শ্যামবাজার | |
---|---|
কলকাতার অঞ্চল | |
দেশ | ভারত |
রাজ্য | পশ্চিমবঙ্গ |
শহর | কলকাতা |
নিকটবর্তী মেট্রো স্টেশন | শ্যামবাজার |
উচ্চতা | ৩৬ ফুট (১১ মিটার) |
সময় অঞ্চল | IST (ইউটিসি+5:30) |
PIN | 700 004 |
এলাকা কোড | +91 33 |
শ্যামবাজার কলকাতার উত্তরভাগে অবস্থিত একটি অঞ্চল। শ্যামবাজার অঞ্চলটি কলকাতা পুলিশের শ্যামপুকুর থানার অন্তর্গত।[১] শ্যামবাজার ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল তথা বাঙালি অভিজাতপল্লি বাগবাজার অতীতে সুতানুটি গ্রামের একটি অংশ ছিল।[২]
কলকাতা পৌরএলাকার ১১ ও ১২ নং ওয়ার্ড নিয়ে শ্যামবাজার-হাতিবাগান অঞ্চলটি গঠিত।[৩]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা হাতিবাগান বাজারে একটি বোমা নিক্ষেপ করেছিল, কিন্তু সেটি ফাটেনি।[৪]
বর্তমান শ্যামবাজার অঞ্চলে অতীতে একটি বিখ্যাত বাজার ছিল। জন জেফানিয়া হলওয়েল এই বাজারটিকে চার্লস বাজার নামে অভিহিত করেন। শোভারাম বসাক তার গৃহদেবতা শ্যামরায়ের (কৃষ্ণ) নামানুসারে এই অঞ্চলের বর্তমান নামকরণটি করেন। উল্লেখ্য, শেঠ ও বসাক পরিবারগুলি ছিল সুতানুটির আদি বাসিন্দা এবং শোভারাম বসাক ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর কলকাতার এক বিশিষ্ট বাঙালি ধনী ব্যবসায়ী।[৫]
সেকালের সুতানুটি অঞ্চলে কোনো বড়ো রাস্তা ছিল না। কেবলমাত্র হালিশহর থেকে বড়িশা পর্যন্ত প্রসারিত একটি তীর্থযাত্রাপথ ছিল। এই পথেরই একটি অংশে পরবর্তীকালে চিৎপুর রোড (অধুনা রবীন্দ্র সরণি) নির্মিত হয়। চিৎপুর রোড শ্যামবাজারের পার্শ্ববর্তী বাগবাজার ও চিৎপুর অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রসারিত ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাস্তাঘাট নির্মাণ শুরু হওয়ার পর থেকেই শ্যামবাজার অঞ্চলের সমৃদ্ধি ঘটতে শুরু করে। লটারি কমিশন (১৮১৭) ও পরবর্তীকালে লটারি কমিটি (১৮৩৬) সালে পুরনো কলকাতার দেশীয়-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির রাস্তাঘাট নির্মাণের দায়িত্ব পায়। চৌরঙ্গী-চিৎপুর রাস্তাটির সমান্তরালে কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রসারিত প্রধান রাস্তাটি এই সময়ই নির্মিত হয়।[৬]
১৭৪২ সালে মারাঠা দস্যুদের সম্ভাব্য কলকাতা আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে তিন মাইল দীর্ঘ মারাঠা খাত খনন করা হয়।[৭] কিন্তু মারাঠারা কলকাতা আক্রমণ করেনি। ১৭৯৯ সালে এই খাতটি বুজিয়ে সার্কুলার রোড নির্মিত হয়।[২] এই রাস্তাটি শ্যামবাজার থেকে ময়দান পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এটিকে পাকা রাস্তায় উত্তীর্ণ করা হয়। একই সময় লটারি কমিটি উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার সংযোগরক্ষাকারী আরও কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা নির্মাণ করে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: উড স্ট্রিট (যার একটি অংশ বর্তমানে ড. মার্টিন লুথার কিং সরণি নামে পরিচিত), ওয়েলেসলি স্ট্রিট (বর্তমান নাম রফি আহমেদ কিদোয়াই স্ট্রিট), ওয়েলিংটন স্ট্রিট (বর্তমান নাম নির্মল চন্দ্র স্ট্রিট), কলেজ স্ট্রিট ও কর্নওয়ালিস স্ট্রিট (বর্তমান নাম বিধান সরণি)। ব্যারাকপুর পর্যন্ত একটি নতুন রাস্তা (যা বর্তমানে ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড বা বিটি রোড ও বিধান সরণির কিয়দাংশ) ও আর. জি. কর রোডও এই সময়েই নির্মিত হয়েছিল।[৬] ১৯১১ সালে ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ-এর একটি প্রসারিত অংশকে (যার শ্যামবাজারের দিকের অংশটির নাম ভূপেন বোস অ্যাভেনিউ) শ্যামবাজারের সঙ্গে যুক্ত করে। এইভাবে পাঁচটি রাস্তা একত্রিত হয়ে গড়ে ওঠে শ্যামবাজারের বিখ্যাত পাঁচমাথার মোড়; যা বর্তমানে কলকাতার অন্যতম ব্যস্ত মোড়।[৮]
