সিমলাপাল | |
---|---|
পশ্চিম বঙ্গের শুমারি শহর | |
Location in West Bengal, India | |
স্থানাঙ্ক: ২২°৫৫′২১.৭″ উত্তর ৮৭°০৪′২৪.২″ পূর্ব / ২২.৯২২৬৯৪° উত্তর ৮৭.০৭৩৩৮৯° পূর্ব | |
দেশ | ভারত |
রাজ্য | পশ্চিম বঙ্গ |
জেলা | বাঁকুড়া জেলা |
জনসংখ্যা (২০১১) | |
• মোট | ৭,২০৬ |
ভাষা সমূহ | |
• অফিসিয়াল | বাংলা, ইংরেজি |
সময় অঞ্চল | আইএসটি (ইউটিসি+৫:৩০) |
পিআইএন | ৭২২১৫১ (সিমলাপাল) |
টেলিফোন কোড | ০৩২৪৩ |
লোকসভা | বাঁকুড়া |
বিধানসভা | তালডাংরা বিধানসভা কেন্দ্র |
সিমলাপাল (ইংরেজি: Simlapal) ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাঁকুড়া জেলার খাতড়া মহকুমায় অবস্থিত সিমলাপাল সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের পুলিশ থানাসহ একটি শুমারি শহর।
আদি সিমলাপালের সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন সিমলাপালের রাজ পরিবারের সদস্যরা। আগেকার দিনে গড় সিমলাপাল হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৮৭৫ বঙ্গাব্দে বা ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে। তখন দিল্লির সুলতান ছিলেন বহলাল খান লোদি, উড়িষ্যার গজপতি ছিলেন পুরুষোত্তম দেব এবং বাংলার শাসক ছিলেন রুকনুদ্দিন বারবক শাহ। আগেকার দিনে এই সিমলাপাল এলাকা উড়িষ্যার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৪৫০ সাল নাগাদ নকুড় তুঙ্গ রাইপুর এলাকায় দলবল সমেত আসেন। তাঁর সেনাপতি ও প্রধান পুরোহিত ছিলেন উৎকল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের শ্রীপতি মহাপাত্র। শ্রীপতি মহাপাত্রের বিভিন্ন কর্মকুশলতায় সন্তুষ্ট হয়ে নকুড় তুঙ্গ তাকে সিমলাপাল পরগনা দান করেন। শ্রীপতি মহাপাত্রই সিমলাপালের জমিদার তথা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর রাজত্বকাল ছিল ৮৭৫ বঙ্গাব্দ থেকে ৯০১ বঙ্গাব্দ। সিমলাপালের শেষ রাজা ছিলেন শ্যামসুন্দর সিংহচৌধুরী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে সিমলাপাল এলাকার সভ্যতার বিকাশ,শিক্ষা এবং সংস্কৃতির উন্নয়ন অনেকাংশেই রাজ পরিবারের হাত ধরেই হয়েছিল। সিমলাপালে মোট রাজা বা জমিদার ছিলেন ১৮ জন। সিমলাপালের সপ্তদশ রাজা মদনমোহনের নামেই সিমলাপাল মদনমোহন হাই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সিমলাপাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয় ৮৭৫ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম রাজা শ্রীপতি মহাপাত্র। জমিদারি প্রথা রদ হয় ১৩৬২ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ। প্রায় ৪৯০ বছরের রাজত্বকালের মধ্যে সিমলাপালে জমিদার বা রাজা ছিলেন মোট ১৮ জন। সিমলাপালের রাজ পরিবারের সদস্য বলগোবিন্দ সিংহবাবুর একটি কবিতায় সিমলাপাল রাজবংশের পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়।[১]
