সরফরাজ আহমেদ নঈমী | |
---|---|
জন্ম | ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ |
মৃত্যু | ১২ জুন ২০০৯ | (বয়স ৬১)
যুগ | আধুনিক যুগ |
অঞ্চল | লাহোর, পাকিস্তান |
ধারা | সুন্নি: হানাফি বেরলভী[১] |
উল্লেখযোগ্য অবদান | আত্মঘাতী বোমা হামলার বিরুদ্ধে স্পষ্টবাদী মতামত |
ভাবগুরু |
সরফরাজ আহমেদ নঈমী শহীদ, (উর্দু: سرفراز نعیمی), (১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ - ১২ জুন ২০০৯) পাকিস্তানের সুন্নি ইসলামের একজন আলেম ছিলেন যিনি তার মধ্যপন্থী এবং সন্ত্রাসবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সুপরিচিত ছিলেন।[২]তেহরিক-ই-তালেবানের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং মতাদর্শকে অনৈসলামিক বলে প্রকাশ্যে নিন্দা করার পর ২০০৯ সালের ১২ জুন পাকিস্তানের লাহোরের জামিয়া নঈমীয়া লাহোরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় তিনি নিহত হন।[৩][৪]
মুফতি মুহাম্মদ হোসাইন নঈমীর ছেলে সরফরাজ আহমেদ নঈমী, ১৯৪৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষরা ভারতের মুরাদাবাদ থেকে পাকিস্তানে চলে আসেন।[৫] তিনি পাকিস্তানের লাহোরের জামিয়া নঈমীয়া মাদ্রাসার সিনিয়র আলেম ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি ১৯৯৮ সালে জামিয়া নঈমীয়ার অধ্যক্ষ হন। মাদ্রাসাটি লাহোরের গাড়ী শাহু পাড়ায় অবস্থিত। তিনি জামিয়া নঈমীয়া থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন এবং তারপর মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংক্ষিপ্ত কোর্সের পাশাপাশি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। নঈমীকে "একজন নম্র, মধ্যপন্থী এবং ব্যাপকভাবে সম্মানিত পণ্ডিত" হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।[৬] পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রগতিশীল আলেমদের একজন হিসেবে তার খ্যাতি ছিল।[৭] তিনি উর্দু, আরবি ও ফারসি ভাষা ভালোভাবে জানতেন ও ধর্মীয় বিষয়ে সংবাদপত্রে কলাম লিখতেন এবং লাহোরের মাসিক আরাফাত পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।[৫] নঈমী, যিনি তার তালেবান বিরোধী অবস্থানের জন্য পরিচিত ছিলেন, এর আগে তানজিম-উল-মাদারিস পাকিস্তানের প্রধান ছিলেন। সংগঠনটি পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংযুক্ত এবং এর স্কিম এবং পাঠ্যক্রম অনুসারে নিজস্ব পরীক্ষা পরিচালনা করে।
তার চার কন্যা এবং এক পুত্র ছিল। রাগিব হোসাইন নাঈমী তার একমাত্র পুত্র, যিনি তার মৃত্যুর পর জামিয়া নঈমীয়ার অধ্যক্ষ হিসেবে তার স্থলাভিষিক্ত হন।[৫]
নঈমী আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তার স্পষ্টবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য, সোয়াতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চলমান অভিযানকে প্রকাশ্যে সমর্থন করার জন্য এবং তালেবানদের কার্যকলাপকে "অ-ইসলামি" বলে চিহ্নিত করার জন্য পরিচিত ছিলেন। ২০০৯ সালের মে মাসে রয়টার্স তাকে উদ্ধৃত করে বলেছিল, "সেনাবাহিনীকে অবশ্যই তালেবানদের একবারে এবং চিরকালের জন্য নির্মূল করতে হবে অন্যথায় তারা পুরো দেশ দখল করবে যা একটি বড় বিপর্যয় হবে"। এছাড়াও ২০০৯ সালের মে মাসে, তিনি সরকার কর্তৃক আহ্বান করা ইসলামি পণ্ডিতদের একটি সম্মেলনে অংশ নেন যেখানে আত্মঘাতী হামলা এবং নিরপরাধ মুসলমানদের শিরশ্ছেদকে অনৈসলামিক বলে সমালোচনা করা হয়।[৩] তিনি তালেবানের ইসলামের কঠোর ব্যাখ্যার বিপরীতে মহিলাদের জন্য শিক্ষার সমান প্রবেশাধিকার এবং বিদ্যালয়ে কম্পিউটারের ব্যবহারের পক্ষে কথা বলেছিলেন।
