ক্রেবস চক্র, সেন্ট-জর্জি-ক্রেবস চক্র বা TCA চক্র (ট্রাইকার্বোক্সিলিক অ্যাসিড চক্র) নামে পরিচিত সাইট্রিক অ্যাসিড চক্র[১][২] হলো শর্করা, প্রোটিন ও লিপিড হতে উৎপন্ন অ্যাসিটাইল-কোএ এর জারণের মাধ্যমে পুষ্টি উপাদান থেকে শক্তি পুনরুদ্ধারের ধারাবাহিক জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া। এই শক্তি ATP আকারে নির্গত হয়। যেসকল জীব অবাত বা সবাত শ্বসনের মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন করে, তাদের দেহের কোষে এ চক্র সংঘটিত হয়। এছাড়া এ প্রক্রিয়ায় অ্যামিনো অ্যাসিড ও বিজারক NADH উৎপন্ন হয়, যা দেহের অন্যান্য বিক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়। এটিকে বিপাকের একটি আদি গতিপথ হিসেবে ধরা হয়।[৩][৪] সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের অন্তত তিনটি বিকল্প অংশ আবিষ্কৃত হয়েছে।[৫]
সাইট্রিক অ্যাসিডের (একটি ট্রাইকার্বোক্সিলিক অ্যাসিড, আয়নিত অবস্থায় সাইট্রেট হিসেবে পরিচিত[৬]) নাম থেকে এ চক্রের নামকরণ করা হয়েছে, যা এই চক্রে উৎপন্ন হয় ও ধারাবাহিক বিক্রিয়া সম্পন্ন করে পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে চক্র পূর্ণ করে। এই চক্রে অ্যাসিটাইল-কোএ ও পানি গৃহীত হয়, NAD+ বিজারিত হয়ে NADH উৎপন্ন হয় ও কার্বনডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হয়। NADH ইলেকট্রন প্রবাহ তন্ত্রে অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশনে অংশ নেয়। এর মাধ্যমে ATP রূপে রাসায়নিক শক্তি উৎপন্ন হয়।
প্রকৃত কোষে মাইটোকন্ড্রিয়নের মাতৃকায় এ চক্র সম্পন্ন হয়। ব্যাকটেরিয়ার মতো আদিকোষে মাইটোকন্ড্রিয়া না থাকায় বিক্রিয়াসমূহ কোষের সাইটোসলে ঘটে।
গ্লাইকোলাইসিসে উৎপন্ন প্রতিটি পাইরুভেট আয়নের জন্য তিন অণু NADH, এক অণু FADH2 এবং এক অণু GTP (বা ATP) উৎপন্ন হয়।[৭]
সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের বিভিন্ন বিক্রিয়াসমূহ ১৯৩০ এর দশকে অ্যালবার্ট সেন্ট-জর্জি গবেষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেন। এ চক্রের একটি উপাদান ফিউমারিক অ্যাসিড সংক্রান্ত আবিষ্কারের কারণে ১৯৩৭ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।[৮] তিনি কবুতরের বুকের পেশি পর্যবেক্ষণ করে এ আবিষ্কার করেন।[৯] সাইট্রিক অ্যাসিড চক্র ১৯৩৭ সালে হান্স অ্যাডলফ ক্রেবস এবং উইলিয়াম আর্থার জনসন কর্তৃক চিহ্নিত হয়,[১০] যার কারণে ক্রেবস ১৯৫৩ সালে একই বিভাগে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর নামানুসারে এ চক্রকে 'ক্রেবস চক্র'ও বলা হয়।[১১]
এ চক্রের বিক্রিয়াসমূহ আটটি উৎসেচক বা এনজাইম দ্বারা সংঘটিত যেগুলো অ্যাসিটাইল-কোএ কে সম্পূর্ণরূপে জারিত করে দুই অণু কার্বনডাইঅক্সাইড ও ২ অণু পানি উৎপন্ন করে। শর্করা, প্রোটিন ও চর্বির ভাঙনের মাধ্যমে ২ কার্বনবিশিষ্ট জৈব অণু অ্যাসিটাইল-কোএ উৎপন্ন হয় যা ক্রেবস চক্রে প্রবেশ করে। এছাড়া এ চক্রে তিন অণু নিকোটিনামাইড অ্যাডেনিন ডাইনিউক্লিওটাইড (NAD+) বিজারিত হয়ে NADH, এক অণু ফ্ল্যাভিন অ্যাডেনিন ডাইনিউক্লিওটাইড (FAD) বিজারিত হয়ে FADH2 উৎপন্ন হয় এবং এক অণু গুয়ানোসিন ডাইফসফেট (GDP) ও অজৈব ফসফেট (Pi) মিলিত হয়ে এক অণু গুয়ানোসিন ট্রাইফসফেট (GTP) উৎপন্ন হয়। NADH ও FADH2 অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশনের মাধ্যমে শক্তিসমৃদ্ধ ATP তে রূপান্তরিত হয়।
অ্যাসিটাইল-কোএ এর একটি প্রধান উৎস হলো গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন পাইরুভেট আয়ন। এটি থেকে পাইরুভেট ডিহাইড্রোজিনেজ কমপ্লেক্সে একটি কার্বন পরমাণু অপসারিত হয়ে অ্যাসিটাইল-কোএ উৎপন্ন করে:
এখানে, HSCoA দ্বারা বুঝানো হচ্ছে Hydrogen Synthesis Co-enzyme A . অর্থাৎ , এখানে কো এনজাইম এ এর একটি কম্পাউন্ড এর আগমন ঘটে।
এটি ফ্যাটি অ্যাসিড থেকেও উৎপন্ন হতে পারে। অ্যাসিটাইল-কোএ হলো সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের সূচনা বিন্দু। চক্রটির সারমর্ম নিম্নরূপ:
সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের ১০টি ধাপ আছে। চক্রে অ্যাসিটাইল-কোএ রূপে কার্বন সরবরাহ চলমান থাকে ও ছকে উল্লিখিত ধাপ ০ এ প্রবেশ করে।[১৪]
ধাপ | বিক্রিয়ার ধরন | বিক্রিয়ক | উৎসেচক | উৎপাদ | মন্তব্য |
---|---|---|---|---|---|
০ / ১০ | অ্যালডল ঘনীভবন | অক্সালোঅ্যাসিটেট + অ্যাসিটাইল-কোএ + H2O | সাইট্রেট সিন্থেজ | সাইট্রেট + CoA-SH | একমুখী, ৪ কার্বনবিশিষ্ট অক্সালোঅ্যাসিটেটকে ৬ কার্বনবিশিষ্ট অণুতে পরিণত করে। |
১ | পানি অপসারণ | সাইট্রেট | অ্যাকোনিটেজ | সিস-অ্যাকোনিটেট + H2O | উভমুখী সমাণুকরণ। |
২ | পানি সংযোজন | সিস-অ্যাকোনিটেট + H2O | আইসোসাইট্রেট | ||
৩ | জারণ | আইসোসাইট্রেট + NAD+ | আইসোসাইট্রেট ডিহাইড্রোজিনেজ | অক্সালোসাকসিনেট + NADH + H + | NADH উৎপন্ন করে (২.৫ অণু ATP এর সমতুল্য)। |
৪ | কার্বন অপসারণ | অক্সালোসাকসিনেট | আলফা-কিটোগ্লুটারেট + CO2 | সীমিত, একমুখী, ৫ কার্বনবিশিষ্ট অণু তৈরি করে। | |
৫ | অক্সিডেটিভ কার্বন অপসারণ |
আলফা-কিটোগ্লুটারেট+ NAD+ + CoA-SH | আলফা-কিটোগ্লুটারেট ডিহাইড্রোজিনেজ, থিয়ামিন পাইরোফসফেট, লিপোয়িক অ্যাসিড, Mg++, ট্রান্স-সাকসিনাইটেজ | সাকসিনাইল-কোএ + NADH + H + + CO2 | একমুখী, NADH তৈরি করে (২.৫ অণু ATP এর সমতুল্য), পুনরায় ৪ কার্বনবিশিষ্ট যৌগ তৈরি করে। |
৬ | ফসফোরাইলেশন | সাকসিনাইল-কোএ + GDP + Pi | সাকসিনাইল-কোএ সিন্থেটেজ | সাকসিনেট + CoA-SH + GTP | GDP→GTP এর পরিবর্তে ADP→ATP তৈরি করে।[১৫] পানির প্রয়োজন হয়। |
৭ | জারণ | সাকসিনেট + ইউবিকুইনোন (Q) | সাকসিনেট ডিহাইড্রোজিনেজ | ফিউমারেট + ইউবিকুইনোল (QH2) | প্রথমে FAD→FADH2 সংঘটিত হয়।[১৫] পরে দুটি ইলেকট্রন QH2 এ স্থানান্তরিত হয় ও এক অণু থেকে ১.৫ অণুর সমতুল্য ATP পাওয়া যায়। |
৮ | পানি সংযোজন | ফিউমারেট + H2O | ফিউমারেজ | L-ম্যালেট | কার্বন-কার্বন দ্বিবন্ধনে পানি সংযোজন |
৯ | জারণ | L-ম্যালেট + NAD+ | ম্যালেট ডিহাইড্রোজিনেজ | অক্সালোঅ্যাসিটেট + NADH + H+ | উভমুখী (প্রকৃতপক্ষে সাম্যাবস্থায় ম্যালেট বেশি থাকে), NADH তৈরি হয়। (২.৫ অণু ATP এর সমতুল্য) |
১০ / ০ | অ্যালডল ঘনীভবন | অক্সালোঅ্যাসিটেট + অ্যাসিটাইল-কোএ + H2O | সাইট্রেট সিন্থেজ | সাইট্রেট + CoA-SH | ধাপ শূন্যের অনুরূপ |
দুটি কার্বন পরমাণু CO2 এ জারিত হয়, এ বিক্রিয়ায় উৎপন্ন শক্তি অন্যান্য বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় GTP অথবা ATP এর মাধ্যমে এবং NADH ও QH2 এ ইলেকট্রন হিসেবে স্থানান্তরিত হয়। চক্রে উৎপন্ন NADH জারিত হওয়ার মাধ্যমে ATP সিন্থেজে অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশন সংঘটিত করতে ভূমিকা রাখে।[১৬] FADH2 সাকসিনেট ডিহাইড্রোজিনেজ এনজাইমের সাথে সমযোজী বন্ধনের মাধ্যমে যুক্ত থাকে, যা সাইট্রিক অ্যাসিড চক্র ও ইলেকট্রন প্রবাহ শিকলের অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশন উভয়ক্ষেত্রেই ভূমিকা রাখে। FADH2 কোএনজাইম-Q এ ইলেকট্রন স্থানান্তর করে যা সাকসিনেটের উপস্থিতিতে সর্বশেষ ইলেকট্রন গ্রহীতা যা ইউবিকুইনোন অক্সিরেডাক্টেজ কমপ্লেক্স নামে পরিচিত। এটি ইলেকট্রন প্রবাহ শিকলের একটি মধ্যবর্তী উৎপাদ।[১৫]
মানুষসহ প্রাণীর মাইটোকন্ড্রিয়ায় দুই ধরনের সাকসিনাইল-কোএ সিন্থেটেজ এনজাইম থাকে, একটি GDP থেকে GTP তৈরি করে, অন্যটি ADP থেকে ATP তৈরি করে।[১৭] উদ্ভিদে দ্বিতীয় ধরনটি উপস্থিত।[১৪] চক্রের বিভিন্ন এনজাইম মাইটোকন্ড্রীয় মাতৃকার মাল্টিজাইম প্রোটিন কমপ্লেক্সে সহযোগী হিসে থাকতে পারে।[১৮]
সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রে GTP তৈরি হলে নিউক্লিওসাইড-ডাইফসফেট কাইনেজ এনজাইমের সাহায্যে ATP তে রূপান্তরিত হতে পারে (প্রভাবকীয় বিক্রিয়াটি হলো GTP + ADP → GDP + ATP)।[১৫]
সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের একটি ঘূর্ণন শেষে প্রাপ্ত উৎপাদ হলো এক অণু GTP (বা ATP), তিন অণু NADH, এক অণু FADH2 ও দুই অণু CO2.
