সাকুরাজিমা | |
---|---|
সর্বোচ্চ বিন্দু | |
উচ্চতা | ১,১১৭ মিটার (৩,৬৬৫ ফুট) |
তালিকাভুক্তি | |
মাপ | |
আয়তন | ৭৭ কিমি২ (৩০ মা২) |
ভূগোল | |
কাগোশিমা প্রশাসনিক অঞ্চল, জাপান | |
ভূতত্ত্ব | |
পর্বতের ধরন | মিশ্র আগ্নেয়গিরি |
সর্বশেষ অগ্ন্যুত্পাত | ১৯৫৫ থেকে বর্তমান |
সাকুরাজিমা (জাপানি: 桜島, আক্ষরিক "চেরি দ্বীপ") হল জাপানের কিউশু দ্বীপের কাগোশিমা প্রশাসনিক অঞ্চলের একটি সক্রিয় মিশ্র আগ্নেয়গিরি এবং ভূতপূর্ব দ্বীপ।[১] ১৯১৪ খ্রিঃ অগ্ন্যুৎপাতের ফলে নিঃসৃত লাভা দ্বারা ভূতপূর্ব দ্বীপটি ওসুমি উপদ্বীপের সাথে সংযুক্ত হয়ে যায়।[২]
বর্তমানেও সাকুরাজিমার আগ্নেয় সক্রিয়তা অব্যাহত আছে এবং এর ফলে সংলগ্ন এলাকাসমূহ নিয়মিত আগ্নেয় ছাইয়ের আস্তরণে আবৃত হয়। পূর্ববর্তী অগ্ন্যুৎপাতসমূহের ফলে অঞ্চলটিতে সাদা বালির একটি উচ্চভূমি গঠিত হয়েছে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের হালনাগাদ অনুযায়ী জাপান আবহবিদ্যা নিয়োগ আগ্নেয়গিরিটির সম্পর্কে তৃতীয় পর্যায়ের (কমলা) সতর্কবার্তা জারি রেখেছে। এর অর্থ অঞ্চলটি একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি এবং এর কাছে যাওয়া বিপজ্জনক।[৩]
সাকুরাজিমা একটি স্তরীভূত পর্বত। এর চূড়ার সংখ্যা তিনটি: কিতাদাকে (উত্তর-চূড়া), নাকাদাকে (মধ্য চূড়া) ও মিনামিদাকে (দক্ষিণ চূড়া)। দক্ষিণ চূড়াটিই বর্তমানে সক্রিয়।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,১১৭ মি (৩,৬৬৫ ফু) উঁচু কিতাদাকে হল সাকুরাজিমার সর্বোচ্চ চূড়া। কাগোশিমা উপসাগরের কিংকো-ওয়ান নামক একটি জায়গায় আগ্নেয়গিরিটি অবস্থিত। ভূতপূর্ব দ্বীপটি কাগোশিমা নগরের অংশ।[৪] বর্তমান আগ্নেয় উপদ্বীপটির ক্ষেত্রফল প্রায় ৭৭ কিমি২ (৩০ মা২)।
সাকুরাজিমার অবস্থান আইরা ক্যালডেরার মধ্যে। ২২,০০০ বছর আগে একটি মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে আইরা ক্যালডেরার সৃষ্টি হয়।[৫] শত শত ঘন কিলোমিটার আয়তনের আগ্নেয় ছাই ও ঝামা পাথর উৎক্ষিপ্ত হওয়ার ফলে সৃষ্ট অত্যধিক চাপে নিম্নস্থ ম্যাগমা প্রকোষ্ঠ ধ্বংস হয়ে যায়। আজ ক্যালডেরাটির ব্যাস ২০ কিমি (১২ মা)। এর উৎপত্তির সময় আগ্নেয়গিরি থেকে ১,০০০ কিমি (৬২০ মা) দূর পর্যন্তও উৎক্ষিপ্ত পদার্থ বা টেফ্রা ছিটকে গিয়েছিল। আজকের সাকুরাজিমা এই আইরা ক্যালডেরা আগ্নেয়গিরিরই একটি সক্রিয় জ্বালামুখ।
ক্যালডেরার মধ্যে ১৩,০০০ বছর আগে থেকে শুরু হওয়া ভূ-আলোড়নের ফলে ক্রমশ সাকুরাজিমা পর্বতের সৃষ্টি হয়।[৬] ক্যালডেরার প্রায় ৮ কিমি (৫ মা) দক্ষিণে এর অবস্থান। নথিভুক্ত ইতিহাসে এর প্রথম অগ্ন্যুৎপাত হয় ৯৬৩ খ্রিঃ[৭] এর অধিকাংশ অগ্ন্যুৎপাতের ধরন স্ট্রম্বোলীয়,[৭] ফলে চূড়ার সংলগ্ন অঞ্চলগুলিই এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে ১৪৭১-১৪৭৬, ১৭৭৯-১৭৮২ এবং ১৯১৪ খ্রিঃ ব্যাপকতর প্লিনীয় অগ্ন্যুৎপাতেরও নজির রয়েছে।[৮]
৪,৯০০ বছর আগে কিতাদাকে-তে অগ্ন্যুৎপাত থেমে যায়: পরবর্তী অগ্ন্যুৎপাতগুলি ঘটেছে মিনামিদাকে-তে।[৯] ২০০৬ এর পর থেকে মিনামিদাকে-র পূর্বদিকে শোয়া জ্বালামুখে বেশি সক্রিয়তা দেখা গেছে।[১০]
