সহদেব | |
---|---|
অন্তর্ভুক্তি | পাণ্ডব এবং আশ্বিনেয় |
অস্ত্র | তলোয়ার |
পরিবার | পিতামাতা
|
দাম্পত্য সঙ্গী | |
সন্তান |
|
আত্মীয় |
সহদেব (সংস্কৃত: सहदेव) হলেন হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতের সর্বকনিষ্ঠ পাণ্ডব এবং প্রধান পাঁচটি প্রধান মুখ্য চরিত্রের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। দেব অশ্বিনীকুমারের বরদানের ফলে মহারাজ পাণ্ডু ও মাদ্রীর ঘরে সহদেব ও তাঁর অগ্রজ যমজ ভাই নকুল জন্মগ্রহণ করেন। সহদেব তলোয়ার চালনায় এবং জ্যোতিষ বিদ্যায় পারদর্শী ও দক্ষ ছিলেন। তিনি ও তাঁর যমজ ভাই নকুল, তাঁদের সৎভাই মহারাজ যুধিষ্ঠিরের পরামর্শক ও সঙ্গী ছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তিনি বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন এবং শকুনি সহ বহু অধর্মি যোদ্ধার নিধন করেন।
সহদেব শব্দটি দুটি সংস্কৃত শব্দ সহ (सह) এবং দেব (দেব) থেকে উৎপন্ন। সহ অর্থ একত্রে এবং দেব একটি সংস্কৃত শব্দ যা দেবতা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। তাই আক্ষরিক অর্থে সহদেব মানে দেবতার সাথে । আরেকটি অর্থ হল সহস্র ঈশ্বর । সহদেব এবং তার ভাই নকুল, উভয়কেই আশ্বিনেয় (आश्विनेय) বলা হয়, কারণ তারা অশ্বিনীকুমারদের বরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। [১]
ঋষি কিন্দম রাজা পাণ্ডুকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, পত্নীর সঙ্গে যৌনসংগম করতে গেলেই তার মৃত্যু হবে। এই কারণে পাণ্ডু তার দুই পত্নী কুন্তী ও মাদ্রীর সঙ্গে মিলিত হতে পারতেন না। কিন্তু ঋষি দুর্বাসা প্রথম জীবনে কুন্তীকে একটি বর দিয়েছিলেন। এই বরের সাহায্যে কুন্তী যেকোনো দেবতাকে আহ্বান করে একজন পুত্রের জননী হতে পারতেন। এই বর ব্যবহার করে কুন্তী তিন পুত্র লাভ করেন। তিনি তার সপত্নী মাদ্রীকেও এই বর দেন। মাদ্রী অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে আহ্বান করেন। যার ফলে তাদের আশীর্বাদে নকুল ও সহদেবের জন্ম হয়।
পরে কিন্দমের অভিশাপ বিস্মৃত হলে পান্ডুর মনে অভিমান জাগে। কামাতুর হয়ে মাদ্রীর সঙ্গে সহবাস করার চেষ্টা করলে পাণ্ডুর মৃত্যু ঘটে। মাদ্রী এই ঘটনার জন্য নিজেকে দায়ী করে পাণ্ডুর চিতায় আরোহণ করে সতী হন। এইভাবে নকুল ও সহদেব অল্প বয়সেই তাদের পিতামাতাকে হারান।
দ্রৌপদীর উক্তি থেকে জানা যায়, কনিষ্ঠ পাণ্ডব সহদেব তার অন্যান্য ভ্রাতাদের মতো যুদ্ধে ভয়ংকর এবং নৈতিকতা সম্পর্কে সদা সচেতন। তিনি ছিলেন অসিচালনায় দক্ষ এবং “নায়কোচিত, বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ও সদা ভয়ংকর। প্রাজ্ঞদের সভায় বুদ্ধি ও বাকবৈদগ্ধে তাঁর সমতুল্য কেউ ছিল না।”
আরও মনে করা হয় যে, সহদেব হলেন দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের অবতার। ভীষ্ম ও বিদুরের মতো তিনি সেই অল্প কয়েকজন ব্যক্তি যাঁরা কৃষ্ণের সমসাময়িক ছিলেন এবং কৃষ্ণকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বলে বুঝতে পেরেছিলেন। অনেক রাজা কৃষ্ণকে আগে সম্মান প্রদর্শন করতে অস্বীকৃত হলে, তিনিই কৃষ্ণের অগ্রপূজা করেন।
