীবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়।
শৈলীবিজ্ঞান এমন একটি বিষয় যা সাহিত্য-সমালোচনা এবং ভাষাবিজ্ঞানের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে ক্রিয়া করে। প্রকৃতপক্ষে শৈলীবিজ্ঞান স্বয়ংসম্পূর্ণ কোন বিষয় নয়, বরং এটা সাহিত্য, ভাষা বিজ্ঞান এবং অনুরূপ বিষয়গুলোর গভীরে প্রবেশের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। [১][২][৩] শৈলীবিজ্ঞান চর্চার উৎস নিয়মতান্ত্রিক লেখা থেকে শুরু করে সাধারণ লেখা, বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে সংবাদ,[৪] নন-ফিকশন, জনপ্রিয় সংস্কৃতি (পপ কালচার), এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জ্ঞানগর্ভ রচনা ইত্যাদি সবখানেই বিদ্যমান।[৫] আসলে, সমালোচনামূলক শৈলীবিজ্ঞান (ক্রিটিকাল স্টাইলিস্টিকস),[৬] বহুধর্মী শৈলীবিজ্ঞান (মাল্টিমোডাল স্টাইলিস্টিকস),[৭] এবং মিডিয়া শৈলীবিজ্ঞানের (মেডিয়েটেড/মিডিয়া স্টাইলিস্টিকস) [৮] সাম্প্রতিক গবেষণা গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সাহিত্যের বাইরের সাধারন রচনাবলিও শৈলীবিজ্ঞানে মূলধারার সাহিত্যের মতই সমান গুরুত্ব পায়। শৈলীবিজ্ঞানে সাহিত্যকে গণ্ডিবদ্ধ না করে বরং তুলনামূলক নমনীয় মাপকাঠিতে মাপা হয়। [৯][১০]
ভাষাবিজ্ঞানের একটি ধারণামূলক শাখা হিসাবে শৈলীবিজ্ঞান বিভিন্ন ব্যক্তির বা বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর মানুষের ভিন্ন ভিন্ন ভাষারীতি ব্যবহারের কারণ ব্যাখ্যা করার মূলনীতি দাড় করাতে পারে। এর সাহায্যে সাহিত্যসৃষ্টি ও সৃষ্ট সাহিত্যের ধারা, লোকশিল্প, উপভাষা বা সাধারন কথ্য ভাষা,সাহিত্য সমালোচনা এবং অধিবাচন বিশ্লেষণ ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনার মূলনীতিও নির্ধারন করা যায়। শৈলী বা রীতির সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো ডায়ালগের ব্যবহার, আঞ্চলিক উচ্চারণ বিধির এবং ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন বাগবিধির (Idiolects) অন্তর্ভুক্তি, বাক্যের দৈর্ঘ্য নির্দিষ্টকরণ, ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবহার্য ভাষার ব্যবহার ইত্যাদি। তাছাড়া শৈলীবিজ্ঞান একটি ব্যতিক্রমধর্মী বিষয় যেটা কোন ভাষার একটি বিশেষ রূপের গঠন বা ধরন এবং দ্বারা প্রভাবান্বিত বিষয় বা ক্ষেত্রসমূহের মধ্যকার যোগসুত্র খুঁজে বের করতে সাহায্য করে। শৈলীবিজ্ঞান প্রকৃতপক্ষে একটি ভাষার অভ্যন্তরে "কী ঘটছে?" এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে।