প্রতি গ্লুকোজ অণু থেকে উৎপন্ন দুই অণু অ্যাসিটাইল-কোএ এর জারণের জন্য চক্রটি দুইবার সম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ উৎপাদের পরিমাণ দাঁড়ায়: দুই অণু GTP, ছয় অণু NADH, দুই অণু FADH2 ও চার অণু CO2.[১৯]
বর্ণনা | বিক্রিয়ক | উৎপাদ |
---|---|---|
সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রে সংঘটিত বিক্রিয়াসমূহের সমষ্টি | অ্যাসিটাইল-কোএ + 3 NAD+ + FAD + GDP + Pi + 2 H2O | → CoA-SH + 3 NADH + FADH2 + 3 H+ + GTP + 2 CO2 |
পাইরুভেটের জারণ ক্রিয়া সহযোগে | পাইরুভেট আয়ন + 4 NAD+ + FAD + GDP + Pi + 2 H2O | → 4 NADH + FADH2 + 4 H+ + GTP + 3 CO2 |
গ্লাইকোলাইসিসের বিক্রিয়া সহযোগে | গ্লুকোজ + 10 NAD+ + 2 FAD + 2 ADP + 2 GDP + 4 Pi + 2 H2O | → 10 NADH + 2 FADH2 + 10 H+ + 2 ATP + 2 GTP + 6 CO2 |
এখামে Pi, ADP, GDP, ATP ও GTP যথাক্রমে H2PO4−, ADP2−, GDP2−, ATP3− ও GTP3− আয়ন নির্দেশ করে।
গ্লাইকোলাইসিস, সাইট্রিক অ্যাসিড চক্র এবং অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশনে গ্লুকোজের সম্পূর্ণ জারণের মাধ্যমে উৎপন্ন ATP অণুর মোট সংখ্যা ৩০ হতে ৩৮ এর মধ্যে।[২০]
তাত্ত্বিকভাবে এক অণু গ্লুকোজের গ্লাইকোলাইসিস, সাইট্রিক অ্যাসিড চক্র ও অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশনে সর্বোচ্চ ৩৮ অণু ATP পাওয়া যায় (এক অণু NADH = ৩ অণু ATP ও এক অণু FADH2 = ২ অণু ATP এর সমতুল্য ধরে)। প্রকৃতকোষী জীবে গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ায় ২ অণু NADH এর এবং ২ অণু ATP এর সমতুল্য উৎপাদ তৈরি হয়, যা সাইটোপ্লাজমে সংঘটিত হয়। যদি ম্যালেট-অ্যাসপারেট শাটলের পরিবর্তে গ্লিসারল ফসফেট শাটলের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়, তাহলে দুই অণু ATP এর সমতুল্য শক্তি খরচ হয়ে যায় এবং প্রাপ্ত ATP এর সংখ্যা ৩৬ হয়। এছাড়া মাইটোকন্ড্রিয়ার ঝিল্লিতে সংঘটিত অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশনের অদক্ষতার (মূলত প্রোটনের অপচয় ও প্রোটন পাম্পের উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট হওয়া) কারণে NADH ও FADH2 হতে ATP প্রাপ্তি কমে যায়।[২০] পর্যবেক্ষণে দেখা যায় এক অণু NADH হতে প্রায় ২.৫ অণু এবং এক অণু FADH2 হতে প্রায় ১.৫ অণু ATP পাওয়া যায়। ফলে প্রাপ্ত ATP এর সংখ্যা কমে ৩০ হয়।[২১] সাম্প্রতিক গবেষণায় এক অণু গ্লুকোজ হতে ২৯.৮৫ এর কাছাকাছি ATP পাওয়া যায়।[২২]
সাইট্রিক অ্যাসিড চক্র সাধারণত একই হলেও জীবের বিভিন্ন ট্যাক্সায় এনজাইমের ভিন্নতা রয়েছে।[২৩] (উল্লেখ্য যে এ পাতায় স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কোষে সংঘটিত চক্রের কথা আলোচিত).