ভাগবত পুরাণ অনুসারে, সহদেব কৃষ্ণের সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্তদের অন্যতম। কৃষ্ণ একবার সহদেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যুদ্ধ থামানোর জন্য কি করা যায়। সহদেব বলেছিলেন, কৃষ্ণকে বেঁধে বন্দী করে সকল পাণ্ডব ও দুর্যোধনকে বনে পাঠিয়ে এবং কর্ণকে রাজা করে যুদ্ধ থামানো যায়। কৃষ্ণ তাকে বেঁধে ফেলতে বললে, সহদেব তাকে শিশু রূপে ধ্যান করেন এবং বেঁধে ফেলেন। সহদেবের ধ্যানে সৃষ্ট বন্ধনাবস্থায় কৃষ্ণ নড়াচড়ার ক্ষমতা হারালে তিনি সহদেবকে দিব্যদৃষ্টি দিয়ে আশীর্বাদ করেন এবং সহদেব তার বন্ধন খুলে দেন।
পরে কুন্তী ও পঞ্চপাণ্ডব হস্তিনাপুরে আসেন। নকুলের মতো সহদেবের দক্ষতা ছিল অসিচালনায়।[২] কথিত আছে, সহদেব ছিলেন বিনয়ী, লাজুক ও গুণী।[৩] তার দক্ষতার জন্য তিনি ‘মহারথী’ উপাধি পান।
পঞ্চপাণ্ডব একসঙ্গে দ্রৌপদীকে বিবাহ করেন। সহদেবের ঔরসে দ্রৌপদীর গর্ভে একটি পুত্র শ্রুতসেনা ও একটি কন্যা সুমিত্রা জন্মগ্রহণ করে।তিনি তার মামা মদ্রের দ্যুতিমতের কন্যা বিজয়াকে স্বয়ম্বরের মাধ্যমে বিয়ে করেন।তাদের সুহোত্র নামে একটি পুত্র হয়।ভীম জরাসন্ধকে বধ করলে সহদেব তার কন্যা দিগাম্বীকে বিয়ে করেন।তার গর্ভে একটি কন্যার জন্ম হয়।মহামহিম ভীষ্মের নামানুসারে কন্যাটির নাম রাখা হয় ভীষ্মা। রাজসূয়কালে তিনি যখন দ্বারকায় যান তখন ভানু নামক এক যাদব তার কন্যা ভানুমতির সাথে সহদেবের বিয়ে দেন।তাদের সৌধেয় ও সুদেব নামে দুটি পুত্র হয়। কুন্তীর দাদা অষ্টকের কন্যা মালাও সহদেবকে প্রেমবিবাহ করেন।যুদ্ধের পর ।সহদেবের সবথেকে প্রিয় স্ত্রী মালার গর্ভে মন্যু ও সুহাসুন্দর নামে দুটি পুত্র হয়।অভিমন্যুর নামানুসারে মন্যুর নামকরণ হয়।বনবাসকালে গন্ধর্ব চিত্রসেনের দুই যমজ কন্যা সুকৃতি ও সুকর্মনা নকুল ও সহদেবের রূপে আকৃষ্ট হয়ে তাদের বিবাহ করেন।যুদ্ধের পরেও সহদেব আরো চারটি বিবাহ করেছিলেন।এদের মধ্যে রাধার গর্ভে ব্রতিনী নামক একটি কন্যা,নিরঞ্জনার গর্ভে কুন্তীর নামানুসারে কুন্তশ্রী নামক একটি কন্যা, তুলহাজাশীর গর্ভে মালবী নামক একটি কন্যা এবং শিত্রসুধার গর্ভে উজাত নামক একটি পুত্রের জন্ম হয়।
ইন্দ্রপ্রস্থের সম্রাট হওয়ার পর প্রথম পাণ্ডব যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞের সময় সহদেবকে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলি জয় করতে পাঠান। তাকে দাক্ষিণাত্যে পাঠানোর কারণ ছিল, ভীষ্ম বলেছিলেন দাক্ষিণাত্যের রাজারা অসিযুদ্ধে বিশেষ দক্ষ এবং সহদেব নিজে ছিলেন অসিযুদ্ধে পারদর্শী।[৪]
মহাভারতে ইন্দ্রপ্রস্থের দক্ষিণে একাধিক রাজ্য জয়ের উল্লেখ আছে। এগুলির মধ্যে কয়েকটি হল:[৫]
