সবর (আরবী:صبر) সবর বা ধৈর্য বলতে বুঝায়- আনন্দ, প্রতিকূলতা, দুঃখ এবং উদ্বেগ ইত্যাদির সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং মন্দ কাজগুলি এড়ানো।
আনন্দ, প্রতিকূলতা, দুঃখ এবং উদ্বেগের সময়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। সহ্য বা অপেক্ষা করবার ক্ষমতা, সহিষ্ণুতা, ধীরতা। [১]
আনন্দ, ঝামেলা, দুঃখ ও উদ্বেগ ইত্যাদী সময়ে নিজেকে নিজে নিয়ন্ত্রণে রেখে আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নির্ধারিত সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকা। [২]
ধৈর্য একটি মহৎ ও উত্তম গুনাবলী সম্পন্ন কাজ যা আল্লাহ তাঁর নবী-রাসুলগণের গুণাবলী প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন-
وَاِسْـمَاعِيْلَ وَاِدْرِيْسَ وَذَا الْكِفْلِ ۖ كُلٌّ مِّنَ الصَّابِـرِيْنَ
অনুবাদ: আর স্মরণ কর ইসমাঈল, ইদরীস ও যুল্ কিফল এর কথা, তাদের প্রত্যেকেই ধৈর্যশীল ছিল।
-সূরা আম্বিয়া, আয়াত - ৮৫
ধৈর্যকে একটি উত্তম কাজ বলে আখ্যায়িত করে এর ফলাফল সম্পর্কে আল্লাহ কুরআন শরীফে বলেন-
وَ أَدخَلنَاہُم فِی رَحمَتِنَا إِنَّہُم مِّنَ الصَّالِحِینَ [৩]
অনুবাদ: আমি তাঁদেরকে আমার রহমাতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। তাঁরা ছিলেন সৎকর্মপরায়ণ।
- সুরা আম্বিয়া,আয়াত: ৮৬
আল্লাহ তাআ’লা শেষ নবী মুহাম্মদ(সা.) কে বলেছিলেন যে, এই মহান কাজ সর্বোচ্চ গুণাগুন সম্পন্ন নবী রাসূলদের গুনাবলীর মধ্যে একটি ছিল এবং তিনি তার রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদেশ করেছেন ধৈর্য ধরতে:
فَاصبِر کَمَا صَبَرَ أُولُوا العَزمِ مِنَ الرُّسُلِ
অনুবাদ: অতএব আপনি ধৈর্য ধারণ করুন যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিলেন দৃঢ় প্ৰতিজ্ঞ রাসূলগণ।
- সূরা আহকাফ,আয়াত - ৩৫
প্রকৃত ধৈর্য বলা হয় -যা কোন অভিঘাত, দুঃখ, দুর্দশার শুরু থেকেই গ্রহণ করা হয়। নবী করীম (সা.) বলেন-
إِنَّمَا الصَّبر عِندَ الصّدمۃ الأولیٰ
অনুবাদ: নিশ্চয় ধৈর্য যা আঘাতের প্রারম্ভেই নেওয়া হয়।
- বুখারী, হাদীস নং ১৩০২; মুসলিম, হাদীস নং ৯২৬ [৪]
ধৈর্যের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব এবং দুনিয়া ও আখিরাতের উপকারিতাগুলো দেখলে এটি ভালভাবে বোঝা যায় যে পবিত্র কুরআনে বহুবার আমাদের জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আমাদের ধৈর্য ধারণ করার আদেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরীফে এরশাদ করেন- [৫]
وَاصْبِرْ وَمَا صَبْرُكَ إِلاَّ بِاللّهِ وَلاَ تَحْزَنْ عَلَيْهِمْ وَلاَ تَكُ فِي ضَيْقٍ مِّمَّا يَمْكُرُونَ
অনুবাদ: ধৈর্য ধারণ করুন। আপনার সবর শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য, তাদের জন্যে দুঃখ করবেন না এবং তাদের চক্রান্তের কারণে মন ছোট করবেন না।[৬]
-সূরা নাহাল, আয়াত- ১২৭।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন:
فَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ وَلَا تُطِعْ مِنْهُمْ آثِمًا أَوْ كَفُورًا
অনুবাদ: অতএব, আপনি আপনার পালনকর্তার আদেশের জন্যে ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করুন এবং ওদের মধ্যকার কোন পাপিষ্ঠ কাফেরের আনুগত্য করবেন না।