প্রকৃতকোষী ও আদিকোষী জীবের মধ্যে পার্থক্য লক্ষণীয়। D-থ্রিয়ো-আইসোসাইট্রেটের ২-অক্সোগ্লুটারেটে রূপান্তরে প্রকৃতকোষে NAD+-নির্ভর EC 1.1.1.41 প্রভাবক হিসেবে কাজ করে, যেখানে আদিকোষে NADP+-নির্ভর EC 1.1.1.42[২৪] প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। একইভাবে (S)-ম্যালেট আয়নের অক্সালোঅ্যাসিটেটে পরিবর্তনে প্রকৃতকোষে NAD+-নির্ভর EC 1.1.1.37 এবং অধিকাংশ আদিকোষী প্রাণীর কোষে কুইনোন-নির্ভর এনজাইম EC 1.1.5.4 ব্যবহৃত হয়।[২৫]
সাকসিনাইল-কোএ হতে সাকসিনেট তৈরি হওয়ার ধাপে বিভিন্ন জীবে পার্থক্য লক্ষ করা যায়। অধিকাংশ জীব EC 6.2.1.5, সাকসিনেট-কোএ লাইগেজ (ATP তৈরিকারী) ব্যবহার করে। স্তন্যপায়ীদের কোষে GTP-তৈরিকারী এনজাইম, সাকসিনেট-কোএ লাইগেজও (EC 6.2.1.4) কাজ করে। এই দুই ধরনের সমাণুর ব্যবহার টিস্যুনির্ভর।[২৬] Acetobacter aceti-র মতো অ্যাসিটেট তৈরিকারী ব্যাকটেরিয়ায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এনজাইম রূপান্তরে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে যা সাকসিনাইল-কোএ:অ্যাসিটেট-কোএ ট্রান্সফারেজ (EC 2.8.3.18) হিসেবে পরিচিত। এই বিশেষায়িত এনজাইম সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রকে অ্যাসিটেট বিপাকের সাথে যুক্ত করে।[২৭] Helicobacter pylori, এই রূপান্তরের জন্য অ্যাসিটোঅ্যাসিটেট ট্রান্সফারেজ (EC 2.8.3.5) এনজাইম ব্যবহার করে।[২৮]
পূর্বের ধাপ তথা ২-অক্সোগ্লুটারেট হতে সাকসিনাইল-কোএ তৈরির ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্য দেখা যায়। অধিকাংশ জীবে ইউবিকুইটোস NAD+-নির্ভর ২-অক্সোগ্লুটারেট ডিহাইড্রোজিনেজ ব্যবহৃত হলেও কিছু ব্যাকটেরিয়ায় ফেরিডক্সিন-নির্ভর 2-অক্সোগ্লুটারেট সিন্থেজ (EC 1.2.7.3) ব্যবহৃত হয়।[২৯] স্বভোজী ও মিথেনোট্রফিক ব্যাকটেরিয়া এবং আর্কিয়াসহ অন্যান্য জীব কোষে ২-অক্সোগ্লুটারেট ডিকার্বোক্সিলেজ (EC 4.1.1.71), সাকসিনেট-সেমিঅ্যালডিহাইড ডিহাইড্রোজিনেজ (EC 1.2.1.79) সাকসিনেট সেমিঅ্যালডিহাইডের সাহায্যে ২-অক্সোগ্লুটারেট সাকসিনেটে পরিণত হয়।[৩০]
ক্যান্সারের ক্ষেত্রে উপাদানের বিপাকীয় অসংগতি দেখা যায় যা টিউমারের বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। যে বিপাকীয় উপাদান এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে তাকে অঙ্কোমেটাবোলাইটস হিসেবে অভিহিত করা হয়।[৩১] ২-হাইড্রোক্সিগ্লুটারেট তার মধ্যে অন্যতম যা আইসোসাইট্রেট ডিহাইড্রোজিনেজ (IDH) এনজাইমে হেটেরোজাইগাস গেইন-অফ-ফাংশন মিউটেশনের মাধ্যমে উৎপন্ন। IDH এনজাইম সাধারণত আইসোসাইট্রেটকে অক্সালোসাকসিনেটে পরিণত করে, যা ডিকার্বোক্সিলেশনের মাধ্যমে আলফা-কিটোগ্লুটারেট তৈরি করে। এই ক্ষেত্রে আলফা-কিটোগ্লুটারেট তৈরির পর NADPH দ্বারা বিজারিত হয়ে ২-হাইড্রোক্সিগ্লুটারেট তৈরি করে। এ কারণে IDH কে অঙ্কোজিন মনে করা হয়। সাধারণত ২-হাইড্রোক্সিগ্লুটারেট একটি গৌণ উৎপাদ যা হাইড্রোক্সিগ্লুটারেট ডিহাইড্রোজিনেজের (L2HGDH ও D2HGDH) সাহায্যে আলফা-কিটোগ্লুটারেটে পরিণত হয়।[৩২] পরীক্ষণে দেখা যায় ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ২-হাইড্রোক্সিগ্লুটারেট মূলত প্রান্তীয় বিপাকীয় উপাদান, কেননা এটি রূপান্তরের মাত্রা পরিমাপযোগ্য নয়।