২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে সিমলাপাল শহরের মোট জনসংখ্যা ছিল ৭,২০৬ জন; যার মধ্যে ৩,৬৯৩ (৫১%) পুরুষ এবং ৩,৫১৩ (৪৯%) মহিলা ছিলেন। জনসংখ্যার ৬ বছরের নিচে ছিল ৯২৭। সিমলাপালে মোট সাক্ষর ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৪,৩৭৪ (৬ বৎসর বয়সী জনসংখ্যার ৬৯.৬৬%)।[২]
সিমলাপাল থানা সিমলাপাল সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের অধীনস্থ। এলাকাটির আয়তন হলো ৩০৯.২৭ বর্গ কিমি এবং জনসংখ্যা ১২৭,৪২৯।[৩][৪]
জনগণনা: ২০১১ |
তপশিলি জাতি-৩৭৭৩৮ |
বনভূমি-৭৮৫৬.৭২ হেক্টর |
সিমলাপাল সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের সদর দফতর সিমলাপালে অবস্থিত। সিমলাপাল ব্লকের মধ্যে মোট সাতটি গ্রাম পঞ্চায়েত আছে, এগুলি হল মণ্ডলগ্ৰাম, দুবরাজপুর, বিক্রমপুর, সিমলাপাল, লক্ষ্মীসাগর, মাচাতোড়া ও পার্শ্বলা
রাজ্য হাইওয়ে ২ (পশ্চিমবঙ্গ) বাঁকুড়া থেকে মালঞ্চা (উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায়) এবং রাজ্য হাইওয়ে ৯ (পশ্চিমবঙ্গ) দুর্গাপুর (পাশ্চিম বর্ধমান জেলার মধ্যে) দিয়ে নয়গ্রাম (ঝাড়গ্রাম জেলার মধ্যে) হয়ে সিমলাপাল দিয়ে যায়।[৮]
সিমলাপাল কলেজ অফ এডুকেশন একটি বেসরকারী অ-সহায়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই কলেজ স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করে। এটি ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ২০১২ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করে[৯][১০] সিমলাপাল মদন মোহন উচ্চ বিদ্যালয়টি ১৯৩৮ সালে সিমলাপালের রাজা মদন মোহন সিংহ চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[১১] সিমলাপাল মঙ্গলময়ী বালিকা বিদ্যামন্দির ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি বাংলা মাধ্যম বালিকা বিদ্যালয়।[১২] এছাড়া এখানে কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও রয়েছে।
সিমলাপাল ব্লক জনস্বাস্থ্য কেন্দ্রটি সিমলাপালের সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সেবাগার। এর অধীনে তিনটি জনস্বাস্থ্য কেন্দ্রঃ লক্ষ্মীসাগর, হাতিবারি এবং অড়রা এবং ২১ টি উপকেন্দ্র রয়েছে।[১৩]
বাঁকুড়া জেলার সিমলাপাল থানা এলাকার প্রত্ন ও পুরাতত্ত্বের নিদর্শন বলতে গেলে প্রথমেই আসে সিমলাপালে রাজবাড়ির বলরাম মন্দিরের কথা। মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা কাল ১৫৮৪ শকাব্দ, বাংলা ১০৬৯ সাল। এই মন্দিরের পূর্ব দিকের দেয়ালের বাইরের গায়ে উপবিষ্ট আছে দুটি যক্ষিণী এবং সাবেক দালানের দেওয়ালে আছে দুটি অম্বিকা মূর্তি। যার একটি অপূর্ব লালিত্যময়। তাছাড়াও এই মন্দিরের বিশিষ্ট সম্পদ হল দুটি জৈন তীর্থঙ্কর, দুটি বেণুকৃষ্ণ, একটি রাম-সীতা ও একটি বাসুদেব মূর্তি।
