সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস বা এমআই৬ যুক্তরাজ্যীয় সরকার তথা ব্রিটিশ সরকারের বৈদেশিক গুপ্তচর বিভাগের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা হিসেবে এমআই৫, সরকারী যোগাযোগের প্রধান দপ্তর বা জিসিএইচকিউ, প্রতিরক্ষা সংস্থা বা ডিআইয়ের সাথে একযোগে কাজ করছে। যুক্তরাজ্যের জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স কমিটি বা জিআইসি'র নিয়ন্ত্রণে থেকে নির্দিষ্ট নির্দেশনার মাধ্যমে কাজ করে সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস।
এটা বারংবার এমআই৬ নামে গণমাধ্যমে উল্লেখ হতে থাকে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস নামটি বহুনামে উল্লেখ হয়, তখন এমআইসিক্স নামকরণটি নিশ্চিত হয়ে যায়।[১] ১৯৯৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত এমআই৬ নামটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়নি ও স্বীকৃত ছিল না।[২]
সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস বা এসআইএস বা এমআই৬ বর্তমানে ব্রিটেনের জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে গুপ্তচরের প্রধান ভূমিকা পালনে সক্ষম।
১৯০৯ সালে উইলিয়াম মেলভিল নামক সিক্রেট সার্ভিস ব্যুরো'র একজন কর্মকর্তা সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা।[১] দপ্তরটি নৌ-সেনাবিভাগ এবং যুদ্ধ অফিসের যৌথ উদ্যোগে গ্রেট ব্রিটেন ও বিদেশের মধ্যে গোয়েন্দা অভিযানের দায়িত্ব নিয়োজিত ছিল। এটি বিশেষ করে জার্মান সাম্রাজ্যের কার্যকলাপের উপরই সবিশেষ মনোযোগ দিয়েছিল। ব্যুরো বা দপ্তরটি নৌ এবং সেনা - এই দুই বিভাগে বিভাজন করা হয়েছিল। এগুলো হলোঃ
এই বিভাজনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল নৌসেনাবিভাগ। তারা জার্মান সাম্রাজ্যের নৌবাহিনীর সামরিক শক্তিমত্তা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী ছিল। এই বিশেষায়ণ ১৯৪১ সালের পূর্বেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল। যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, দু'টি শাখাই প্রশাসনিকভাবে রূপান্তরিত হয়ে ডাইরেক্টরেট অব মিলিটারী ইন্টেলিজেন্স সেকশন ৬ (এমআইসিক্স) হয়ে যায়। এ নামই বর্তমানকালে সাধারণ নাম হয়ে এমআই৬ হিসেবে সর্বসাধারণ্যে পরিচিতি পেয়ে আসছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়কালে সংস্থাটির ভূমিকা ছিল মিশ্রতায় পরিপূর্ণ। কারণ, জার্মানিতে তারা তাদের নিজস্ব কোন নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করতে পারেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামরিক বাহিনী কিংবা বাণিজ্যিক গোয়েন্দা সংস্থাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হতো। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ দেশ, দখলকৃত অঙ্গরাজ্য এবং রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।[৩]