নঈমী তালেবানদের বিরোধিতা করার জন্য ধর্মীয় সংগঠনগুলোর জোট গঠনের পাশাপাশি তালেবানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভও করেছিলেন। গত মাসে সুন্নি ইত্তেহাদ কাউন্সিল ঘোষণা করেছিল যে তারা "তালেবানের তীব্র নিন্দা করে এবং পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে দ্রুত তাদের নির্মূল করার আহ্বান জানায়", কাউন্সিল আরও বলেছিল যে এটি তাদের বর্বরতা প্রকাশ করে "জনসাধারণের সামনে তালেবানের আসল চেহারা উন্মোচন করবে"।[৮] তিনি আত্মঘাতী বোমা হামলার নিন্দা জানিয়ে একটি ফতোয়াও প্রণয়ন করেছিলেন,[৯]সেইসাথে তালেবান নেতা সুফি মুহাম্মদের সমালোচনা করে বলেছিলেন যে "যদি তিনি একজন মহিলার মতো লুকিয়ে থাকেন তবে তার চুড়ি পরা উচিত"। নঈমী বলেছিলেন, "যারা জান্নাত লাভের জন্য আত্মঘাতী হামলা করবে তারা জাহান্নামে যাবে, কারণ তারা অনেক নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে।" খালিদ জহিরের মতে, একজন পাকিস্তানি অধ্যাপক এবং ধর্মীয় পণ্ডিত "তার যুক্তি সহজ ছিল: ধর্ম সহিংসতার পক্ষে দাঁড়ায় না। আপনি কোনও ব্যক্তির বা নিজের জীবন নিতে পারবেন না। এবং আপনি আপনার নিজের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারবেন না।"[২] নঈমী ছিলেন তাহাফুজ-ই-নামুস-ই-রিসালাত মাহাজ (TNRM) এর পিছনে চালিকা শক্তি, ২০টিরও বেশি সুন্নি দলের সমন্বয়ে একটি দল যা তালেবান দ্বারা সংঘটিত সহিংসতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিল। ২০০৯ সালের জানুয়ারী মাসে তাহাফুজ-ই-নামুস-ই-রিসালাত মাহাজ (TNRM) জামিয়া নঈমীয়াতে একটি সম্মেলন করে এবং ভারতের আক্রমণের ক্ষেত্রে সমস্ত পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য জিহাদকে বাধ্যতামূলক করার ফতোয়া জারি করে। এছাড়াও এটি ভারতের সাথে যুদ্ধের ক্ষেত্রে পাকিস্তান সরকারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। আলেমরা পাকিস্তান সরকারকে "বিশ্বের সামনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় ষড়যন্ত্র উন্মোচন করার" আহ্বান জানিয়েছেন।[১০]
তিনি বিশ্বব্যাপী মুসলিম ইস্যুতে তার অবস্থানের জন্য পরিচিত ছিলেন যেমন মুসলিম আন্দোলন দমন এবং মুসলিম দেশগুলিতে আক্রমণ। তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটকে লজিস্টিক সহায়তা প্রদানে পারভেজ মোশাররফের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তার আওয়াজ তুলেছিলেন যার জন্য তাকে প্রথমে সরকার পরিচালিত আওকাফ বিভাগে খতিবের চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছিল এবং পরে সংক্ষিপ্তভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।[৫]নঈমী প্রায়ই যুক্তি দিয়েছিলেন যে আমেরিকান, ইসরায়েলি এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করতে এবং তার পারমাণবিক অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ দখল করার জন্য তালেবানদের সমর্থন করছে।[১১]
এসব কথা বলার জন্য তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছিল। তিনি পুলিশি নিরাপত্তা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। মৃত্যুর দিন তিনি শুক্রবার জুমার নামাজের পর তার অফিসে দর্শনার্থীদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন তখন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী ভিতরে ঢুকে বিকাল ৩টার দিকে বিস্ফোরণ ঘটায়।[১২]প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, আক্রমণকারী ক্লিন শেভ করা ছিল, তার বয়স প্রায় ১৮-২০ বছর ছিল এবং মনে হয়েছিল সে পাঞ্জাব প্রদেশের দক্ষিণ অংশের বাসিন্দা।[১২] হামলায় আরও চারজন নিহত ও ১০ জন আহত হয়েছিলেন।[১৩] প্রাদেশিক পুলিশ প্রধান তারিক সেলিম ডোগারের মতে, "সরফরাজ নঈমীকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তিনি মারা যান"। তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান হামলার দায় স্বীকার করেছিল। পরের দিন তার অনুসারীরা তালেবান বিরোধী স্লোগানের মধ্যে তাকে সমাহিত করেছিল।[১৪]
বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ পরে, শত শত শোকার্ত লোক মসজিদে জড়ো হয় এবং "তালেবানের মৃত্যু" বলে স্লোগান দেয়।[১২] হামলার পর লাহোরে ব্যাপক বিক্ষোভ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। শহরের সব বড় মাদ্রাসা ও মসজিদ ঘিরে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছিল। অল পাকিস্তান ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন পরের দিন দেশব্যাপী ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়েছিল। নঈমীর ছেলে রাগিব পরের দিন পুলিশের কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করেন যে "আমার বাবাকে হত্যাকারী হামলার পরিকল্পনা ও অনুপ্রেরণার জন্য বায়তুল্লাহ মেহসুদ দায়ী", এবং তাকে হত্যার জন্য অভিযুক্ত করে।
পরদিন পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী করাচি কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। জামাত আহলে সুন্নাতের প্রায় ২০০ কর্মী, একটি মধ্যপন্থী মুসলিম সম্প্রদায়, তালেবানদের জন্য একটি ব্যঙ্গ মিছিল করেছিল। তারা স্লোগান দিয়েছিল "তালেবান নিপাত যাক, তালেবান ইসলামের শত্রু, সরফরাজ নঈমীর হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।" মোহাম্মদ আরিফ, ৩৫ বছর বয়সী নঈমীর একজন প্রাক্তন ছাত্র যিনি এখন মসজিদে ইমামতি করেন, তিনি বলেন, "আমাদের কোন সন্দেহ নেই যে তালেবানরাই আমাদের নেতাকে হত্যা করেছে, সরকারের কাছে আমাদের দাবি হল তারা যেন প্রত্যেক তালেবানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। আমাদের আরও দাবি যে তাদের প্রধান বায়তুল্লাহ মেহসুদকে গ্রেফতার করে জনসমক্ষে ফাঁসিতে ঝুলানো উচিত। এটাই এই দেশকে বাঁচানোর একমাত্র বিকল্প।"
প্রতিবেশী ভারতে, মুসলিম দলগুলোও নঈমী হত্যা এবং পাকিস্তানি তালেবানদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ভারতের মুসলিম স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের প্রধান শাহনওয়াজ ওয়ার্সি বলেছেন, "পাকিস্তানে ওহাবি তালেবান সন্ত্রাসীদের দ্বারা সুন্নি আলেমদের চলমান হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আমরা একত্রিত হয়েছি"। "আমরা পাকিস্তান সরকারকে এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সমর্থন করি। সন্ত্রাসীরা ইসলামের শত্রু ছাড়া আর কিছুই নয় এবং তারা তাদের ইসলামের বিকৃত সংস্করণ উপস্থাপন করেছে," বিক্ষোভে একজন নেতা বলেছিলেন।[১৫]
সরফরাজ নঈমীর হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করেছেন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি। পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের চেয়ারম্যান ইমরান খানও এই হত্যার নিন্দা করেছেন। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বার্নার্ড কাউচনার এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছেন এবং নঈমীকে "একজন সুপরিচিত সুন্নি আলেম যিনি ইসলাম সম্পর্কে তার মধ্যপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সম্মানিত" বলে অভিহিত করেছেন। গভীর রাতে জাতির কাছে সম্প্রচারে রাষ্ট্রপতি আসিফ আলি জারদারি নঈমী হত্যাকাণ্ডের কথা তুলে ধরেন এবং তালিবানকে নৃশংস এবং পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য আখ্যা দিয়ে নিন্দা করেন।[১৬] ১৪ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন বায়তুল্লাহ মেহসুদের শক্ত ঘাঁটিতে এটি এবং অন্যান্য সাম্প্রতিক হামলার স্পষ্ট প্রতিশোধ হিসেবে আঘাত হানে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীও এটি এবং অন্যান্য সাম্প্রতিক হামলার প্রতিক্রিয়ায় তালেবানের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালায়।[১৪] ১৫ জুন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি নঈমীর জন্য সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ঘোষণা করেন, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদও হত্যার নিন্দা ও নঈমীর কাজের প্রশংসা করে একটি প্রস্তাব পাস করেছিল।[৪]
২০১৮ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সিতারা-ই-শুজাত (বীরত্বের তারকা) পুরস্কার দেওয়া হয়। [১৭]