সিমলাপালের পূর্বের গ্রাম রামনগরে প্রয়াত রমাপদ সিংহবাবুর বহিরাঙ্গনে তিনটি জৈন মূর্তি আছে। একটি ক্ষয়িষ্ণু, অন্যটি এখনও সম্পূর্ণ অক্ষত।
শিলাবতী নদী তীরে অবস্থিত লায়েক পাড়া গ্রামে প্রয়াত যদুনাথ ধামাইৎকন্নীর গৃহে আছে এক নাগবেষ্টিত বিশাল জৈন মূর্তি যা আজও অক্ষত। ঐ গ্রামের পশ্চিমে গোতড়া গ্রামে একটি জৈন মূর্তি আছে যা আজও পূজিত হচ্ছে। এছাড়া সিমলাপালের পূর্ব প্রান্তীয় জয়পণ্ডার তীরে অবস্থিত ভূতশহর গ্রামে একটি ভূতেশ্বর শিবের জৈন মূর্তি ছিল, যার নামানুসারে গ্রামের নাম ভূতশহর। শিলাবতী নদীর তীরবর্তী আঁকড় গ্রামে একটি ৮-১০ ফুট গভীর খাতের ভিতর জৈন মূর্তি বিরাজমান। সেখানে বাৎসরিক মেলা বসে। এছাড়াও হাতিবারি মৌজায় একটি শিয়াকূল ঝোঁপে একটি জৈনমূর্তি আছে যা বলদ্যা বুড়ি নামে আজও পূজিত হয়। সিমলাপালের পশ্চিম দিকে আমাকোন্দা গ্রামের উত্তরে একটি উঁচু টিলার উপর নাগবেষ্টিত জৈন মূর্তি ছিল যা চুরি হয়ে গেছে। ঐ স্থানে পায়রাসিনি নামে এখ্যান দিনের বিকালে পূজা হয় এবং মেলা বসে। এছাড়া শিলাবতীর দক্ষিণ তীরে পল্লীভারতী উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন বাঁকিপাল গ্রামে একটি মস্তক বিহীন ও একটি অক্ষত জৈন মূর্তি ছিল, সেগুলিও চুরি হয়ে গেছে। লক্ষ্মীসাগরের দক্ষিণে রঙ্কিণীতড়াতে একটি পাথরের উপর জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তি খোদিত ছিল। পার্শ্বলা গ্রামে একটি অশ্বত্থ গাছের নিচে একটি পাথরের জৈনচক্র আজও দেখতে পাওয়া যায়। জামদা গ্রামের পূর্বে একটি শাকাইসিনির মন্দির ছিল যা আজ বিলুপ্ত। দুবরাজপুর অঞ্চলের মাদারিয়া গ্রামে (পূর্ব নাম মন্দিরা) যত্রতত্র জৈনতীর্থঙ্কর মূর্তি ছিল যেগুলি সবই চুরি হয়ে গেছে। এছাড়াও ভেলাইডিহার নিকট অলকাধরা গ্রামে নীল পদ্মের উপর দণ্ডায়মান একটি জৈন তীর্থঙ্কর মূর্তি আছে যা আজও দেবতা জ্ঞানে পূজিত হয়। মাচাতোড়া অঞ্চলের গাড়রা গ্রামে বিরাজ শিবলিঙ্গ আজও পূজিত হচ্ছে কিন্তু পুরানো মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত। সিমলাপালের পূর্ব প্রান্তে জয়পণ্ডা ও শিলাবতী নদীর সংযোগ স্থলে একটি গ্রাম আছে, নাম -সিঙ্গাড়কুড়ি। এখানের মন্দির নদীগর্ভে বিলীন। ধুল্যাপুর মৌজার হরিহরপুরে একটি কাপালিক শিবের মন্দির আছে। সিমলাপাল সংলগ্ন জড়িষ্যা গ্রামের ভিতর যত্রতত্র পুরানো মাটির পাটের পাটকুয়ো আছে। এখানে একটি পাথরের বসুবালা মূর্তি আছে। সিমলাপালের মুসলিম পাড়ায় একটি মাকড়া পাথরের বৌদ্ধচক্র এখনও বিদ্যমান। এই সমস্ত জিনিসের সংগ্রহশালা করে রক্ষা কার যায় কিনা তা ভাববার বিষয়।[১৪]
