সিস-ট্রান্স সমানুতা, জ্যামিতিক সমানুতা বা গাঠনিক সমানুতা নামেও পরিচিত, অজৈব রসায়নে ব্যবহৃত একটা বিষয়। সিস এবং ট্রান্স শব্দটি লাতিন থেকে এসেছে। সিস অনুতে কার্যকরী মূলক কার্বন শৃংখলের একই পাশে থাকে,[১] এবং ট্রান্স অনুতে কার্যকরী মূলক কার্বন শৃংখলের বিপরীত পাশে থাকে। আলোকসমানু বর্ণনা করতে এটা ব্যবহার করা হয়। আলোক সমানু হচ্ছে এক জোড়া অণু যাদের সংকেত একই কিন্তু তাদের কার্যকরী মূলক ভিন্ন ভিন্ন ত্রিমাত্রিক অবস্থানে ঘোরে। ই-জেড সমানুতার সংগে বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না, যা পরম স্টেরিওক্যামিক্যাল বর্ণনা এবং শুধুমাত্র এলকেনের জন্য ব্যবহার করা হয়।
সাধারণত স্টেরিও আইসোমারে দ্বৈত বন্ধন থাকে যা ঘুরতে পারেনা অথবা তাদের কাঠামোয় রিং থাকে যেখানে বন্ধনীর ঘুর্ণন নিষিদ্ধ।[২] সিস এবং ট্রান্স সমানুতা জৈব অণু এবং অজৈব সন্নিবেশ যৌগে দেখা যায়। কনফর্মেশানাল আইসোমারের ক্ষেত্রে সিস এবং ট্রান্স কথাটির পরিবর্তে সিন ও এন্টি ব্যবহৃত হয় যেখানে দুটি জ্যানিতিক রূপ খুব সহজে আন্ত:রূপান্তরিত হয়, যেমন অধিকাংশ একক বন্ধনীর কাঠামো।
IUPAC জ্যামিতিক সমানুতাকে সিস-ট্রান্স সমানুতার অপ্রচলিত সমার্থক শব্দ হিসেবে বিবেচনা করে।[৩]
যখন প্রতিস্থাপন মূলক একই দিকে বিন্যস্ত থাকে তখন ডাইস্টেরিওমারকে সিস বলা হয় এবং যখন বিপরীত দিকে বিন্যস্ত থাকে তখন ডাইস্টেরিওমারকে ট্রান্স বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় হাইড্রোকার্বন বিউট-২-ইন সিস-ট্রান্স সমানুতা প্রদর্শন করে।
এলিসাইক্লিক যৌগ সিস-ট্রান্স সমানুতা প্রদর্শন করে। রিং স্ট্রাকচারের কারণে 1,2-dichlorocyclohexane জ্যামিতিক সমানুতা প্রদর্শন করে:
![]() ![]() |
![]() ![]() |
ট্রান্স-1,2-dichlorocyclohexane | সিস-1,2-dichlorocyclohexane |
সিস এবং ট্রান্স সমানু আলাদা ভৌত বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে। অণুর গঠন এবং ডাইপোল মোমেন্টের পার্থক্যের কারণের সমানুর মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়।
