ষষ্ঠীদেবী | |
---|---|
সন্তান অধিষ্ঠাত্রী ও সন্তানদাত্রী এবং রক্ষাকর্ত্রী | |
![]() ষষ্ঠী দেবী | |
অন্যান্য নাম | কৌমারী, দেবসেনা,বালি, ছঠী-মাই, স্কন্দ-জায়া |
দেবনাগরী | षष्ठीदेवी |
সংস্কৃত লিপ্যন্তর | Ṣaṣṭhī |
অন্তর্ভুক্তি | দেবী, প্রকৃতি |
আবাস | স্কন্দলোক |
মন্ত্র | ॐ হ্রীঁ ষষ্ঠীদেব্যৈয় স্বাহা, ওম সাস্থামে চন্ডী বধূ কার্তিক প্রিয়ে নমঃ স্তুতি |
বাহন | রত্নবিমান বা বিড়াল |
গ্রন্থসমূহ | ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ও দেবীভাগবত পুরাণ |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
মাতাপিতা | |
সঙ্গী | কার্তিক (যখন দেবসেনার সাথে পরিচয় হয়) |
ষষ্ঠী দেবী বা (সংস্কৃত: षष्ठी) হল একজন হিন্দু দেবী, যাকে নেপাল, বাংলাদেশ ও ভারতে শিশুদের কল্যাণদাতা এবং রক্ষাকর্তা হিসেবে পূজা করা হয়। তিনি সন্তানদাত্রী ও তাহার রক্ষাকর্ত্রী দেবী; তার কৃপায় নিঃসন্তান দম্পতিদের সন্তান লাভ হয় এবং তিনিই সন্তানের রক্ষাকর্ত্রী, পুরাণ মতে যেহেতু তিনি আদিপ্রকৃতির ষষ্ঠাঙ্গ অংশভুতা তাই তাহার নাম ষষ্ঠী দেবী। সম্পূর্ণ বঙ্গ ও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ষষ্ঠী দেবীর নামে বহু কঠিনতঃ ও সরল দুই ব্রত প্রচলিত আছে। বিহার সীমান্ত উত্তরপ্রদেশ কিছু অঞ্চল সম্পূর্ণ বিহার, ঝাড়খণ্ড ও মিথিলাঞ্চলে এই ষষ্ঠীদেবী ও সূর্যদেবতারই উদ্দেশ্যে চৈত্র ও কার্তিক শুক্লা ষষ্ঠী তে ছট পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সেইখানের লোকভাষাতে দেবীকে ছঠী-মাই বলে সম্বোধিত করা হয়। এই ব্রত ঝাড়খণ্ড, বিহার ও মিথিলা অঞ্চলের গৃহস্থদের সবথেকে কঠিনতম ব্রতের মধ্যে অন্যতম।
সনাতন হিন্দু শাস্ত্রানুসারে হিন্দু বর্ষপঞ্জীর প্রতিমাসের শুক্লাষষ্ঠী তিথিতে বিভিন্ন নামে ষষ্ঠীদেবী পূজিতা হন (জৈষ্ঠ মাসে:অরণ্যষষ্ঠী, শ্রাবণ মাসে: লুণ্ঠনষষ্ঠী বা লোটনষষ্ঠী, ভাদ্র মাসে : চাপড়া বা মন্থনষষ্ঠী, আশ্বিন মাসে: দুর্গাষষ্ঠী বা বোধনষষ্ঠী, অগ্রহায়ণ মাসে: মূলাষষ্ঠী, পৌষ মাসে: পাটাইষষ্ঠী, মাঘ মাসে : শীতলষষ্ঠী, চৈত্র মাসে: অশোকষষ্ঠী এবং নীলষষ্ঠী)। এছাড়া, শিশুর জন্মের পর 'সূতিকাষষ্ঠী , ষষ্ঠ দিনে 'ঘাটষষ্ঠী', একুশদিনে 'একুশে' এবং শিশুর বারো বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি জন্মতিথিতে 'জলষষ্ঠী' দেবীর পৃূজা হয়ে থাকে।
