সাগু সাইকাস জাপানি সাগু পাম | |
---|---|
![]() | |
পাতা ও পুং কোণ | |
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস ![]() | |
জগৎ/রাজ্য: | প্লান্টি (Plante) |
গোষ্ঠী: | ট্র্যাকিওফাইট (Tracheophytes) |
বিভাগ: | Cycadophyta |
শ্রেণি: | Cycadopsida |
বর্গ: | Cycadales |
পরিবার: | Cycadaceae |
গণ: | Cycas থুনবার্গ |
প্রজাতি: | C. revoluta |
দ্বিপদী নাম | |
Cycas revoluta থুনবার্গ |
সাগু সাইকাস, জাপানি সাগু পাম বা রাজ সাগু (বৈজ্ঞানিক নাম: Cycas revoluta; জাপানি: ソテツ, অনুবাদ 'সোতেৎসু') সাইকাডাসি গোত্রের একটি নগ্নবীজী উদ্ভিদ প্রজাতি। রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জসহ দক্ষিণ জাপানের এটি স্থানীয় প্রজাতি। সাগু উৎপাদন ও গৃহসজ্জার কাজে এই উদ্ভিদ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ থেকে বর্ণিত পাঁচটি নগ্নবীজী উদ্ভিদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না হলেও বাগানে আলঙ্কারিক উদ্ভিদ হিসেবে এটি বেশ জনপ্রিয়।[২]
প্রকৃত পাম গাছের (আরেকাসিয়া) সাথে সাইকাসের একমাত্র সাদৃশ্য হলো এরা উভয়ই সবীজী। সাগু সাইকাস উদ্ভিদের প্রজাতিক নাম revoluta (রেভোলুটা; অর্থ "পেছনে কুঞ্চিত") একটি ল্যাটিন শব্দ,[৩] যা এর পাতার প্রতি নির্দেশ করে। উর্দুভাষী এলাকায় উদ্ভিদটি কাঙ্গি (চিরুনি) পাম নামেও পরিচিত।[৪] ১৮শ শতাব্দীর শেষ দিকে এই প্রজাতি বর্ণিত হয়।
অত্যন্ত প্রতিসম সাগু সাইকাস উদ্ভিদের ২০ সেমি (৭.৯ ইঞ্চি) মতো ব্যাসবিশিষ্ট অমসৃণ কাণ্ডের ওপর চকচকে, গাঢ় সবুজ রঙের পাতার মুকুট থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় উদ্ভিদটির কাণ্ড মাটির নিচের দিকে খুব একটা বাড়ে না, কিন্তু সময়ের সাথে মাটির ওপরে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। অত্যন্ত পরিণত অবস্থায় কাণ্ড ৬–৭ মিটার (২০ ফুটের বেশি) পর্যন্ত হতে পারে, যদিও সাগু সাইকাসের বৃদ্ধি অত্যন্ত ধীরগতিসম্পন্ন এবং এই পর্যন্ত বাড়তে ৫০–১০০ বছর লেগে যেতে পারে। কাণ্ডে কয়েকবার পর্যন্ত শাখা বিভাজন হয়ে বহুমাথাওয়ালা সাইকাসে পরিণত হতে পারে।[৫]
সাগু সাইকাসের পাতা কিছুটা চকচকে গাঢ় সবুজ রঙের এবং পরিণত অবস্থায় ৫০–১৫০ সেমি (২০–৫৯ ইঞ্চি) লম্বা হয়। এরা প্রায় ১ মি (৩.৩ ফু) ব্যাসবিশিষ্ট পালকের ন্যায় রোজেট আকারে তৈরি হয়। সরু ও ৮–১৮ সেমি (৩.১–৭.১ ইঞ্চি) লম্বা কচি পাতার প্রান্ত কুঞ্চিত হয়ে ঘনসন্নিবেশিত ও শক্ত হয়। গোড়ার দিকের কচিপাতাগুলো অনেকটা কাঁটার মতো হয়। পাতার বোঁটা ৬–১০ সেমি (২.৪–৩.৯ ইঞ্চি) লম্বা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাঁটাযুক্ত।
সাগু সাইকাসের মূলকে বলা হয় কোরালয়েড মূল, যেখানে অ্যানাবিনা প্রভৃতি নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী মিথোজীবী শৈবাল বাস করে।[৬] তবে শৈবালের অন্তঃআক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য শৈবালস্তরের উভয় দিকে ট্যানিন-সমৃদ্ধ কোষ থাকে।