সিমলাপাল এলাকার বেশ কিছু মানুষ স্বাধীনতার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিচারে তাঁদের কারাবাসও হয়। ভারত সরকার এঁদের অনেককে তাম্রপত্র দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। সিমলাপাল এলাকার যেসব স্বাধীনতা সংগ্রামী বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তাঁদের নাম এবং গ্রামের নাম উল্লেখ করা হলো।[১৫]
চন্দ্রভূষণ সিংহবাবু (সিমলাপাল রাজবাটি) |
বলরাম কর্মকার(লক্ষ্মীসাগর) |
সিমলাপাল ব্লকের অধিকাংশ মানুষই কৃষিজীবী। তাই এখানে অধিকাংশ লোকউৎসবের ধারা কৃষিকে ভিত্তি করেই। সিমলাপালের মানুষের সামাজিক আচার ব্যবহার, ভাবধারা, ভাষা কিছুটা অন্য রকমের এবং তার প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন লোকউৎসবে।
ভাদ্র মাসে ভাদু পূজা এই অঞ্চলে বেশ উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। ভাদ্রমাসে ভাদুকে সবাই বরণ করে নেয়। কুমারী ভাদু পূজারিণীদের সমবেত কণ্ঠে এক বিশেষ সুরে গীত হয়;
"ওমা ভদ্রেশ্বরী।
তোমায় ডাকছি মা বিনয় করি।।
তোমাধনে পূজব বলে গো,
মনেতে মানস করি।
বেছে বেছে ফুল এনেছি,
সারা বন ঘুরি ঘুরি।।"
আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে গ্রাম বাংলার বুকে শুরু হয় ধান বোনা। ভাদ্র মাসে ধানচারা হয়ে ওঠে সতেজ। গেরুয়া রঙের মাঠে দেখা যায় সবুজের সমারোহ। ঠিক এই সময়েই ভাদু উৎসব। তাই চাষের সাথে এর আছে নিবিড় বন্ধন। বিশেষত বৈশাখ মাসের পর আর কোন বড় উৎসব থাকে না। ভাদ্র মাসে শুরু হয় ভাদুপূজা ছোট মাটির মূর্তিকে কেন্দ্র করে। ভাদু প্রতিমাতে বিশেষত্ব দেখা যায়। নাচের ভঙ্গিমায় অলংকারভূষিতা এক তরুণী মূর্তিই ভাদু। সাধারণত এক থেকে দেড় হাত উঁচু হয় এই মূর্তি। অবশ্য নানা রকম রুচিভেদ অনুযায়ী মৃৎশিল্পীরা মূর্তি তৈরি করেন।
প্রকৃতি উৎসব, করম উৎসব, আদিবাসীদের ছত্তাবেঙ্গা পরব ও জাওয়া পরবের সাথে ভাদু উৎসবের মিল আছে। উৎসবগুলির সময়কাল ও আচার অনুষ্ঠান প্রায় একই রকম। অনেকেই বলেন, আদিবাসীদের করম উৎসব, বৃক্ষ উৎসব থেকে ভাদু উৎসব রূপান্তরিত হয়েছে। ভরা ভাদরে যেমন মাঠ হয় ধানের চারায় সবুজ, সরস মাটিতে বীজের হয় অঙ্কুরোদগম ঠিক তেমনি এই সময়েই বালিকা কন্যার হৃদয়ে জাগে আগামী জীবন রচনার আকূতি। তাই এই ভাদু উৎসবের সাথেও বালিকাদের মনের গভীর বাসনা একাকার হয়ে আছে। তাই ভাদু গানের মধ্যেও ধরা পড়ে জীবনের হাসি কান্নার চিত্র এমন কি মনের গভীর আবেদন। সেদিক দিয়ে এই ভাদু পূজার মন্ত্র স্বরূপ ভাদু গানের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক বিরাট তাৎপর্য। সেই জন্যই শোনা যায়;
"ওলো ভাদু ডিয়ার।
মাইরি বলি রূপখানা তোর চমৎকার।।
সারা অঙ্গ ঢল ঢল লো, উঠে যৌবনের
জোয়ার।
তোর বাঁকা চোখের চাহনিতে,
ইচ্ছে হয় করি পেয়ার।।"