ছট তাঁর এবং সূর্যের (সূর্য দেবতার) সম্মানে বিহারে, বছরে দুইবার (কার্তিকের চন্দ্র মাসগুলিতে, আরও বিশিষ্টতা চৈত্র মাস অন্য মাসগুলিকে দেওয়া হয়) পালন করা হয়।
বেশিরভাগ পণ্ডিত বিশ্বাস করেন যে ষষ্ঠী দেবীর শিকড় হিন্দু লোক ঐতিহ্যগুলিতে চিহ্নিত হতে পারে। এই দেবীর উল্লেখ হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিতে ৮ম ও ৯ম শতকে বা খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাওয়া যায়, যার মধ্যে তিনি শিশুদের নিয়ে হিন্দু যুদ্ধ-দেবতা স্কন্দের সাথে যুক্ত। সময়ের সাথে সাথে, এই দেবী সন্তানের উপকারী ত্রাণকর্তা এবং উপদেষ্টাতে পরিণত হন।[১]
এই দেবীর নির্দিষ্ট অবয়ব নেই। মঙ্গল ঘটে আঁকা মূর্তি, শিল, পিটুলি দিয়ে তৈরি মূর্তি, ঘটে পোঁতা বটগাছের ডাল ইত্যাদিতে ষষ্ঠীদেবীর প্রতিমা কল্পনা করা হয়। দেবীর বাহন কালো বিড়াল।[১] তবে তার সম্পর্কে ধ্যানমন্ত্রগুলির সার কথা হল- তিনি গৌরবর্ণা দ্বিভূজা দেবী; উত্তম বসন ও অলঙ্কার পরিহিতা; চন্দ্রাননা ও কৃষ্ণমার্জার বাহনা; পীনোন্নত পয়োধরা এবং কোলে একাধিক শিশুপুত্র। অনেকের মতে, দেবীর বিড়াল বাহনার মূলে রয়েছে দেবী জগদ্ধাত্রীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কেননা বিড়াল বাঘ না হলেও বাঘের মাসি বলে সুপরিচিত। স্বামী নির্মলানন্দ তার 'দেব-দেবী ও তাদের বাহন'গ্রন্থে লিখেছেন যে, বিড়াল হলো প্রজনন শক্তির প্রতীক।আর বিড়ালির দুগ্ধ নাকি স্ত্রীরোগের আরোগ্যলাভের অন্যতম পথ্য। এমন প্রাচীন লোকবিশ্বাসের সূত্র ধরেই ষষ্ঠীর বাহন বিড়াল।
ষষ্ঠীদেবীর পূজা সাধারণত বটগাছতলায়, বাড়ির আঙিনায়, নদী বা পুকুরের ধারে হয়ে থাকে। অনেক গ্রামে বট-অশ্বত্থ বৃক্ষমূলে 'ষষ্ঠীতলা' বলে নির্দিষ্ট স্থানে বিভিন্ন ষষ্ঠীদেবী নির্দিষ্ট তিথিতে পূজিতা হন। মূলত গৃহস্থ নারীরা তেল-হলুদ-দই, ঘট, বটের ডাল ইত্যাদি উপকরণের মাধ্যমে পূজা নির্বাহ করে থাকেন, পূজাশেষে 'ব্রতকথা' শ্রবণ করে স্নান সেরে বাড়ি ফিরে ফলাহার করেন।বটতলাই হলো ষষ্ঠীর আটন।এই কারণে তাকে বটবিটপবিলাসী বলা হয়েছে। বর্ণহিন্দু নবশাখ গোষ্ঠীর মহিলারা ষষ্ঠীর ব্রত করলেও তথাকথিত অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের রমণীরা শুধুমাত্র অরণ্য ও শীতলা ষষ্ঠী ব্রত পালন করেন। তবে সন্তান প্রসব করার ছয় দিন পরে ষেটেরা বা ষষ্ঠীপুজো গ্রামাঞ্চলের হিন্দুমাত্রই পালন করে থাকেন। মধ্যযুগীয় বাংলাকাব্যে শিশুজন্মের পর ষেটেরা ,আটকলাই, নর্তা, একতির্সা প্রভৃতি উৎসব পালন করার বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে।শিশু জন্মের ছয় দিনের মাথায় গো-ভাগার থেকে গো-মুন্ড নিয়ে এসে আঁতুরঘরের দরজায় পোঁতা হতো। এখন আর লোকাচারটি পালিত না হলেও এই দিনে প্রথম মায়ে-ছায়ে স্নান করার বিধি আছে।বারো মাসেই ষষ্ঠীব্রত পালন করার বিধি।যেমন বৈশাখমাসে ধূলাষষ্ঠী।জষ্ঠিতে অরণ্য।আষাঢ়ে কোড়া।শ্রাবণে নোটন,ভাদ্রে মন্থন বা চাপড়া। আশ্বিনে দুর্গা ষষ্ঠী।কার্তিকে গোটা,অঘ্রানে মূলা,পৌষে পাটাই। মাঘমাসে শীতলা।ফাল্গুনে অশোক আর চৈত্রে নীলষষ্ঠী। অরণ্যষষ্ঠীর পুজোর উপকরণে বিস্মৃত যুগের উপাচার।সাতটি সতেজ বাঁশপাতা,গোটা ফল ৫-৭ টি।তালেরপাখা একটি।একগুচ্ছ দূর্বাঘাস।দই-হলুদ-তেল। ষষ্ঠীর ডোর বা সুতো। যে সব মহিলাদের কন্যাসন্তান হয়েছে ও প্রথম ষষ্ঠী ব্রত পালন করেন --তাদের প্রয়োজন হয় সাতটি ডালি। তাতে সাতটি গোটা ফল ও সাতটি তালের পাখা। আর পুত্রসন্তান হলে লাগে ৯টি পাখা ও ডালি। পুজোর পর ঐ ডালিগুলি বাচ্ছাদের মধ্যে বিতরণ করতে হয়। দই তেল হলুদের যাদু ফোঁটা দেন মা তাদের সন্তানের ও জামাতার কপালে। কেউ অনুপস্থিত থাকলে তার উদ্দেশে প্রতীকী ফোঁটা পড়ে বাড়ির বড়ঘরের দরজার বাজুর উপরে। এই পুজো যে প্রজননের ও সতেজ জীবনের কামনায় তা বোঝা যায় পুজোর উপকরণ দেখে। তবে তালপাখার বিষয়ে অন্য কাহিনি আছে। জষ্ঠি মাসের তাপ দগ্ধ দহনে পুড়ে খাক মাঠ-ঘাট বন-বাদাড়। মেয়েরা বৃষ্টি কামনায় , উত্তম ফসল প্রাপ্তির আশায় বনে গিয়ে গান গেয়ে আর পুজো দিয়ে বনদেবীকে সন্তুষ্ট করতো। যাতে নেমে আসে বৃষ্টি।নারী আর কৃষি যখন সমার্থক হয়ে উঠলো তখন থেকেই অরণ্যের দেবী হয়ে উঠলেন প্রজননের দেবী।নারীর ফসল অর্থাৎ সন্তান রক্ষয়িত্রী।রাঢ় অঞ্চলে তাই শুধু মায়েরাই ষষ্ঠীর ব্রত করেন না, কৃষি জমিরও ষষ্ঠীপুজো হয় । এর নাম গাবরষষ্ঠী। ভাদ্র সংক্রান্তিতে ধানের জমির এক কোনে এই গাবর ষষ্ঠীর পুজো আজও পালিত হয়। রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্ব থেকে জানা যায় জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা তিথিতে মহিলারা অরণ্যে গিয়ে পাখা হাতে বিন্দ্যবাসিনী স্কন্দ ষষ্ঠীর পুজো করতো। এ পুজো গ্রামের বা বাড়ির ভিতরে হতো না ,বনভূমি বা অরণ্যের মধ্যেই নিস্পন্ন হতো।এই কারণেই এর নাম অরণ্যষষ্ঠী। একসময় শশুড়বাড়িতে অধিকাংশ বউ'র কপালে জুটতো লাঞ্ছনা গঞ্জনা।