অন্যান্য সাইকাসের মতোই সাগু সাইকাস ডাইওয়িশাস। পুরুষ উদ্ভিদ পরাগ সমৃদ্ধ পুংকোণ বা স্ট্রোবিলাস এবং স্ত্রী উদ্ভিদ একগুচ্ছ মেগাস্পোরোফিল ধারণ করে। প্রাকৃতিকভাবে পতঙ্গ দ্বারা বা কৃত্রিমভাবেও পরাগায়ন ঘটতে পারে।
বীজ বা শাখা-প্রশাখার খণ্ডায়ন দ্বারা সাগু সাইকাসের বংশবৃদ্ধি ঘটে। এটি সবচেয়ে বেশি চাষ হওয়া সাইকাসের মধ্যে অন্যতম। নাতিশীতোষ্ণ ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় উন্মুক্ত জায়গায় এবং শীতপ্রধান অঞ্চলে কাচঘরের ভেতরে সাগু সাইকাস লাগানো হয়ে থাকে। জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ বালুকাময়, পানি নিষ্কাশনের সুবিধাসম্পন্ন মাটিতে সাগু সাইকাস ভালো হয়। পানি নিষ্কাশন ভালো না হলে এর কাণ্ড পচে যায়। সাগু সাইকাস খুব ভালো খরা-সহনীয় প্রজাতি। ঘরের বাইরে কড়া রোদে, কিংবা হালকা ছায়ায় ভালো হয়। ঘরের ভেতরে লাগানোর জন্য উজ্জ্বল আলোর দরকার পড়ে। তারপরেও ঘরের ভেতর থেকে হঠাৎ বাইরে উজ্জ্বল রোদে নেওয়া হলে, পাতা বিবর্ণ হয়ে যেতে পারে।
সবগুলো সাইকাসের মধ্যে সাগু সাইকাস চাষ করা সবচেয়ে জনপ্রিয়। নাতিশীতোষ্ণ থেকে শুরু করে ক্রান্তীয় অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি উদ্ভিদ উদ্যানে সাগু সাইকাস দেখা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক চাষকৃত উদ্ভিদ। সেই সাথে বনসাই হিসেবেও সাগু সাইকাস জনপ্রিয়। এটি মৃদু থেকে হালকা ঠান্ডায় বেঁচে থাকতে পারে, যদি মাটি শুকনো রাখা যায়। −১০ °সে (১৪ °ফা) তাপমাত্রার নিচে শৈত্যজনিত ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে। সাগু সাইকাস উত্তরে মিসৌরির সেন্ট লুইস ও নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত সামান্য যত্নেই শৈত্য সহ্য করে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে। উভয় শহরই যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের ৭বি অঞ্চলে অবস্থিত। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় সাগু সাইকাস শীতকালে পাতা ঝড়িয়ে দেয় এবং বসন্তের সাথে সাথে নতুন পাতা গজায়।
২০১৭ সালে রয়েল হর্টিকালচার সোসাইটি সাগু সাইকাস উদ্ভিদকে অ্যাওয়ার্ড অব গার্ডেন মেরিটে ভূষিত করে।[৭][৮]
সাগু সাইকাসের মজ্জায় ভোজ্য শ্বেতসার থাকে, যা থেকে সাগু উৎপাদন করা হয়। তবে ব্যবহারের পূর্বে খুবই সতর্কতার সাথে মজ্জার বিষাক্ত উপাদানকে ধুয়ে বের করে আনতে হয়। সাইকাসের বিষাক্ততার জন্যই সাগু তৈরিতে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।