ভাদ্রমাস জুড়ে ভাদুপূজার পর সংক্রান্তির রাতে "ভাদু জাগরণ" অনুষ্ঠিত হয়। তার পরদিন পয়লা আশ্বিন ভাদুর বিসর্জন। প্রকৃতি সতত পরিবর্তনশীল। দণ্ডে দণ্ডে প্রকৃতির বুকে চলেছে রং বদলে পালা। পরিবর্তনের এই ছোঁয়াও লেগেছে ভাদু গানের মধ্যে। তাই এই গানে দেবদেবী থেকে শুরু করে বর্তমান যুগের ভাবধারা সবই আছে। স্থানীয় অভাব অভিযোগ ঘটনা ও স্থান পাচ্ছে ভাদু গানে। ভাদু গানে কি নেই? সবই আছে। ভাদু গান হয়ে উঠেছে জীবনের আলেখ্য। সুখ দুঃখ, ভালোবাসা, আশা আকাঙ্খা সবই আছে ভাদু গানে।
তাই ভাদু গানে দেখা যায়;
(১)
"ভাদু আমার কলেজে যাবে গো
পড়াতে তার ঝোঁক ভারি।
খাতা কলমের ধার ধারে না
ডান হাতে তার বাঁধা ঘড়ি।।"
(২)
"ভাদু আমার হেমামালিনী
বাংলা বইয়ের মাধুরী।
"ববি" বইয়ের হয় সে ববি
রূপের তার নাইকো জুড়ি।।"
(৩)
"এসো ভাদু চা খাও,
গুড়েরই পানা।
দেশে দেশে কন্ট্রোল হল
চিনি মেলে না।।"
এলাকার রাস্তাঘাটের কথাও ভাদু গানে আছে। যেমন-
"ভাদু বলি তোরে।
আসছে বছর আনবো লো মোটর কারে।।
পাকা রাস্তা করব ভাদু লো।
পিচ ঢালব উপরে।।"
ভাদু উৎসবের মধ্যে অনেক কিছুই আছে সত্য কিন্তু উগ্র আধুনিকতার চাপে এই লোকউৎসব ক্রমশই যেন প্রিয়মান হয়ে পড়ছে। উৎসবের ধারাকে শিক্ষিত সমাজ ধীরে ধীরে দূরে ফেলে দিচ্ছেন।[১৬]
সিমলাপাল এলাকায় এমন কোন বছর যায়নি যে বছরে সর্পদংশনে মৃত্যু ঘটেনি। তাই বিষহরি মা মনসার পূজা এই এলাকার অনেকেই করেন। মনসা পূজার সাথে সাথে ঝাঁপান উৎসব সত্যিই অসামান্য ব্যাপার। সিমলাপালের বিভিন্ন গ্রামের ঝাঁপান উৎসব দেখলে অনেকেই ভীত ও চমকিত হবেন। প্রতিবছর শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে এই উৎসব হয়। শোনা যায়, মল্ল রাজাদের আমলে সাপুড়েদের মধ্যে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। এতে সর্পকুশলীদের শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করে উপযুক্ত পুরস্কার দেওয়ারও ব্যবস্থা ছিল। এখন আর সেরকম অবশ্য হয় না। কাঠের মাচার উপর বসে সর্পবিশারদরা কাঁসর ঘণ্টা বাজিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করেন, গান করেন, বিভিন্ন সাপ নিয়ে খেলান এবং আদব কায়দা দেখান। কোন কোন সময় বিশারদরা উল্লসিত হয়ে নেচে ওঠেন। ঝাঁপানের গানের মধ্যে মনসা বন্দনাই করা হয়। সর্পবিশারদরা বলেন;
"একবার এসো মা
আমার আসরে,
ধূলায় পড়ে কাতর হয়ে
ডাকি মা তোমারে।"
কিম্বা,
"এসো মা
জয় বিষহরি দেবী,
এসো মা
আমার আসরে
ধূলায় পড়ে
তোমায় ডাকি কাতরে।"
মা মনসার বর্ণনা করে এক গানে বলা হয়েছে;
"উদয় লাগ (নাগ) মা তোর
গলাভরা মালা।
বিছালাগ মা তোর
সিঁতা পাটি পাটি।।
শিয়ারচাঁদ মা তোর বসিবার আসন।
হেলালাগ মা তোর
কোমরের দড়ি।।"
উৎসবে গুরুবন্দনা, দেবদেবী বন্দনা, ভাসান ইত্যাদির গানও গাওয়া হয়। কালের প্রবাহে বর্তমান দিনে ঝাঁপান উৎসব লুপ্তপ্রায়।
