সিদরাতুল-মুনতাহা (আরবি: سِـدْرَة الْـمُـنْـتَـهَى ; "প্রান্তস্থিত কুলবৃক্ষ বা শেষ প্রান্তের বরই গাছ")[১] হল একটি বিশাল রহস্যময় কুল গাছ বা সিদর গাছ[২] যা সপ্তম আসমানের অর্থাৎ (লাবিয়্যাহ বা দামিয়াহ্ ) নামক আসমানের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত, ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে, সেই সীমানার পরে কোনও সৃষ্টিই বা মাখলুকাত অতিক্রম করতে পারে না, এমনকি ফেরেশতা ও সর্বোচ্চ সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত যেতে পারে তা বেশি নয়। প্রচলিত অর্থে সিদরাতুল মুনতাহা হচ্ছে মহাবিশ্বের শেষ প্রান্তসীমা। সিদরাতুল মুনতাহা অপর নাম রয়েছে দুটি অর্থাৎ একটি কাল্বের প্রথম স্তর আর আরেকটি সুদূরের মাকাম। সিদরাতুল মুনতাহা পর থেকে শুরু হয় অবিনশ্বর বা শাশ্বত জগৎ। সিদরাতুল মুনতাহার ফুল হাজার অঞ্চলের তৈরি মটকার ন্যায়, পাতাগুলো হাতির কানের ন্যায় আর এই গাছের রং অনবরত পরিবর্তন হচ্ছে। পৃথিবীতে আমরা সবাই যেসব রং দেখি, সেগুলো সাতটি রংধনুর সৃষ্টি রং। কিন্তু সিদরাতুল মুনতাহার রং প্রায় অন্যরকম, সেটা বুঝানো প্রায় অসম্ভব। সিদরাতুল মুনতাহার চারপাশে অনেক প্রজাপতি ঘোরাঘুরি করছিল। সিদরাতুল মুনতাহার পাদদেশ থেকে চারটি(قناة),(নদী/ঝর্ণাধারা) প্রবাহমান, দুটি (ক্বোনাত্ ) (একটি ফোরাত নদী ও অপরটি হলো নীলনদ) এবং বাহিরে মানে পৃথিবীর দিকে; বাকি দুটি ক্বোনাত্ বা ঝর্ণা ভিতরে প্রবাহিত, দুটি নহর হল একটি (হাউজে আল কাওসার) হাশরের মাঠে দিকে ও অপরটি (সালসাবিল) জান্নাতের একটি স্তর জান্নাতুল মাওয়ার দিকে প্রবাহিত। ইসরা ও মেরাজের সময় মুহাম্মাদ (সঃ)ই একমাত্র এটি অতিক্রমের অনুমতি পান। এবং তিনি ফেরেশতা প্রধান বা সরদার জিব্রাইলকে নিয়ে গাছের দিকে যাত্রা করেন (যেখানে ফেরেশতা থামলেন)। আর গাছ অতিক্রমের পরে তিনি আল্লাহর সাক্ষাত পান এবং সেখানে তিনি আল্লাহর কাছে দৈনিক পাঁচবেলা নামাজ আদায় করার বিধান পান। সিদরাতুল মুনতাহার পাশে জান্নাতের একটি স্তর জান্নাতুল মাওয়া অবস্থিত।[৩]
সুরা নাম্বার ৫৩, " আন-নাজম " ("তারকা"), আয়াত ১০-১৮ তে বলা হয়েছেঃ
১০ তখন আল্লাহ তাঁর দাসের প্রতি যা প্রত্যাদেশ করবাব, তা প্রত্যাদেশ করলেন।
১১ রসূলের অন্তর মিথ্যা বলেনি যা সে দেখেছে।
১২ তোমরা কি বিষয়ে বিতর্ক করবে যা সে দেখছে?