পার্থক্য খুবই ছোট হতে পারে, সরল শিকল এলকেনের ক্ষেত্রে স্ফুটনাঙ্ক যেমন পেন্ট-২-ইন সিস আইসোমারে ক্ষেত্রে ৩৭ °C এবং ট্রান্স আইসোমারের ক্ষেত্রে ৩৬ °C।[৪] পোলার বন্ধন উপস্থিত থাকলে সিস এবং ট্রান্স সমানুর পার্থক্য বড় হয় যেমন ১,২-ডাইক্লোরোইথেন। এই ক্ষেত্রে সিস আইসোমারের স্ফুটনাংক ৬০.৩ °C, অন্যদিকে ট্রান্স আইসোমারের ক্ষেত্রে ৪৭.৫ °C।[৫] সিস আইসোমারে দুটো পোলার C-Cl বন্ধন ডাইপোল মোমেন্ট একত্রিত হয়ে একটি সামগ্রিক মলিক্যুলার ডাইপোল প্রদান করে ফলে সেখানে আন্তঃঅণু ডাইপোল-ডাইপোল বল বা কীসম বল তৈরী হয়, যা লন্ডন বিচ্ছুরণ বলের সাথে যুক্ত হয়ে স্ফুটনাঙ্ক বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে ট্রান্স আইসোমারের ক্ষেত্রে এরকম হয় না কারণ দুটি C-Cl বন্ধন মোমেন্ট পরস্পরকে বাতিল করে দেয় এবং অণুকে শূন্য ডাইপোল প্রদান করে।
বিউটিনডাইঅয়িক এসিডের দুটি সমানুর ভৌত ধর্ম এবং সক্রিয়তায় এত বেশি পার্থক্য থাকে যে তাদেরকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি নামে ডাকা হয়। সিস সমানুটি ম্যালেয়িক এসিড নামে এবং ট্রান্স আইসোমারটি ফিউমারিক এসিড নামে পরিচিত। আপেক্ষিক স্ফুটনাঙ্ক বিন্দু নির্ণয়ে পোলারিটি চাবি হিসেবে কাজ করে যখন এটা আন্ত আণবিক বল বৃদ্ধি করে তখিন স্ফুটনাংকও বেড়ে যায়। একই পদ্ধতিতে আপেক্ষিক গলনাঙ্ক নির্ণয়ে সিমেট্রি বা প্রতিসাম্যতাকে চাবি হিসেবে ধরা হয় যদিও এটা অণুর পোলারিটিকে কোন ব্যত্যয় না ঘটায় তবুও। অলেয়িক এসিড এবং ইলাডিক এসিডের মধ্যকার সম্পর্ক হচ্ছে এর উদাহরণ। সিস সমানু অলেয়িক এসিডের গলনাঙ্ক ১৩.৩ °C, কক্ষতাপমাত্রায় এটি তরলাকারে থাকে অন্যদিকে ট্রান্স আইসোমার এলাডিক এসিড এর গলনাঙ্ক ৪৩ °C, যেহেতু সরলাকৃতির ট্রান্স আইসোমার খুবই শক্তভাবে বিন্যস্ত থাকতে পারে তাই কক্ষতাপমাত্রায় এটি কঠিনাকারে থাকে।
যেসকল ট্রান্স এলকেন কম পোলার এবং অধিক প্রতিসম তাদের স্ফুটনাঙ্ক কম এবং গলনাঙ্ক বেশি। সিস এলকেনের, যা সাধারণত বেশি পোলার এবং কম প্রতিসম, উচ্চ স্ফুটনাঙ্ক এবং নিম্ন গলনাঙ্ক বিন্দু।
জ্যামিতিক সমানুর ক্ষেত্রে দ্বৈত বন্ধনের পারষ্পরিক উপস্থিতি থাকে এবং কিছু ক্ষেত্রে যখন উভয় প্রতিস্থাপক একই হয় তখন কিছু সাধারণ প্রবণতা প্রদর্শন করে। এই প্রবণতার পেছনে অবদান রাখে যে বিষয়টা তা হচ্ছে সিস সমানুতে প্রতিস্থাপকের দ্বিপোল যুক্ত হয়ে সামগ্রিক আণবিক দ্বিপোল প্রদান করে। অন্যদিকে ট্রান্স সমানুতে প্রতিস্থাপকের ডাইপোল অণুর বিপরীত পাশের কারণে বাতিল হয়ে যায়। ট্রান্স সমানু তাদের বিপরীত সিস সমানুর তুলনায় কম ঘনত্বের হয়। সাধারণত ট্রান্স এলকেনের উচ্চ গলনাঙ্ক এবং জড় দ্রাবকে নিম্ন দ্রাব্যতা প্রদর্শন করে। ট্রান্স এলকেনসমূহ সিস এলকেনসমূহের তুলনায় অধিক প্রতিসম।[৬]
NMR বর্ণালিবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা ভিসিনাল কাপলিং ধ্রুবক (3JHH) পরিমাপ করা হয়, ট্রান্স সমানু (পরিসীমা: 12–18 Hz; সাধারণত: 15 Hz) সিসের তুলনায় বৃহৎ (পরিসীমা: 0–12 Hz; সাধারণত: 8 Hz)।[৭]
সাধারণত অচক্রীয় পদ্ধতিতে সিস সমানুর তুলনায় ট্রান্স সমানু অধিক স্থায়ী। সিস সমানুর প্রতিস্থাপকদের মধ্যে স্টেরিক মিথষ্ক্রিয়া বৃদ্ধির ফলে এটা হয়। ট্রান্স সমানুর দহনে কম এক্সোথার্মিক তাপ উৎপন্ন হয় যা উচ্চ তাপরাসায়নিক স্থায়িত্ব নির্দেশ করে। বেনসন হিট অভ ফরমেশন গ্রুপ এডিটিভি ডাটাসেট অনুসারে সিস সমানু 1.10 kcal/mol স্থায়িত্ব হারায়। এই নিয়মের ব্যতিক্রমও দেখা যায় যেমন 1,2-difluoroethylene, 1,2-difluorodiazene (FN=NF) এবং কিছু হ্যালোজেন ও অক্সিজেন প্রতিস্থাপিত ইথিলিন। এক্ষেত্রে সিস আইসোমার ট্রান্স আইসোমারের তুলনায় অধিক স্থায়ী।[৮] এই ফেনোমেনা সিস ইফেক্ট নামে পরিচিত।[৯]
এলকেন সমানুতে শুধুমাত্র দুটি ভিন্ন প্রতিস্থাপক উপস্থিত থাকলে সিস-ট্রান্স পদ্ধতিতে নামকরণ করা হয়। তাই তার প্রতিস্থাপক সম্পর্কে বর্ণনায় কোন বিভ্রান্তির অবকাশ থাকেনা। বেশি জটিল ক্ষেত্রে সিস/ট্রান্স নামকরণ সব থেকে দীর্ঘ কার্বন শিকলের উপর ভিত্তি করে করা হয়। সকল ক্ষেত্রের জন্য IUPAC এর আদর্শ নকশা ই-জেড দ্ব্যর্থহীন এবং ট্রাই ও টেট্রা সাবস্টিটিউটেড এলকেনের জন্য বিশেষ উপযোগী। এর ফলে কোন গ্রুপকে সিস অথবা ট্রান্স নামকরণ করা হবে সেটা নিয়ে কোন সংকোচের অবকাশ থাকেনা।
জেড এসেছে জার্মান জুসাম্মেন zusammen) থেকে যার অর্থ "একসাথে"। ই ( জার্মান থেকে entgegen) অর্থ বিরোধিতা, বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত হয়। জেড এর উচ্চ অগ্রাধিকার সিস দল এবং ই এর উচ্চ অগ্রাধিকার ট্রান্স দল রয়েছে। Cahn-Ingold-Prelog অগ্রাধিকার নীতিমালা অনুযায়ী একটি অণুর গঠন ই না জেড তা নির্ধারণ করা হয়। উচ্চ পারমাণবিক সংখ্যা উচ্চ অগ্রাধিকার প্রদর্শন করে। দ্বৈত বন্ধনের দুই পরমাণুর প্রতিটির জন্য, প্রতিটি প্রতিস্থাপকের অগ্রাধিকার নির্ণয় করা জরুরী। যদি উচ্চ অগ্রাধিকার প্রতিস্থাপকক একই পাশে অবস্থান করে তবে বিন্যাসটি জেড; যদি বিপরীত পাশে অবস্থান করে তবে বিন্যাসটি ই।