১৯২০ এর দশক পর্যন্ত কূটনৈতিক দপ্তরের সাথে নিবিঢ় সম্পর্কের মাধ্যমে সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস গড়ে উঠে। এটি দূতাবাসসমূহে পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তার পদ তৈরী করে। ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ব্রিটিশ আর্মি ইন্টেলিজেন্সের পদ্ধতিগণ উন্নয়নের জন্য এ পদের প্রয়োজন পড়েছিল।[৪] এর ফলে সামগ্রীকভাবে কার্যসম্পাদন করা এবং কূটনৈতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো মজবুত হয়। কিন্তু পুনরায় ১৯৩০ এর দশকে সৃষ্ট ভেনলো ঘটনায় সঙ্কটাপন্ন হয়েছিল।
ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার ভবিষ্যত কাঠামো নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত থাকে। কিন্তু কামিং কর্তৃক বৈদেশিক দপ্তর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এ বিতর্ক অনেকাংশেই দূরীভূত হয়। ঐ সময়ে প্রতিষ্ঠানটি হার মেজিস্ট্রিজ সিভিল সার্ভিস বা হুয়াইটহল থেকে বিভিন্ন নামে পরিচিতি পায়। বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা, নিরাপত্তা সংস্থা, এমআইওয়ান(সি), বিশেষ গুপ্তচর বিভাগ, এমনকি সি'জ সংগঠন ইত্যাদি নামে এর বহুবিধ নামকরণ হতে থাকে। ১৯২০ সালের মধ্যে এটি দ্রুত 'সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস' নাম পরিচিতি পেতে থাকে। এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস নামেই গুপ্তচর বিভাগ অধ্যাদেশ, ১৯৯৪ এর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।[১]
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সংস্থাটি 'স্যার ম্যানসফিল্ড স্মিথ-কামিংয়ের' অধীনে ছিল। সমগ্র ১৯২০ এর দশকের অধিকাংশ বছরই সমাজতন্ত্র বিশেষ করে রাশিয়ার বলশেভিক আন্দোলনের দিকেই নজর ছিল বেশি। বলশেভিক সরকার উৎখাতে ১৯১৮ সালে গুপ্তচর হিসেবে সিডনী জর্জ র্যালী এবং স্যার রবার্ট ব্রুশ লকহার্টকে প্রেরণ করেছিল। ক্যাপ্টেন জর্জ হিলের নেতৃত্বে সোভিয়েট রাশিয়ার প্রথমদিকে একনিষ্ঠ গুপ্তচর মোতায়েনের চেয়ে ভাল ফলাফল বয়ে এনেছিল।
অবসরগ্রহণের অল্পকিছুদিন পূর্বে ১৪ জুন, ১৯২৩ সালে স্মিথ-কামিং আকস্মিকভাবে নিজ বাড়ীতে মারা যান। তার পরিবর্তে সি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন অ্যাডমিরাল স্যার হিউ কিউয়েক্স সিনক্লেয়ার। যদিও পূর্বসুরীর অনন্যসাধারণ প্রতিভা তার মাঝে অনুপস্থিত ছিল, তবু সিনক্লেয়ারের মাঝে সংগঠনের ভবিষ্যত নিয়ে স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গীতে অগ্রসর হয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে কার্যপরিধি বিকশিত হয়েছিল।
১৯৩০ এর দশকে নাত্সী জার্মানির উত্থানজনিত ভীতিতে সংস্থাটির দৃষ্টি পরিবর্তিত হয়ে নাৎসীদের কর্মকাণ্ডের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়।[৪] সরকার এবং জার্মান নৌসেনাবিভাগের মধ্য থেকে বিশ্বস্ত সূত্রের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে সেবা কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। কিন্তু বৈদেশিক বিভাগে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত সহকারী সচিব রবার্ট গিলবার্ট ভ্যানসিটার্টের কূটনৈতিক যোগাযোগে এটি কম গুরুত্ব পায়।