১৮৮২ সালে ঘোড়ায় টানা ট্রামের পরিষেবা শ্যামবাজার পর্যন্ত প্রসারিত করা হয়। ১৮৯৯ সালে ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি ট্রাম বিদ্যুতায়িত করা শুরু করে। ১৯০২ সালের মধ্যেই সমগ্র কলকাতায় বিদ্যুৎচালিত ট্রাম চালু হয়ে যায়। এরপরই ট্রাম পরিষেবা বেলগাছিয়া অবধি প্রসারিত করা হয়। ১৯৪১ সালে সার্কুলার রোডে ট্রাম চালু হয়। উল্লেখ্য, এর পর দীর্ঘদিন ট্রামই ছিল কলকাতার একমাত্র গণ পরিবহন মাধ্যম। ১৮৯৬ সালে কলকাতায় মোটরগাড়ি চালু হলেও, মোটর বাস চালু হয়েছিল ১৯২০ সালে। পাঁচমাথার মোড়ের কাছে বিধান সরণিতে শ্যামবাজার ট্রামডিপো অবস্থিত। সার্কুলার রোডে উনিশশো পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত একটি গারবেজ ক্লিয়ারেন্স লাইট রেলওয়ে ছিল।
শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনটিও পাঁচমাথার মোড়েই অবস্থিত। ১৯৯৪ সালের ১৩ অগস্ট কলকাতা মেট্রোর শ্যামবাজার-বেলগাছিয়া ও দমদম-বেলগাছিয়া অংশ দুটি চালু হয়। ১৯৯৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি শ্যামবাজার-শোভাবাজার-গিরিশ পার্ক ও চাঁদনি চক-সেন্ট্রাল অংশদুটি চালু হয়। দমদম থেকে টালিগঞ্জ (বর্তমানে মহানায়ক উত্তম কুমার মেট্রো স্টেশন) মেট্রো রেলপথটি চালু হয় ১৯৯৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর।[৯] মেট্রো রেলের অধিকাংশ অংশই মাটি খুঁড়ে ও বুজিয়ে (কাট-অ্যান্ড-কভার পদ্ধতি) করা হলেও শ্যামবাজার-বেলগাছিয়া অংশটির কাজ হয়েছিল সুড়ঙ্গ নির্মাণ করে।
শ্যামবাজার উত্তর কলকাতার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। মধ্য কলকাতার কলেজ স্ট্রিট-মহাত্মা গান্ধী রোড ক্রসিং ও দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাটের মতো শ্যামবাজার উত্তর কলকাতার প্রধান বস্ত্র বিপণন কেন্দ্র। আবার মধ্য কলকাতার বউবাজার ও দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাটের মতো শ্যামবাজারও একটি বিখ্যাত অলংকার বিপণন কেন্দ্রও বটে। অতীতে শ্যামবাজারের বিশিষ্ট অলংকার ব্যবসায়ী এম. বি. সরকারের উত্তরসূরিরা বর্তমানে সমগ্র শহরে বিভিন্ন নামের দোকানের মালিক।[১০] শ্যামবাজারের দ্বারিক ঘোষ ও সেন মহাশয়ের মিষ্টান্ন অতি বিখ্যাত। অতীতের বিখ্যাত মিষ্টির দোকান জলযোগ ও রেস্তোরাঁ গোলবাড়ি আজও স্বমহিমায় বিরাজমান।
অনেক বাঙালি পরিবারেই পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে নতুন পোশাক পরা বাধ্যতামূলক। তাই প্রতি বছর চৈত্রমাসে গড়িয়াহাট ও নিউ মার্কেটের মতো শ্যামবাজারেও কেনাকাটার বিশেষ পর্ব চলে।[১১] দুর্গাপূজা, বিবাহ ও অন্যান্য উৎসব অনুষ্ঠানে শ্যামবাজার-হাতিবাগান অঞ্চল থেকে জামাকাপড় কেনার বিশেষ চল রয়েছে। একটি ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধ অনুসারে, “A formidable matron with husband and children in tow wading through the crowds at Gariahat and Shyambazar is a familiar sight on the eve of Poila Baishakh.”[১২]