সাহিত্যে শৈলীর আলোচনা মূলত ধ্রুপদী অলংকারশাস্ত্র থেকে উদ্ভূত। যদিও আধুনিক শৈলীবিজ্ঞানের মূল প্রোথিত রয়েছে রাশিয়ান রুপশাস্ত্র (রাশিয়ান ফর্মালিজম)[১১] এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রভাব বিস্তারকারী প্রাগ শহরকেন্দ্রিক প্রখ্যাত ভাষাবিদদের একটি চক্র 'প্রাগ স্কুলের' মধ্যে। ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে, ভাষাবিদ চার্লস ব্যালি তার ত্রেইতে দ্য স্তিলিস্তিক ফ্রঁসেস (Traité de stylistique française) -এ সোজুরিয়ান (ভাষাবিদ ফের্দিনঁ দ্য সোস্যুর এর অনুসারী) ভাষাবিদদের সম্মানার্থে শৈলীবিজ্ঞানকে আলাদা একাডেমিক ডিসিপ্লিন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব করেন।
ব্যালির অভিমতে সোস্যুঁরের প্রবর্তিত ভাষাবিজ্ঞান নিজে ব্যক্তিভেদে ভাষার ভিন্নতা পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে না। [১২] তবে ব্যালির প্রস্তাবনা প্রাগ স্কুলের উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। [১৩] রাশিয়ান ফর্মালিস্টদের ধারণার উৎকর্ষ ঘটিয়ে প্রাগ স্কুলের ভাষাবিদরা 'প্রমুখন' (ফোরগ্রাউন্ডিং) এর ধারণা তৈরি করেন। যেখানে ধরে নেওয়া হয় যে বিচ্যুতি (দৈনন্দিন ভাষার ব্যবহারের রীতির কারণে) এবং সমান্তরালতা (প্যারালালিজম)-র কারণে কাব্য-ভাষা সাধারণত অসাহিত্যিক ভাষা থেকে আলাদা। [১৪] প্রাগ স্কুল এর মতে, এই দৈনন্দিন ভাষা পরিবর্তিত হয় প্রতিনিয়ত, এবং এই কারণে দৈনন্দিন ভাষা এবং কাব্যভাষার মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ত পরিবর্তনশীল।[১৫]
রোমান জেকবসন ১৯৪০-এর দশকে আমেরিকায় অভিবাসনের পূর্বে রাশিয়ান ফর্মালিস্টদের একজন এবং প্রাগ স্কুলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৫
৮ খৃষ্টাব্দে ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত একটি শৈলীবিজ্ঞান-বিষয়ক কনফারেন্সে তিনি রাশিয়ান ফর্মালিজম এবং আমেরিকান নিউ ক্রিটিসিজম কে একীভূত করার প্রয়াস পান।[১৬] এখানে তার বক্তৃতাটি ১৯৬ ০ খৃষ্টাব্দে 'ভাষাবিজ্ঞান ও রসশাস্ত্র' (Linguistics and Poetics) শিরোনামে প্রকাশিত হয় এবং শৈলীবিজ্ঞানের প্রথম সুসংগত রচনা বলে সমাদৃত হয়। তিনি বলেছেন, কাব্য-ভাষা বিষয়ক চর্চা ভাষাবিজ্ঞানের একটি উপশাখা হওয়াই যুক্তিযুক্ত।[১৭] এই বক্তৃতায় তিনি কাব্যিক ফাংশন কে ভাষার ছয়টি সাধারণ ফাংশন এর একটি বলে উল্লেখ করেন।
মাইকেল হ্যালিডে ব্রিটিশ শৈলীবিজ্ঞান এর ক্রমবিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।[১৮] ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে হ্যালি-প্রণীত 'ফাংশন এন্ড লিটারারি স্টাইল: এন ইনকোয়ারি ইনটু দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ অব গোল্ডিং দ্য ইনহেরিটরস' (Linguistic Function and Literary Style: An Inquiry into the Language of William Golding's The Inheritors)—শৈলীবিজ্ঞানের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পথপ্রদর্শক রচনা।[১৯] তিনি ভাষামুদ্রা(Register) দ্বারা ভাষা এবং পরিস্থিতির যোগ সূত্র ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। [২০] তার মতে ভাষামুদ্রা (Register) এবং উপভাষা (Dialect) এক নয়। তিনি বলেন উপভাষা মূলত ভৌগোলিক এলাকা বা সামাজিক অবস্থা কে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে এবং ভাষামুদ্রা স্বয়ং ভাষার ব্যবহারকর্তার উপর নির্ভর করে। [২১]