সবুজের সমারোহে, আনন্দের দিনে সিমলাপালের আদিবাসী সাঁওতালগণ তাঁদের করম দেবতার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন। এঁদের বিশ্বাস এই দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে না পারলে সমূহ বিপদ উপস্থিত হতে পারে। বন থেকে সবুজ তাজা করম গাছের ডাল সংগ্রহ করে তা ঘরের আঙিনায় পুঁতে দেবতা হিসেবে পূজা করা হয়। তাঁকে ঘিরে সাঁওতাল রমণীগণ আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে নৃত্য ও গীত পরিবেশন করতে থাকেন। বিভিন্ন দল কর্তৃক দফায় দফায় নৃত্য ও গীত পরিবেশিত হয়ে নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত তা চলে। এর পূর্বে কোন মতেই নৃত্য ও গীত বন্ধ রাখা চলে না।
সারুল বা সারিপূজা সিমলাপালের সাঁওতালরা করেন। শালগাছে যখন ফুল ফোটে সেই সময় এক নির্দিষ্ট তিথিতে সারি উৎসব পালিত হয়। রমণীরা সারিবদ্ধ ভাবে হাতে হাত ধরে নৃত্য করেন আর পুরুষরা মাদল বাজান। শাল ফুল দিয়ে দেবতাকে অঞ্জলি দেওয়া হয়।
বনের মধ্যে বড় বড় শাল গাছের নিচে আদিবাসীগণ "গেরাম দেবতা (গ্রাম- দেবতা বা গ্ৰাম্য দেবতা) স্থাপন করেন। গাছের গোড়ায় বড় বড় পাথর, পোড়া মাটির পুতুল, পাঁচমুড়ার তৈরি মাটির হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি রেখে দেবতাজ্ঞানে তাদের পূজা করা হয়। পুরুষ আদিবাসীরা শিং এর বাঁশী "শিঙায়” সুর তোলেন আর রমণীরা নৃত্য করেন।
হৈমন্তিক পার্বণ সিমলাপালের প্রাণরূপ। দেবতা, পিতৃপুরুষ ও পৃথিবীকে উৎসর্গের পর নতুন ধানের চাল ব্যবহারের অনুষ্ঠান নব-অন্ন বা নবান্ন উৎসব। সিমলাপালের নতুন ধান কাটার উৎসব "ডেনি ঠাকুরের পরব" নামে পরিচিত। উৎসব হয় অগ্রহায়ণ মাসে। জমির শেষ ধান কাটার সময় চার পাঁচটি ধানের গোছা না কেটে রেখে দেওয়া হয় জমিতে। সহজে নষ্ট বা চুরি যাতে না হয় সেজন্য তাল বা খেজুর পাতা দিয়ে ঢেকে তার ওপর মাটির চাঁই দেওয়া হয়। ইনিই 'ডেনিঠাকুর'। সময় করে সন্ধ্যে বেলায় ঘরের কর্তা, ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি সহ তাঁকে ভক্তি সহকারে আনেন। মাটির চাঁই ফেলে ধানের গোছা বেণীর মতো পাকানো হয়। সঙ্গে থাকে ধান কাটার অস্ত্র কাস্তে, সিঁদুর, পঞ্চপল্লব, ফুল, জল ইত্যাদি পূজার উপকরণ।আর থাকে বাটিভর্তি গুড়, চাল, জল ও আখের কুচি মিশিয়ে 'নবান্ন'। ধানের গোছা, কাস্তে, পঞ্চপল্লব ইত্যাদিতে সিঁদুর লাগিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়। একটু পরেই 'হরি হরি বোল্লা বলে' ধানের গোছা গুলির শেকড় উপড়ে ফেলা হয়।