পাশাখেলায় পরাজিত হয়ে যুধিষ্ঠির সহ পাণ্ডবদের তেরো বছরের জন্য নির্বাসনে যেতে হয়। নির্বাসনকালে জটাসুর এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে দ্রৌপদী, যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেবকে অপহরণ করে। ভীম তাদের উদ্ধার করেন।
১৩ বছর পর বিরাট রাজ্যে অজ্ঞাতবাসকালে সহদেব তান্তিপথ নাম নিয়ে এক বৈশ্যের ছদ্মবেশ ধারণ করেন। পাণ্ডবদের মধ্যে তিনি জয়দবল নামে পরিচিত হন।[৬] তিনি বিরাট রাজার গোশালার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ত্ব নিয়েছিলেন।
সহদেব ছিলেন ভাল জ্যোতিষী। শকুনির পরামর্শে দুর্যোধন সহদেবের কাছে এসেছিলেন এই কথা জানতে যে কোন সময় যুদ্ধ শুরু করলে কৌরবরা বিজয়ী হবেন। সহদেব সৎ ছিলেন। তাই কৌরবরা তার শত্রু জেনেও তিনি সঠিক সময়টি বলে দেন। এরপর কৃষ্ণ যুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই একটি গ্রহণের পরিকল্পনা করেন। কৃষ্ণের চিন্তায় ভীত হয়ে সূর্য ও চন্দ্র তার কাছে এসে বলেন যে এতে মহাবিশ্বে সময়ের একটি বড়ো অসঙ্গতি ঘটবে। তখন কৃষ্ণ ঘোষণা করেন যেহেতু পৃথিবী, চন্দ্র ও সূর্য একযোগে একসাথে এসেছে, সেহেতু এটিই একটি গ্রহণ।
সহদেব বিরাটকে পাণ্ডব বাহিনীর সেনাপতি হিসেবে চেয়েছিলেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির ও অর্জুন বেছে নেন ধৃষ্টদ্যুম্নকে।[৭]
যোদ্ধা হিসেবে সহদেব শত্রুপক্ষের সেরা কয়েকজন যোদ্ধাকে বধ করেন। সহদেবের রথের পতাকায় একটি রৌপ্য হংসের প্রতীক ছিল।[৮][৯] পাশাখেলায় পরাজয়ের সময় সহদেব শকুনিকে বধ করবেন বলে শপথ গ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধের অষ্টাদশ দিনে তিনি এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেন। শকুনি ছাড়াও শকুনির পুত্র উলুকা ও ত্রিগত রাজকুমার নিরমিত্রকেও সহদেব বধ করেন।
যুদ্ধের পর যুধিষ্ঠির সহদেব ও নকুলকে তাদের মায়ের রাজ্য মদ্রের রাজা নিযুক্ত করেন।[১০]
কলিযুগের আগমন ত্বরান্বিত হলে এবং কৃষ্ণের মৃত্যু ঘটলে পাণ্ডবরা তাদের একমাত্র জীবিত বংশধর পরীক্ষিতের হাতে রাজ্যভার তুলে দিয়ে হিমালয়ের পথে মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করেন। যাত্রাকালে যুধিষ্ঠির ছাড়া অন্যান্যরা দুর্বল হয়ে পড়েন এবং দ্রৌপদীর পরেই সহদেবের মৃত্যু হয়। ভীম যুধিষ্ঠিরকে সহদেবের মৃত্যুর কারণ জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বলেন সহদেবের জ্ঞানের অহংকারই তার মৃত্যুর কারণ।[১১]
সহদেব তার ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছিলেন। যুধিষ্ঠির তাকে দেবগুরু বৃহস্পতির থেকেও অধিক বুদ্ধিমান বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া সহদেব ও নকুল ছিলেন ভাল জ্যোতিষী। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ঘটনা তিনি আগেই জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাকে অভিশাপ দেওয়া হয়েছিল, সেই ঘটনার কথা কাউকে বললে তার মাথা খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাবে। সহদেব যুদ্ধ পরিকল্পনাতেও বেশ দক্ষ ছিলেন।