শ্যামবাজার অঞ্চলে দুটি বড়ো বাজার রয়েছে: শ্যামবাজার বাজার ও হাতিবাগান বাজার। শ্যামবাজার জনপ্রিয় ব্যবসাকেন্দ্র বলে এখানকার ফুটপাথগুলি সবই হকারদের দখলে চলে গেছে। ১৯৯৬ সালে পৌরসংস্থা অপারেশন সাইশাইন নামে এক অভিযান চালিয়ে শ্যামবাজার ও গড়িয়াহাটকে হকারমুক্ত করেছিল। এরপরই পৌরসংস্থা কলকাতার ২১টি রাস্তায় হকারদের গতিবিধির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। তবে পরে আবার পুরনো ব্যবস্থাই ফিরে আসে।[১৩] ২০০২ সালে পৌরসংস্থা এক তৃতীয়াংশ ফুটপাথ পথচারীদের জন্য উন্মুক্ত করে রাখার নির্দেশিকা জারি করে।[১৪]
শ্যামবাজার জনাকীর্ণ বসতি ও বাজার অঞ্চল হওয়ায় এখানে খেলাধুলার মাঠ কমই আছে। যদিও কলকাতার প্রসিদ্ধ মোহনবাগান ক্লাবের প্রথম মাঠ এখানকার মোহনবাগান রো-তে অবস্থিত। মোহনবাগান ভিলার একটি ফলক থেকে জানা যায় যে উক্ত মাঠটি ১৮৮৯-১৮৯২ সাল পর্যন্ত মোহনবাগান মাঠ ছিল। ফুটবল এখানকার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় খেলা। তবে অন্যান্য খেলাও জনপ্রিয়। দেশপ্রিয় পার্কে নিয়মিত টেনিস খেলার আসর বসে।[১৫]
শ্যামবাজার কলকাতার একটি প্রসিদ্ধ বিনোদনকেন্দ্রও বটে। ১৮৩৫ সালে প্রথম বাংলা নাট্যপ্রযোজনা বিদ্যাসুন্দর নবীনচন্দ্র বসু কর্তৃক শ্যামবাজারের একটি ঘরোয়া থিয়েটারে মঞ্চায়িত হয়েছিল।[১৬] ঊনবিংশ শতাব্দীর পরার্ধে জনসাধারণের মধ্যে নাটকের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে বাণিজ্যিক নাটক মঞ্চায়নের জন্য বাগবাজার অ্যামায়েচার থিয়েটার ও শ্যামবাজার নাট্যসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, এই সময় ধনীদের গৃহে ঘরোয়া নাট্যমঞ্চেই নাটক মঞ্চস্থ হত, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল না।[১৭]
শ্যামবাজারের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল স্টার থিয়েটার। বিডন স্ট্রিটে স্টারের পূর্বতন জমিটি বিক্রয়ের পর ৭৬/৩, কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে (বর্তমান বিধান সরণি) স্টারের বর্তমান ভবনটি গড়ে ওঠে। ১০০ বছরে ৮০ জন বিশিষ্ট নাট্যকারের ২৫০টি নাট্যপ্রযোজনা মঞ্চস্থ স্টারে। ১৯৯১ সালের ১৬ অক্টোবর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে স্টার ভস্মীভূত হয়।[১৮] বর্তমানে অবশ্য স্টার থিয়েটার পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এখন নাট্যপ্রযোজনার পাশাপাশি এখানে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়। স্টার থিয়েটার আন্তর্জাতিক কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের অন্যতম প্রদর্শনীস্থল।
কলকাতার অন্যতম প্রধান নাট্যগোষ্ঠী নান্দীকারের কেন্দ্রও শ্যামবাজারে।[১৯]
শ্যামবাজারের বিধান সরণিতে রাধা, রূপবাণী, মিনার, মিত্রা ও দর্পণা নামে পাঁচটি সিনেমাহল পরপর অবস্থিত। এই অঞ্চলটি সিনেমাপাড়া নামে পরিচিত। এককালে গৃহবধূদের কাছে এই সিনেমাহলগুলি খুবই জনপ্রিয় ছিল। দ্বিপ্রাহরিক শো-তে তারা প্রায়ই এখানে সিনেমা দেখতে আসতেন। অন্যদিকে ফড়েপুকুরের টকি শো হাউস ইংরেজি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর জন্য বিখ্যাত ছিল। বর্তমানে অবশ্য টেলিভিশনের দাপটে সেই জনপ্রিয়তা অনেক কমে গেছে।
|7=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)