- সূরা দা’হর, আয়াত - ২৫
আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন:
لَتُبْلَوُنَّ فِي أَمْوَالِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ وَلَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُواْ الْكِتَابَ مِن قَبْلِكُمْ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُواْ أَذًى كَثِيراً وَإِن تَصْبِرُواْ وَتَتَّقُواْ فَإِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الأُمُورِ [৭]
অনুবাদ: অবশ্য ধন-সম্পদে এবং জনসম্পদে তোমাদের পরীক্ষা হবে এবং অবশ্য তোমরা শুনবে পূর্ববর্তী আহলে কিতাবদের কাছে এবং মুশরেকদের কাছে বহু অশোভন উক্তি। আর যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং পরহেযগারী অবলম্বন কর, তবে তা হবে একান্ত সৎসাহসের ব্যাপার।
- সূরা আলে ইমরান, আয়াত - ১৮৫
এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে, ধৈর্যের অর্থ এই নয়-কাফের, মুশরিকের দুঃখকষ্ট, দুর্ভোগ, নিপীড়ন ও হিংসা সর্বদা সহ্য করা হবে বরং তাদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে হবে, তাদের কাছে সত্যকে স্পষ্ট করতে হবে তবে যদি তারা অমান্য করে বা আল্লাহ বা আল্লাহর রসূলের সাথে ঔদার্যতা প্রদর্শন করে,মুসলমানদের এলাকায় আক্রমণ করে জান,মাল ও সম্মানের ক্ষতি করে তাহলে উচিত হলো যথাসম্ভব প্রতিহত করা। এমতাস্থায় জিহাদ করার আদেশ রয়েছে।
সৎ কাজ করা ও অসৎ কাজ করার ক্ষেত্রে যেই কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়, সেক্ষেত্রে ধৈর্য ধরার জন্য আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেন:
يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ
অনুবাদ: হে বৎস, নামায কায়েম কর, সৎকাজে আদেশ দাও, মন্দকাজে নিষেধ কর এবং বিপদাপদে সবর কর। নিশ্চয় এটা সাহসিকতার কাজ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসার (আঃ) কে বলেছিলেন যে তিনি সর্বদা ধৈর্য ধরতে হবে এবং একই সাথে তাকে এই মহান নেকী অর্জন করার উপায় শিখিয়েছিলেন।
হাদীস শরীফে এসেছে:
حَدَّثَنَا عَبْدُ اللهِ بْنُ يُوسُفَ أَخْبَرَنَا مَالِكٌ عَنْ ابْنِ شِهَابٍ عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَزِيدَ اللَّيْثِيِّ عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ إِنَّ نَاسًا مِنْ الأَنْصَارِ سَأَلُوا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَأَعْطَاهُمْ ثُمَّ سَأَلُوهُ فَأَعْطَاهُمْ ثُمَّ سَأَلُوهُ فَأَعْطَاهُمْ حَتَّى نَفِدَ مَا عِنْدَهُ فَقَالَ مَا يَكُونُ عِنْدِي مِنْ خَيْرٍ فَلَنْ أَدَّخِرَهُ عَنْكُمْ وَمَنْ يَسْتَعْفِفْ يُعِفَّهُ اللهُ وَمَنْ يَسْتَغْنِ يُغْنِهِ اللهُ وَمَنْ يَتَصَبَّرْ يُصَبِّرْهُ اللهُ وَمَا أُعْطِيَ أَحَدٌ عَطَاءً خَيْرًا وَأَوْسَعَ مِنْ الصَّبْرِ [৮]
অনুবাদ: আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, কিছু সংখ্যক আনসারী সাহাবী আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট কিছু চাইলে তিনি তাঁদের দিলেন, পুনরায় তাঁরা চাইলে তিনি তাঁদের দিলেন। এমনকি তাঁর নিকট যা ছিল সবই শেষ হয়ে গেল। এরপর তিনি বললেনঃ আমার নিকট যে মাল থাকে তা তোমাদের না দিয়ে আমার নিকট জমা রাখি না। তবে যে চাওয়া হতে বিরত থাকে, আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রাখেন আর যে পরমুখাপেক্ষী না হয়, আল্লাহ তাকে অভাবমুক্ত রাখেন। যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ তাকে সবর দান করেন। সবরের চেয়ে উত্তম ও ব্যাপক কোন নি‘আমত কাউকে দেয়া হয়নি।
-বুখারী,হাদীস নং-৬৪৭০, মুসলিম, হাদীস নং-১০৫৩, মুসনাদে আহমাদ হাদীস নং-১১৮৯০।
আল্লাহ তায়ালা তার সাহায্য প্রাপ্তির উপায় হিসাবে ধৈর্যকে ঘোষণা করেছেন:
وَاسْتَعِينُواْ بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلاَّ عَلَى الْخَاشِعِينَ [৯]
অনুবাদ: ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য লাভ কর। সালাতকে অবশ্যই কঠিন মনে হয়, কিন্তু তাদের পক্ষে (কঠিন) নয়, যারা খুশূ’(অর্থাৎ ধ্যান ও বিনয়)-এর সাথে পড়ে।
-সূরা বাকারা, আয়াত-৪৫[১০]
ধৈর্য বা সবরের ফল দুনিয়ার মধ্যেও পাওয়া যায়, আখেরাতেও পাওয়া যাবে। প্রবাদ আছে, “সবুরে মেওয়া ফলে”। ধৈর্য ধরার উপকরিতা অনেক।
আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন:
وَأَطِيعُواْ اللّهَ وَرَسُولَهُ وَلاَ تَنَازَعُواْ فَتَفْشَلُواْ وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ وَاصْبِرُواْ إِنَّ اللّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ [১১]
অনুবাদ: আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করবে এবং পরস্পরে কলহ করবে না, অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের হাওয়া (প্রভাব) বিলুপ্ত হবে। আর ধৈর্য ধারণ করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন:
وَاللَّہُ یُحِبُّ الصِّابِرِین [১২]
অনুবাদ: আল্লাহ ধৈর্যশীলদের পছন্দ করেন।<bআল্লাহ তায়ালা আরো বলেন-
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ
الَّذِینَ إِذَا ذُکِرَ اللَّہُ وَجِلَت قُلُوبُہُم وَالصَّابِرِینَ عَلَی مَا أَصَابَہُم وَالمُقِیمِی الصَّلَاۃِ وَمِمَّا رَزَقنَاہُم یُنفِقُونَ
অনুবাদ: আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কোরবানী নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ কারার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। অতএব তোমাদের আল্লাহ তো একমাত্র আল্লাহ সুতরাং তাঁরই আজ্ঞাধীন থাক এবং বিনয়ীগণকে সুসংবাদ দাও;
যাদের অন্তর আল্লাহর নাম স্মরণ করা হলে ভীত হয় এবং যারা তাদের বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করে এবং যারা নামায কায়েম করে ও আমি যা দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে।
-সূরা হজ্জ, আয়াত: ৩৪-৩৫। [১৩]
অনুবাদ: পবিত্রতা হল ঈমানের অর্ধেক অংশ। “আলহামদুলিল্লাহ” (শব্দটি) পাল্লাকে ভরে দেয়। “সূবহানাল্লাহ ও আলহামদুলিল্লাহ (পাল্লাকে) ভরে দেয়, কিংবা [রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন] আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবতীঃ স্থান ভরে দেয়। সালাত (নামায/নামাজ) হল আলো, সাদাকা হল প্রমাণিকা, ধৈর্য হল জ্যোতি। কুরআন তোমার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে দলীল। প্রত্যেক মানুষ প্রত্যহ আপন সত্তাকে বিক্রি করে, তখন কেউ সত্তার উদ্ধারকারী হয় আর কেউ হয় ধবংস কারী।[১৫]