সামাজিক বিজ্ঞানের ইতিহাসের সূত্রপাত হয় পশ্চিমা দর্শনসহ বিভিন্ন পূর্বসূরী হতে, কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্রত্যক্ষবাদী বিজ্ঞানের দর্শনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি হতে কেবল সমাজবিজ্ঞানই নয় বরং সমাজ ও সংস্কৃতি, নৃবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান থেকে শুরু করে গণমাধ্যম অধ্যয়নের ব্যাখ্যা করে এমন সকল শাখায় "সামাজিক বিজ্ঞান" আরও ব্যাপকভাবে উল্লেখিত হতে থাকে।
পাণ্ডিত্যপূর্ণ রীতিনীতি ও পদ্ধতি অনুসারে সমাজ নিয়ে অধ্যয়ন করা যায় এই ধারণাটি তুলনামূলকভাবে নতুন। মধ্যযুগীয় ইসলামে সমাজবিজ্ঞানের প্রারম্ভিক ধারণার প্রমাণ পাওয়া যায় এবং কনফুসিয়াসের মত দার্শনিকগণ দীর্ঘকাল পূর্ব থেকেই সামাজিক রীতিনীতির মত বিষয়ের তত্ত্ব প্রদান করেছেন। আলোকিত যুগ থেকে শুরু করে আধুনিকতা পর্যন্ত "মানুষ" ধারণাটির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ খুবই অদ্ভুত। সামাজিক বিজ্ঞান সময়ের নৈতিক দর্শন থেকে উদ্ভূত এবং বিপ্লবী যুগ, তথা শিল্প বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লব হতে অনুপ্রাণিত।[১] অষ্টাদশ শতাব্দীতে সামাজিক বিজ্ঞানের সূত্রপাত দিদেরোর মহা বিশ্বকোষে জঁ-জাক রুসোর ও সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যান্য অগ্রদূতদের নিবন্ধ হতে পাওয়া যায়।
প্লেটোর রিপাবলিক রাজনৈতিক দর্শন ও জীবনের প্রভাবশালী গবেষণামূলক আলোচনা গ্রন্থ।
অ্যারিস্টটল সামাজিক সংগঠনের উপর পলিটিক্স ও কনস্টিটিউশন অব দি অ্যাথেনিয়ান্স-সহ কয়েকটি রচনা প্রকাশ করেন।
মধ্যযুগীয় ইসলামি সভ্যতায় সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান পাওয়া যায়। আল বিরুনি (৯৭৩-১০৪৮) মধ্যপ্রাচ্য, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও দক্ষিণ এশিয়ায় মানুষ, ধর্ম ও সংস্কৃতির নৃবিজ্ঞান নিয়ে বিস্তারিত তুলনামূলক গবেষণা রচনা করেছেন।[২] পণ্ডিতবৃন্দ ইসলামি নৃবিজ্ঞানে বিরুনির কাজের প্রশংসা করেন।[৩]
ইবন খালদুন (১৩৩২-১৪০৬) জনসংখ্যা,[৪] ঐতিহাসিক চিত্র,[৫] ইতিহাসের দর্শন,[৬] সমাজবিজ্ঞান[৪][৬] ও অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি মুকাদ্দিমা রচনার জন্য সুপরিচিত।
রেনেসাঁস যুগের কাছাকাছি সময়ে চতুর্দশ শতাব্দীর দিকে বুরিদানুস ও ওরেসমিউস অর্থ নিয়ে গবেষণা করেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ফ্লোরেন্সের সন্ত আতোনিন তুলনামূলক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ে লিখেন। ষোড়শ শতাব্দীতে লিওনার্দ দে লেইস, হুয়ান দে লেগো ও বিশেষ করে লুইস মলিনা অর্থনীতি সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে লিখেন। এইসব লেখকগণ ব্যাখ্যা করেন যে সম্পত্তি জনকল্যাণের নিমিত্তে ব্যবহৃত হয়।[৭]
বিজ্ঞানের এই শাখাটি বর্ণনামূলকই রয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, টমাস হবসের সময়ে তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে স্বতঃসিদ্ধ অবরোহী যুক্তি থেকে বৈজ্ঞানিক কাঠামো তৈরি হয় এবং তার লেভিয়াথান রচনাটি রাজনৈতিক কমনওয়েলথের এক বৈজ্ঞানিক বর্ণনা।
১৮২৪ সালে উইলিয়াম টমসন (১৭৭৫-১৮৩৩) রচিত অ্যান ইনকোয়ারি ইনটু দ্য প্রিন্সিপালস অব দ্য ডিস্ট্রিবিউশন অব ওয়েলথ মোস্ট কনডাক্টিভ টু হিউম্যান হ্যাপিনেস; অ্যাপ্লাইড টু দ্য নিউলি প্রপোজড সিস্টেম অব ভলান্টারি ইকোয়ালিটি অব ওয়েলথ (An Inquiry into the Principles of the Distribution of Wealth Most Conducive to Human Happiness; applied to the Newly Proposed System of Voluntary Equality of Wealth) বইতে প্রথমবারের মত "সামাজিক বিজ্ঞান" ধারণাটি দেখা যায়। অগুস্ত কোঁত (১৭৯৭-১৮৫৭) যুক্তি প্রদর্শন করে যে ধারণা তিনটি উদীয়মান স্তরের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, সেগুলো হল ধর্মতাত্ত্বিক, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক। তিনি এই তিনটি স্তরের পার্থক্য দেখান যে প্রথমটি অনুমাননির্ভর, দ্বিতীয়টি সমালোচনামূলক চিন্তাধারানির্ভর এবং তৃতীয়টি ইতিবাচক পর্যবেক্ষণনির্ভর। কার্ল মার্ক্স প্রথম দিকের লেখকদের একজন যিনি দাবি করেন যে তার গবেষণার পদ্ধতি ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক দিক তুলে ধরে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে মানব আচরণ বিষয়ক উক্তিতে সমীকরণ প্রয়োগের চেষ্টা বহুল ব্যবহৃত হতে থাকে। তন্মধ্যে প্রথম ছিল ভাষাবিজ্ঞানের আইন, যা ভাষায় শব্দের পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ্বে পরিসংখ্যান ফলিত গণিতের উল্লেখযোগ্য শাখা হিসেবে রূপান্তরিত হয়। জীববিজ্ঞানের পরিসাংখ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিসাংখ্যিক পদ্ধতি দৃঢ়তার সাথে ব্যবহৃত হত।
জন ডিউয়ি (১৮৫৯-১৯৫২) দর্শনের বৈজ্ঞানিক মতবাদের অন্যতম সমর্থক। ১৮৮৭ সালে তার রচিত সাইকোলজি বইতে তিনি মার্ক্সের মত হেগেলীয় ভাববাদ ও যুক্তি নিরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের সাথে গ্রন্থিত করেন। তবে তিনি হেগেলীয় মতবাদ পরবর্তীকালে ত্যাগ করে চার্লস স্যান্ডার্স পিয়ার্স ও উইলিয়াম জেমস হতে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি মার্কিন প্রয়োগবাদ আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি এরপর মৌলিক মতবাদ উদ্ভব করেন এবং তার দি ইনফ্লুয়েন্স অব ডারউইন অন ফিলসফি (The Influence of Darwin on Philosophy) প্রবন্ধে (১৯১০) তা সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন।