সানুসি আন্দোলন হলো একটি ইসলাম ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, যা লিবিয়া এবং সুদানে সংঘটিত হয়েছিল; এটি পশ্চিম আলজেরিয়ার মোস্তাগানেমে ১৮৩৭ সালে শায়খ মুহাম্মদ বিন আলী আস-সানুসি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার পরে ১৮৪৩ সালে এটি লিবিয়ার আল-বায়দা শহরে স্থানান্তরিত হয়।[১][২][৩] এই আন্দোলনটি অন্য ইসলামী সংস্কার আন্দোলনগুলি থেকে আলাদা ছিল; বিশেষ করে এর গভীর ও কার্যকর উপায় এবং লক্ষ্যগুলির ক্ষেত্রে। এটি আস্তে আস্তে উত্তর আফ্রিকা, সুদান ও কেপ ভার্দেসহ অন্যান্য কিছু ইসলামি দেশে ছড়িয়ে পড়ে।[৪]
সানুসি আন্দোলন লিবিয়ায় হিজরি ১৩শ শতাব্দীতে (১৯শ শতকে) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ বিন আলী সানুসি তৎকালীন মুসলমানদের দুর্বলতা ও তাদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক অনগ্রসরতা অনুভব করার পর তিনি এই পুনর্নবীকরণ আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[৪]
- শেখ মুহাম্মদ বিন আলী আল-সানুসি; ১২০২-১২৭৬ হি./১৭৮৭–১৮৫৯ খ্রি., তিনি সানুসি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা এবং সানুসি নামটি তার চতুর্থ পিতামহের নাম থেকে নেওয়া হয়। তিনি বর্তমান আলজেরিয়ার মোস্তাগানেমে জন্মগ্রহণ করেন। জ্ঞান ও ধার্মিকতায় পরিপূর্ণ একটি বাড়িতে তিনি বেড়ে ওঠেন। তারপর যখন তিনি পরিণত বয়সে উপনীত হন, তখন তিনি মরক্কোর আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যান। তারপর তিনি আরব বিশ্ব ভ্রমণ শুরু করেন এবং নিজের জ্ঞান বৃদ্ধি করেন। তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিশর, হিজাজ এবং ইয়েমেন সফর করেন। তারপর তিনি মক্কা ফিরে আসেন। তখন তিনি প্রথম একটি আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীকালে সানুসি আন্দোলন নামে পরিচিত হয়। তিনি প্রায় ৪০ টি গ্রন্থের লেখক, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থও রয়েছে।[৪]
- মুহাম্মদ আল-মাহদি আস-সেনুসি: ১২৬১-১৩১৯ হি./১৮৪৪-১৯০২খ্রি.। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়ে সানুসি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।[৫]
- আহমদ শরীফ আস-সানুসি: তিনি মাহদীর চাচাতো ভাই (জন্ম: ১২৯০ হিজরি/১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ) তিনি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর চাচার কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। উত্তর আফ্রিকায় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক আক্রমণ এবং লিবিয়ায় ইতালীয় আক্রমণের তিনি নেতা ছিলেন। তাই তিনি ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে উসমানি সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন, কিন্তু তাকে সাহায্য করা হয়নি। প্রথমে তিনি মোস্তফা কামালের পক্ষে ছিলেন এ ভেবে যে, তিনি ধর্মের রক্ষক হবেন। যখন তার ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন শেখ আহমেদ ১৯২৩ সালে তুরস্ক ছেড়ে দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ফ্রান্স তখন তাকে বিপজ্জনক মনে করে তাকে তুলে দেওয়ার অনুরোধ করে। তাই তিনি মরুভূমি পার হয়ে আরব উপদ্বীপে পালিয়ে যান।[৬]
- শেখ ওমর আল-মুখতার: ১২৭৫–১৩৫০ হি/১৮৫৬ –১৯৩১ খ্রি.। হলেন সেই লিবীয় মুজাহিদ যার সত্তর বছর বয়স তার ও লিবিয়ার ইতালীয় উপনিবেশের মাঝে বাধা হয়ে দাড়ায়নি। তিনি প্রায় বিশ বছর ধরে কয়েক ডজন বাহিনীর সাথে লড়াই করেন, যা তার চেয়ে বহুগুণ বড় ও সেই যুগের সবচেয়ে বড় অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ইতালি সরকার তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।[৭]
• সানুসি একটি ইসলামি পুনর্নবীকরণ আন্দোলন।
- সানুসি নেতাগণ শেখ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এবং আবু হামিদ আল-গাজালি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