তারিখ | জানুয়ারি ১৯১৪ |
---|---|
ধরণ | পেলীয় |
VEI | ৪ |
প্রভাব | অগ্ন্যুৎপাত ভূমিকম্পের ফলে অন্তত ৩৫ জন মারা যান; স্থানীয় জনবসতির স্থানান্তর এবং ভূ-প্রকৃতিগত পরিবর্তন সাধিত হয়। |
বিংশ শতাব্দীর জাপানে ১৯১৪ খ্রিঃ সাকুরাজিমা অগ্ন্যুৎপাত ছিল ব্যাপকতম। লাভা প্রবাহ মূল ভূখণ্ড ও সাকুরাজিমা দ্বীপের মধ্যে জমে উঠে একটি সংযোজক সৃষ্টি করে এবং দ্বীপটিকে উপদ্বীপে পরিণত করে। ১৯১৪ এর আগে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আগ্নেয়গিরিটি সুপ্ত ছিল।[৫] ১১ই জানুয়ারি অগ্ন্যুৎপাত আরম্ভ হয়। এর আগের কয়েক দিন ধরে ছোটবড় অনেকগুলি [[ভূমিকম্প|ভূমিকম্পের মাধ্যমে প্রায় সমস্ত স্থানীয় বাসিন্দা আসন্ন অগ্ন্যুৎপাতের আভাস পেয়ে দ্বীপ ছেড়ে গিয়েছিলেন। প্রাথমিকভাবে অগ্ন্যুৎপাতটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে শুরু হয় এবং একটি বিস্ফোরণ স্তম্ভ ও শক্তিশালী পাইরোক্লাস্টিক স্রোত উৎপন্ন করে। কিন্তু ১৩ই জানুয়ারি ৩৫ জনের প্রাণঘাতী একটি ভূমিকম্পের পর বিস্ফোরক প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়ে লাভার স্রোত বইতে শুরু করে।[৫] জাপানে লাভাস্রোত সচরাচর দেখা যায় না; স্থানীয় ম্যাগমায় সিলিকার উচ্চ অনুপাত থেকে বোঝা যায় বিস্ফোরণঘটিত অগ্ন্যুৎপাত সেখানে অপেক্ষাকৃত বেশি।[১১] কিন্তু সাকুরাজিমার লাভাস্রোত কয়েক মাস ধরে অব্যাহত ছিল।[৫]
এই অগ্ন্যুৎপাতের ফলে দ্বীপটির আয়তন বাড়তে বাড়তে অবশেষে একটি সংযোজক উৎপন্ন করে মূল ভূখণ্ডের সাথে জুড়ে যায়। কাগোশিমা উপসাগরের অংশবিশেষের গভীরতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়, এবং এর ফলে জোয়ারের সময় সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা বেড়ে যায়।[৫]
অগ্ন্যুৎপাতের শেষ পর্যায়ে আইরা ক্যালডেরার নিম্নস্থ ম্যাগমা গহ্বর থেকে ক্রমাগত লাভা ও অন্যান্য পদার্থ উদ্গীরণের ফলে ক্যালডেরাটি প্রায় ৬০ সেমি (২৪ ইঞ্চি) বসে যায়।[৫] যেহেতু এই অবনমনের স্থান সাকুরাজিমার ঠিক নিচে না হয়ে আইরা ক্যালডেরায় অবস্থিত, তাই বোঝা যায় সাকুরাজিমার ম্যাগমা ঐ প্রাচীন ক্যালডেরার ম্যাগমা প্রকোষ্ঠ থেকেই সরবরাহ হয়।[৫] ১৯১৪ খ্রিঃ মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র রথ অফ দ্য গড্স এই অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা থেকে আংশিকভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এখানে একটি শাপগ্রস্ত পরিবারের দুর্ভাগ্যকে বিপর্যয়টির কারণ হিসেবে দেখানো হয়।
১৯৫৫ খ্রিঃ সাকুরাজিমার সক্রিয়তা প্রকট হয়ে ওঠে, আর তার পর থেকে প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে পর্বতটি অগ্ন্যুদ্গীরণ করে চলেছে। প্রতি বছর সহস্রাধিক ছোট ছোট বিস্ফোরণ হয় এবং চূড়ার উপর কয়েক কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত ছাইয়ের স্তম্ভ ছিটকে ওঠে। ১৯৬০ খ্রিঃ এই সমস্ত বিস্ফোরণের গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য সাকুরাজিমা আগ্নেয় মানমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়।[৭]
