ত্রিস্তরী প্রাণীর ভ্রূণীয় পরিস্ফুটনের সময় যে দেহগহ্বর সৃষ্টি হয় তাকে সিলোম বলা হয়। এটি মেসোডার্মাল কোষের পেরিটোনিয়াম নামক ঝিল্লিতে আবদ্ধ থাকে। তবে দেহগহ্বর মানেই সিলোম না। মেসোডার্মালের পেরিটোনিয়াম ঝিল্লির গহ্বরই শুধু সিলোম। সিলোম একটি গ্রিক শব্দ যার অর্থ ফাঁপা গহ্বর।
প্রাণীতে নিষেক ঘটার পরে উৎপন্ন জাইগোটটি বিভিন্ন কোষীয় বিভাজনের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে ক্লিভেজ, মরুলা ও ব্লাস্টুলা দশাপ্রাপ্ত হয়। ক্লিভেজ হতে উৎপন্ন কোষগুলো হলো ব্লাস্টোমিয়ার। এরপরে একসময় ব্লাস্টোমিয়ার বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ব্লাস্টুলা ফাঁপা বলের আকৃতি নেয়। এই ব্লাস্টুলার কেন্দ্রীয় গহ্বরকে ব্লাস্টোসিল বলে। ব্লাস্টুলা একসময় গ্যাস্ট্রুলায় রূপান্তরিত হয়। গ্যাস্ট্রুলার গহ্বর আর্কেন্টেরোন নামক এন্ডোডার্ম দ্বারা আবদ্ধ থাকে। গ্যাস্ট্রুলার বাইরের স্তর হচ্ছে এক্টোডার্ম আর ভেতরের স্তর হচ্ছে এন্ডোডার্ম। আর এর মাঝখানের গহ্বর হলো ব্লাস্টোসিল। ইউসিলোমেট প্রাণীর ব্লাস্টোসিলে সিলোম অবস্থান করে।
প্রাণিদেহে সিলোমের উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে শ্রেণিবিন্যাসও করা হয়। সিলোমের উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে প্রাণিকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়।
১. এসিলোমেটঃ এসব প্রাণিতে সিলোম নেই। ব্লাস্টোসিল মেসোডার্মাল কোষ দিয়ে পূর্ণ থাকে। এখানে স্পঞ্জোসিল/ স্পঞ্জি প্যারেনকাইমা বিদ্যমান। উদাহরণঃ পরিফেরা, নিডারিয়া, টিনোফোরা প্রভৃতি।
২. স্যুডোসিলোমেটঃ এদের শরীরে প্রকৃত সিলোম নেই। ব্লাস্টোসিল আংশিকভাবে মেসোডার্মাল কোষ দিয়ে পূর্ণ থাকে। দেহগহ্বরটি মেসোডার্ম দিয়ে আবদ্ধ থাকে শুধু দেহপ্রাচীরের দিকে। অন্ত্রের দিকে মেসোডার্ম অনুপস্থিত। উদাহরণঃ গোলকৃমি।
৩. ইউসিলোমেটঃ এরা প্রকৃত সিলোমবিশিষ্ট প্রাণী। দেহপ্রাচীর ও অন্ত্র উভয় দিকেই দেহগহ্বরটি মেসোডার্ম দিয়ে আবদ্ধ থাকে। গ্যাস্ট্রুলার ব্লাস্টোসিল প্রকৃত সিলোম দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। উদাহরণঃ এনেলিডা ও কর্ডাটা পর্বের প্রাণি।
তবে ভ্রূণীয় বিকাশের উপর ভিত্তি করে ইউসিলোমেট প্রাণীদেরকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যেমনঃ প্রোটোস্টোম ও ডিউটারোস্টোম। মেসোডার্মের বিভাজন থেকে সিলোম উৎপন্ন হলে সেই প্রাণী প্রোটোস্টোম। এবং এ ধরনের সিলোমকে সাইজোসিলোম বলে। আবার, সিলোম যদি আর্কেন্টেরোনের অভ্যন্তরীণ বিকাশের ফলে উদ্ভূত হয় তাহলে সে প্রাণীগুলোকে ডিউটারোস্টোম বলে৷ এ ধরনের সিলোমকে বলে এন্টারোসিলোম। [১]
সিলোমের উৎপত্তি কীভাবে হয় তার জন্য দুটি বিতর্কিত তত্ত্ব রয়েছে। প্রথম তত্ত্ব হিসেবে এসিলোমেট এর কোনো পূর্বপুরুষ থেকে সিলোমের উৎপত্তি ঘটে। এ তত্ত্বটি এসিলোমেট তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত। আবার অন্য তত্ত্বানুসারে, সিলোম নিডারিয়া প্রাণীর গ্যাস্ট্রিক থলি থেকে উদ্ভূত। এ তত্ত্বটি এন্টেরোসিল তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত। এ দুটির তত্ত্বের ভেতরে এন্টেরোসিল তত্ত্ব বেশি সমর্থন পেয়েছে। [২]
১. সিলোম শরীরের স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও দেহাভ্যন্তরীণ অঙ্গকে সংকুচিত করে যেকোনো আঘাত থেকে শরীরকে রক্ষা করে।
২. সিলোম তরল হাইড্রোস্ট্যাটিক স্কেলেটন (কঙ্কাল) হিসেবে কাজ করে। যার দরুন এটি নরম শরীর বিশিষ্ট প্রাণীর চলনে সহায়তা করার পাশাপাশি প্রাণীটিকে একটি সুনির্দিষ্ট আকৃতি দেয়।
৩. সিলোমোসাইট কোষগুলো প্রাণীর ইমিউনিটি বৃদ্ধি করে। তারা ইমিউন সাড়া প্রদান ও ফ্যাগোসাইটোসিস এর মাধ্যমে ইমিউনিটিতে ভূমিকা রাখে। এ কোষগুলো সিলোমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় আবার প্রাচীরের সাথেও লেগে থাকে।
৪. সিলোম তরলের ফলে গ্যাসীয় সংবহন ও রেচনকার্যে প্রাণি সহায়তা পায়। এছাড়াও সিলোম প্রাণীর অঙ্গ বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গার যোগান দেয় ও সেগুলোর বিকাশ ঘটায়। যেমনঃ হৃৎপিন্ডে রক্ত পাম্প করা, গর্ভে শিশু ধারণ ও বহন করা ইত্যাদি। [৩]