তিনি আরো বলেন কোন ব্যক্তির ভাষা মুদ্রা তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে— প্রথমত, ক্ষেত্র (Field) —ব্যক্তিটি কোন্ কার্যে নিয়োজিত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে আলোচনারত।[২২] দ্বিতীয়ত, শ্রোতা (Tenor) —যার সাথে ভাবের আদান প্রদান করা হয়। এবং সবশেষে মোড (Mode) — যে কোন উদ্দেশ্য এবং পরিস্থিতিতে ভাষা যেভাবে ব্যবহৃত হয়। ফাউলার মন্তব্য করেন ক্ষেত্রে (Field) ভিন্নতা ভাষার ভিন্নতার উপর প্রভাব বিস্তার করে, বিশেষত শব্দচয়নের উপরে।(ফাউলার. ১৯৯৬,১৯২) ভাষা বিজ্ঞানী ডেভিড ক্রিস্টাল দেখান যে হ্যালি যে 'Tenor' (প্রেক্ষিত/শ্রোতা)-এর কথা বলেছেন দ্ব্যর্থবোধকতা এড়ানোর জন্য সে ক্ষেত্রে 'Style' (শৈলী) শব্দটি ব্যবহার করা শ্রেয়তর এবং অনেকানেক ভাষাবিজ্ঞানী সেটাই করে থাকেন।(ক্রিস্টাল. ১৯৮৫,২৯২) হ্যালি তৃতীয়তঃ যে মোডের (Mode) উপর আলোকপাত করেছেন সেখানে তিনি মোড বলতে 'যে পরিস্থিতিতে এবং উদ্দেশ্যে ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে তার প্রতীকী বিন্যাসকে বুঝিয়েছেন।' উইলিয়াম ডাউনস উল্লেখ করেছেন মোড দুটি ভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল— প্রথমত, মাধ্যম বা মিডিয়াম(কথা, লেখা ইত্যাদি) এবং দ্বিতীয়ত, জনরা (Genre) বা ধরন। (ডাউনস. ১৯৯৮,৩১৬)
জনরা বলতে হ্যালিডে বুঝিয়েছেন একটি পূর্ব-নির্দেশিত ভাষারূপ। সাধারণভাবে একই জনরার অন্তর্গত ভিন্ন ভিন্ন রচনার ভাষায় ভিন্নতা থাকলেও টেক্সট বা পাঠকৃতির 'অর্থ' একই জাতীয় হয়ে থাকে। উইলিয়াম ডাউনস আরও উল্লেখ করেন, ভাষামুদ্রা (Register) যতই বৈচিত্র্যপূর্ণ অথবা অদ্ভুত হোক, তা সহজেই অবধানযোগ্য। (ডাউনস. ১৯৯৮,৩০৯)
ভাষাবিজ্ঞানী ক্রিস্টাল কেমব্রিজ ভাষা-বিশ্বকোষে (The Cambridge Encyclopedia of Language) দেখেছেন যে, বাস্তবে অধিকাংশ শৈলী পর্যালোচনা হয়েছে সাহিত্যের জটিল এবং সাহিত্যমূল্য সমৃদ্ধ ভাষার উপর, যেটাকে নামান্তরে সাহিত্য-শৈলীও বলা যায়। তিনি বলেন এই ধরনের পরীক্ষণের পরিসর পাঠকৃতি বা বয়ানের পূর্ণাঙ্গ গঠনশৈলী কে অন্তর্ভুক্ত না করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাহিত্যিক ভাষার কেবলমাত্র বিচ্যুত এবং অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য গুলোতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, কাব্যের ভাষার জটিলতর গঠনশৈলী, নাটক অথবা উপন্যাসে ব্যবহৃত ভাষার চেয়ে, ভাষার গঠনশৈলীর ব্যাপারে বেশি রহস্য উন্মোচন করতে পারে বলে অনেক শৈলীবিজ্ঞানী ধারণা করে থাকেন।(ক্রিস্টাল. ১৯৮৭,৭১)