তার উপর যদি বউ'র বাচ্ছা কাচ্ছা না হতো অত্যাচারের মাত্রাটি কোথায় গিয়ে পৌঁছাত সহজেই অনুমান করা যায়।এই কারণেই জামাইকে তোয়াজ করার বিষয়টি এসে পড়ে।তাছাড়া শশুড় শাশুড়ির কাছে জামাতাও পুত্র। সারা বছরে ষষ্ঠী পুজোয় নিজের সন্তানদের মঙ্গল কামনাই হয়ে ওঠে মুখ্য। বেচারা জামাই থাকে বাইরে। তাই শুধু মাত্র অরণ্যষষ্ঠীতেই জামাইদের এই স্পেশাল খাতির। কোন কোন গবেষক আবার মনে করেন জষ্ঠিমাসের কৃষ্ণপক্ষের সাবিত্রী চতুর্দশী তিথিতে স্ত্রীরা স্বামীদের দীর্ঘজীবন কামনা করে যমের আরাধনা করতেন। এই লোকাচারটির সূত্র ধরেই কলকাতার বাবু সংস্কৃতিতে নাকি জামাই ষষ্ঠীর অনুপ্রবেশ। বাল্যবিবাহ, সতীদাহ ইত্যাদি ঘটনার অনুষঙ্গ ধরেই হয়তো এক সময় খুব স্বাভাবিক ভাবেই শাশুড়িমাতা জামাইবাবাজীবনের দীর্ঘজীবন কামনা করতেন।[১]
দেবী ষষ্ঠী সন্তান দায়িনী এবং সন্তান পালিনী দেবী। আবার শুধু পৌরাণিক দেবী ও;মান্ধাতার আমলের লোকদেবী। আরও প্রাচীন;ব্রতের দেবী। কুমার কার্তিকের ঘরণী।প্রত্নযুগের এই দেবীকে পৌরাণিক রূপ-সাগরে স্নান করিয়ে নতুন রূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে। দেবী দুর্গার সঙ্গে একীভূত করা হয়েছে। মহাষষ্ঠীর সকালেই তো দেবী দুর্গার সংকল্প।দেশি বিদেশি পন্ডিতেরা দাবি করেছেন হিন্দু ধর্মের বারোয়ানাই অ-বৈদিক কালচার থেকে গৃহীত। পুজোপাঠ,ভূত-প্রেতে বিশ্বাস,পূর্বপুরুষপুজো,পরজন্মে বিশ্বাস,আত্মা এ সব ধারণাগুলি এসেছে অস্ট্রিক-দ্রাবিড় ইত্যাদি মিশ্র সংস্কৃতি থেকে।ষষ্ঠীও একইভাবে ছাড়পত্র পেয়েছে।প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতিবিদ আশুতোষ ভট্টাচার্য মনে করেছেন সুদূর প্রাচীন কাল থেকেই সমাজে শিশুরক্ষক দেবীর অস্তিত্ব ছিল। হরপ্পা সভ্যতায় কতকগুলি ক্ষুদ্রাকৃতি মাতৃমূর্তি পাওয়া গেছে।এই দেবীরা ছিলেন মূলত গৃহদেবী।অন্যদিকে নবজাত শিশুর রক্ষয়িত্রী।পরবর্তীকালে এই সমস্ত মাতৃকামূর্তি থেকেই ষষ্ঠীর উদ্ভব। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবে ষষ্ঠী্র মূর্তি বিশেষ একটা মেলেনি।কবি কৃষ্ণরাম দাসের ষষ্ঠী্মঙ্গলকাব্যের ভূমিকা লিখতে গিয়ে ড.সত্যনারায়ণ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, উড়িষ্যায় বালেশ্বর জেলা থেকে একটি ষষ্ঠী মূর্তি মিলেছে। দেবীর কোলে শিশুসন্তান। বাঁকুড়ার পাঁচমুড়ো কিম্বা সোনামুখিতে স্থানীয় কুম্ভকারেরা এক ধরনের মাটির পুতুল তৈরী করেন। নাম ষষ্ঠীপুতুল বা যো পুতুল। এগুলি ষষ্ঠীতলায় মানত হিসাবে দেওয়া হয়। পুতুলগুলি স্রেফ আঙুল টিপে তৈরি। ষষ্ঠীর কোলে এক বা দুই কিম্বা দশের অধিক শিশু থাকে।