- সানুসিরা ইবাদাতের বিষয়ে কঠোর এবং খাদ্য ও পোশাকের ক্ষেত্রে যুহুদের অনুশীলন করেন।
- সানুসিরা ইজতেহাদ এবং অন্ধ অনুকরণের বিরুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান জানায়। যদিও তারা মালিকি মাজহাবের অনুসারী ছিল। তবে দলিল শক্তিশালী প্রমাণিত হলে তাদের মতে ভিন্ন মত গ্রহণে সমস্যা নেই।
- হেকমত ও উত্তমকথার মাধ্যমে দীনের প্রতি আহ্বান করা এবং হিংসা ও বলপ্রয়োগ এড়ানো।
- প্রত্যহ কায়িক শ্রমের প্রতি মনোযোগ দেওয়া সানুসি আন্দোলনের অন্যতম শিক্ষা। আস-সানুসি সর্বদা বলতেন: "মূল্যবান জিনিস একটি গাছ রোপণ এবং এর পাতায় পাওয়া যায়। তাই লিবীয় মরুদ্যানগুলি কৃষি ও বাণিজ্যে ভরপুর হয়েছিল, যেখানে সানুসি প্রচারকেন্দ্র ছিল।
- "ক্রুসেডার ঔপনিবেশিক ও তাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে আল্লাহর জন্যে স্থায়ী জিহাদ এবং এটি সানুসিদের স্থায়ী স্লোগান। ইতালীয় ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে তাদের জিহাদে হাজার হাজার মানুষ এই স্লোগানের মূল্য দিয়েছে।[৪]
আস সানুসি নিজের বিরোধীদের সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে গিয়েছেন। তিনি সর্বদা কারো সাথে শত্রুতা না দেখিয়ে কুরআন ও সুন্নাহ মতে দ্বিমত পোষণ করতেন।[৪]
- এটি লিবীয় পূর্ব মরুভূমিতে (আল-জাগবুব) ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল,যা মিশরীয় সীমান্তবর্তী উপকূলীয় শহর তাব্রুকের দক্ষিণে অবস্থিত। সানুসি আন্দোলনের কেন্দ্র আল-বায়দা শহর এবং আল-জাগবুব গ্রামে প্রতি বছর শতশত প্রচারককে শিক্ষা দেওয়া হত। তারপর তারা উত্তর আফ্রিকার সমস্ত অংশে ইসলামের প্রচারক পাঠাত।
- সানুসি আন্দোলন লিবিয়ায় প্রথম একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে, যা বায়দা শহরে মুহাম্মদ বিন আলী আল-সানুসির নামে ছিল।
- সানুসি আন্দোলন সমস্ত উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং এর বিস্তৃতি ছিল মিশর থেকে মারাকেশ পর্যন্ত। এটি দক্ষিণে সুদান ও সোমালি মরুভূমি এবং পশ্চিমে আলজেরিয়া পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এছাড়া তা আফ্রিকার বাইরে দূর প্রাচ্যের মালয় দ্বীপপুঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
- সানুসিরা আফ্রিকার পৌত্তলিক উপজাতিদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করতে সক্ষম হয় এবং তাদের জন্যে শিক্ষামূলক স্কুল ও জাউইয়া প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। শিক্ষা শুধুমাত্র পুরুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং উভয় লিঙ্গের নারী ও শিশুদের জন্য প্রসারিত ছিল এবং তারা পৌত্তলিক উপজাতির মহিলাদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের জন্য মহিলাদের ব্যবহার করেছিল।[২]
অনেকে সানুসিদের বিস্তার এবং স্থায়ী না থাকার জন্য তাদের ভিন্নমতের সাথে জড়িত হওয়া ও সশস্ত্র সংগ্রাম এড়িয়ে চলাকে দায়ী করে।[৪]
সানুসি ছিল বিশ্বের অন্যতম ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন এবং আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ইমাম মুহাম্মদ বিন আলী আসসানুসি ১৭৮৭ সালে পশ্চিম আলজেরিয়ার মোস্তাগানেম শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পরে তিনি মরক্কোর ফেজে চলে যান; তারপর হিজাজে চলে যান, যেখানে তিনি এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারপর তিনি সাইরেনাইকা যান এবং সবুজ পাহাড়ে বসবাস করেন এবং জাওয়্যাত আল-বায়দা নির্মাণ করেন। পরে তিনি আল-জাগবুবে চলে যান এবং ১৮৫৯ সালে তিনি মারা না যাওয়া পর্যন্ত সেখানেই বসবাস করেন।
তার নাতি মুহাম্মদ ইদ্রিস আল-সেনুসি প্রায় ১ দশকের অধিক সময় রাজা হিসেবে লিবিয়া শাসন করেন। তবে বর্তমানে, লিবিয়াতে সানুসি আন্দোলনের লক্ষণসমূহ দিন দিন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।[৪]