ভাষার সাধারণ প্রচলিত ব্যবহারের পাশাপাশি কিছু কিছু রীতি বিবর্জিত ব্যবহারও স্বীকৃত, যেমন— কবিতায়। এইচ জি উইডোসন প্রায়োগিক শৈলীবিজ্ঞান এর উপরে কাজ করতে গিয়ে সাধারন সমাধিফলকের লেখাগুলোর শৈলীবিচার করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, সেগুলোর একটা হলো—
উইডোসন বলেছেন, এই ধরনের অনুভূতি গুলো সাধারনত ততটা আকর্ষক নয় এবং অনেক সময় "খোদাইকৃত অপরিপক্ক শব্দগুচ্ছ" বলে চালিয়ে দেওয়ার মতো। তৎসত্ত্বেও, উইডোসন যুক্তি দেখিয়েছেন প্রত্যেক সমাধিফলক নিঃসন্দেহে এক একজন মানুষের প্রয়ান উপলক্ষে সত্যিকারের শোকবার্তা বহন করে এবং এগুলো অবশ্যই প্রিয় প্রয়াতের স্মৃতি সংরক্ষনার্থে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। কাব্যের বৈশিষ্ট্য এবং সমীকরণে সমাধিফলকে উৎকীর্ণ পংক্তিমালা কাব্য হিসেবে বিবেচ্য না হলেও অবস্থিতির স্থানের কারণে এগুলো কাব্যিক হয়ে ওঠে। কাব্যিক পরাকাষ্ঠার বিচারে এই চরণগুলো প্রাপ্তের অতিরিক্ত মর্যাদা পেয়ে থাকে কেবলমাত্র সমাধি ক্ষেত্রের মতো ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ স্থানে খোদিত থাকার কারণে।
উইডোসন বলেছেন, কাব্য সমাধিক্ষেত্রের পাথরে খোদিত সরল শব্দগুচ্ছের মত নয়, বরং এটার ভাষাশৈলী অনিয়মিত এবং আন্তঃপাঠকৃতি দ্বন্দ্বের ফলে সর্বদা পরিবর্তনশীল।(উইডোসন. ১৯৯২,৪)
পি এম ওয়েদেরিল প্রণীত 'লিটারারি টেক্সট: এ্যান এক্সামিনেশন অব ক্রিটিক্যাল মেথডস'(Literary text: An examination of critical methods)–এ বলা হয়েছে, কাব্যের শৈলী বিচারের ক্ষেত্রে দুটি সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রথমত, একটি বিশেষ ক্ষেত্র বা বৈশিষ্ট্যের উপর অতিরিক্ত মনোযোগ বা গুরুত্ব দিলে অন্যান্য সমগুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র বা বৈশিষ্ট্যের আলোচনা কম হতে পারে; দ্বিতীয়তঃ কোন পাঠকৃতিকে কেবলমাত্র সুন্দর/উচ্চ শৈলীসমৃদ্ধ ভাষার সংগ্রহ হিসাবে বিবেচনা করলে অন্যান্য অনেক অর্থবহ পাঠকৃতিকে অবহেলা করা হতে পারে। (ওয়েদেরিল. ১৯৭৪,১৩৩)
সাহিত্যের প্রয়োগতত্ত্বের (Literary Pragmatics)অন্তর্গত কাব্য-প্রভাব (Poetic Effect) আলোচনা করতে গিয়ে ভাষাবিদ আদ্রিয়ান পিলকিংটন প্রচ্ছন্ন অভিব্যক্তির বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছেন। ড্যান স্পারবার এবং দিরদ্রে উইলসনের কাজগুলো থেকে পিলকিংটন এ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভ করেন। প্রচ্ছন্ন অভিব্যক্তি প্রধানত দ্বিধাবিভক্ত— প্রথমত, প্রবল প্রচ্ছন্ন অভিব্যক্তি ও দুর্বল প্রচ্ছন্ন অভিব্যক্তি; যদিও এই দুই চরম বিন্দুর মাঝে অনেকগুলো বিকল্প আছে। কথক অথবা লেখক যখন জোর