[৩৩] এটি কিছু সংখ্যক এনজাইমের কার্যক্ষেত্রে বাধা হতে পারে যেগুলো আলফা-কিটোগ্লুটারেটের বিক্রিয়াসমূহ সংঘটিত করে। এই পরিব্যক্তি কোষের বিপাকে বিভিন্ন পরিবর্তন আনে। যেমন, একটি অতিরিক্ত NAD-নির্ভর বিজারণের কারণে কোষে NAD অণুর ঘাটতি তৈরি হতে পারে যা কোষে উপস্থিত আলফা-কিটোগ্লুটারেটের পরিমাণ কমাতে পারে। মূলত NADPH এর ঘাটতি সমস্যা তৈরি করে কারণ এটি অঙ্গানুসমূহের মধ্যে মুক্তভাবে ব্যাপিত হতে পারে না। এটি প্রধানত সাইটোপ্লাজমে পেন্টোজ ফসফেট গতিপথে তৈরি হয়। NADPH এর ঘাটতি কোষাভ্যন্তরে অক্সিডেটিভ টান বাড়ায় যার কারণে ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। জেনেটিক ও এপিজেনেটিক পর্যায়েও হিস্টোন লাইসিন ডিমিথাইলেজ (KDMs) ও টেন-ইলেভেন ট্রান্সলোকেশন (TET) এনজাইমের কার্যক্রমে পরিবর্তন দেখা যায়। সাধারণত TET এনজাইমসমূহ ডিমিথাইলেশনের জন্য ৫-মিথাইলসাইটোসাইনসকে হাইড্রোক্সিলেট করে। কিন্তু আলফা-কিটোগ্লুটারেটের অনুপস্থিতিতে এটি ঘটতে পারে না, ফলে কোষের ডিএনএর হাইপারমিথাইলেশন ঘটে, এবং কোষীয় পৃথকীকরণকে বাধাগ্রস্ত করে।
KDM এনজাইমের জুমনজি সি গোত্রে অনুরূপ ঘটনা দেখা যায় যেখানে অ্যামিনোমিথাইল মূলকে ডিমিথাইলেশনের জন্য হাইড্রোক্সিলেশন প্রয়োজন।[৩৪]
সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে বিক্রিয়ক ও উৎপাদের পরিমাণ দ্বারা নির্ধারিত। চক্রটি অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলমান থাকলে বৃহৎ পরিমাণ বিপাকীয় শক্তি অধিক পরিমাণে উৎপাদিত হয়ে অপচয় হতো। চক্রের অন্যতম প্রধান উপকরণ ADP যা ATP তে রূপান্তরিত হয়। কম পরিমাণ ADP NADH সঞ্চিত করে যা এনজাইমের কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত করতে পারে। সাকসিনেট ডিহাইড্রোজিনেজ ব্যতীত সকল ডিহাইড্রোজিনেজ এনজাইমের ক্রিয়ায় উৎপন্ন NADH পাইরুভেট ডিহাইড্রোজিনেজ, আইসোসাইট্রেট ডিহাইড্রোজিনেজ, আলফা-কিটোগ্লুটারেট ডিহাইড্রোজিনেজ এবং সাইট্রেট সিন্থেজ এনজাইমকে বাধা দেয়। অ্যাসিটাইল-কোএ পাইরুভেট ডিহাইড্রোজিনেজকে বাধা দেয়, যেখানে সাকসিনাইল-কোএ আলফা-কিটোগ্লুটারেট ডিহাইড্রোজিনেজ ও সাইট্রেট সিন্থেজকে বাধা দেয়।[১৬]
ক্যালসিয়ামও সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। কোষীয় সক্রিয়করণের সময় মাইটোকন্ড্রীয় মাতৃকায় ক্যালসিয়ামের মাত্রা দশ মাইক্রোমোলার পর্যন্ত হতে পারে।[৩৫] এটি পাইরুভেট ডিহাইড্রোজিনেজ ফসফেটেজকে সক্রিয় করে যা পরবর্তীতে পাইরুভেট ডিহাইড্রোজিনেজ কমপ্লেক্সকে সক্রিয় করে। তাছাড়া ক্যালসিয়াম আইসোসাইট্রেট ডিহাইড্রোজিনেজ ও আলফা-কিটোগ্লুটারেট ডিহাইড্রোজিনেজকেও সক্রিয় করে। ফলে বিভিন্ন ধাপে বিক্রিয়ার হার বৃদ্ধি পায় ও প্রাপ্তির পরিমাণ বেড়ে যায়।[৩৬]
গবেষণায় সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের মধ্যবর্তী উৎপাদ ও হাইপোক্সিয়া ইনডিউসিবল ফ্যাক্টর (HIF) এর নিয়ন্ত্রণের যোগসূত্র পাওয়া গেছে। HIF দেহে অক্সিজেনের সুস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অবদান রাখে এবং অ্যানজিওজেনেসিস, ভ্রূণের ভাস্কুলার রিমডেলিং, গ্লুকোজ ব্যবহার, লৌহ স্থানান্তর ও কোষপতনের মতো কাজে ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টরের ভূমিকা রাখে। HIF ক্রমাগত সংশ্লেষিত হতে থাকে, এবং দুটির অন্তত একটি প্রোলিন অবশিষ্টাংশের হাইড্রোক্সিলেশন ও ভন হিপেল লিন্ডাউ ই৩ ইউবিকুইটিন লাইগেজ কমপ্লেক্সের মধ্যে মধ্যস্ততা করে, যা তাদের দ্রুত ক্ষয়ের জন্য চিহ্নিত করে। এই বিক্রিয়াটি প্রোলাইল ৪-হাইড্রোক্সিলেজ কর্তৃক প্রভাবিত। ফিউমারেট ও সাকসিনেট হলো প্রোলাইল হাইড্রোক্সিলেজের বাধাদানকারী, যা HIF এর স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।[৩৭]