[৯] পাম গাছ থেকে তৈরি সাগুর মতোই সাইকাসের সাগুও একইভাবে ব্যবহার করা হয়। সাইকাসের কাণ্ড, মূল ও বীজ কেটে মজ্জাকে দানাদার গুঁড়ায় রূপান্তরিত করা হয়। এই গুঁড়াকে পরে বারবার সতর্কতার সাথে ধুয়ে বিষ বের করে আনা হয়। শ্বেতসারপূর্ণ অবশিষ্টাংশকে শুকিয়ে ও জ্বাল দিয়ে পাম গাছের সাবুদানা বা সাগুর মতোই এক ধরনের শ্বেতসার উৎপন্ন হয়। সাইকাসিন নামক বিষ থাকায় সাইকাসের বীজ খাওয়ার অনুপযোগী, এমনকি বারবার খুব ভালোভাবে ধোয়ার পরও বিষ থেকে যেতে পারে। সাইকাসিন বিষের প্রভাবে পেশিকোষের পার্শ্বীয় কাঠিন্য (অ্যামায়োট্রফিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস), পারকিনসন, প্রোস্টেট ক্যান্সার ও ফাইব্রোল্যামেলার হেপাটোসেলুলার কারসিনোমা প্রভৃতি হতে পারে।
অলাকাস্পিস (Aulacaspis yasumatsui) নামক আঁইশাকার এক ধরনের পোকা সাগু সাইকাস থেকে খাবার গ্রহণ করে। এই পোকা দমন করা না গেলে সম্পূর্ণ উদ্ভিদটিকেই ধ্বংস করে দিতে পারে।[১০]
সাগু সাইকাসের পাতার জলীয়-অ্যালকোহলীয় নিষ্কাশন থেকে অ্যালকালয়েড, স্টেরয়েড ও ট্যানিন এবং ক্লোরোফর্ম নিষ্কাশন থেকে স্যাপোনিন, ট্যানিন ও চিনির উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়।[১১] কচি পাতায় বাইফ্ল্যাভোনয়েডও থাকে।[১২] এস্ট্রাগল পুং ও স্ত্রী কোণ থেকে নির্গত প্রধান উদ্বায়ী যৌগ।[১৩]
সাইকাস থেকে নিষ্কাশিত সাগু মানুষসহ প্রাণিদের জন্য অত্যন্ত বিষাক্ত। বিশেষত পোষা প্রাণিরা খাদ্য বিবেচনায় সাইকাস খেয়ে থাকতে পারে।[১৪] সাইকাসের বিষ পেটে যাওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যে বিষের প্রভাব, যেমন বমি, উদরাময়, দুর্বলতা, খিচুনি, যকৃতে বিষক্রিয়াজনিত যকৃতের বৈকল্য, জন্ডিস, সিরোসিস বা অন্ত্রের সংকোচন, অ্যাসিটেস ইত্যাদি দেখা যেতে শুরু করে। প্রাণিদেহে নীলাভ দাগ দেখা যায়, নাক থেকে রক্ত পড়তে পারে (অ্যাপিট্যাক্সিস), রক্তপূর্ণ মল হতে পারে (মেলেনা), রক্তাভ শিটা (হেমাটোশেজিয়া) বা সন্ধিতে রক্তক্ষরণ (হেমারথ্রোসিস) হতে পারে।[১৫] প্রাণির প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে মার্কিন সোসাইটির প্রাণি বিষ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সমীক্ষা মতে, সাইকাসের বিষ পেটে গেলে ৫০ থেকে ৭০% ক্ষেত্রে প্রাণির মৃত্যু ঘটে। সাগু সাইকাসের সামান্যতম অংশ পেটে গেলেও ডাক্তার বা বিষ প্রতিষেধক কেন্দ্রে তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করা উচিত। সাইকাসের পেটে গেলেই আভ্যন্তরীণ স্থায়ী রক্তক্ষরণ এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
সাগু সাইকাসের প্রায় সবটুকু অংশই বিষাক্ত; তবে বীজে সাইকাসিন বিষের মাত্রা বেশি। সাইকাসিন পরিপাকগহ্বরে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করে, এমনকি বেশি মাত্রায় সেবনে যকৃৎ বিকল হয়ে যেতে পারে।[১৬] এছাড়া বিটা-মিথাইলঅ্যামিনো এল-অ্যালানিন নামক একটি নিউরোটক্সিক অ্যামিনো অ্যাসিড এবং গবাদি পশুর পশ্চাৎপদের পক্ষাঘাতের জন্য দায়ী আরেকটি অজ্ঞাত বিষ প্রত্যক্ষ করা যায়।[১৭]