দিয়ে কিছু প্রকাশ করেন বা বুঝাতে চান সেটা সবচেয়ে প্রবল প্রচ্ছন্ন অভিব্যক্তি, কিন্তু যখন লেখক বা কথকের আলোচনায় দ্ব্যর্থবোধকতা থাকে তখন সেটা হয় দুর্বল প্রচ্ছন্ন অভিব্যক্তি। পিলকিংটন মত প্রকাশ করেছেন, অনেকগুলো দুর্বল প্রচ্ছন্ন অভিব্যক্তি একত্রে মিলিত হয়ে একজন কথক বা লেখকের আলোচনা শ্রবণমাত্র বা পাঠমাত্র সে সম্পর্কে যে ধারণা হয় তার থেকে আলাদা অর্থ প্রকাশ করলে সেটাই কাব্য-প্রভাব (Poetic effect)। তবে যে গুনাগুনের বা বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে দুর্বল প্রচ্ছন্ন অভিব্যক্তির থেকে পাঠক বা শ্রোতাকে ধারণা আলাদা হয় সেগুলো অনেকাংশে় মন্ময় (Subjective)। পিলকিংটন আরো বলেছেন, বর্ণনাকারীর অনুমিতি এবং শ্রোতার স্বতস্ফূর্ত অনুমিতির মধ্যে কোন সীমা বা পার্থক্যকারী বৈশিষ্ট্য নির্দিষ্ট করা নেই। (পিলকিংটন. ১৯৯১,৫৩)
তদুপরি, কাব্যের শৈলীগুণ ও পিলকিংটনের কাব্য-প্রভাব বিশ্লেষণ কোন কবিতার মর্মার্থ উদঘাটনে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখে।
উইডোসন লক্ষ্য করেন, এস. টি. কোলরিজের 'দ্য রাইম অব দি এনশিয়েন্ট মেরিনার'( The Rhyme of The Ancient Mariner) কবিতায় নাবিকের স্বল্পকালীন উপস্থিতি দীর্ঘায়িত হয়েছে কালের(Tense) নিয়মবহির্ভূত ব্যবহারের কারণে। দেখা যায় নায়ক নাবিক বর্তমানকালে (Present tense) তার "অস্থিচর্মসার হাত"(Skinny hand) দিয়ে বিবাহে আমন্ত্রিত অতিথির হাত "ধরেন"(Holds)।তারপর হাত ছাড়েন অতীতকালে(Past tense) ('... his hands dropt he.'); পুনর্বার নাবিককে "জাজ্বল্যমান চোখে" (Shining eyes) অতিথির হাত ধরতে দেখা যায় বর্তমানকালে।(উইডোসন. ১৯৯২,৪২)
উইডোসন লক্ষ্য করেছেন, কোন কাব্যের সারাংশ আলোচনা করলে প্রায়শঃ দেখা যায়, তা খুব মামুলী ও সাধারণ ভাব প্রকাশ করে। যেমন– "প্রকৃতি উপভোগ্য ও সুন্দর", "প্রেম মহান", "জীবন নিঃসঙ্গ", "সময় অবিরত বহমান" ইত্যাদি। (উইডোসন. ১৯৯২,৯)
কিন্তু,
অথবা,
এই ভাষা অতি পরিচিত, প্রচলিত বিষয়বস্তু সমূহ কে নতুন ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিমায় পাঠকের কাছে তুলে ধরে, এবং ব্যক্তিগত অথবা সামাজিক দর্শন অসচেতনভাবে মূল বিষয়বস্তুর সাথে মিশ্রিত না করেই পাঠক সেটা উপভোগ করতে পারে। (উইডোসন, ১৯৯২,৯)
সুতরাং, পাঠক "প্রেম", "হৃদয়", "আত্মা" ইত্যাদি বহু ব্যবহৃত শব্দ ও অস্পষ্ট পরিভাষা ব্যবহার দ্বারা মানুষের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে, তবে কবি এই সকল বহুল ব্যবহৃত শব্দ ও অস্পষ্ট পরিভাষা গুলোকে চিত্তাকর্ষক পেক্ষাপটে উপস্থাপন করার মাধ্যমে মানব মনের আকুলতা ব্যক্ত করতে পারে এবং ভণিতা ব্যতিরেকেই সাধারণের সংসর্গে আসতে পারে। এটা শৈলীবিজ্ঞানেরই অংশ এবং উইডোসনের মতানুযায়ী এটাই কাব্যের অস্তিত্বের যৌক্তিকতা। (উইডোসন, ১৯৯২,৭৬)