বিভিন্ন বিশ্লেষণ (ক্যাটাবলিক) গতিপথ সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রে মিলিত হয়। অধিকাংশ বিক্রিয়া চক্রে মধ্যবর্তী উৎপাদ যোগ করে, ফলে এদের বলা হয় অ্যানাপ্লেরোটিক বিক্রিয়া, যার গ্রিক অর্থ হলো 'পূর্ণ করা'। এগুলো চক্রে অ্যাসিটাইল-কোএ এর ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও মাইটোকন্ড্রিয়নের শ্বসনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। যে প্রক্রিয়া চক্রের মধ্যবর্তী উৎপাদ সরিয়ে দেয় তাকে ক্যাটাপ্লেরোটিক বিক্রিয়া বলে।[৩৮]
গ্লাইকোলাইসিসে উৎপন্ন পাইরুভেট অণু সক্রিয়ভাবে মাইটোকন্ড্রিয়নের অন্তস্থ আবরণীতে ও পরবর্তীতে মাতৃকায় স্থানান্তরিত হয়। এখানে এটি জারিত হয়ে CO2, অ্যাসিটাইল-কোএ ও NADH উৎপন্ন করে।[৩৯]
কিন্তু এটি সম্ভব যে পাইরুভেট কার্বোক্সিলেজ এনজাইমের সাহায্যে কার্বন সংযুক্ত হয়ে অক্সালোঅ্যাসিটেটে পরিণত হয়। এতে চক্রে অক্সালোঅ্যাসিটেট বৃদ্ধি পায় ও টিস্যুর (যেমন পেশি) শক্তির প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি অনুসারে চক্রের বিপাকীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।[৪০]
সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের প্রতি ঘূর্ণনে প্রতিটি মধ্যবর্তী উৎপাদ (সাইট্রেট, আইসোসাইট্রেট, আলফা-কিটোগ্লুটারেট, সাকসিনেট, ফিউমারেট, ম্যালেট ও অক্সালোঅ্যাসিটেট) পুনরুৎপাদিত হয়। এগুলোর পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে অতিরিক্ত পরিমাণ চক্রে থেকে যায় এবং রূপান্তরের মাধ্যমে অন্য উৎপাদও বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ কোনো একটি উপাদান যোগ করলে অ্যানাপ্লেরোটিক প্রভাব ও সরিয়ে ফেলা হলে ক্যাটাপ্লেরোটিক প্রভাব রাখবে, যা যথাক্রমে অক্সালোঅ্যাসিটেটের পরিমাণ বাড়াবে অথবা কমাবে। ফলে মাইটোকন্ড্রিয়ার দ্বারা ATP উৎপাদনের হার এবং কোষে ATP এর উপস্থিতি প্রভাবিত হয়।[৪০]
অন্যদিকে পাইরুভেটের জারণ বা ফ্যাটি অ্যাসিডের বিটা-জারণ থেকে উৎপন্ন অ্যাসিটাইল-কোএ সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রে একমাত্র জ্বালানি হিসেবে প্রবেশ করে। প্রতি চক্রে এক অণু অ্যাসিটাইল-কোএ মাইটোকন্ড্রীয় মাতৃকায় উপস্থিত এক অণুঅক্সালোঅ্যাসিটেট গ্রহণ করে, কিন্তু অ্যাসিটাইল-কোএ কখনোই পুনরুৎপাদিত হয় না। অ্যাসিটেট অংশের জারণের মাধ্যমে CO2 ও পানি তৈরি হয় এবং ATP আকারে শক্তি নির্গত হয়।[৪০] বিটা-জারণের তিনটি ধাপ সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের সাকসিনেট থেকে অক্সালোঅ্যাসিটেট তৈরির ধাপগুলোর অনুরূপ। অ্যাসাইল-কোএ জারিত হয়ে ট্রান্স-ইনোয়িল-কোএ তৈরি করে ও FAD বিজারিত হয়ে FADH2 উৎপন্ন করে, যা সাকসিনেটের জারণের মাধ্যমে ফিউমারেট তৈরির অনুরূপ। একইভাবে ট্রান্স-ইনোয়িল-কোএ অণুতে পানি সংযোজিত হয়ে বিটা-হাইড্রোক্সিঅ্যাসাইল-কোএ তৈরি করে যেভাবে ফিউমারেট থেকে ম্যালেট উৎপন্ন হয়। শেষে ম্যালেট থেকে অক্সালোঅ্যাসিটেট ও NADH তৈরির ন্যায় বিটা-হাইড্রোক্সিঅ্যাসাইল-কোএ জারিত হয়ে বিটা-কিটোঅ্যাসাইল-কোএ ও NAD+ বিজারিত হয়ে NADH তৈরি হয়।[৪১]
যকৃতে সাইটোপ্লাজমীয় পাইরুভেট কার্বন সংযোজনের মাধ্যমে অন্তঃমাইটোকন্ড্রীয় অক্সালোঅ্যাসিটেট তৈরি হলো গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ার প্রথম দিকের একটি ধাপ, যেখানে রক্তে অধিক মাত্রায় গ্লুকাগন এবং/অথবা অ্যাড্রেনালিন হরমোনের উপস্থিতিতে ল্যাকটেট ও অ্যামিনমুক্ত অ্যালানিন হতে গ্লুকোজ উৎপন্ন হয়।[৩৯][৪০] এখানে মাইটোকন্ড্রিয়নে অক্সালোঅ্যাসিটেট বৃদ্ধির ফলে অ্যানাপ্লেরোটিক প্রভাব দেখা যায় না, কারণ সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের অন্য একটি মধ্যবর্তী উৎপাদ (ম্যালেট) তাৎক্ষণিকভাবে মাইটোকন্ড্রিয়ন থেকে বেরিয়ে গিয়ে সাইটোপ্লাজমীয় অক্সালোঅ্যাসিটেটে পরিণত হয়, যা প্রায় গ্লাইকোলাইসিসের বিপরীত প্রক্রিয়ায় পরবর্তীতে গ্লুকোজে পরিণত হয়।[৪০]