গোছা বেঁধে তাকে আঁটির মতো করে তাতে আম পল্লব ও কাস্তে গুঁজে দেওয়া হয়। যত্ন করে তাকে নেওয়া হয় মাথায়। কর্তাবাবু আলপথে বাড়ির দিকে এগিয়ে যান। এসময় তাঁর কথা বলা একেবারে বারণ। ছেলে, মেয়ে ও অন্যান্যরা থর থর কাঁপতে কাঁপতে টিম টিম আলো নিয়ে শঙ্খধ্বনি দিতে দিতে এগোয়। সামনের আঙ্গিনায় ঠাকুমা, মা, মাসিমা অপেক্ষা করেন। কাছে আসামাত্র উলুধ্বনি ও জলধারা দিতে দিতে ডেনিকে নিয়ে যাওয়া হয় খামারে। ডেনির স্থান হয় পালুই এর উপর। তারপর সবাই ভক্তিভরে প্রণাম সেরে বাড়িতে আসেন। নবান্ন বিতরণ করা হয়। পরে ডেনি ঠাকুরের ঐ ধান মেড়ে সংগ্রহ করে লক্ষ্মীর হাঁড়িতে দেওয়া হয়। মা লক্ষ্মীর কৃপায় সোনার ধানে ভরে যাবে ঘর।
আনন্দের দিনে, পূজাপার্বণে, বিয়েবাড়িতে চলে এক বিশেষ ধরণের নাচ যাকে বলা হয় 'থালাবাটি নাচ'। ভাত ডাল খাওয়ার বাসনই এই নাচের বাদ্যযন্ত্র। মূলত সিমলাপালের সাঁওতালরা এই নাচ করেন। কাঁসার থালার উপর বাটি ঠুকে ঝন্ ঝন্ আওয়াজের মতো তালে তালে সাঁওতাল মেয়েরা গান ও নাচ করেন। এই নাচে অংশ নেন কেবল মেয়েরাই। এক একটি দলে থাকেন প্রায় চোদ্দ পনের জন। গানের সুরে পিতৃপুরুষ ও দেবতাকে স্মরণ করে তাঁদের কাছে প্রার্থনা করা হয়, যেন এই থালাবাটি চিরকাল খাদ্যকণায় ভরপুর থাকে। নিজেদের ঘর ছাড়াও পাড়ার অন্যান্য ঘরে গিয়েও সাঁওতালরা এই নাচ পরিবেশন করেন। থালাবাটি নাচের উদ্দেশ্য হচ্ছে কল্যাণ কামনা করা।
শীতের অন্যতম উপহার 'ভেজা বিন্ধা' উৎসব। বাঁকুড়া জেলার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার অন্যতম আকর্ষণীয় উৎসব এটি। সিমলাপালের বিভিন্ন এলাকায় এই উৎসব বেশ আড়ম্বরের সাথে পালিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এটি উৎসবের মাধ্যমে এক প্রতিযোগিতা। মকর সংক্রান্তির পূণ্য প্রভাতে নদী অথবা পুকুরে স্নান করার পর বিভিন্ন মাঙ্গলিক কাজের শেষে যখন বিকেল গড়িয়ে আসে তখনই সাধারণত 'ভেজা বিন্ধার' আয়োজন করা হয়। উৎসবের উদ্যোক্তা হন সাধারণত গ্রামের মোড়লরা। বনে বা নদীর ধারে একজায়গায় কলাকাণ্ড পুঁতে মাথায় চিতি পিঠা লাগানো হয়। গোটা কলা কাণ্ডটিই লক্ষ্যস্থল। সদলবলে মাদল, লাগড়া, শিঙা ও কাঁসরঘন্টা বাজাতে বাজাতে আদিবাসীরা স্থানটিতে আসেন। পুরুষদের বাজনার তালে তালে মহিলারা বিশেষ ভঙ্গিমায় নাচ করেন। সে এক ধুমধাম ব্যাপার। আবালবৃদ্ধবনিতা সবারই হাতে থাকে কিছু তির ও একটি করে ধনুক। একটি নির্দিষ্ট দূর থেকে সবাই একসাথে তির ছুঁড়তে থাকেন কলা গাছকে লক্ষ্য করে। শতশত তির যখন আকাশপথ পরিক্রম করে তখনকার দৃশ্য সত্যিই দেখার মতো। তির ছোঁড়া হয়ে যাওয়ার পর সবাই ছুটে যান লক্ষ্যস্থলে তা বিদ্ধ হয়েছে কিনা দেখতে। তিরবিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আবার তির ছোঁড়ার পালা চলে। কোন তির কলাকাণ্ড ভেদ করলে কাণ্ড টিকে উপড়ে নিয়ে তাকে মাথায় নেওয়া হয়। সফল প্রতিযোগীকে কেউ নেয় কাঁধে। তারপর চলে আবার নাচ ও গান। কোন কোন সময় পুরস্কার হিসেবে ধুতি ও গামছা দেওয়া হয়। যখন সূর্য পশ্চিম গগনে অস্তায়মান ঠিক তখনই সবাই ঘরে পা বাড়ান। আর সন্ধ্যের সময় প্রতি ঘরে পিঠের যে রেশ চলে তা না বললেও চলে।[১৭]