সিস/ট্রান্স এবং ই/জেড পদ্ধতি এলকেনের বিভিন্ন দলের মধ্যে তুলনা করার কারণে জেড সর্বদা সিস এবং ই ট্রান্স এটা সত্য নয়। উদাহরণস্বরূপ, trans-2-chlorobut-2-ene (দুটো মিথাইল মূলক, C1 ও C4, but-2-ene এর কাঠামোয় হচ্ছে পরস্পরের ট্রান্স) হচ্ছে (Z)-2-chlorobut-2-ene (ক্লোরিন ও C4 একত্রে কারণ C1 ও C4 পরস্পরের বিপরিতে)।
সিস-ট্রান্স সমানুতা অজৈব যৌগেও হতে পারে বিশেষ করে ডায়াজেন এবং কোঅর্ডিনেশন যৌগসমূহে।
ডায়াজেন (এবং সম্পর্কিত ডাইফসফিনসমূহ) সিস-ট্রান্স সমানুতা প্রদর্শন করতে পারে। জৈব যৌগের সাথে সিস সমানু অধিক সক্রিয়তা প্রদর্শন করে এবং একমাত্র সমানু যা অ্যালকিন এবং অ্যালকাইনকে অ্যালকেনে বিজারিত করতে পারে কিন্তু ভিন্ন কারণে ট্রান্স সমানু অ্যালকিন বিজারিত করতে পারেনা।
![]() ![]() |
![]() ![]() |
ট্রান্স-ডায়াজিন | সিস-ডায়াজিন |
অজৈব সহযোজন যৌগে অক্টাহেড্রাল বা বর্গীয় প্লানার জ্যামিতি থাকলে সেখানে যাদের লিগ্যান্ড খুব কাছাকাছি থাকে তারা সিস সমানু এবং যারা দূরে থাকে তারা ট্রান্স সমানু।
দুটি আইসোমারিক যৌগ হচ্ছে সিসপ্লাটিন এবং ট্রান্সপ্লাটিন। ১৮৯৩ সালে আলফ্রেড ওয়ারনারের ব্যাখ্যামতে দুটো বর্গ তলীয় Pt(NH3)2Cl2 সমানু আছে। সিস আইসোমার যার পুরো নাম cis-diamminedichloroplatinum(II), ১৯৬৯ সালে বার্নেট রোজেনবার্গ টিউমারবিরোধী ক্রিয়া প্রদর্শন করেন এবং বর্তমানে সংক্ষিপ্ত নাম সিসপ্লাটিন নামে পরিচিত একটি কেমোথেরাপি ঔষধ। ট্রান্স আইসোমার ট্রান্সপ্লাটিনের কোন ক্যানসার বিরোধী উপযোগিতা নেই। ট্রান্স ইফেক্ট ব্যবহার করে কোন সমানু সংশ্লেষণ করা হবে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
অক্টাহেড্রাল যৌগ যার সংকেত MX4Y2, দুটি সমানু বিদ্যমান। এখানে M হচ্ছে ধাতব পরমাণু এবং X ও Y দুটি ভিন্ন ধরনের লিগ্যান্ড। সিস সমানুতে দুটি Y লিগ্যান্ড পরস্পরের সাথে ৯০° কোণে অবস্থান করে, এটা দুটো ক্লোরিন পরমাণুরর জন্য সত্য বামে সবুজ রঙে দেখানো সিস-[Co(NH3)4Cl2]+। ট্রান্স আইসোমারে দুটো ক্লোরিন পরমাণু কেন্দ্রীয় Co পরমাণুর বিপরীত পাশে অবস্থান করে।
অক্টাহেড্রাল MX3Y3 যৌগে এই ধরনের একটি সমানুতা দেখা যায় যা ফেসিয়াল-মেরিডিয়োনাল (বা fac/mer) সমানুতা নামে পরিচিত যেখানে বিভিন্ন সংখ্যার লিগ্যান্ড পরস্পরের সিস বা ট্রান্স। ইনফ্রারেড বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে ধাতব কার্বনিল যৌগকে "fac" অথবা "mer" হিসেবে সনাক্ত করা যায়।