প্রোটিনের বিশ্লেষণে প্রোটিন অণু প্রোটিয়েজ এনজাইম দ্বারা ভেঙে বিভিন্ন অ্যামিনো অ্যাসিডে পরিণত হয়। সেগুলোর কার্বন কঙ্কাল (অণু থেকে অ্যামিনোমূলক পৃথকীকৃত) মধ্যবর্তী উৎপাদ (গ্লুটামেট অথবা গ্লুটামিন থেকে উৎপন্ন আলফা-কিটোগ্লুটারেট) হিসেবে সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রে প্রবেশ করে চক্রে অ্যানাপ্লেরোটিক প্রভাব ফেলে, অথবা লিউসিন, আইসোলিউসিন, লাইসিন, ফিনাইলঅ্যালানিন, ট্রিপ্টোফ্যান, ও টাইরোসিনের ক্ষেত্রে তারা অ্যাসিটাইল-কোএ তে রূপান্তরিত হয় যা থেকে দহন প্রক্রিয়ায় CO2 ও পানি উৎপন্ন হতে পারে, অথবা দহনযোগ্য কিটোন বডিতে পরিণত হতে পারে, অথবা মূত্র বা নিশ্বাসের সাথে অপসারিত হতে পারে।[৪০] তাই এই অ্যামিনো অ্যাসিডগুলোকে "কিটোজেনিক" অ্যামিনো অ্যাসিড বলা হয়, যেখানে যেগুলো সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রে প্রবেশ করে সেগুলো ম্যালেটের মাধ্যমে গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়া সংঘটিত করণার্থে চক্র থেকে অপসারিত হয়। এদেরকে তথাকথিত "গ্লুকোজেনিক" অ্যামিনো অ্যাসিড বলা হয়। অ্যামিনমুক্ত অ্যালানিন, সিসটিন, গ্লাইসিন, সিরিন ও থ্রিয়োনিন পাইরুভেট রূপান্তরিত হয়ে অক্সালোঅ্যাসিটেট রূপে অথবা অ্যাসিটাইল-কোএ রূপে চক্রে প্রবেশ করে।[৪০]
চর্বি, ট্রাইগ্লিসারাইড ইত্যাদি আর্দ্রবিশ্লেষিত হয়ে ফ্যাটি অ্যাসিড ও গ্লিসারলে বিভক্ত হয়। যকৃতে গ্লিসারল গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ায় ডাইহাইড্রোক্সিঅ্যাসিটোন ফসফেট ও গ্লিসার্যালডিহাইড-৩-ফসফেটের মাধ্যমে গ্লুকোজে পরিণত হতে পারে। কঙ্কাল পেশিতে গ্লিসারল, গ্লিসারল-৩-ফসফেট এবং পরবর্তীতে ডাইহাইড্রোক্সিঅ্যাসিটোন ফসফেট ও গ্লিসার্যালডিহাইড-৩-ফসফেটে রূপান্তরিত হয়ে গ্লাইকোলাইসিসে প্রবেশ করে।[৪২]
বিভিন্ন টিস্যুতে, বিশেষ করে হৃৎপেশি ও কঙ্কাল পেশিতে, ফ্যাটি অ্যাসিডের ভাঙন বিটা-জারণের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, যা মাইটোকন্ড্রীয়অ্যাসিটাইল-কোএ, অণুতে রূপান্তরিত হয় যা সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রে প্রবেশ করে। বিজোড় সংখ্যক কার্বনবিশিষ্ট ফ্যাটি অ্যাসিডের বিটা-জারণে প্রোপিয়োনিল-কোএ উৎপন্ন হয়, যা সাকসিনাইল-কোএ তে পরিণত হয়ে ক্রেবস চক্রে প্রবেশ করে।[৪৩]
প্রকৃতকোষী জীবে এক অণু গ্লুকোজের সম্পূর্ণ জারণে বিমুক্ত ৩০ অণু ATP তৈরি হয়। ছয় কার্বনবিশিষ্ট ফ্যাটি আসিডের বিটা-জারণের ফলে ৮ অণু ATP এর সমতুল্য শক্তি প্রদানকারী উৎপাদ ও ৩ অণু অ্যাসিটাইল-কোএ পাওয়া যায়। ফলে সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের পর মোট ATP দাঁড়ায় ৩৮টি।[৪৪]
সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের কিছু মধ্যবর্তী উৎপাদ গুরুত্বপূর্ণ যৌগ সংশ্লেষণে ব্যবহৃত হয়, যার উল্লেখযোগ্য ক্যাটাপ্লেরোটিক প্রভাব চক্রে লক্ষ করা যায়।[৪০] অ্যাসিটাইল-কোএ মাইটোকন্ড্রিয়নের বাইরে স্থানান্তরিত হতে পারে না। সাইটোপ্লাজমীয় অ্যাসিটাইল-কোএ পেতে হলে, সাইট্রেটকে চক্র থেকে বের করে আবরণী ভেদ করে সাইটোপ্লাজমে আনতে হয়। তারপর এটি ATP সাইট্রেট লাইয়েজ এনজাইম্বে সাহায্যে অ্যাসিটাইল-কোএ ও অক্সালোঅ্যাসিটেটে রূপান্তরিত হয়। অক্সালোঅ্যাসিটেট ম্যালেটরূপে মাইটোকন্ড্রিয়নে ফিরে যায় (তারপর আরো অ্যাসিটাইল-কোএ স্থানান্তরের জন্য পুনরায়অক্সালোঅ্যাসিটেটে পরিণত হয়)।[৪৫] সাইটোপ্লাজমীয় অ্যাসিটাইল-কোএ ফ্যাটি অ্যাসিড সংশ্লেষণ ও কোলেস্টেরল তৈরিতে ভূমিকা রাখে। কোলেস্টেরল স্টেরয়েড হরমোন, পিত্ত লবণ ও ভিটামিন ডি সংশ্লেষণে ভূমিকা রাখে।[৩৯][৪০]