সাকুরাজিমার বিস্ফোরণের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, কারণ এর মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে ৬,৮০,০০০ জনসংখ্যাবিশিষ্ট কাগোশিমা নগর। নগর প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত আপৎকালীন পরিস্থিতির মহড়া নেওয়া হয়, এবং পতনশীল আগ্নেয় বর্জ্য থেকে বাসিন্দাদের আত্মরক্ষার সুবিধার্থে অনেকগুলি আশ্রয় নির্মাণ করা হয়েছে।[১২]
সাকুরাজিমা স্থানীয় জনবসতির পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে বিবেচনা করে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ "প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধের আন্তর্জাতিক দশক" কর্মসূচী উপলক্ষে ১৯৯১ খ্রিঃ পর্বতটিকে বিশেষ গবেষণার জন্য দশক আগ্নেয়গিরির তালিকাভুক্ত করে।[১৩]
১০ই মার্চ ২০০৯ এ সাকুরাজিমায় বিস্ফোরণ হয়। উৎক্ষিপ্ত পদার্থ ২ কিমি (১.২ মা) পর্যন্ত উঁচুতে ছিটকে গিয়েছিল। এর এক সপ্তাহ আগে থেকে ছোট ছোট ভূমিকম্পের দরুন বিস্ফোরণটি অপ্রত্যাশিত ছিল না। কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবরও পাওয়া যায়নি।[১৪]
২০১১ থেকে ২০১৩ অবধি সাকুরাজিমা একাধিক বড় মাপের বিস্ফোরণের সাক্ষী থাকে।[১৫] ২০১৩-এর জানুয়ারি মাসে আলোকচিত্রী মার্টিন রীৎশে ম্যাগমা উদ্গীরণের সময় ছাইয়ের মেঘের মধ্যে বিদ্যুচ্চমকের একটি বিরল মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করেন। ছবিটি ঐ মাসে নাসার অন্যতম 'অ্যাস্ট্রোনমি পিকচার অফ দ্য ডে' ঘোষিত হয়।[১৬]
১৮ই আগস্ট ২০১৩-এ আগ্নেয়গিরিটি শোওয়া জ্বালামুখ থেকে অগ্ন্যুৎপাত ঘটায় এবং ২০০৫ খ্রিঃ এর পর নথিভুক্ত সর্বোচ্চ মেঘের সৃষ্টি করে। এই মেঘের উচ্চতা ছিল ৫,০০০ মিটার এবং কাগোশিমা নগরের মধ্যভাগে এর ফলে অন্ধকার নেমে আসে ও রীতিমত ছাইয়ের বৃষ্টি হয়। বিস্ফোরণের সময় ছিল বিকেল ৪ টে বেজে ৩১ মিনিট (স্থানীয়) এবং এটি ছিল সাকুরাজিমায় ঐ বছরের ৫০০ তম বিস্ফোরণ।[১৭]
২০১৫-এর আগস্টে জাপানের আবহবিদ্যা নিয়োগ একটি চতুর্থ পর্যায়ের আপৎকালীন সতর্কবার্তা জারি করে ও স্থানীয় বাসিন্দাদের স্থানত্যাগের জন্য তৈরি থাকতে বলে।[১৮] বিজ্ঞানীরা জানান যে কোনো মুহূর্তে বড়সড় বিস্ফোরণের সম্ভাবনা রয়েছে।[১৯]
সাকুরাজিমা কিরিশিমা-য়াকু জাতীয় উদ্যানের অন্তর্গত এবং এর লাভাস্রোত স্থানীয় পর্যটনশিল্পের একটি বিশিষ্ট আকর্ষণ। এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে অনেকগুলো উষ্ণ প্রস্রবণ কেন্দ্রিক রিসর্ট আছে। সাকুরাজিমার অন্যতম প্রধান কৃষিজ পণ্য হল এক রকম বিশালাকার বাস্কেটবল আকারের সাদা মূলো (সাকুরাজিমা দাইকোন)।[২০]
১৯৪৬ এ জাপানি লেখক হারুও উমেজ়াকি 'সাকুরাজিমা' নামে একটি গল্প লেখেন। এর বিষয়বস্তু ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে মার্কিন বিমান হানায় আক্রান্ত জাপানে আগ্নেয় দ্বীপটিতে কর্তব্যরত একজন নৌবাহিনী আধিকারিকের উপলব্ধি। গল্পটি উমেজ়াকি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছিলেন; নিকটবর্তী কাগোশিমা নগরের একটি সামরিক ঘাঁটিতে তাকে নিযুক্ত থাকতে হয়েছিল।
জাপানের আগ্নেয়গিরিসমূহের তালিকা