সিনক্লেয়ার ১৯৩৯ সালে অসুস্থতাজনিত কারণে মারা যান। তার পরিবর্তে নতুন 'সি' হিসেবে আসেন লেফ্টেন্যান্ট কর্ণেল স্টুয়ার্ট মেনজিস। তিনি ১ম বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত অশ্বারোহী বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন।
১৯৯৫ সাল থেকে সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের সদর দপ্তর লন্ডনের টেম্স নদীর পাশে ৮৫ ভক্সহল ক্রসে অবস্থিত। ১৯৬৬-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত পূর্ববর্তী সদর দপ্তর সেঞ্চুরি হাউস, ১০০ ওয়েস্টমিনিস্টার ব্রিজ রোড, ল্যাম্বেথে ছিল। তারপূর্বে এ ভবনের অবস্থান ছিল ১৯২৪-১৯৬৬ সাল পর্যন্ত লন্ডনের ভিক্টোরিয়া স্ট্রীটে। যদিও সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস ব্রডওয়ে থেকে পরিচালিত হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে এটি পরিচালিত হতো সেন্ট জেমস স্ট্রিট থেকে।
সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস সংস্থাটির ভবনের অঙ্গসজ্জা জেমস বন্ড চলচ্চিত্রের গোল্ডেনআই, দি ওয়ার্ল্ড ইজ নট এনাফ এবং ডাই এনোদার ডে ছবিতে দেখানো হয়েছে। এমআইসিক্স প্রথমবারের মতো ভবনের অঙ্গসজ্জ্বা জেমস বন্ড সিরিজের 'দি ওয়ার্ল্ড ইজ নট এনাফ' চলচ্চিত্রে প্রদর্শনের অনুমতি প্রদান করে। উক্ত চলচ্চিত্রে ভবনের অভ্যন্তরে ব্রিফকেস পরিপূর্ণ টাকায় বিস্ফোরণ ঘটানোর দৃশ্য ধারণ করা হয়। ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশিত নিবন্ধে জানা যায় যে, ব্রিটিশ সরকার চলচ্চিত্রের অংশবিশেষ ধারণ করার প্রস্তাবে বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু এই দাবীটি আদৌ সত্য নয় বলে বৈদেশিক এবং কমনওয়েলথ দপ্তরের একজন মুখপাত্র নাকচ করে দেন।[৫]
২০ সেপ্টেম্বর ২০০০ তারিখের সন্ধ্যায় ভবনটি রাশিয়ায় নির্মিত আরপিজি-২২ ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নবম তলায় ক্ষেপণাস্ত্রটি অগভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল। মেট্রোপলিটন পুলিশ সার্ভিসের সন্ত্রাস-বিরোধী শাখা থেকে জানা যায়, এ ঘটনায় রিয়্যাল আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি বা রিয়্যাল আইআরএ তাদের সম্পৃক্ততার কথা জানিয়েছে।[৬]
ক্রমিক নং | অবস্থান | নাম |
১| | ১৯০৯-১৯২৩ | ক্যাপ্টেন স্যার ম্যানস্ফিল্ড কামিং (১৮৭৩-১৯৩৯) |
২| | ১৯২৩-১৯৩৯ | অ্যাডমিরাল স্যার হিউজ সিনক্লেয়ার (১৮৫৯-১৯২৩) |
৩| | ১৯৩৯-১৯৫২ | মেজর জেনারেল স্যার স্টুয়ার্ট মেনজিস (১৮৯০-১৯৬৮) |
৪| | ১৯৫৩-১৯৫৬ | স্যার জন আলেকজাণ্ডার সিনক্লেয়ার (১৮৯৭-১৯৭৭) |
৫| | ১৯৫৬-১৯৬৮ | স্যার রিচার্ড হুয়াইট (১৯০৬-১৯৯৩) |
৬| | ১৯৬৮-১৯৭৩ | স্যার জন রেনি (১৯১৪-১৯৮১) |
৭| | ১৯৭৩-১৯৭৮ | স্যার মরিস ওল্ডফিল্ড (১৯১৫-১৯৮১) |
৮| | ১৯৭৯-১৯৮২ | স্যার ডিক ফ্রাঙ্কস্ (১৯২০-২০০৮) |
৯| | ১৯৮২-১৯৮৫ | স্যার কলিন ফিগারস্ (১৯২৫-২০০৬) |
১০| | ১৯৮৫-১৯৮৯ | স্যার ক্রিস্টোফার কারেন (১৯২৯-বর্তমান) |
১১| | ১৯৮৯-১৯৯৪ | স্যার কলিন ম্যাককল (১৯৩২-বর্তমান) |
১২| | ১৯৯৪-১৯৯৯ | স্যার ডেভিড স্পেডিং (১৯৪৩-২০০১) |
১৩| | ১৯৯৯-২০০৪ | স্যার রিচার্ড ডিয়ারলাভ (১৯৪৫-বর্তমান) |
১৪| | ২০০৪-২০০৯ | স্যার জন স্কারলেট (১৯৪৮-বর্তমান) |
১৫| | ২০০৯-বর্তমান | স্যার জন সয়ার্স (১৯৫৫-বর্তমান) |