কোষে তৈরি হয় এমন অ্যামিনো অ্যাসিডের কার্বন কঙ্কাল তথা আলফা কিটো-অ্যাসিফ সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের উৎপাদসমূহ থেকে তৈরি হয়। তাদেরকে অ্যামিনো অ্যাসিডে পরিণত করতে ট্রান্স-অ্যামিনেশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে গ্লুটামেট হতে অ্যামিনোমূলক আহরণ করা হয়, যেখানে পাইরিডক্সিন কো-ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। এই বিক্রিয়ায় গ্লুটামেট সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের উৎপাদ আলফা-কিটোগ্লুটারেটে পরিণত হয়। অ্যামিনো অ্যাসিড সংশ্লেষণের জন্য অক্সালোঅ্যাসিটেট কার্বন কঙ্কাল প্রদান করে যা অ্যাস্পার্টেড এবং অ্যাসপ্যারাজিন তৈরি করে। পাশাপাশি আলফা-কিটোগ্লুটারেট গ্লুটামিন, প্রোলিন ও অ্যারজিনিন উৎপাদন করে।[৩৯][৪০]
অ্যাস্পার্টেড ও গ্লুটামিন কার্বন ও নাইট্রোজেন পরমাণুর সাথে মিলে পিউরিন গঠন করে যা ডিএনএ ও আরএনএ এবং ATP, AMP, GTP, NAD, FAD ও CoA এর নাইট্রোজেন ক্ষারক।[৪০]
পাইরিমিডিন অণু আংশিকভাবে অ্যাস্পার্টেড থেকে গঠিত। পাইরিমিডিন থাইমিন, সাইটোসিন ও ইউরাসিল যা ডিএনএ ও আরএনএ অণুতে পিউরিন ক্ষারকের পরিপূরক ক্ষারক হিসেবে এবং CTP, UMP, UDP and UTP গঠনের উপাদান হিসেবে থাকে।[৪০]
পোরফাইরিনের অধিকাংশ কার্বন পরমাণু সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের উৎপাদ সাকসিনাইল-কোএ থেকে আসে। এই অণুগুলো হিমোপ্রোটিনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেমন হিমোগ্লোবিন, মায়োগ্লোবিন ও বিভিন্ন সাইটোক্রোম গঠন করে।[৪০]
গ্লুকোনিওজেনেসিসে মাইটোকন্ড্রীয় অক্সালোঅ্যাসিটেট বিজারিত হয়ে ম্যালেট গঠন করে যা মাইটোকন্ড্রিয়নের বাইরে সাইটোপ্লাজমে পুনরায় অক্সালোঅ্যাসিটেটে পরিণত হয়। এ অণু থেকে কার্বোক্সিকাইনেজ এনজাইমের সহায়তায় কার্বন অপসারিত হয়ে ফসফোইনলপাইরুভেটে পরিণত হয়, যা যকৃত ও বৃক্কে সংঘটিত গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ার পূর্বসুরীদের (যেমন গ্লুকোজেনিক অ্যামিনো অ্যাসিড ও ল্যাকটেট) রূপান্তরের হার নির্ধারক ধাপ।[৩৯][৪০]
ল্যাকটেট আয়নের বিপাকীয় ভূমিকা টিস্যুর জ্বালানি, মাইটোকন্ড্রিয়াল সাইটোপ্যাথি ও অঙ্কোলজির বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। সাধারণ কোরি চক্রে পেশিকোষ ল্যাকটেট তৈরি করে যা যকৃতে গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। ধারণা করা হয় এই চক্রে ল্যাকটেট কার্বনের উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে।[৪৬]
ধারণা করা হয় যে সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের উপাদানসমূহ অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়া হতে উৎপন্ন এবং চক্রটি একাধিকবার পরিবর্তিত হয়েছে।[৪৭] তাত্ত্বিকভাবে চক্রটির বিভিন্ন বিকল্প থাকলেও এটিই সবচেয়ে কার্যকর হিসেবে গণ্য করা হয়। যদি চক্রটির বিভিন্ন বিকল্প থাকেও, তা হয়তো এই চক্রের সাথেই মিলে গেছে।[৪৮][৪৯]
|name-list-style=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
this process is outlined graphically in page 73