সবিচার চিন্তন বা সূক্ষ্ম চিন্তন (ইংরেজি: Critical thinking) বলতে এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ, সযত্ন, নির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখী ও সমস্যাকেন্দ্রিক জটিল সুবিবেচনা ও বিচক্ষণতার সাথে সম্পাদিত চিন্তন প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যার মাধ্যমে কোনও ব্যক্তি ব্যক্তিগত অনুভূতি বা মতামত পরিহার করে পক্ষপাতমুক্ত মন নিয়ে, সংশয়বাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে কোনও পরিস্থিতি, বিষয় বা ধারণা সম্পর্কে বিভিন্ন উৎস থেকে (যেমন বাস্তব ঘটনা, পর্যবেক্ষণ, সাক্ষ্যপ্রমাণ, অভিজ্ঞতা, গভীর চিন্তা, যুক্তি বা যোগাযোগ থেকে) প্রাপ্ত তথ্য সক্রিয়ভাবে ও দক্ষভাবে নির্দিষ্ট মানদণ্ডের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন ও সংশ্লেষণ করে যৌক্তিক বস্তুনিষ্ঠ বিবেচনাভিত্তিক একটি সম্ভাব্য সমাধান, মত, অনুমান বা সিদ্ধান্তে উপনীত হয় ও সেটির বৈধতা পরীক্ষা করে দেখে।[১][২]
সবিচার চিন্তন আত্ম-নির্দেশিত, আত্ম-শৃঙ্খলাবদ্ধ, আত্ম-নজরদারিকৃত ও আত্ম-সংশোধনকারী চিন্তন।[৩] সবিচার চিন্তন প্রক্রিয়াতে ত্বরিত কোনও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না, এমনকি শক্তিশালী সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় বিচারবিবেচনা মুলতবি রাখা হয়, প্রশ্নাতীত কোনও ভাবাদর্শ বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তিনির্মাণ করা পরিহার করা হয় এবং নিয়মিতভাবে একটি কলনবিধি (অ্যালগোরিদম) ব্যবহার করে কোনও প্রশ্নের উত্তর প্রদানের চেষ্টা করা হয়। এতে বুদ্ধিবৃত্তিক নিয়মানুবর্তিতা ও দক্ষতার প্রয়োগ ঘটানো হয়। এটি পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষিতের প্রতি সর্বদা সংবেদনশীল থাকে, কিছু নির্দিষ্ট মানদণ্ডের উপর নির্ভর করে ও আত্ম-সংশোধনশীল। সবিচার চিন্তনের সাথে সাধাণত নৈতিক চিন্তনের কোনও সম্পর্ক নেই। এটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়া। এটি স্পষ্টতা, সঠিকতা, সূক্ষ্মতা, পূর্বাপর সামঞ্জস্য, প্রাসঙ্গিকতা, নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ, উত্তম যুক্তি, গভীরতা, ব্যাপ্তি ও ন্যায্য পক্ষপাতহীনতার মতো মূল্যবোধগুলির উপর নির্ভরশীল।
সবিচার চিন্তন একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং এর অনেকগুলি উপাংশ বিদ্যমান।[৪] প্রথম ধাপ হল পর্যবেক্ষণ: একজন ব্যক্তি তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কোনও কিছু যত্নের সাথে ও সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে, যে পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে সে এক ধরনের অনিশ্চয়তা বা দ্বিধা অনুভব করে, ফলে সে সেই অনুভূতিটি দূর করে সন্তুষ্ট হবার সংকল্প গ্রহণ করে। অতঃপর সে যে প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে, সেটিকে পরিস্কারভাবে সূত্রায়িত করে। এ ব্যাপারে সে প্রাসঙ্গিক সমস্ত বিষয় বা ধারণার পরিষ্কার ও পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা প্রদান করে। এরপরে সে কল্পনা ও সৃষ্টিশীলতা কাজে লাগিয়ে সম্ভাব্য উত্তরগুলি নিয়ে চিন্তা করে। এরপর প্রদত্ত তথ্য থেকে যুক্তিযুক্তভাবে অনুমানে উপনীত হয়ে বিকল্প উত্তরগুলির বৈধতা নিয়ে চিন্তা করে। দরকার হলে একটি পরীক্ষা নকশা করে তার যৌক্তিক অনুমান নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। সে সমস্যা সমাধানের জন্য প্রাসঙ্গিক, নির্ভরযোগ্য, গ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য তথ্য সংগ্রহ ও বিন্যস্ত করে। এ কাজে সে পক্ষপাতহীনভাবে বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী মত, যুক্তি ও সিদ্ধান্ত সংগ্রহ করে ও ন্যায্যভাবে সেগুলির ওজন নির্ণয় করে। সে যুক্তির বৈধতা বিশ্লেষণ করতে পারে। বিদ্যমান সাক্ষ্যপ্রমাণ ও যুক্তির ভিত্তিতে কতটুকু আস্থার সাথে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়, সেটি নির্ণয় করাও তার একটি কাজ। এছাড়া একজন সবিচার চিন্তাকারী বাইরের পৃষ্ঠতলের পেছনে লুক্কায়িত কোনও মিথ্যা বা অন্যায্য পূর্বানুমান ও পক্ষপাত শনাক্ত করে থাকে। সে কোনও বিশেষ মত অতিরিক্ত আকর্ষণীয় করতে ব্যবহৃত কুযুক্তি বা মিথ্যা যুক্তি বা মনজয়মূলক বাগালংকারের কৌশলগুলিও শনাক্ত করতে পারে।