কালো বা লাল দু'রঙেরই হয়। চোখে মুখে গড়নে প্রত্ন পুতুলের মায়াবি বিন্যাস। আদিমতার ছাপ। সুতরাং ষষ্ঠীর উপস্থিতি সেই সুপ্রাচীনকালেই।আজও যার অস্তিত্ব টিকে আছে বাংলার বিলীয়মান পুতুল শিল্পে। অনেকেই আবার বৌদ্ধ হারিতীর সঙ্গে ষষ্ঠীকে একাকার করে দিয়েছেন।[২] কিন্তু হারিতী বড়ো ভয়ংকরী শিশু নিধনকারী যক্ষিণী। তাকে পুজো না করলে রেহাই নেই; এভাবেই ভয়ে ভক্তি আদায় করে হারিতী। আর ষষ্ঠী হলেন শিশু রক্ষয়িত্রী, কল্যাণকারী মাতৃমূর্তি। শিশুকে যদি কেউ আঘাত করে,অপমান করে তাতেই তিনি ভয়ংকর রেগে উঠবেন।জৈনধর্মের শিশুরক্ষক দেবী নৈগমেসার সঙ্গে অদ্ভুত মিল রয়েছে ষষ্ঠীর। ইনিও শিশুর কল্যাণকারী দেবী। ব্রতের দেবী হিসাবে ষষ্ঠী আরও আরও পুরানো। এই দেবী এসেছে আমাদের আদিমাতৃতান্ত্রিক সমাজ থেকে।এই কারণে ষষ্ঠীকে বুড়ি বলা হয়।কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তার চন্ডীমঙ্গল কাব্যে ষষ্ঠী সম্পর্কে লিখেছেনঃ
দুয়ারে বান্ধিল জাল বেত্র উপনাদে। ফেড়িয়া চালের খড় জ্বালিল আঁতুরি। গো-মুন্ডে থুইয়া দ্বার পূজে ষষ্ঠী বুড়ি।।
পশ্চিমরাঢ় অঞ্চল প্রাচীন জনবসতির অন্যতম কেন্দ্র। এখনো সেখানে বুড়ি নামাঙ্কিত সুপ্রাচীন লোকদেবীর পুজো হয়। যেমন খুনিয়াবুড়ি, মেলা বুড়ি, ভাঁড়রা বুড়ি।আর আসানসোলের জাগ্রতা ঘাঘরবুড়ির নাম আশাকরি অনেকেই শুনেছেন। এবার আসি ব্রত কথায়। ব্রত-এমন এক ধরনের মেয়েলি আচার-কৃত্য,পুজো অনুষ্ঠান যা নির্দিষ্ট তিথি মেনে পালিত হয়।এই পুজো মূলত প্রজনন শক্তির। গুহ্য যাদু শক্তির।সব ধরনের বিপদ আপদ থেকে মুক্ত হবার জন্য পুজো।এছাড়া সাংসারিক সুখ স্বাছন্দ্য কামনাতো আছেই। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। পরিণত বয়সে স্বামীর কোলে মাথা রেখে স্বর্গ লাভের দুর্মদ বাসনা।ব্রত আর ব্রাত্য শব্দদু'টি বৈন অনার্য মহিলাদিক সাহিত্যের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। মেয়েলি এই ব্রতের সঙ্গে বৈদিক বা পৌরাণিক ধর্মের কোন মিল নেই। পন্ডিতেরা অনুমান করেছেদের ধর্মীয় সংস্কৃতি ব্রতের মধ্যেই টিকে আছে। আর্যরা এই ধর্মটিকে বিশেষ পাত্তা দিতেন না। হয়তো আর্য সমাজের একাংশ বা অনার্যরা এই ব্রতধর্ম পালন করতো বলে তাদেরকে ব্রাত্য বলা হতো। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় মন্তব্য করেছেন -"ঋগবেদীয় আর্যরা ছিলেন যজ্ঞধর্মী। যজ্ঞধর্মী আর্যদের বাহিরে যাহারা ব্রতধর্ম পালন করিতেন, ব্রতের গুহ্য যাদু শক্তি বা ম্যাজিকে বিশ্বাস করিতেন তাহারাই হয়তো ছিলেন ব্রাত্য" ।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, দেবীর ভক্ত রাজা প্রিয়ব্রতের কথা। তিনি ষষ্ঠী পুজো করে মৃত সন্তানদের জীবিত অবস্থায় ফিরে পেয়েছিলেন।আর সেই থেকেই নাকি হিন্দু সমাজে প্রতি মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে ষষ্ঠীপুজো প্রচলিত হয়েছে।[৩] অরণ্যষষ্ঠী উপলক্ষ্যে বহুল প্রচলিত লোকগল্পটি হল বেণেবাড়ির ছোট বউকে নিয়ে। খাবার জিনিসে তার বড়ো লোভ।খুবই নোলা আর খাই খাই বাই।ষষ্ঠী পুজোর আয়োজন চলছে ।নানা লোভনীয় ফল-মূল মিস্টি ইত্যাদি।লোভ আর সংবরণ করতে পারলে না ছোট বউ।ফাঁকা নির্জন দেখেই কয়েকটা মন্ডা মেঠাই টপাটপ মুখে পুরে নিল।আর দোষ চাপিয়ে দিল ঐ নিশকেলে বিড়ালটার উপর।বিড়াল গেল বেজায় চটে।সে তো যে সে বিড়াল নয়।মা ষষ্ঠীর বাহন। অতএব সেও ফন্দি আঁটতে লাগলো।ছোট বউ সন্তান প্রসব করেই একটু খানি ঘুমুতেই বিড়াল ছেলে মুখে করে বনে দিল চম্পট।এমনি করে সাত ছেলে গেল হারিয়ে। ছোট বউ তখন হাহাকার করে বনে বনে বেড়াতে লাগলো। মা ষষ্ঠীর বড়ো দয়া হলো। বামনির বেশ ধরে এসে বউকে জিজ্ঞেস করে জানলো সব কথা। বিড়ালের উপর দোষ চাপিয়ে সে ঠিক করে নি তাও জানালে। নিজের পরিচয় দিয়ে পুজো করার পরামর্শ দিলে বনের মধ্যে। চালু হয়ে গেল ষষ্ঠীপুজা। যা হল আজকের জামাই ষষ্ঠী ।[৩] মা ষষ্ঠীর কিংবদন্তি মঙ্গল-কাব্য গ্রন্থে, বিশেষ করে এর ষষ্ঠী-মঙ্গল ভাগে রয়েছে।[৪] মঙ্গল-কাব্য এবং বাঙালি লোক কাহিনীগুলোতে তাকে মনসা্র ঘনিষ্ঠ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। [৫] মনসার নাগ পঞ্চমী উত্সবের সময় ষষ্ঠীর কার্যক্রম বর্ণনা করা হয়েছে বিখ্যাত লোকক্যেছে।যাতে তিনি মনসার সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হন। [৬]
ষষ্ঠীদেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য সৃষ্ট 'ষষ্ঠীমঙ্গল' পালার গীতিনাট্যাভিনয় অনেক সন্তানহীনের গৃহে সন্তানের কামনায় বা সন্তানলাভের পর মানসিক পূরণের পর অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের উড়িষ্যা-সন্নিহিত মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় এই পালার প্রচলন আছে।[১]