১৩ নিশ্চয় সে তাকে আরেকবার দেখেছিল,
১৪ সিদরাতুল মুনতাহার নিকটে
১৫ যার কাছে অবস্থিত বসবাসের জান্নাত
১৬ যখন বৃক্ষটি দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার, তদ্দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল।
কুরআন ৫৩ঃ ১০-১৮
এই গাছের কথা সূরা সাবা, আয়াত ১৬ তে এবং সূরা ওয়াকিয়াহ্, ২৮ নং আয়াতেও উল্লেখ করা হয়েছে। [৪]
এখানে ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’র সেই দৃশ্য ও অবস্থার বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে, যা নবী করীম মি’রাজের রাতে দর্শন করেছিলেন। সোনার প্রজাপতি তার চতুস্পার্শ্বে উড়ে বেড়াচ্ছিল। ফেরেশতামন্ডলীও সে বৃক্ষকে ঘিরে রেখেছিলেন এবং মহান প্রভুর জ্যোতির দৃশ্যও ছিল সেখানে। (ইবনে কাসীর প্রভৃতি) এই স্থানেই নবী করীম -কে তিনটি জিনিস প্রদান করা হয়। আর তা হল, পাঁচ ওয়াক্ত নামায, সূরা আল-বাকারা শেষের আয়াতগুলো এবং সেই মুসলিমের ক্ষমার প্রতিশ্রুতি, যে শিরকএর মলিনতা থেকে পবিত্র থাকবে। (মুসলিমঃ কিতাবুল ঈমান, সিদরাতুল মুন্তাহা পরিচ্ছেদ), মহানবী মিরাজে গিয়ে জান্নাতের চারটি নদী দর্শন করেছিলেন। দু’টি বাহ্যিক ও দু’টি আভ্যন্তরিক। বাহ্যিক নদী দু’টি দুনিয়ায় প্রবহমান, নীল ও ফুরাত। (মুসলিম ১৬৪নং)
অন্য এক বর্ণনায় আছে, রাসুলল্লাহ বলেছেন, “(শামের) সাইহান ও জাইহান, (ইরাকের) ফুরাত এবং (মিসরের) নীল প্রত্যেক নদীই জান্নাতের নদ-নদীসমূহের অন্যতম। (মুসলিম ২৮৩৯নং)।জান্নাতের নদীমালার মধ্যে একটির নাম কাওসার; যা শেষ নবী -কে হওযরূপে দান করা হয়েছে। (সুরা কাওসার) এ নদীর মাটি-কাদাও কস্তুরী। (বুখারী) যেখান হতে মহানবী তাঁর উম্মতকে কিয়ামতে পানি পান করাবেন।
সুর্ববৃহৎ হাউজে আল কাওসার নহর (অমৃত নদী) থাকবে জান্নাতী শারাবে পরিপূর্ণ। যে পবিত্র শারাব বা পানীয় দুগ্ধ হতেও সাদা, বরফ হতেও শীতল, মধু হতেও মিষ্ট এবং মিসক চেয়েও সুগন্ধময়। যে একবার সে পানি পান। করবে তাকে আর কোনদিন পিপাসা স্পর্শ করবে না। (বুখারী ৬৫৭৯নং)
জান্নাতের নিম্নদেশে চারটি নহর প্রবাহিত। নির্মল পানির নহর, দুগ্ধের নহর; যার স্বাদ অপরিবর্তনীয়, সুস্বাদু সুধার নহর এবং পরিশোধিত মধুর নহর। [৫]
আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী, যার পবিত্র কোরআন: পাঠ, অনুবাদ এবং ভাষ্য কুরআন যেটি ইংরেজি সংস্করণগুলির মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত, [৬] ব্যাখ্যা করেছেন যে, এই গাছটি "মানুষের কাছে আসমানি জ্ঞানের সীমানা প্রকাশিত আছে, তার বাইরে মানুষ বা ফেরেশতা কেউই যেতে পারে না।"[৭]
আঠারো শতকের ইংরেজি পণ্ডিত জর্জ সেল বলেন "ফেরেশতারা নিজেরা এটি অতিক্রম করতে পারে না; বা আমাদের জ্ঞাত কোন প্রাণীর জ্ঞান প্রসারিত হতে পারে না।"[৮] সেল আরও উল্লেখ করেছে যে ১৬ নং লাইনে গাছের চারপাশে "ফেরেশতারা উপাসনা করে"[৯] এবং অন্য বর্ণনায় গাছের ডালে বসা পাখির কথা বলা হয়েছে।[১০]